You dont have javascript enabled! Please enable it! আনােয়ারা থানা আক্রমণ-২, গুনাগরি রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন, আরাকান রােডে পাকিস্তানি সেনাদের সাথে সংঘর্ষ - সংগ্রামের নোটবুক
আনােয়ারা থানা আক্রমণ-২
 
উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা
 
প্রথম বার আনােয়ারা থানা আক্রমণ করার পর পুনরায় এক দল পুলিশ ও রাজাকার থানা কমপ্লেক্সে অবস্থান নেয়। এখান থেকে মূলত রাজাকারদের অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা করা হতাে। ক্যাপটেন করিমের নেতৃত্বে আনসার অধিনায়ক মাহমুদুল হক ও আরও কয়েকটি দল মিলে থানা আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। স্থানীয় অনেক মুক্তিযােদ্ধা থানার আশপাশের এলাকা চিনতেন, তাই পর্যবেক্ষণ করার প্রয়ােজন হয় নি। প্রায় ৩০জনের মতাে মুক্তিযােদ্ধা দল গঠনের পর পুরাে দলকে ২টি ভাগে বিভক্ত করা হয়। ১টি দলের কমান্ডে থাকেন ক্যাপটেন করিম এবং তার সাথে ছিলেন আনসার অধিনায়ক মাহমুদুল হক। এ দলে প্রায় ১০-১২জন। দ্বিতীয় দলে ২০জনের মতাে মুক্তিযােদ্ধা রাখা হয়।
 
অপারেশন
 
পটিয়ার ফকিরহাট থেকে দলটি রাত আনুমানিক ১টার দিকে রওনা হয়। গ্রামের মধ্য দিয়ে আড়াআড়ি পথ চলে রাত আনুমানিক ৩টার মধ্যেই ২টি দলের অবস্থান নেয়ার কাজ সম্পন্ন হয়। প্রথম দল থানার সামনে রাস্তার বিপরীতে অবস্থান নেয়। তাদের পিছন দিকে সিও অফিস। মুক্তিযােদ্ধারা পূর্বেই বিশ্বস্ত সূত্রে নিশ্চিত হয়েছিলেন, সিও অফিসে কোনাে রাজাকার কিংবা পুলিশ অবস্থান করে না। প্রথম দল থেকে কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধাকে সিও অফিস লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণে দায়িত্ব দেওয়া হয়। দ্বিতীয় দল অবস্থান নেয় থানার পশ্চিম দিকে। এ দলের কাজ ছিল থানার দিকে ক্রমাগত গুলি বর্ষণ এবং পশ্চিম দিক থেকে শত্রুর সম্ভাব্য শক্তিবৃদ্ধির প্রচেষ্টা প্রতিহত করা।
 
অবস্থান নেয়ার কাজ সম্পন্ন করে পুরাে দল ভাের ৫টা পর্যন্ত নীরবে অবস্থান নিয়ে ৫টার সময় পূর্বপরিকল্পনা মতাে একযােগে থানা লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করতে থাকে। থানার অভ্যন্তরে অবস্থানরত পুলিশ ও রাজাকার কিছুক্ষণ পালটা গুলি বর্ষণ করে। এক পর্যায়ে অনেকে পালিয়ে যেতে থাকে। সকাল ৭টার দিকে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রথম দলটি ক্রলিং করতে করতে থানার দিকে অগ্রসর হয়। দ্বিতীয় দলকে খবর দেওয়া হয় গুলি বর্ষণ বন্ধ করতে। থানার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে মুক্তিযােদ্ধারা কাউকে পায় নি। মূলত সবাই থানার পিছন দিক দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। মুক্তিযােদ্ধারা কিছু অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ উদ্ধার করেন।
বিশ্লেষণ
আনােয়ারা থানায় প্রথম অপারেশনের পর পুনরায় কিছু পুলিশ ও রাজাকার অবস্থান নিলেও তাদের মনােবল ছিল দুর্বল। তাই মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পলায়ন করে। এ আক্রমণের পর থানায় আর কোনাে তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় নি। তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা আনসার অধিনায়ক মাহমুদুল হক।
 
গুনাগরি রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন
 
প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে প্রতিনিয়ত বাঁশখালীর গুনাগরি রাজাকার ক্যাম্পের রাজাকাররা ঐ এলাকায় নানা ধরনের অত্যাচার, নিপীড়ন ও মুক্তিযুদ্ধ বিরােধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল। ক্যাম্পটি মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান, বিস্তৃতি ও কর্মকাণ্ডের পথে প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ বলে সেখানে অপারেশন ছিল অত্যন্ত জরুরি।
 
পরিকল্পনা
গুনাগরি রাজাকার ক্যাম্পটি ছিল পাহাড়ের ওপর। ক্যাপটেন আলম ১৩০১৪০জনের মতাে ১টি বড়াে গ্রুপ এ অপারেশনে অংশ নেবে বলে পরিকল্পনা করেন। সিদ্ধান্ত নেন, ক্যাম্পটির চারপাশে নিরাপদে অবস্থান নেয়ার জন্য তারা রাতের আঁধারকে ব্যবহার করবেন। মুক্তিযােদ্ধারা ২টি দলে বিভক্ত হয়ে ১টি গ্রুপ পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থান নেবে। গ্রুপটির কাজ হবে অপারেশন চলাকালীন শত্রুকে সাহায্য করার জন্য কেউ এগিয়ে এলে তাদের বাধা দেওয়া, কোনাে রাজাকার পালিয়ে যেতে চাইলে তাকে বন্দি অথবা হত্যা করা এবং নিজস্ব বাহিনী। অসুবিধায় পড়লে তাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে যাওয়া। দ্বিতীয় গ্রুপটি ক্যাপটেন আলমের নেতৃত্বে চুপিসারে পাহাড়ে উঠে চারদিকে অবস্থান গ্রহণ করবে। অধিনায়কের নির্দেশ মােতাবেক ক্যাম্পটির ওপর আক্রমণ চালাবে। এ অপারেশনের সার্বিক নেতৃত্বে থাকবেন ক্যাপটেন আলম। তাকে সাহায্য করবেন ইপিআর-এর অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার লতিফ ও হাবিলদার মদন এবং গেরিলা গ্রুপ অধিনায়ক ছমিরউদ্দিন, সফিকুল ও শাহজাহান।
 
অপারেশন
তৈলারদ্বীপ রাজাকার অবস্থানের ওপর ব্যর্থ অ্যামবুশের পর ক্যাপটেন আলমের। গ্রুপ সেদিনই বাঁশখালীতে চলে যায়। সেখানে তিনি আরও ৩জন গেরিলা অধিনায়ক শাহজাহান, ছমিরউদ্দিন ও সফিকুলের সাথে মিলিত হয়ে নিজেদের পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা করেন। ব্যর্থ অপারেশনের দরুন দলের মনােবল দুর্বল থাকায় তা চাঙা করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে। ফলে ঐ আলােচনায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তাঁরা ত্বরিত গুনাগরি রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ করবেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পর দিন রাতে প্রায় ১২০-১৩০জনের ১টি বিরাট মুক্তিযােদ্ধা দল ক্যাপটেন আলমের নেতৃত্বে রাতের আঁধারে তার আশ্রয় স্থল বাঁশখালীর পরিত্যক্ত খাসমহল থেকে যাত্রা শুরু করে। পাহাড়ের ভিতর দিকে ঘণ্টা খানেক হাঁটার পর তাঁরা রাত ১০টার দিকে ক্যাম্পটি যে পাহাড়ে, তার পাদদেশে এসে পৌঁছেন। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৪০জনের মতাে মুক্তিযােদ্ধাকে নিচে রেখে বাকিদের নিয়ে ক্যাপটেন আলম পাহাড়ের ওপর গিয়ে দ্রুত ক্যাম্পটির চারদিকে অবস্থান নেন। মুক্তিযােদ্ধারা দেখতে পান, ২জন সেন্ট্রি ক্যাম্পটি পাহারা দিচ্ছে। অধিনায়কের নির্দেশে ২জন মুক্তিযােদ্ধা ক্রলিং করে সেন্ট্রিদের কাছে পৌছে হঠাৎ করে তাদের জাপটে ধরেন এবং তাদের রাইফেল কেড়ে নিয়ে বন্দি ও পরে হত্যা করা হয়। ক্যাম্পটিকে সেন্ট্রি মুক্ত করার পর ক্যাপটেন আলম আরেকজন। মুক্তিযােদ্ধাসহ ক্যাম্পটির দরজায় ধাক্কা দেন। মুক্তিযােদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে ভিতর থেকে রাজাকাররা গুলি শুরু করে। সাথে সাথে ক্যাপটেন আলম গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন। তবে মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর গ্রুপকে গুলি করার নির্দেশ দেন। দুই পক্ষে প্রায় ঘন্টা খানেক গােলাগুলি চলে। এক সময় রাজাকাররা ক্যাম্পটির পিছন দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। মুক্তিযােদ্ধারা ক্যাম্পটির ভিতরে তল্লাশি চালান। তারা সেখান থেকে ৭-৮টি রাইফেল উদ্ধার করেন। অধিনায়কের মৃতদেহ চাদর মুড়িয়ে পাহাড়ের নিচে নিয়ে আসেন মুক্তিযােদ্ধারা। সেখানে তাঁকে সমাহিত করে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসেন তারা।
বিশ্লেষণ
এ অপারেশন বিশ্লেষণে এটি প্রমাণিত হয়, অধিনায়ক ক্যাপটেন আলমের বীরত্ব ও সাহসের কোনাে কমতি না থাকলেও পরিকল্পনায় সামরিক জ্ঞানের প্রায়ােগিক দক্ষতার অভাব ছিল। তিনি পাহাড়ের পাদদেশে এক দল মুক্তিযােদ্ধাকে সাহায্যকারী দল ও বিচ্ছিন্নকারী দলের দায়িত্বে রাখলেও সমর পরিকল্পনার দৃষ্টিতে এটি যথেষ্ট ছিল না। কারণ, তাদের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট রাস্তার দায়িত্বে রাখা হয়েছিল। পুরাে পাহাড়টিকে ঘিরে রাখার প্রয়ােজন থাকলেও তা করা হয় নি। ফলে অপারেশনের শেষ মুহূর্তে শক্ররা সহজে ও নিরাপদে বিকল্প পথে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয়ত, পাহাড়ের পাদদেশের সাহায্যকারী দল পাহাড়ের ওপরে আক্রমণকারী দলকে কীভাবে সাহায্য করবে, সে ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশনা ছিল না। তৃতীয়ত, ক্যাপটেন আলম এক পর্যায়ে আবেগের বশীভূত হয়ে যুদ্ধের নিয়ম লঙ্ঘন করে শক্রর অবস্থানে ঢুকে পড়েন। তার এ অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের ফলে নিজের জীবন হনন করাসহ পুরাে অপারেশনটি বাস্তবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তথ্যসুত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা মাে. সাবের। 
আরাকান রােডে পাকিস্তানি সেনাদের সাথে সংঘর্ষ
প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য
মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে এসে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযােগীদের ধ্বংস করতে একটি বিস্তারিত ও সমন্বিত পরিকল্পনা করেন। তারা ঠিক করেন, কক্সবাজার-বান্দরবান সড়কে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর অ্যামবুশ করবেন। এ লক্ষ্যে মুক্তিযােদ্ধারা ঠিক করেন, এ পথে ইন্দ্রপুল ব্রিজ ধ্বংস করে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাথে চট্টগ্রাম শহরের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দেবেন; শত্রুর আসার পথে আরাকান রােডের আরেক গুরুত্বপূর্ণ সেতু রাখালিয়া ব্রিজ ধ্বংস করে দিয়ে রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় অ্যামবুশ পাতবেন। পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযােদ্ধাদের এসব অ্যামবুশের আওতায় এলে তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে ধ্বংস নিশ্চিত করবেন।
পরিকল্পনা
অধিনায়ক শাহজাহান ইসলামাবাদী ও সার্জেন্ট আলম উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। তারা ঠিক করেন, এ অপারেশনে মােট ৮০-৮৫জন মুক্তিযােদ্ধা থাকবেন। লােক সংগ্রহে নবী গ্রুপ, রশিদ গ্রুপ, হাবিব গ্রুপ, গনি গ্রুপ (পটিয়া), মহসিন গ্রুপ (পটিয়া), রফিক ও আলম গ্রুপ (পটিয়া) ও আবুল হােসেন। গ্রুপের (বােয়ালখালী) সাহায্য নেয়া হবে। অধিনায়ক ইসলামাবাদী নিজস্ব ইনফর্মার মারফত এসব গ্রুপের কাছে সংবাদ পাঠান, তাঁরা যেন নির্দিষ্ট দিনে আমজুরহাটের নন্দীদের ঝাউবাগানে করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে একত্রিত হন। সংবাদ প্রাপ্তির পর উল্লিখিত সব গ্রুপ রাত ২টার দিকে ঐ বাগানে উপস্থিত হয়। ঐ সভায় সার্বিক পরিস্থিতি আলােচনা শেষে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়: ক, মুক্তিযােদ্ধারা কয়েকটি ছােটো গ্রুপে ভাগ হয়ে পর পর কয়েকটি অপারেশন চালাবেন। রাখালিয়া ব্রিজ ধ্বংস করার দায়িত্বে থাকবেন গ্রুপ অধিনায়ক আবুল হােসেন। তার সাথে মােট ১২জন সহযােদ্ধা থাকবেন। এঁরা অপারেশনে অস্ত্র হিসেবে গ্রেনেড, এসএলআর, স্টেনগান, রাইফেল ও বিস্ফোরক ব্যবহার করবেন। ইন্দ্রপুল ব্রিজ ধ্বংস করার দায়িত্বে থাকবেন আলম ও রফিক গ্রুপ। তারা এ অপারেশনে মােট ৭-৮জন সহযােদ্ধা নিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন।
ঘ, অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক হাবিবের গ্রুপের সদস্য মােট ৭জন। তারা আমুজরহাটের কালভার্ট ধ্বংস করে অ্যামবুশ অবস্থানে থাকবেন। শহর থেকে পাকিস্তানি সেনারা এ স্থানে এলে তাদের ওপর অ্যামবুশ করবে। ৬. মুক্তিযােদ্ধা নবী ১০-১২জন সহযােদ্ধা নিয়ে পটিয়া রেললাইনের কোনাে এক সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নেবেন। তাদের কাজ হবে পাকিস্তানি সেনারা নতুন করে সাহায্য পাঠালে তাদের ধ্বংস করা। চ, মহসিন ও সগীর গ্রুপকে রসদ সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পাশাপাশি তারা কেউ আহত অথবা অসুবিধায় পড়লে সাহায্য করবে। তারা বিভিন্ন গ্রুপকে খাদ্য ও অস্ত্র সরবরাহ করবে। এ গ্রুপে সদস্য। থাকবেন ১০-১২জন। অপারেশন পরিকল্পনা গৃহীত হওয়ার পর গ্রুপগুলাের মধ্যে অস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি বণ্টন করে দেওয়া হয়।
অপারেশন
পরদিন আবুল হােসেন গ্রুপ রাখালিয়া ব্রিজে যাওয়ার পথে সকাল ৮টার দিকে নয়ারহাটে আরাকান রােডের ওপর থেকে দেখতে পায়, ১টি জিপে করে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা আসছে। সুবিধাজনক স্থানে মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্রের কার্যকর ক্ষমতার আওতায় এলে তাঁরা গাড়িটির ওপর গুলি বর্ষণ শুরু করেন। দুই পক্ষের মধ্যে ৫-৭ মিনিট ধরে গুলি বিনিময় চলে। পাকিস্তানি সৈন্যরা সুবিধা করতে না পেরে এক পর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। পরে ধৃত ২জন পাকিস্তানি সৈন্যকে মুক্তিযােদ্ধারা হত্যা করেন। এ ঘটনার পর ঐ গ্রুপটি রাখালিয়া ব্রিজের দিকে এগিয়ে যায়। পথিমধ্যে গ্রুপটি মিলিটারি পুলের (পটিয়া) উভয় পাশের মাটি সরিয়ে দিয়ে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে পুনরায় রাখালিয়া ব্রিজের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। রাত ৯টার দিকে তারা সাফল্যের সাথে ব্রিজটিতে বিস্ফোরক লাগিয়ে ব্রিজটি উড়িয়ে দেয়। অতঃপর তারা পূর্বোক্ত নন্দীদের ঝাউবাগানে ফিরে আসে।
এদিকে আরেকটি গ্রুপ (কয়েকটি উপদলের সমন্বয়ে গঠিত) ৭ ডিসেম্বর পটিয়ার কমলমুন্সির হাটের দিকে এসে ঐ স্থানে অ্যামবুশ পাতে। পরদিন সকাল ৯টার দিকে ঐ স্থানে পাকিস্তানি সেনাদের ১টি গাড়ি এলে মুক্তিযােদ্ধারা গাড়িটির ওপর হামলা চালান। দুই পক্ষের মধ্যে ঘণ্টা দুয়েক প্রচণ্ড গােলাগুলি চলে। মুক্তিযােদ্ধাদের গুলিতে ঘটনাস্থলে ২জন পাকিস্তানি সেনা মারা যায়। এক সময় মুক্তিযােদ্ধাদের গুলি ফুরিয়ে এলে এবং গুলির সরবরাহ না আসায় তারা পিছু হটে যান। তবে এ ঘটনার জের হিসেবে কমলমুন্সির হাট এলাকায় পাকিস্তানি সেনারা। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় এবং ৬জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। অন্যদিকে, অধিনায়ক হাবিব তার অধীনস্তদের নিয়ে ৭ ডিসেম্বর আমজুরহাটে পেীছেন এবং ওখানকার কালভার্ট ধ্বংস করেন। তারপর তারা রাস্তার পূর্ব দিকে পশ্চিমমুখী হয়ে অবস্থান নেন। ৮ ডিসেম্বর ঐ কালভার্টের কাছে এসে পাকিস্তানি সৈন্য বােঝাই ১টি গাড়ি থামে। ঘটনা বােঝার জন্য ৩জন পাকিস্তানি সেনা গাড়ি থেকে নিচে নেমে আসে এবং দ্রুত পজিশন নেয়। এমতাবস্থায় অধিনায়ক হাবিব সহযােদ্ধাদের আদেশ দিলে তারা পাকিস্তানি সৈন্যদের এ অবস্থানের ওপর গুলি। বর্ষণ শুরু করেন। ইতােমধ্যে পাকিস্তানি সেনারা ওয়্যারলেস সেটের মাধ্যমে তাদের আক্রান্ত হওয়ার খবর অন্যত্র পাঠালে ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে পাকিস্তানি সৈন্য বােঝাই আরেকটি গাড়ি ঐ স্থানে এসে উপস্থিত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা এ গ্রুপটির ওপরও গুলি চালাতে থাকেন। কিন্তু গুলি ফুরিয়ে এলে তারা অধিনায়কের নির্দেশে ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে আড়াল নিয়ে ক্রলিং করে নিরাপদে আশ্রয় স্থলে ফিরে আসেন।
বিশ্লেষণ
এ অপারেশনে মুক্তিযােদ্ধাদের সমন্বিত পরিকল্পনা ও কার্যকর অবস্থান নেয়ার কৌশলগত দিকটি ফুটে উঠলেও তাদের সরবরাহ ব্যবস্থা যে অত্যন্ত দুর্বল ছিল তা অত্যন্ত স্পষ্ট। পরিকল্পিত ৩টি অপারেশনের মধ্যে ২টি অপারেশন থেকে তারা শুধু গুলি ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে পিছু ফিরে আসতে বাধ্য হন। যে-কোনাে যুদ্ধজয়ের জন্য যােগাযােগ ও সরবরাহ গুরুত্বপূর্ণ দিক। সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারায় তারা উদ্দেশ্য অর্জনে ব্যর্থ হন। মহসিন ও সগীর গ্রুপকে গুলি সরবরাহের দায়িত্বে রাখলেও তারা সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় গুলি পৌছাতে না পারায় যােদ্ধারা আপাত পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হন। তবু এ অপারেশনগুলাে রণকৌশলগত দৃষ্টিতে সফল মনে না হলেও গেরিলা যুদ্ধের নিরিখে এগুলাের গুরুত্ব রয়েছে।
তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা এনামুর রশীদ চৌধুরী।

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড