You dont have javascript enabled! Please enable it!
পটিয়া রেজিস্ট্রি অফিসে অপারেশন
প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য
প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জনগণকে তকালীন পাকিস্তান সরকারকে সকল প্রকার ট্যাক্স দেওয়া বন্ধ করতে আহ্বান জানায়। তা ছাড়া যুদ্ধের সুযােগে কেউ যেন কারাে জমি অন্যায়ভাবে দখল করে রেজিস্ট্রি না করতে পারে, সে জন্য রেজিস্ট্রি অফিস বন্ধ রাখারও নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান পন্থিরা তা মানে নি। এ জন্য দেশের অন্য স্থানের মতাে পটিয়ার রেজিস্ট্রি অফিসটি খােলা রাখার চেষ্টা করলে পটিয়ার কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা সেখানকার রেজিস্ট্রি অফিসটি পুড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেন। উল্লেখ্য, সে সময় দেশের প্রত্যন্ত অনেক তহসিল অফিস গেরিলা আক্রমণের শিকার হয়েছিল। এ তথ্য ত্রয়ােদশ অধ্যায়ে আদালতের নথিপত্রে সন্নিবেশিত দলিল নম্বর ৫০৬-এ প্রমাণিত।
পরিকল্পনা
ক্যাপটেন করিম প্রথমে পটিয়া রেজিস্ট্রি অফিস পােড়ানাের সিদ্ধান্ত নেন। পরে তিনি ঐ এলাকার আরও ২জন গ্রুপ অধিনায়ক অধ্যাপক শামসুল ইসলাম ও শামসুদ্দিনকে ঐ পরিকল্পনার কথা বলেন এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাদের সাহায্য চান। এ ২টি গ্রুপ ক্যাপটেন করিমের পরিকল্পনার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে।
অপারেশন
অধিনায়ক শামসুদ্দিনকে রেজিস্ট্রি অফিস পর্যবেক্ষণ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার পর্যবেক্ষণ রিপাের্টের ওপর ভিত্তি করে অপারেশন পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয় । সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, রাত ১১-১২টার দিকে রেজিস্ট্রি অফিসটি পুড়িয়ে দেওয়া হবে। আরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, মুক্তিযােদ্ধা দলটি ৩টি ভাগে ভাগ হয়ে অপারেশন চালাবে। প্রথম ২টি গ্রুপ অফিসের দুই দিকে ‘গার্ডিং পাটি’ হিসেবে থাকবে। অপর ১টি গ্রুপ অফিসটিতে অগ্নিসংযােগ করবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, রাত ১২টার দিকে ১০-১২জনের মুক্তিযােদ্ধা গ্রুপটি রেজিস্ট্রি অফিসের পাশে এসে উপস্থিত হয় । প্রথম গ্রুপ ২টির একটি অফিসের পূর্ব দিকে, অপরটি পশ্চিম দিকে অবস্থান নেয়। তৃতীয় গ্রুপটি পরিকল্পনামাফিক অফিসের দেওয়ালে ও চালে পেট্রোল ও কেরােসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। এ অপারেশনে ১টি এসএমজি, ২টি স্টেনগান, ১টি এসএলআর, ৮-৯টি রাইফেল, ২টি গ্রেনেড এবং প্রয়ােজনমাফিক কেরােসিন ও পেট্রোল ব্যবহৃত হয়েছিল।
 
বিশ্লেষণ
মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে মুক্তিযােদ্ধাদের এ অপারেশনটি ছিল একটি সফল অপারেশন তাদের দেওয়া আগুনে অফিসটি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়। জনসাধারণও রেজিস্ট্রি অফিসে যাতায়াত বন্ধ করে দেয়। ফলে সরকারের রাজস্ব আয় বন্ধ হয়ে যায়। গেরিলা যুদ্ধনীতি অনুযায়ী সরকারকে যথাসম্ভব ব্ৰিত, ক্ষতিগ্রস্ত ও হয়রানি করার এ অপারেশন সফল হয়েছে।
 
তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা প্রদ্যুৎ কুমার পাল। সম্পাদকের টীকা: সাক্ষাৎকার ছাড়া এ অপারেশন-সম্পর্কিত তথ্য ডা. মাহফুজুর রহমান। রচিত, বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম গ্রন্থের ৪৪৮ পৃষ্ঠায় নিমলিখিত তথ্য আছে: ক, অপারেশনের তারিখ ছিল ১৯৭১ সালের ৫ জুন। খ. অপারেশনটি ভােররাতে কার্যকর করা হয়েছিল। গ, মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয় স্থল ছিল তাদের সহযােদ্ধা নায়েব সুবেদার লতিফের বাড়ি। ঘ, এ অপারেশনে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা হলেন: ক্যাপটেন করিম, শামসুদ্দিন, অনিল লালা, আবছার, আনােয়ার, আসলাম, কাসেম, মাহফুজ ও লতিফ।
 
পােমরায় ইলেকট্রিক পাইলন ধ্বংস
 
উদ্দেশ্য
চট্টগ্রাম শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে পাকিস্তানি প্রশাসনকে বিরূপ পরিস্থিতিতে ফেলা এবং মুক্তিযােদ্ধাদের সর্বত্র উপস্থিতি প্রমাণ করা- এ দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা ১৯৭১ সালের ৬ সেপটেম্বর রাত ২-৩টার সময় পােমরায় হাইড্রো ইলেকট্রিক পাইলনের ওপর অপারেশন পরিচালনা করে।
 
পরিকল্পনা
প্রাথমিকভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে অর্থাৎ ১৪ আগস্ট চট্টগ্রাম শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হবে, যাতে কর্তৃপক্ষ স্বাধীনতা দিবস পরিকল্পনা অনুযায়ী পালন করতে না পারে। কিন্তু বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করার জন্য আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র সময়মতাে জোগাড় করতে না পারায় পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ঐ দিন অপারেশন করা সম্ভব হয় নি। অপারেশন পুনরায় পরবর্তী মাসে অর্থাৎ সেপটেম্বরে করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ উদ্দেশ্যে তারা তাদের বিবেচনায় নিরাপদ ও প্রত্যন্ত এলাকা হিসেবে রাঙ্গুনিয়া এলাকার পােমরার জলবিদ্যুৎ টাওয়ার উপড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক নাসির ও ক্যাপটেন করিম ছিলেন ঐ অপারেশনের মূল পরিকল্পক।
 
অপারেশন
৩০-৩২জনের মতাে ১টি মুক্তিযােদ্ধা গ্রুপ ক্যাপটেন করিম ও অধিনায়ক নাসিরের নেতৃত্বে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী রাত ১০টার দিকে রাউজানের পাহাড়তলী থেকে পােমরার দিকে যাত্রা করে। তাদের সাথে পথপ্রদর্শক হিসেবে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক মিলনবাবুর ছেলে এবং বাহাদুর নামে আরও ১জন। তারা যে ইলেকট্রিক পাইলন নির্বাচন করেন, তা থেকে প্রায় দেড় কিলােমিটার দূরে পাকিস্তানি সেনাদের একটি ক্যাম্প ছিল। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে মুক্তিযােদ্ধা দলটি ২টি ভাগে বিভক্ত করা হয়। বড়াে দলটি প্রােটেকশন পার্টি হিসেবে ২০-২৫জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে পাইলনের দিকে আসার সম্ভাব্য রাস্তায় অবস্থান নেন। ৫-৭জনের অপর দলটি বিদ্যুৎ সংযােগ বিচ্ছিন্নকারী দল হিসেবে পাইলনের পাশে চলে যায়। এ দলটি হ্যাকস ব্লেড দিয়ে প্রথমে পাইলনের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ জয়েন্ট কেটে দেয়। তারা ৩টি পাইলন নির্বাচন করেন। প্রথম পাইলনটিতে থাকেন অধিনায়ক নাসির, দ্বিতীয়টিতে মনসুর সিদ্দিকী এবং তৃতীয়টিতে গােলাপুর রহমান। তারা প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে পাইলনগুলাের জয়েন্ট কাটা সম্পন্ন করেন। তারপর পাইলনগুলােতে বিস্ফোরক লাগিয়ে অতি দ্রুত নিকটবর্তী টিলার ওপরে নিরাপদ স্থানে চলে আসেন। টিলার ওপর আসতে না আসতেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ৩টি পাইলন উপড়ে এবং ১টি পাইলন হেলে পড়ে। অপারেশন শেষে মুক্তিযােদ্ধা দলটি প্রােটেকশন পার্টির অন্য সদস্যদের সাথে নিয়ে নিরাপদে তাদের আশ্রয় স্থল পাহাড়তলীতে ফিরে আসেন। এ অপারেশনে যথেষ্ট সংখ্যক হ্যাক-স ব্লেড, বিস্ফোরক (পিকে-টু), ২টি এলএমজি, ৩টি স্টেনগান, ২৪-২৫টি ৩০৩ রাইফেল ব্যবহার করা হয়।
ফলাফল ও প্রভাব
এ অপারেশনের মাধ্যমে মােট ৩টি পাইলন সম্পূর্ণ এবং ১টি পাইলন আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় চট্টগ্রাম শহরে পূর্ণ এক দিন বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। এ সংবাদটি বিবিসি থেকেও প্রচার করা হয়। ফলে বহির্বিশ্ব গেরিলাদের কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে জানতে পারে। জনগণেরও মনােবল ও আস্থা বৃদ্ধি পায়।
বিশ্লেষণ
পােমরা ইলেকট্রিক পাইলন অপারেশনে মুক্তিযােদ্ধারা চমৎকার ও কার্যকরভাবে গেরিলা অপারেশন পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন। অপারেশনের স্থান হিসেবে তারা প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকা নির্বাচন করেন। দ্বিতীয়ত, তারা ঐ এলাকার ভূমির সাথে পরিচিত স্থানীয় এক ব্যক্তিকে গাইড হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।
তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা প্রদ্যুৎ কুমার পাল। সম্পাদকের টীকা ক, ডা. মাহফুজুর রহমানের বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ গ্রন্থের ৪৬০ পৃষ্ঠায় এ অপারেশন-সম্পর্কিত বিধৃত তথ্য মতে নাসির, হাবিলদার গােলাপুর রহমান, প্রদ্যুৎ কুমার পাল (দুলাল), নুরুল ইসলাম ও আবুল মনসুর সিদ্দিকসহ মােট ৫জন মুক্তিযােদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। খ, ১১.১০.১৯৭১ তারিখে ক্যাপটেন করিম কর্তৃক সেক্টর অধিনায়ক মেজর রফিককে লেখা এক চিঠিতে এ অপারেশনের উল্লেখ রয়েছে। দ্রষ্টব্যঃ গ্রন্থের একাদশ অধ্যায়, দলিল নম্বর ৩২৬।
(পােমরায় ইলেকট্রিক পাইলন ধ্বংসের নকশাটি ১১৪৩ পাতায়)

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড

 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!