You dont have javascript enabled! Please enable it!

গহিরার হাটের কমিউনিটি সেন্টার রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ

উদ্দেশ্য

নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযােদ্ধারা আনােয়ারা থানার গহিরার হাট গ্রামের কমিউনিটি সেন্টারে রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল রাজাকারদের হত্যা, তাদের অস্ত্র ও গােলাবারুদ হস্তগত করা এবং গহিরার হাট গ্রামে রাজাকারদের অত্যাচার ও নির্যাতন বন্ধ করে তাদের ঔদ্ধত্যে আঘাত করা।

পরিকল্পনা

অধিনায়ক মহসিন ও সার্জেন্ট আলমের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধাদের ২টি গ্রুপ ঐ ক্যাম্প আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে। আক্রমণ করার পূর্বে তারা ক্যাম্পটি পর্যবেক্ষণ এবং আক্রমণকালীন অবস্থান ও প্রত্যাবর্তনের পথ নির্ধারণ করেন।

অপারেশন

সকাল ৯টার দিকে ৩০-৩২জনের ১টি মুক্তিযােদ্ধা দল ঐ ক্যাম্প আক্রমণের উদ্দেশ্যে বের হয়। যাত্রা পথে তারা ১জন রাজাকারের দেখা পেলে তাকে হত্যা করে তার এসএমজিটি হস্তগত করে। মুক্তিযােদ্ধা গ্রুপটি ২টি ভাগে বিভক্ত হয়ে এক ভাগ অধিনায়ক মহসিনের নেতৃত্বে ক্যাম্প থেকে প্রায় ৩০০-৪০০ মিটার দূরে রুস্তমহাটে অবস্থান নেয়। অন্য গ্রুপটি সার্জেন্ট আলমের নেতৃত্বে ক্যাম্পের নিকটস্থ পুকুরপাড়ে অবস্থান নেয়। সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নেয়া শেষ হলে সার্জেন্ট আলমের নির্দেশে মুক্তিযােদ্ধারা ক্যাম্পের ওপর গুলি বর্ষণ শুরু করেন। ক্যাম্প থেকে রাজাকাররাও পালটা গুলি চালাতে থাকে। কিছুক্ষণ গােলাগুলি চলার পর রাজাকাররা সুবিধা করতে না পেরে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। গহিরার হাট রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধারা ২টি এলএমজি, ১২টি এসএলআর, ৫টি স্টেনগান এবং ১২-১৩টি রাইফেল ব্যবহার করেন।

ফলাফল

মুক্তিবাহিনী এ অপারেশনে ১১জন রাজাকার বন্দিসহ ৫-৬টি রাইফেল উদ্ধার করে। তবে অপারেশন শেষে ফেরার পথে মুক্তিযােদ্ধা রুস্তম রাজাকারদের গুলিতে শহিদ হন। রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের খবর পেয়ে ক্যাম্পে ফেরার পথে এ মুক্তিযােদ্ধাকে একলা পেয়ে হঠাৎ আক্রমণ করে হত্যা করে মূল দল থেকে দূরে থাকা কয়েকজন রাজাকার।

বিশ্লেষণ
প্রকাশ্য দিবালােকে পরিচালিত এ অপারেশনে ১জন মুক্তিযােদ্ধা শাহাদতবরণ করলেও মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে এটি ছিল একটি বিরাট সাফল্য। এ সাফল্যের মাধ্যমে তাদের মনােবল ও সাহস প্রভূত পরিমাণে বেড়ে যায়। খবরটি গ্রামে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়; যা মুক্তিযুদ্ধ ও যােদ্ধা সম্পর্কে মানুষের আস্থা বৃদ্ধি করে। সেইসাথে এখান থেকে রাজাকার ক্যাম্পটি উঠে যায় এবং সাধারণ মানুষের ওপর রাজাকারদের অত্যাচার ও নির্যাতন বন্ধ হয়।
তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা প্রদ্যুৎ কুমার পাল (দুলাল) (গহিরার হাটের কমিউনিটি সেন্টার রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের নকশাটি ১১৪৬ পাতায়)
ধলঘাট হাসপাতাল অপারেশন
উদ্দেশ্য
ধলঘাট হাসপাতালে অত্যাচার, নির্যাতন পরিচালনাকারী আলবদর বাহিনী হত্যা, অস্ত্র হস্তগত করা এবং তাদের কার্যক্রম সীমিত করার উদ্দেশ্যে এ অপারেশনের পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনা ১৭ সেপটেম্বর মুক্তিযােদ্ধা নাসির গ্রুপ নিজস্ব দলের ইনফর্মার মারফত খবর পান যে, আলবদর বাহিনীর ১টি গ্রুপ ধলঘাট হাসপাতালে কর্মরত মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ও সহযােগী ডাক্তার বদিউল আলমকে হত্যা করার জন্য ধরে নিয়ে গেছে। এ খবরে বিচলিত না হয়ে মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক নাসির তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেন, তিনি তার গ্রুপসহ এর প্রতিকারার্থে এবং সম্পূর্ণ বিষয়টি বুঝতে হাসপাতালে যাবেন। মুক্তিযােদ্ধাদের এ ছােটো গ্রুপটি হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার আলমের দুই মেয়েকে ক্রন্দনরত অবস্থায় দেখতে পান। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে মুক্তিযােদ্ধারা বুঝতে পারেন, আলবদর বাহিনী তাদের লালসা নিবৃত্তির উদ্দেশ্যে পুনরায় এ হাসপাতালে আসবে। ফলে তারা তাৎক্ষণিকভাবে পরিকল্পনা করেন যে, আবার এলে তারা আলবদর বাহিনীকে হাসপাতালেই আক্রমণ ও হত্যা করবেন। পরিকল্পনা মাফিক মুক্তিযােদ্ধারা প্রথমে

ডাক্তারের দুই মেয়েকে রিকশায় করে অন্যত্র পাঠিয়ে দেন। পর্যাপ্ত লােকবল ও অস্ত্র সংগ্রহ করে পুনরায় সেখানে আসার জন্য তারা দ্রুত হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পড়েন। এ সময় ক্যাপটেন করিমের গ্রুপটি ধলঘাটের গােপন আশ্রয়স্থলে অবস্থান করছিল। এ খবর জানতে পেরে অধিনায়ক নাসির ক্যাপটেন করিমের সাথে দেখা করে অস্ত্র ও লােকবল বৃদ্ধি এবং আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে তার সাথে আলােচনা করে নিমলিখিত পরিকল্পনা করেন: ক, মুক্তিযােদ্ধারা মােট ৩টি গ্রুপে ভাগ হয়ে আলবদরদের আক্রমণ করবেন। অধিনায়ক নাসির তার ২জন সহযােদ্ধা প্রদ্যুৎ কুমার পাল (দুলাল) ও মনসুর সিদ্দিকীকে নিয়ে হাসপাতালে লুকিয়ে থাকবেন এবং সুযােগ বুঝে আলবদরদের ওপর গুলি চালাবেন। খ, দ্বিতীয় গ্রুপটি হাবিলদার গােলাপুর রহমানের নেতৃত্বে কৃষ্ণখালী বাজারে। অবস্থান নেবে। নাসির গ্রুপের গুলির আওয়াজ পাওয়া মাত্র তারা গুলি। করতে করতে হাসপাতালের দিকে অগ্রসর হবে। গ, তৃতীয় গ্রুপটি হাবিলদার নূর আলমের নেতৃত্বে হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পথে প্রভাত স্টলের পাশে অবস্থান নেবে এবং সেখান থেকে অগ্রসর হবে।
 
অপারেশন
মুক্তিযােদ্ধারা যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে হাসপাতালের দিকে আসার পথেই খবর পান। যে, তাদের পূর্বেই আলবদর বাহিনী হাসপাতালে এসে উপস্থিত হয়েছে। ফলে পূর্বপরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়। তবুও নাসির গ্রুপ তাৎক্ষণিক চিন্তার ফসল হিসেবে। হাসপাতালের পূর্ব দিক থেকে বেতঝাড়ের ভিতর দিয়ে গুলি করতে করতে হাসপাতালের দিকে এগােতে থাকে। গুলির আওয়াজ পেয়ে আলবদর বাহিনীও হাসপাতালের ভিতর থেকে পালটা গুলি শুরু করে। পরস্পরের মধ্যে প্রায় ৫-৭ মিনিট গুলি বিনিময় চলে। অবশেষে আলবদর বাহিনী হাসপাতাল ত্যাগ করে। পশ্চিম দিকের রাস্তা দিয়ে দৌড়ে পালানাের চেষ্টা করে। এ সময় অপর দুই গ্রুপ আলবদর বাহিনীর ওপর দুই দিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। তবে আলবদর বাহিনী পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। কিন্তু তারা ৩টি রাইফেল ও ১টি রিভলভার ফেলে যায়। এ অপারেশনে ২৮-৩০জন মুক্তিযোেদ্ধা ১টি স্টেনগান ও ২৫-২৬টি রাইফেল ব্যবহার করেন।
 
ফলাফল ও বিশ্লেষণ
এ অপারেশনে আলবদর ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে গুলি বিনিময়কালে একজন অসামরিক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন। তা ছাড়া মুক্তিযােদ্ধাদের কোনাে ক্ষতি হয়নি। বরং তারা শত্রুপক্ষের ৩টি রাইফেল ও ১টি রিভলভার হস্তগত করেন। ধলঘাট হাসপাতালে আলবদর ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে গুলিবিনিময়ের খবর ব্যাপক প্রচার পায়। এতে মুক্তিবাহিনীর ওপর মুক্তিকামী জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পায়। তারপর থেকে ধলঘাট এলাকায় আলবদর ও রাজাকার বাহিনীর অত্যাচার ও নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পায়। সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য দিক হলাে, এ অপারেশনের জন্য স্বল্প। সময়ে একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা কার্যকর করার প্রয়ােজনীয় লােক ও অস্ত্র সগ্রহ করতে পেরেছিলেন মুক্তিযােদ্ধারা। কিন্তু পরিকল্পনা মাফিক আক্রমণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। তবু তাতে হতােদ্যম না হয়ে তাৎক্ষণিক পরিকল্পনায় বিপদের প্রচণ্ড ঝুকি সত্ত্বেও অকুতােভয়ে তারা শত্রুপক্ষকে আক্রমণ ও পরাভূত করেন। তা ছাড়া তাৎক্ষণিক আক্রমণে পরিচালিত ৩টি গ্রুপই অংশ নিয়েছিল, যা তাদের উপস্থিত বুদ্ধি, সুদৃঢ় সমন্বয় ও সুবিবেচনার পরিচায়ক।
তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক নাসির। সম্পাদকের টীকা: সাক্ষাৎকার ছাড়া এ অপারেশন-সম্পর্কিত তথ্য ডা. মাহফুজুর রহমান। রচিত, বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ-২ গ্রন্থের ৫৪-৫৫ পৃষ্ঠায় নিম্নলিখিত তথ্য আছে: ক, ধলঘাট হাসপাতাল অপারেশনে ৩টি গ্রুপ অংশগ্রহণ করে। প্রথম গ্রুপের নেতৃত্ব দেন অধিনায়ক নাসির। তাদের অবস্থান ছিল হাসপাতালের পূর্ব পাশে। দ্বিতীয় গ্রুপের নেতৃত্ব দেন সুবেদার আলম। তাদের অবস্থান ছিল হাসপাতালের পশ্চিম-উত্তর কোণে। তৃতীয় গ্রুপের নেতৃত্ব দেন হাবিলদার গােলাপুর রহমান। তাদের অবস্থান ছিল হাসপাতালের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে। খ, এ অপারেশনে ১৭-১৮জন রাজাকার ও আলবদর নিহত হয়। গ. ধলঘাট হাসপাতাল অপারেশনে মুক্তিযােদ্ধাদের কোনাে ক্ষতি হয় নি। (ধলঘাট হাসপাতাল অপারেশনের নকশাটি ১১৪৭ পাতায়)

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!