You dont have javascript enabled! Please enable it!
বােয়ালখালী থানা অপারেশন
প্রেক্ষাপট
স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে জুন-জুলাই মাসে বাংলাদেশে শুরু হওয়া গেরিলা যুদ্ধের প্রভাবে গেরিলারা ক্রমান্বয়ে সাহস, মনােবল ও দক্ষতা অর্জন করেন। সীমিত শক্তি সত্ত্বেও তারা অদম্য সাহসের সাথে শত্রুর মােকাবিলা করেন। চট্টগ্রাম-পটিয়া সড়কের প্রায় ২০০ গজ পূর্ব দিকে এবং কালুরঘাট সেতু থেকে প্রায় দুই মাইল দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বােয়ালখালী থানাটি অবস্থিত। এ থানায় রাজাকার ও পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই অবস্থান করছিল। তারা ঐ এলাকায় সাধারণ। জনগণের ওপর নানারকম অত্যাচার চালাতে থাকে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাপটেন। করিম, নাসির ও স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা আরও কয়েকটি মুক্তিযােদ্ধা দল ঐ থানা আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
পরিকল্পনা ও অপারেশন
ক্যাপটেন করিমের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২-৩জন মুক্তিযােদ্ধার ১টি ছােটো দল থানা আক্রমণের ২ দিন পূর্বে প্রয়ােজনীয় পর্যবেক্ষণ সম্পন্ন করে। পর্যবেক্ষণের তথ্যের ভিত্তিতে ক্যাপটেন করিম ও অধিনায়ক নাসির মিলে থানা আক্রমণের পরিকল্পনা ও তারিখ নির্ধারণ করেন। গৃহীত পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩০-৩২জনের মুক্তিযােদ্ধা গ্রুপটি ক্যাপটেন করিমের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ২৫ সেপটেম্বর রাত ১১টায় আশ্রয় স্থল রতনপুর থেকে অপারেশন স্থলের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। যাত্রা পথে তারা ২জন আলবদর ইনফর্মারকে পেয়ে হত্যা করে তাদের অস্ত্র হস্তগত এবং গােপনীয়তা নিশ্চিত করেন। থানায় যাওয়ার পথে ঘুষখিল গ্রামে একটি ব্রিজের পাশে এসে মুক্তিযােদ্ধা দলটি ৩টি গ্রুপে ভাগ হয়ে যায়। প্রথম গ্রুপটি অধিনায়ক নাসিরের নেতৃত্বে ‘আক্রমণকারী গ্রুপ হিসেবে পথ পার হয়ে অন্ধকার ও ধানক্ষেতের আড়াল নিয়ে থানার পিছন দিকে অবস্থান নেয়। দ্বিতীয় গ্রুপটি আক্রমণকারী (ফ্রন্ট) গ্রুপ হিসেবে হাবিলাস দ্বীপ হয়ে থানা থেকে আনুমানিক ২০০ গজ দূরে থানার দক্ষিণ দিকে খালের দক্ষিণ পাড়ে সেনেরহাটে অবস্থান নেয়। তৃতীয় গ্রুপটি শাকপুরা মিলের ভিতর দিয়ে ধানক্ষেতের আড়াল নিয়ে থানার পশ্চিম পাশে তেলিফকিরের মাজারে অবস্থান নেয়। তাদের কাজ ছিল আক্রমণকারী গ্রুপ কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে শত্রু দল ঐ রাস্তা ধরে পালাতে চেষ্টা করলে তাদের প্রতিহত ও যথাসম্ভব ধ্বংস করা। রাত ১টার মধ্যে গ্রুপগুলাে অবস্থান গ্রহণ সম্পন্ন করে। থানার উত্তর পাশে। ধানক্ষেতে অবস্থানরত নাসির গ্রুপ আইলের আড়াল থেকে প্রথমে থানার ওপর

গুলি চালাতে থাকে। সাথে সাথে খালের দক্ষিণে অবস্থানরত গ্রুপও গুলি চালানাে। শুরু করে।
মুক্তিবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থানায় অবস্থানরত শত্রুরা দক্ষিণ দিকের মুক্তিযােদ্ধা গ্রুপের ওপর পালটা আক্রমণ শুরু করে। তারা সুবিধাজনক অবস্থান। থেকে উত্তর দিকের নাসির গ্রুপের ওপরও প্রতিআক্রমণ চালায়। থানাটি প্রাচীর বেষ্টিত থাকায় শত্রু দলের অবস্থান ছিল বেশ সুবিধাজনক। দ্বিতীয়ত, পর্যবেক্ষণ তথ্যে শুধু রাজাকার ও মিলিশিয়াদের উপস্থিতি সম্পর্কে বলা হয়েছিল। কিন্তু আক্রমণ করার পর দেখা যায়, সেখানে পরিখা বেষ্টিত হয়ে পাকিস্তানি সেনারা সুদৃঢ়ভাবে অবস্থান করছে। মুক্তিযােদ্ধারা হতােদ্যম না হয়ে অবস্থানে অনড় থেকে। গুলি চালাতে থাকেন। এভাবে দুই পক্ষের মধ্যে সকাল পর্যন্ত গুলি বিনিময় হয়। ইতােমধ্যে কালুরঘাট সেতুর নিরাপত্তায় নিয়ােজিত পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি দল। বােয়ালখালী থানায় আক্রান্ত নিজস্ব বাহিনীর সাহায্যে অগ্রসর হয়। ফলে মুক্তিবাহিনী আর শক্রদের ওপর তেমন ফলপ্রসূ আক্রমণ চালাতে না পেরে এবং পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রসরমাণ দল দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অবশেষে নিজেদের অবস্থান ত্যাগ করে। উল্লেখ্য, শারীরিক অসুস্থতার কারণে ক্যাপটেন। করিম এ অপারেশনে অংশ নেন নি। মুক্তিযােদ্ধারা এ অপারেশনে ৮টি স্টেনগান, ৩টি এলএমজি, ১৬-১৮টি রাইফেল ও ১টি রিভলভার ব্যবহার করেন।
ফলাফল
আপাত বিচারে এটি একটি অসফল অপারেশন হলেও কার্যকর ছিল। প্রকৃতপক্ষে মুক্তিবাহিনী ও শক্তিশালী শত্রুর মধ্যে গুলি বিনিময়ের খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে জনগণ মুক্তিযােদ্ধাদের উপস্থিতিতে আশান্বিত হয়। তাদের মনােবল বৃদ্ধি পায়। তারা বুঝতে পারে, তাদের পাশে দাড়ানাের জন্য মুক্তিযােদ্ধারা আছেন।
বিশ্লেষণ
গেরিলা অপারেশনের সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা লক্ষ্যবস্তু ধ্বংসের ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল নয়। এ ধরনের অপারেশন ক্ষেত্র বিশেষে আপাতভাবে সফলতালাভ করতে না পারলেও পরােক্ষভাবে সার্বিক বিজয়ে ভূমিকা রেখেছিল। এ অপারেশন বিশ্লেষণ করলে মুক্তিযােদ্ধাদের অপারেশন প্রক্রিয়ার নিম্নবর্ণিত দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়:
ক, পর্যবেক্ষিত তথ্য যথাযথ ছিল না। তাই থানায় সৈন্য পরিখার উপস্থিতি অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি।
খ. থানার প্রাচীর বেষ্টনীর অভ্যন্তরে প্রবেশের তেমন কোনাে পূর্বপরিকল্পনা ছিল না।
গ, এ ধরনের অপারেশনে শেষ মুহূর্তে পরিবর্তনের সংবাদ প্রাপ্তির জন্য। স্পটার (spotter – যে শেষ পর্যন্ত অপারেশন এলাকায় অবস্থান করে)
নিযুক্ত করা হয় নি বলে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ সম্পর্কে কোনাে তথ্য অপারেশন দলের সংগ্রহে ছিল না। ঘ, ক্যাপটেন করিমের মতাে যােগ্য একজন দল নেতার অনুপস্থিতি এ অপারেশনের অসফলতার একটি কারণ হিসেবেও চিহ্নিত করা যায় ।
তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক নাসির। সম্পাদকের টীকা: ১. ডা. মাহফুজুর রহমান রচিত বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ-২ গ্রন্থের ৫২-৫৩ পৃষ্ঠায় এ অপারেশন-সম্পর্কিত নিম্নলিখিত তথ্য আছে: ক, বােয়ালখালী থানা অপারেশনে ৩টি গ্রুপ অংশগ্রহণ করে। প্রথম গ্রুপের নেতৃত্ব দেন অধিনায়ক নাসির। তাদের অবস্থান ছিল থানার পিছনে উত্তর। পাশের ধানক্ষেতে। দ্বিতীয় গ্রুপটির অবস্থান ছিল থানার সামনের খালের অপর পাড়ে সেনেরহাটে। তৃতীয় গ্রুপটির অবস্থান ছিল থানার সামনে দিয়ে চলে যাওয়া প্রধান রাস্তার পাশে তেলিফকিরের মাজারে। খ, এ অপারেশনে ৩-৪জন রাজাকার নিহত হয়। ২. তারই রচিত বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম গ্রন্থের ৪৫৭ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, এ অপারেশনে থানার ওসির স্ত্রীসহ মােট ২০জন পাকিস্তানি পুলিশ ও রাজাকার মারা যায়। ৩, ১১ অক্টোবর ক্যাপটেন করিম কর্তৃক সেক্টর অধিনায়ক মেজর রফিককে লিখিত এক চিঠি থেকে জানা যায়, বােয়ালখালী থানায় তখন শক্র সংখ্যা ছিল ১৫০জন, যুদ্ধের স্থায়িত্ব ছিল ৫ ঘন্টা। এ অপারেশনে ৮০জনের মতাে শক্র মারা যায়। তবে এ যুদ্ধে বেশ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধাও শহিদ হন এবং অস্ত্র। হারানাে যায়। দ্রষ্টব্য: এ গ্রন্থের একাদশ অধ্যায়, দলিল নম্বর ৩২৬। (বােয়ালখালী থানা অপারেশনের নকশাটি ১১৪৯ পাতায়)

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!