সদরখালে রাজাকার পুলিশ বাহিনীর উপর আক্রমণ
প্রেক্ষাপট
গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযােদ্ধাদের অনুপ্রবেশের পর জুন মাস থেকে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের সর্বত্র মুক্তিযােদ্ধাদের যে অপারেশন শুরু হয়, সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে তা আরও পরিপক্ক, কার্যকর ও লক্ষ্যভেদী হয়ে ওঠে। গেরিলারা গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েন এবং উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে শত্রুকে আক্রমণ করে হতচকিত করেন। প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ গেরিলারা যেখানেই আক্রমণ যােগ্য শক্রর দেখা পেয়েছেন, সেখানেই তাদের আক্রমণ করেছেন।
অপারেশন
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ক্যাপটেন করিম ও অধিনায়ক নাসিরসহ আনুমানিক ১০-১১জন মুক্তিযােদ্ধা কর্ণফুলি নদীর দক্ষিণ পাড়ের ভাণ্ডালঝুরি ঘাট থেকে নৌকাযােগে বেতাগী গ্রামের দিকে যাচ্ছিলেন। নদীর মাঝামাঝি গিয়ে তারা দেখতে পান, নদীর অন্যদিক থেকে দুটি নৌকায় পুলিশ ও রাজাকার বাহিনীর ১টি দল লাম্বুরহাটের দিকে যাচ্ছে। ক্যাপটেন করিম ও অধিনায়ক নাসির ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেন, এ রাজাকার ও পুলিশ বাহিনীকে আক্রমণ করতে হবে। তাই তারা শত্রুর নৌকা ২টিকে পিছন থেকে অনুসরণ করতে থাকেন। একসময় তারা দেখতে পান পুলিশ ও রাজাকারদের নৌকা ২টি সদর খাল দিয়ে ঢুকে পড়ে রাউজান অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে। মুক্তিযােদ্ধারা লাম্বুরহাটে এসে নেমে পড়েন এবং খালের পাড় হয়ে ঝােপঝাড়ের আড়াল নিয়ে দৌড়ে উদ্দিষ্ট নৌকা ২টির সামনে এগিয়ে গিয়ে একটি সুবিধাজনক জায়গায় অবস্থান নেন, যাতে নৌকা ২টিকে অ্যামবুশে ফেলে ধ্বংস করা যায়। নৌকা ২টি খালের ভিতর দিয়ে অ্যামবুশ স্থানে এসে উপস্থিত হলে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালান। মুক্তিযােদ্ধাদের এ আক্রমণে রাজাকার ও পুলিশ হতচকিত হয়ে পড়ে। বিভ্রান্ত হয়ে কেউ কেউ পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে। অন্যদিকে, কয়েকজন শক্র খালের অপর তীরে অবস্থান নিয়ে পালটা গুলি চালাতে থাকে। ১০-১২ মিনিট গুলি বিনিময়ের পর রাজাকার ও পুলিশ বাহিনী সুবিধা করতে না পেরে ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীও ত্বরিতগতিতে নৌকায় খাল পার হয়ে পলায়নপর শত্রুর পিছু ধাওয়া করে।
বিশ্লেষণ
এ অপারেশনে অধিনায়কের ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি একটি বিশেষ লক্ষণীয় দিক। গেরিলা যুদ্ধে তৃণমূল পর্যায়ে সব আদেশ নির্দেশ স্পষ্টভাবে দেওয়া সম্ভব নয়। গেরিলা যুদ্ধের সাফল্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তৃণমূল পর্যায়ের অধিনায়কের ক্ষিপ্রতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দ্রুত খাপ খাওয়ানাে, উদ্যম প্রভৃতির ওপর নির্ভরশীল। এ অপারেশনে অধিনায়কের মনােবল, উদ্যম ও সাহসের দৃষ্টান্ত অত্যন্ত সুস্পষ্ট’। তা ছাড়া গেরিলারা সাধারণত হিট অ্যান্ড রান’ কৌশল অবলম্বন করলেও এ ক্ষেত্রে অধিনায়ক শত্রুদের পিছু ধাওয়া করেছেন। এতে মুক্তিযােদ্ধাদের শক্তি, সাহস ও বিক্রমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে, তা শক্রর নিমগামী মনােবলের সূচক হিসেবে পরিচ্ছন্নভাবে ফুটে উঠেছে। গেরিলা যুদ্ধসহ যে-কোনাে যুদ্ধে অধিনায়কের ভূমিকা যে সাফল্যের একটি প্রধান বিষয়, তা এ অপারেশনের মাধ্যমে প্রতিভাত।
তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক নাসির। (সদরখালে রাজাকার পুলিশ বাহিনীর উপর আক্রমণের নকশাটি ১১৪৪ পাতায়)
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড