You dont have javascript enabled! Please enable it!
পটিয়ার ধলঘাট রেলসেতু অপারেশন
উদ্দেশ্য
চট্টগ্রাম-দোহাজারি রেললাইন দিয়ে প্রতিনিয়ত রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা রেলে করে এ অঞ্চলের বিভিন্ন স্টেশনে নেমে স্থানীয় অসামরিক জনগণের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যা ও পাশবিক নির্যাতনসহ বিভিন্ন অপকর্ম করত। পাকিস্তানি সেনাদের এ নির্যাতন বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ধলঘাট এলাকার মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক শাহ আলম গ্রুপ শত্রুর ওপর অপারেশনের পরিকল্পনা করেন।
পরিকল্পনা
এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে অধিনায়ক শাহ আলম ও ডেপুটি অধিনায়ক উদয়ন নাগ প্রাথমিকভাবে পরিস্থিতি পর্যালােচনা করে দেখেন। তাদের মনে হয়, মুক্তিযােদ্ধাদের বর্তমান সংখ্যা, অস্ত্রবল ও অভিজ্ঞতা দিয়ে ঐ এলাকার অত্যাচারের সাথে জড়িত রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হওয়া ও বিজয় অর্জন সম্ভব নয়। বরং এতে এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচার আরও বেড়ে যেতে পারে তাই বিকল্প হিসেবে তারা ধলঘাট এলাকার রেলসেতু উড়িয়ে দেয়া, রেললাইন উপড়ে ফেলা এবং পরিবহণ ট্রেনের ওপর আক্রমণ চালানাের সিদ্ধান্ত নেন। রেললাইন উপড়ে ফেলার জন্য লােকজন জড়াে করার উদ্দেশ্যে ঐ এলাকার পাড়ায় পাড়ায় গােপনে তৎপরতা চালানাে হয়। এ লক্ষ্যে মুক্তিযােদ্ধারা বিভিন্ন পাড়ায় রাতের বেলায় ছােটো ছােটো সভা করে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের সমর্থক জনগণের সাহায্য চান। মুক্তিকামী জনগণ মুক্তিযােদ্ধাদের এ আহ্বানে স্বতঃস্ফূর্ত ও ইতিবাচক সাড়া প্রদান করে। সবাইকে নির্দিষ্ট একটি তারিখে নির্দিষ্ট স্থানে কোদাল ও শাবল নিয়ে উপস্থিত হতে বলা হয়। ঠিক হয়, জনগণের সহায়তায় তারা রেললাইনের পাশাপাশি যে খাল রয়েছে, তার এক দিক মাটি দিয়ে ভরাট এবং খালের গতিপ্রবাহ রেল সড়ক কেটে তার নিচ দিয়ে প্রবাহিত করে দেবেন এবং রেললাইন উপড়ে ফেলবেন।
অপারেশন
১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের এক নির্দিষ্ট দিনে প্রায় ২০০-২৫০জনের মতাে এলাকাবাসী রাত ১০টায় পূর্বনির্ধারিত জায়গায় এসে উপস্থিত হয়। জনগণকে তাদের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা ৩টি গ্রুপে ভাগ হন। ১টি দল পটিয়া রেল স্টেশনের আশপাশে অবস্থান নেয়। কারণ, এ পথ দিয়ে পাকিস্তানি সেনারা চট্টগ্রাম  থেকে এ এলাকায় আসে। ঠিক হয়, তৃতীয় গ্রুপ থেকে খবর পাওয়ার পর দ্বিতীয় গ্রুপ জনগণকে সাথে নিয়ে অপারেশন স্থানে যাবে। তৃতীয় গ্রুপকে রেকি গ্রুপ বা পর্যবেক্ষণ দল হিসেবে ধলঘাট রেল স্টেশনে পাঠানাে হয়। তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল, ঐ স্টেশন এলাকায় পাকিস্তানি সেনা বা রাজাকার থাকলে স্টেনগান দ্বারা | অনবরত গুলি বর্ষণ করবে। আর স্টেশন পাকিস্তানি বাহিনী বা রাজাকার মুক্ত থাকলে সিঙ্গেল শট অর্থাৎ এক এক রাউন্ড করে গুলি করবে। তাদের এ সিগন্যালের ওপর দ্বিতীয় গ্রুপ ও জনগণের পরবর্তী কার্যক্রম নির্ভর করবে। | ধলঘাট স্টেশনে পাঠানাে রেকি গ্রুপ এসএমজি থেকে অনবরত গুলি বর্ষণ করে। এর অর্থ রেকি গ্রুপ স্টেশনে পাকিস্তানি বা রাজাকার বাহিনীর উপস্থিতি জানাচ্ছে। ফলে পরিকল্পনা মাফিক জনগণকে নিয়ে দ্বিতীয় দলটি আর অগ্রসর হয়। নি। কিন্তু তৃতীয় গ্রুপটি বাস্তবে সিগন্যাল দিতে চেয়েছিল, এলাকায় কোনাে শত্রু নেই তােমরা অগ্রসর হও।’ ভুলে তারা গুলি করে বসে। ফলে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা। করার পরও দ্বিতীয় গ্রুপ না আসায় পর্যবেক্ষণ দলটি ধলঘাট স্টেশন থেকে তাদের অবস্থান ত্যাগ করে এবং পূর্ববতী অবস্থানের দ্বিতীয় গ্রুপের কাছে আসার লক্ষ্যে অগ্রসর হয়। পর্যবেক্ষণ দলটি দ্বিতীয় গ্রুপকে এসে জানায় যে এলাকা মুক্ত এবং কোনাে পাকিস্তানি সেনা বা রাজাকার নেই। এবার দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্রুপ জনগণকে সাথে নিয়ে ধলঘাট স্টেশনের দিকে অগ্রসর হয়ে রেললাইনে পৌছে। সবাই মিলে  রেললাইনের পাথর সরাতে থাকে কিন্তু ইতােমধ্যে প্রায় ১ কিলােমিটার দূরের বেঙ্গুরা রাজাকার ক্যাম্পের রাজাকাররা রেললাইন উপড়ে ফেলার খবর পেয়ে গুলি। বর্ষণ করতে করতে এগিয়ে আসে। মুক্তিবাহিনীর প্রথম গ্রুপটি মূল ফায়ারিং গ্রুপ হিসেবে পটিয়া স্টেশনে অবস্থান করছিল। তাদের খবর দেওয়া হয় দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করে রাজাকারদের প্রতিহত করার জন্য। তারা দ্রুত ফিরে এলে ভাের ৪টা পর্যন্ত রাজাকারদের সাথে। মুক্তিবাহিনীর গুলি বিনিময় চলতে থাকে। এর মধ্যে মুক্তিযােদ্ধারা জনগণের সহায়তায় প্রায় আধা কিলােমিটার রেললাইন উপড়ে ফেলে। তা ছাড়া ধলঘাট রেলসেতুর গার্ডার প্লাস্টিক বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়।
 
ফলাফল ও বিশ্লেষণ
এ অপারেশনের পরদিন পাকিস্তানি সেনারা একটি ট্রেনে করে কৃষ্ণখালী ব্রিজের কাছে এসে নেমে ঐ এলাকার বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং নিরীহ জনগণকে হত্যা করে। তবে রেললাইন উপড়ানাে এবং রেলসেতু বিধ্বস্ত হওয়ায় দোহাজারিচট্টগ্রাম রেল যােগাযােগ বন্ধ হয়ে যায়। এ অপারেশন পরিকল্পনায় কিছুটা অসামঞ্জস্যতা লক্ষ্য করা যায়। প্রাথমিকভাবে যে সংকেতগুলাে নির্ধারণ করা হয়, তা খুব যুক্তিযুক্ত নয় বলে প্রতীয়মান। কেননা, পর্যবেক্ষণ দল ফায়ারের মাধ্যমে সিগন্যাল নির্ধারণ করে, যার কোনাে প্রয়ােজনীয়তা ছিল না। বরং ফায়ারের মাধ্যমে তারা শত্রুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফলস্বরূপ তাদের মূল কাজ শত্রু দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। শক্র না থাকলেও ফায়ার করে সিগন্যাল প্রদানের জোরালাে কোনাে যুক্তি নেই। বলে ধারণা করা যায়। এ ক্ষেত্রে শত্রু লক্ষ্যস্থলের দিকে অগ্রসর হলেই শুধু ফায়ারের মাধ্যমে তাদের বাধা প্রদান ও সংকেত প্রদান যুক্তিসঙ্গত ছিল। যদিও মুক্তিযােদ্ধারা চান নি যে স্থানীয় বাসিন্দারা পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক অত্যাচারিত হােক। তবুও তাদের ঢালাও সম্পৃক্তিতে পাকিস্তানি বাহিনী যে এলাকাবাসীর ওপর অত্যাচারের অজুহাত খুঁজে পাবে, সে ব্যাপারটি যথাযথভাবে অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে যে গণজাগরণের সৃষ্টি হয়েছিল এলাকাবাসীর সম্পৃক্তি নিঃসন্দেহে এর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। তথ্যসূত্র: সাক্ষাঙ্কার: মুক্তিযােদ্ধা উদয়ন নাগ। সম্পাদকের টীকা: ডা. মাহফুজুর রহমান রচিত ‘বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ গ্রন্থের ৪৫১ পৃষ্ঠায় এ অপারেশন-সম্পর্কিত নিম্নলিখিত তথ্য আছে: ক. এ অপারেশনের তারিখ ছিল ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১। খ. অপারেশনে অংশগ্রহণকারী লােকবলের সংখ্যা ছিল ৫০০-৬০০জন। গ. অপারেশনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুক্তিযােদ্ধা শাহ আলম। 
 
লাহারা সিগন্যাল অফিস অপারেশন
 
উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা
পটিয়ার লাহারার সিগন্যাল অফিসের পাহারায় থাকা রাজাকারদের হত্যা এবং তাদের অস্ত্র ও গােলাবারুদ হস্তগত করার জন্য মুক্তিযােদ্ধারা এ অপারেশনের পরিকল্পনা করেন। ক্যাপটেন করিম ও অধ্যাপক শামসুল ইসলাম এর পরিকল্পনাকারী ছিলেন। পর্যবেক্ষণ অপারেশনে যাওয়ার পূর্বে সিগন্যাল অফিসের অবস্থান, রাজাকারদের সংখ্যা ও অস্ত্র, ডিউটি পরিবর্তন হওয়ার সময় প্রভৃতি বিষয়ে যথাসম্ভব খবর নেয়া হয় এবং এ পর্যবেক্ষিত তথ্যের ভিত্তিতে সিগন্যাল অফিসে অপারেশন পরিচালিত হয়।
 
অপারেশন
অপারেশনের দিন বিকাল সাড়ে ৫টায় ২০-২৫জনের ১টি মুক্তিযােদ্ধা দল ক্যাপটেন করিম ও অধ্যাপক শামসুল ইসলামের নেতৃত্বে বনি সাহারা গ্রামের ডা. শামসুর রহমানের বাড়ি থেকে অপারেশন স্থানের দিকে যাত্রা করেন। প্রায় ঘণ্টা খানেক পথ চলার পর তারা সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে সিগন্যাল অফিসের কাছাকাছি এসে উপস্থিত হন। সিগন্যাল অফিসের প্রধান ফটকে রাজাকারদের উপস্থিতি সম্পর্কে জানার জন্য ১জন মুক্তিযােদ্ধাকে পাঠানাে হয়। ঐ মুক্তিযােদ্ধা ফিরে এসে খবর। দেন যে, সিগন্যাল অফিসের ফটকে কেউ নেই। ফলে মুক্তিযােদ্ধাদের দলটি দ্রুত প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে ২টি গ্রুপে ভাগ হয়ে অফিসের দুই দিকে অবস্থান নেন। ১টি গ্রুপ উত্তর দিকে এবং অন্য গ্রুপটি দক্ষিণ দিকে অবস্থান গ্রহণ করে। অবস্থান নেয়া শেষ হলে তারা একসাথে দুই দিক থেকে অফিসটির ওপর গুলি বর্ষণ। শুরু করেন। এভাবে ১০-১২ মিনিট পর্যন্ত গুলি চলার পরও ভিতর থেকে কোনাে পালটা গুলি বর্ষিত না হওয়ায় মুক্তিযােদ্ধারা ঐ অফিসটি তল্লাশি করার উদ্দেশ্যে অফিসে ঢুকে পড়েন। কিন্তু তল্লাশিতে অফিসের ভিতরে তারা কোনাে রাজাকারকে খুঁজে পান নি। তবে অফিসের ভিতর থেকে ২টি রাইফেল উদ্ধার করা হয়। তল্লাশির এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী দেখতে পায়, অফিসের পিছনে একটি হোটে দরজা এবং সেই বরাবর অফিস বেষ্টিত দেয়ালে আরেকটি ছােটো দরজা রয়েছে যা দিয়ে সহজেই রাজাকাররা পিছনের ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে নিরাপদে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছে। কারণ, পর্যবেক্ষণের সময় এ দরজা সম্পর্কে তথ্য জানা হয়নি। ফলে সেখানে কোনাে প্রােটেকশনের পরিকল্পনা করা হয় নি। মুক্তিযােদ্ধারা এ অপারেশনে ১টি এলএমজি, ১টি এসএমজি, ১টি এসএমসি, ২টি এসএলআর এবং ২০-২২টি রাইফেল ব্যবহার করেন।
 
ফলাফল ও বিশ্লেষণ
এ অপারেশনের দুটি উদ্দেশ্যের মাত্র একটি আংশিক সফল হয়েছে। তবে তারা ঘটনাস্থল থেকে ২টি রাইফেল উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। অপারেশনের প্রথম উদ্দেশ্য সফল না হওয়ার অন্যতম কারণ অসম্পূর্ণ তথ্য। সুতরাং, মুক্তিযােদ্ধাদের নেতৃত্ব উপলব্ধি করে সুচিন্তিত, সুপরিকল্পিত ও সফল অপারেশনের পূর্বশর্ত হলাে বিভিন্ন সূত্র ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পর্যাপ্ত তথ্যসংগ্রহ করা এবং তথ্যাদি ভালােভাবে যাচাই করা। অন্যথায় সমস্ত প্রস্তুতি ও প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। এ উপলব্ধি মুক্তিযােদ্ধাদের পরবর্তী অপারেশন পরিকল্পনায় এবং তাতে সফলতা অর্জনে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে।
তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা প্রদ্যুৎ কুমার পাল (দুলাল)।
 
রাঙ্গুনিয়ার উদালবন্যা পাহাড়ে অ্যামবুশ
 
উদ্দেশ্য
রাজাকার ও মিলিশিয়া বাহিনীকে ফাঁদে ফেলে তাদের হত্যা করা এবং অস্ত্র ও গােলাবারুদ হস্তগত করার উদ্দেশ্যে মুক্তিযােদ্ধারা রাঙ্গুনিয়ার উদালবন্যা পাহাড়ে অ্যামবুশের পরিকল্পনা করেন।
 
পরিকল্পনা
১৯৭১ সালের ২৮ নভেম্বর ক্যাপটেন করিম ও তার ২জন সহযােদ্ধা (প্রদ্যুৎ কুমার পাল ও স্বপন দাশ) পাদুয়ায় অবস্থিত টি এম আলীর মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে বিশেষ কোনাে কাজে যান। ক্যাম্পে অবস্থানকালীন ঐ দিন বিকালেই তারা ইনফর্মার মারফত সংবাদ পান, এক দল রাজাকার ও মিলিশিয়া পরদিন অর্থাৎ ২৯ নভেম্বর ধােপাছড়ি-চন্দ্রঘােনা রাস্তা দিয়ে চন্দ্রঘােনার দিকে যাবে। তবে ইনফর্মার তাদের সংখ্যা এবং সময় সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারে নি। ঐ সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে ক্যাপটেন করিম সিদ্ধান্ত নেন, রাজাকার ও মিলিশিয়া গ্রুপটিকে সুবিধাজনক স্থানে অ্যামবুশ করবেন। এ লক্ষ্যে ক্যাপটেন করিম টি এম আলীর কাছ থেকে অস্ত্র ও গােলাবারুদের সাহায্য গ্রহণ করেন। টি এম আলী ক্যাপটেন করিমের গ্রুপকে ৫টি এলএমজি, ৫জন প্রাক্তন সৈনিক ও (এঁদের মধ্যে ২জন হলেন: আলমগীর ও সুজাত আলী) প্রয়ােজনীয় গােলাবারুদ দিয়ে সাহায্য করেন।
অপারেশন
২৯ নভেম্বর ভাের ৪টায় টি এম আলীর দলের ৫জন অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক এবং ক্যাপটেন করিমের গ্রুপের ৩জনসহ মােট ৮জন মুক্তিযােদ্ধা অ্যামবুশ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে পাদুয়া থেকে ধােপাছড়ি-চন্দ্রঘােনা সংযােগ সড়ক ধরে যাত্রা। শুরু করেন। প্রায় ঘন্টা খানেকের পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে তারা ভাের ৫টার দিকে উদালবন্যা পাহাড়ের কাছে এসে উপস্থিত হন। ক্যাপটেন করিম স্থানটিকে অ্যামবুশ করার জন্য উপযুক্ত বিবেচনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী পিছনের পাহাড়ে ক্যাপটেন করিম এবং অন্য মুক্তিযােদ্ধারা সামনের পাহাড়ে অবস্থান নেন। সামনের পাহাড়ে ৫টি এলএমজি, ১টি এসএমজি, ১টি স্টেনগান, ১টি এসএলআর ও ৭টি গ্রেনেডসহ মুক্তিযােদ্ধারা অবস্থান নেন। ক্যাপটেন করিমের। কাছে ছিল ১টি এসএমজি। পরিকল্পনায় ছিল ক্যাপটেন করিমের নির্দেশে গুলি ছােড়া হবে। মুক্তিযােদ্ধা গ্রুপটি সেখানে টার্গেটের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
অবশেষে দুপুর ১টায় অ্যামবুশ গ্রুপটি দেখতে পায়, প্রায় ১০০-১৫০জনের ১টি বিরাট রাজাকার-মিলিশিয়া গ্রুপ সশস্ত্র অবস্থায় এ পথে এগিয়ে আসছে। পাকিস্তানি বাহিনীর সহযােগীরা পাহাড়ের কাছাকাছি আসার সাথে সাথে ক্যাপটেন করিমের নির্দেশে মুক্তিযােদ্ধা দল প্রথমে অতর্কিতে তাদের ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। ৫টি এলএমজিও এক সাথে ফায়ার শুরু করে। শত্রুপক্ষ প্রথমে হতচকিত হলেও তারাও পালটা ফায়ার শুরু করে। এভাবে ১৫-২০ মিনিট উভয়পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময়ের পর ক্যাপটেন করিমের নির্দেশে মুক্তিযােদ্ধা গ্রুপটি পাহাড় ত্যাগ করে পিছন দিকে ক্রলিং করে খালের পাশ দিয়ে নিরাপদে। পাদুয়া টিএম আলীর ক্যাম্পে ফিরে আসে। এ অ্যামবুশে মুক্তিযােদ্ধারা ৫টি এলএমজি, ১টি স্টেনগান, ১টি এসএমজি, ১টি এসএলআর, ৭টি গ্রেনেড ব্যবহার করেন।
ফলাফল ও বিশ্লেষণ
বিভিন্ন অসামরিক সূত্রে মুক্তিযােদ্ধারা জানতে পারেন, এ অপারেশনে প্রায় ২০২৫জন রাজাকার ও মিলিশিয়া নিহত হয়। তবে তারা বেশিক্ষণ ঐ স্থানে না থেকে গেরিলা যুদ্ধের নীতি অবলম্বন করে দ্রুত প্রত্যাবর্তন করেন। কারণ, বিপক্ষ দল সংখ্যায় ছিল অত্যধিক। এটা ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য এক বিরাট সাফল্য। এতে তাঁদের মনােবল ও সাহস বৃদ্ধি পায়। তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা প্রদ্যুৎ কুমার পাল (দুলাল)। (রাঙ্গুনিয়ার উদালবন্যা পাহাড়ে অ্যামবুশের নকশাটি ১১৫১ পাতায়)

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড

 
 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!