You dont have javascript enabled! Please enable it!
বেঙ্গুরা ব্রিজে অপারেশন (বােয়ালখালী)
উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা
বেঙ্গুরা ব্রিজটি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযােগ সেতু। ফলে পাকিস্তানি সেনা, পুলিশ ও রাজাকাররা সব সময় ঐ সেতুর ওপর টহল দিত, যাতে মুক্তিযােদ্ধারা এ সেতুটি দখল অথবা ধ্বংস করতে না পারেন। অন্যদিকে, মুক্তিযােদ্ধারা ঠিক করে যে করেই হােক সেতুটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে পাকিস্তানি বাহিনীর যাতায়াত সীমিত করে ফেলতে হবে এবং এ লক্ষ্যে বেঙ্গুরা ব্রিজ অপারেশনের পরিকল্পনা করা হয়।
পর্যবেক্ষণ
ক্যাপটেন করিমের নির্দেশে তার গ্রুপের কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা ছদ্মবেশে ঐ ব্রিজের অবস্থান, টহলরত শক্রর সংখ্যা, যাত্রাপথ, ব্রিজের ধরন প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তারিত তথ্যসগ্রহ করেন। পর্যবেক্ষণ রিপাের্টের ওপর ভিত্তি করে ক্যাপটেন করিম ঐ ব্রিজে অপারেশন পরিকল্পনা করেন।
অপারেশন
অপারেশনের দিন বােয়ালখালীর হুলাইন গ্রামের একটি গােপন আশ্রয় কেন্দ্র থেকে ক্যাপটেন করিমের নেতৃত্বে রাত সাড়ে ১০টা-১১টার দিকে ১৫-২০জন মুক্তিযােদ্ধা প্রয়ােজনীয় অস্ত্রশস্ত্রসহ অন্ধকারের সুযােগ নিয়ে ব্রিজের দিকে যাত্রা শুরু করেন। ১৫-২০ মিনিট হাঁটার পর তারা চুপিসারে ব্রিজটির পাশে পৌছে যান। ব্রিজটির ওপর তখন রাজাকার, পুলিশ ও সহযােগীরা বসে আলাপ করছিল ও সিগারেট যুঁকছিল। পরিস্থিতি অনুকূল হওয়ায় মুক্তিযােদ্ধারা ক্যাপটেন করিমের নির্দেশে অতর্কিতে শক্রর ওপর আক্রমণ চালান। অপ্রত্যাশিত এ আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধাদের। কোনােপ্রকার বাধা দিতে অসমর্থ হয়ে হতচকিত ও ভীত শক্রর দল অস্ত্র ফেলে বেঙ্গুরা খালের মধ্যে ঝাপিয়ে পড়ে। মুক্তিযােদ্ধাদের এলােপাতাড়ি গুলিতে ঘটনাস্থলে ৩-৪জন শত্রু মারা যায়। ঘটনাস্থল থেকে মুক্তিযােদ্ধারা ৫-৬টি ৩০৩ রাইফেল হস্তগত করেন। তবে মুক্তিযােদ্ধারা ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ার মূল পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়। কারণ, গােলাগুলির আওয়াজে তাদের অবস্থানের গােপনীয়তা ভঙ্গ হয়। ফলে ব্রিজটি ধ্বংস করা মােটেই নিরাপদ নয় মনে করে তারা তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নিরাপদ আশ্রয় স্থলে ফিরে আসেন।
 
বিশ্লেষণ
এ অপারেশনের পরিকল্পনার মূল বিষয়টি বাস্তবায়িত হয় নি। ফলে প্রধান লক্ষ্যও অর্জিত হয় নি। ব্রিজের ওপর সহজ ও আক্রমণযােগ্য টার্গেট হিসেবে রাজাকার ও পুলিশ নিধনের প্রচেষ্টা গ্রহণ করে অপারেশনের পূর্ব গােপনীয়তা নিজেরাই বিনষ্ট করেন। তবে প্রধান উদ্দেশ্য অর্জিত না হলেও সে সময়কার আবেগ বিবেচনায় অপারেশন অসফল নয়। অধিকন্তু, কয়েকটি অস্ত্রও তাদের হস্তগত হয়। কয়েকজন শক্রকে হত্যা করে তাদের মনে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক সংকট ও ভীতি সঞ্চারে মুক্তিযােদ্ধারা সফল হয়েছিলেন। তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা এম এ ইসলাম।
 
অপারেশন রাখালি ব্রিজ (আরাকান সড়ক)
 
উদ্দেশ্য
চট্টগ্রাম শহর থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচল তথা যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যেই এ ব্রিজ ধ্বংসের পরিকল্পনা করা হয়।
 
অবস্থান
চট্টগ্রামের কর্ণফুলি নদীর ওপর অবস্থিত কালুরঘাট ব্রিজ থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক দিয়ে ৪ কিলােমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অগ্রসর হলে রাখালি ব্রিজের অবস্থান। পাচরিয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে এ ব্রিজ আধা কিলােমিটার উত্তরে। রাখালি ব্রিজ থেকে ৪০০ গজ দক্ষিণে মিলিটারি পােল অবস্থিত।
 
পর্যবেক্ষণ
গেরিলারা সব সময় এ ব্রিজের ওপর দিয়ে আসা-যাওয়া করতেন। গেরিলাদের অনেকেই এ এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে পর্যবেক্ষণ করার প্রয়ােজন হয়নি। ব্রিজটির দৈর্ঘ্য ছিল আনুমানিক ২৫-৩০ গজ এবং প্রস্থ ১২-১৫ গজ। ব্রিজটি পূর্ব-পশ্চিমে লম্বালম্বিভাবে অবস্থিত।
 
পরিকল্পনা
গ্রুপ অধিনায়ক আহম্মদ নবী, আসলাম, মহসীন ও পুলিশের হাবিলদার এ বি সিদ্দিকী মিলে পটিয়া থানার পাচরিয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে বসে এ অপারেশনের পরিকল্পনা করেন। ১৬জনের গেরিলা দল ২টি গ্রুপে ভাগ হয়ে এ অপারেশনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আরও সিদ্ধান্ত হয়, অধিনায়ক আসলাম গ্রুপের সদস্যরা পাচরিয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে সন্ধ্যা ৬টায় অপারেশন স্থলের দিকে। যাবেন এবং অধিনায়ক আবুল হােসেনের গ্রুপ বােয়ালখালী থানা থেকে ১ নম্বর। দলের রাখালি ব্রিজের কাছে যাওয়ার আগেই সেখানে অবস্থান নেবেন।

 
অপারেশন
১০ ডিসেম্বর সন্ধ্যা আনুমানিক ৬টার দিকে গ্রুপ অধিনায়ক আসলামের নেতৃত্বে এ কে এম জয়নাল আবেদীন, আলমগীর, নায়েক সাজ্জাদ, থােকন নন্দী, চন্দন লালা। ও রঞ্জিতসহ ৮জনের ১ম গেরিলা দল পাচরিয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অস্থায়ী গেরিলা শেল্টার থেকে বের হয়ে আরাকান সড়কে এসে দাঁড়ান। সে সময় ১টি প্রাইভেট কার আরাকান সড়ক দিয়ে দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে যাচ্ছিল। অধিনায়ক আসলামের নির্দেশে কয়েকজন গেরিলা যােদ্ধা কারটিকে থামিয়ে তাদেরকে রাখালি ব্রিজের কাছে দিয়ে আসার জন্য অনুরােধ করলে চালক রাজি হয়। কার চালক ৪ জন-৪ জন করে মােট ২ বারে ৮জন গেরিলাকে ব্রিজের দক্ষিণ পাশে পৌঁছে দেয়। আসলাম গ্রুপের গেরিলা সদস্যরা ব্রিজের কাছে পৌছে দেখতে পান, পূর্বপরিকল্পনা। অনুযায়ী অধিনায়ক আবুল হােসেনের নেতৃত্বে ৮জনের ১টি গেরিলা দল আগে। থেকেই রাখালি ব্রিজের উত্তর-পূর্ব কোণায় রাস্তার নিচে ধানক্ষেতে নিরাপদ দূরত্বে পজিশন নিয়ে আছে। ১ নম্বর দলের গেরিলারা অপারেশনে যাওয়ার সময় ব্রিজ ধ্বংসের জন্য প্রায় ১০ কেজি এক্সপ্লোসিভসহ প্রয়ােজনীয় উপকরণ সাথে করে নিয়ে যান। তারা ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য ১টি এলএমজি, ২টি এসএলআর, ১টি স্টেনগান ও ৫টি হ্যান্ড গ্রেনেড নিয়ে যান। ব্রিজের কাছে পৌছেই ১ নম্বর দলের অধিনায়ক আসলাম, রঞ্জিত, চন্দন লালা ও জয়নাল আবেদীন এক্সপ্লোসিভ নিয়ে দ্রুত ব্রিজের ওপর চলে যান এবং ব্রিজের দক্ষিণ পাশে পাটাতনের ওপর ১০ কেজি এক্সপ্লোসিভ লম্বালম্বি করে বিছানাে শুরু করেন। ১ নম্বর দলের অন্য সদস্যরা। তখন ব্রিজের দক্ষিণ দিক কভার করেন। ২ নম্বর দল উত্তর দিকের কভারে থাকে। দলীয় অধিনায়ক আবুল হােসেন মাঝে মাঝে ব্রিজের ওপর এসে কাজের অগ্রগতি দেখে যান। ইতােমধ্যে অধিনায়ক আসলাম, রঞ্জিত, চন্দন লালা ও জয়নাল আবেদীন ব্রিজের ওপর এক্সপ্লোসিভ স্থাপন করে তাতে ফিউজ ও ডেটোনেটর লাগিয়ে অধিনায়ক আসলামের সাথে থাকা তারের এবং বিস্ফোরক থেকে আনা তারের দুই মাথা একত্রে সংযুক্ত করে প্রধান তারকে ব্রজের দক্ষিণে ৮-১০ গজ দূরে রাস্তার ঢালে টেনে নিয়ে যান। | ১ নম্বর দলের গেরিলারা ব্রিজের দক্ষিণে এবং ২ নম্বর দলের গেরিলারা ব্রিজের পূর্ব দিকে নিরাপদ দূরত্বে চলে যাওয়ার পর অধিনায়ক আসলাম তারে আগুন ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। আগুন লাগানাের দেড় থেকে ২ মিনিটের মাথায় প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ব্রিজের দক্ষিণ অংশ ধসে নিচে পড়ে যায়। বিস্ফোরণের পর ১ নম্বর দলের গেরিলারা সড়ক দিয়ে হেঁটে পাচরিয়া অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে ফিরে যান।
 
বিশ্লেষণ
সাফল্যজনকভাবে গেরিলা যােদ্ধারা রাখালি ব্রিজ ধ্বংস করার ফলে এ সড়ক দিয়ে | ২-৩ দিন যাবৎ সরাসরি যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। এতে পাকিস্তানি সামরিকবাহিনীর চলাচলে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটে। ব্রিজ ধ্বংস করার পর পাকিস্তানি সেনারা এর আশপাশের দোকানপাট ও বসতবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং লুটপাট করে। তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা জয়নাল আবেদীন।
 
উত্তর সামুরা অপারেশন (পটিয়া-বােয়ালখালী বর্ডার)
 
উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা
উত্তর সামুরায় রাজাকারদের প্রভাব হ্রাস, তাদের অত্যাচার ও আক্রমণ প্রতিহত করা এবং ঐ এলাকায় মুক্তিবাহিনীর অবস্থান সুসংহতকরণ, এ কয়টি উদ্দেশ্য সামনে রেখে উত্তর সামুরায় শত্রু বাহিনীর ওপর অপারেশন পরিচালনা করা হয়। অধিনায়ক শাহ আলম এ অপারেশনের পরিকল্পনা করেন।
অপারেশন
পটিয়া-বােয়ালখালী থানা দুটির সীমান্তের উত্তর সামুরায় মুক্তিবাহিনীর একটি অস্থায়ী গুপ্তাশ্রয় ছিল। ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে অধিনায়ক শাহ আলমের নেতৃত্বে ২০-২২জনের ১টি মুক্তিযােদ্ধা দল জুলাই মাসের শেষ দিকে ভাের সাড়ে ৪টায় এ গুপ্তাশ্রয়ে পৌছেন। পূর্ব থেকেই মুক্তিবাহিনীর জানা ছিল, সে এলাকায় রাজাকারদের প্রভাব বেশ প্রবল এবং তাদের উপস্থিতি সর্বত্র। ফলে তাঁরা গুপ্ত আশ্রয়ের নিরাপত্তার জন্য আসার পথে (Approaching road) ৪-৫জনের ১টি প্রহরী দল নিয়ােগ করেন। তবু মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের কথা রাজাকারদের কাছে পেীছে যায়। প্রায় ৮-১০জন রাজাকার মুক্তিযােদ্ধাদের এ অবস্থানটি ধ্বংস এবং মুক্তিযােদ্ধাদের হত্যা করার লক্ষ্যে ঐ দিনই সকাল ৬টায় ঐ গুপ্ত আশ্রয়ের দিকে এগিয়ে আসে। প্রহরী দল অগ্রসরমাণ শত্রুদের দেখতে পায়। রাজাকারদের আসন্ন আক্রমণ। প্রতিহত করার জন্যই প্রহরী দল দ্রুত অন্য মুক্তিযােদ্ধাদের স্ব স্ব অবস্থান গ্রহণের সংকেত পাঠায় এবং নিজেরাও নির্দিষ্ট জায়গায় অবস্থান গ্রহণ করেন। ইতােমধ্যে অন্য মুক্তিযােদ্ধারাও এসে অবস্থান গ্রহণ করেন। রাজাকাররা মুক্তিবাহিনীর অস্ত্রের কার্যকর ক্ষমতার মধ্যে এলে তাদের ওপর অতর্কিতে গুলি চালানাে হয়। দুই পক্ষের মধ্যে কিছুক্ষণ গােলাগুলির পর রাজাকাররা পিছু হটতে বাধ্য হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের ছিল ১টি এলএমজি, ১টি স্টেনগান ও ২০-৩০টি রাইফেল।
ফলাফল
রাজাকারদের সাথে গুলি বিনিময়কালে মুক্তিযােদ্ধাদের গুলিতে ৩জন রাজাকার ঘটনাস্থলে মারা যায় এবং ৩টি .৩০৩ রাইফেল মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়।
প্রভাব ও বিশ্লেষণ
অধিনায়ক শাহ আলম গ্রুপের এটি ছিল প্রথম ও সফল অপারেশন। স্বভাবতই প্রথম অপারেশনের সাফল্য তাদের মনােবল, দৃঢ়তা ও সাহস ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি। করে। দ্বিতীয়ত, তাদের সাফল্যে জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পায় এবং মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর বিশ্বাস দৃঢ় হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয় স্থলের পরিধি বৃদ্ধি পায়। এ অপারেশনের ফল হিসেবে ঐ এলাকার ৩জন যুবক মুক্তিবাহিনীতে যােগ দেন। অপারেশনটি গ্রামাঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা শুরুর একটি অন্যতম নিদর্শন। পাকিস্তান সরকারের কাছে মুক্তিযােদ্ধাদের উপস্থিতি এতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মুক্তিকামী জনগণের কাছেও ঘটনাটি ছিল খুবই আশাপ্রদ। তাই প্রতিরােধ অপারেশনটি অপ্রত্যাশিত হলেও সফল ও তাৎপর্যপূর্ণ। এ অপারেশনে মুক্তিযােদ্ধারা নিজেদের উপস্থিত বুদ্ধি ও সাহসের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা উদয়ন নাগ। (উত্তর সামুরা অপারেশন (পটিয়া-বােয়ালখালী বর্ডার)-এর নকশাটি ১১৫০ পাতায়)

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড

 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!