You dont have javascript enabled! Please enable it!
আনােয়ারা থানার পশ্চিম এলাকায় কতিপয় রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন
অবস্থান
বারখাইন ইউনিয়নের অন্তর্গত শঙ্খ নদীর উত্তর পাড়ে অবস্থিত তৈলারদ্বীপ গ্রাম। মুক্তিযােদ্ধারা এ গ্রামের লতিফ মিয়ার বাড়িতে তাঁদের বেস ক্যাম্প (আশ্রয় কেন্দ্র) স্থাপন করেছিলেন।
প্রেক্ষাপট
কার্তিক মাসের শেষের দিক (সঠিক তারিখ সংগ্রহ করা সম্ভব হয় নি)। মাঠে ধান ছিল। ৫ দিন যাবৎ একটানা বৃষ্টি হচ্ছিল। সমুদ্রে নিম্নচাপের কারণে সাইক্লোনের সৃষ্টি হওয়ায় আবহাওয়া দুর্যোগপূর্ণ। প্রচারমাধ্যমগুলােয় সরকারিভাবে ১০ নম্বর মহা বিপৎ সংকেতের ঘােষণা দেওয়া হয়। বিশেষ করে রাতের বেলায় ছিল। কনকনে শীত ও গাঢ় অন্ধকার। এমনি পরিস্থিতিতে সার্জেন্ট মহিউল আলমের নেতৃত্বে এ আশ্রয় কেন্দ্র থেকে একই সাথে ৩টি রাজাকার ক্যাম্পে অপারেশন। পরিচালনা করা হয়। পাকিস্তানি সেনারা ঐ সময় মেরিন একাডেমিতে ক্যাম্প স্থাপন করায় এবং শান্তি কমিটির সভাপতি জালাল চৌধুরীর বাড়ি রায়পুরে হওয়ায় কর্ণফুলি নদীর সমগ্র পূর্ব এলাকা ছিল পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের দখলে। ফলে এ এলাকায় পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের তৎপরতার মাত্রা ছিল তুলনামূলকভাবে খুবই বেশি। তাই নৌকমান্ডােদের পক্ষে চট্টগ্রাম বন্দরে আগত দেশি-বিদেশি জাহাজে অপারেশন চালানাে ছিল খুবই কঠিন ব্যাপার! এমনই পরিস্থিতিতে নৌকমান্ডােরা যাতে বন্দর এলাকায় আগত দেশি-বিদেশি পণ্যবাহী ও অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহকারী জাহাজগুলােয় নিরাপদ অপারেশন চালাতে পারে, সে জন্য ১ নম্বর সেক্টর সদর থেকে তৈলারদ্বীপে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধাদের দায়িত্ব দেওয়া হয় যে, যেকোনােরকমেই হােক কর্ণফুলি নদীর উপকূলীয় এলাকায় পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের তৎপরতা বন্ধ করতে হবে। এমন নির্দেশ পেয়ে মুক্তিযােদ্ধারা ফ্লাইট সার্জেন্ট মহিউল আলমের নেতৃত্বে জালাল চৌধুরীর বাড়ির সম্মুখে কমিউনিটি সেন্টারে, জৈদ্দার হাটে দুদু মিয়ার বাড়িতে এবং বারসত ইউনিয়নের অন্তর্গত গােবাদিয়া গ্রামের শান্তি কমিটির সহসভাপতি গনি চৌধুরীর বাড়িতে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্পগুলােয় একসাথে অপারেশন করার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ক্যাম্পগুলাে অপারেশন করার উদ্দেশ্য ছিল রাজাকারদের হতাহত করে ঐ এলাকায় পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসর রাজাকারদের মনােবল দুর্বল করা এবং পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকারদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করে তাদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তােলা এবং নৌকমান্ডােদের অপারেশন চালাতে সুযােগ সৃষ্টি করে দেওয়া।
 
পর্যবেক্ষণ
মুক্তিযােদ্ধা আবদুল মােতালেবের বাড়ি ছিল বারসত ইউনিয়নের গােন্দী গ্রামে। ঐ এলাকা সম্পর্কে তার ভালাে ধারণা ছিল। তাই তাঁকে ঐ এলাকায় স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্পগুলাে পর্যবেক্ষণ করার জন্য পাঠানাে হয়। তিনি সার্জেন্ট মহিউল আলমের নির্দেশে রাজাকার ক্যাম্পগুলাে পর্যবেক্ষণ করার উদ্দেশ্যে ছদ্মবেশে খুব সকালে রওনা হন। পরে তিনি রাজাকার ক্যাম্পগুলাের অবস্থান, রাজাকারদের। কার্যকলাপ, তাদের অভ্যাস প্রভৃতি পর্যবেক্ষণ শেষে সন্ধ্যায় ক্যাম্পে এসে বিস্তারিত রিপাের্ট প্রদান করেন।
 
অপারেশন
পর্যবেক্ষিত তথ্যের ভিত্তিতে অধিনায়ক সার্জেন্ট মহিউল আলম ঐ দিনই আনুমানিক ৫০জন মুক্তিযােদ্ধাকে নিয়ে রাত ১০টার দিকে রাজাকার ক্যাম্পগুলােয় অপারেশনের জন্য রওনা হন। তারা তৈলারদ্বীপ ক্যাম্প হতে রওনা হয়ে জিওরী, হাজীগাঁও ও বটতলী গ্রাম হয়ে বারসত গ্রামের ফোরা মহাজনের বাড়িতে (হিন্দু বাড়ি) অবস্থান নেন। এ বাড়ির ঘরগুলাের মধ্যে প্রধান ঘরটি ছিল মাটির তৈরি দেয়ালে টিনের চালাবিশিষ্ট দোতলা। মুক্তিযােদ্ধারা আনুমানিক রাত ১২টায় সেখানে পৌছেন। আগে থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের গ্রুপগুলাের মধ্যে সমন্বয় করা হয়েছিল এ মর্মে যে, পটিয়া থেকে শাহজাহান ইসলামাবাদী ও মধুসূদন নাথের গ্রুপের মুক্তিযােদ্ধারাও এখানে এসে তাঁদের সাথে মিলিত হয়ে অপারেশনে যাবেন। আকাশ দুর্যোগপূর্ণ থাকায় নির্ধারিত সময়ের পরে তাদের গ্রুপগুলাে আনুমানিক রাত ৪টায় আসে এবং আসার সাথে সাথে সবাই সার্জেন্ট মহিউল আলমের নির্দেশে সারিবদ্ধ হন। তারপর অপারেশন স্থান ৩টির জন্য সকল মুক্তিযােদ্ধাকে ৩টি গ্রুপে বিভক্ত করা হয়।
তবে গ্রুপ করার সময় লক্ষ্য রাখা হয় যে, যাদের বাড়ি অপারেশন স্থানের কাছাকাছি এবং অপারেশন স্থান সম্পর্কে ভালাে জানা আছে, তাদেরকেই সেই স্থানের অপারেশন গ্রুপে রাখা হয়। হাবিলদার মদন আলীর নেতৃত্বে ১টি গ্রুপ জৈদ্দার হাটে, অধিনায়ক মধুসূদন নাথের নেতৃত্বে ১টি গ্রুপ গনি চৌধুরীর বাড়িতে এবং সার্জেন্ট মহিউল আলমের নেতৃত্বে ১টি গ্রুপ জালাল চৌধুরীর বাড়ির সম্মুখে কমিউনিটি সেন্টারে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্পে অপারেশন করার জন্য আনুমানিক রাত সাড়ে ৪টায় রওনা দেন। হাবিলদার মদন আলীর গ্রুপ জৈদ্দার হাট রাজাকার ক্যাম্পে পৌছেন আনুমানিক ভাের পৌনে ৫টায়। সেখানে পৌছে তারা দেখতে পান যে, ক্যাম্পে কোনাে রাজাকার নেই। ঐ রাতে আবহাওয়া খুবই খারাপ (১০ নম্বর বিপৎসংকেত) এবং মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ায় রাজাকাররা ক্যাম্পে না থেকে তাদের নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান করে। কাজেই রাজাকারদের না পেয়ে তারা সুরমা পুকুরের পাড়ে গ্রুপগুলাের মিলন স্থানে চলে যান। ওখানে গিয়ে তারা একটি দোকান থেকে মুড়ি খান এবং অপর ২টি গ্রুপের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।

তখন সময় সকাল ৭টা এবং মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। ঐ সময় মুক্তিযােদ্ধা রুস্তম আলী দেখতে পান যে, কালীবাড়ির দিক থেকে অর্থাৎ উত্তর দিক থেকে রাস্তা ধরে সুরমা পুকুর পাড়ের দিকে কেউ আসছে। রুস্তম আলী ভেবেছিলেন যে, হয়তাে লােকগুলাে তাদেরই অন্য গ্রুপের সহযােদ্ধা। তাই তিনি তাদেরকে স্বাগত জানানাের জন্য সামনের। দিকে এগিয়ে যান। তিনি নিজ সিদ্ধান্তে হঠাৎ করে সম্মুখে এগিয়ে গিয়েছিলেন। এগিয়ে আসা সেই লােকগুলাে ছিল রাজাকার। তারা রুস্তম আলীকে গুলি করে হত্যা করে এবং তাঁর ব্যক্তিগত ৩০৩ রাইফেল ছিনিয়ে নেয়। তাকে গুলি করার আওয়াজ শুনে সুরমা পুকুর পাড়ের অন্য মুক্তিযােদ্ধারাও পালটা ফায়ার করতে থাকেন। পরে রাজাকাররা ওখান থেকে দূরে চলে যায়। মুক্তিযােদ্ধারা রুস্তমের লাশ পানি থেকে তােলেন। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া এবং রাজাকারদের ভয়ে মুক্তিযােদ্ধারা রুস্তমের লাশ স্থানীয় এক দোকানদারের হেফাজতে রেখে নির্দেশ দেন যে, অন্য মুক্তিযােদ্ধা দল এলে তাদের মাধ্যমে যেন লাশ পুকুর পাড়ে দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। তারপর তারা রুস্তমহাট হয়ে তৈলারদ্বীপ ক্যাম্পে চলে যান। পরে রাজাকাররা রুস্তম আলীর লাশ সেখান থেকে তুলে রশি দিয়ে বেঁধে মেরিন একাডেমিতে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে নিয়ে আবার ফেরত নিয়ে আসে।
অন্যদিকে, গনি চৌধুরীর বাড়িতে রাজাকারদের ক্যাম্প অপারেশনে যাওয়া মুক্তিযােদ্ধাদের গ্রুপটি ভাের ৫টায় বাড়ি ঘেরাও করে ফায়ার করেছিল। কিন্তু ফায়ার করা সত্ত্বেও প্রথম দিকে কেউ বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে নি। পরে মুক্তিযােদ্ধারা ফায়ার বন্ধ করে দিলে রাজাকাররা মনে করেছিল যে মুক্তিযােদ্ধারা চলে গেছেন। তাই তারা ক্যাম্প থেকে বের হয়ে আসে। তখন আবার মুক্তিযােদ্ধারা ফায়ার করলে ১জন রাজাকার নিহত হয় এবং বাকি রাজাকাররা অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। পরে গনি চৌধুরীর মেয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের জানান যে, রাজাকারদের অস্ত্রশস্ত্র তাদের বাড়িতে আছে। তারা ফায়ার না করে বাড়ি থেকে অস্ত্রগুলাে যেন নিয়ে যান। মুক্তিযােদ্ধারা সেখান থেকে ৫টি .৩০৩ রাইফেল উদ্ধার করেন। তারপর এ গ্রুপ দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য তৈলারদ্বীপে নিজেদের ক্যাম্পে চলে যায়। অন্যদিকে, সার্জেন্ট মহিউল আলমের গ্রুপটি জালাল চৌধুরীর  বাড়িতে কোনাে রাজাকার না পেয়ে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য সুরমা পুকুর পাড়ে গিয়ে তৈলারদ্বীপে চলে যায়। পরবর্তী সময় গ্রুপগুলাে একত্র হলে রুস্তম আলীর মৃত্যুর ঘটনা শুনে লাশ দাফন করার জন্য যাবতীয় খরচের টাকা মুক্তিযােদ্ধা আবদুল মােতালেবকে দিয়ে সুরমা পুকুর পাড়ে পাঠান। আবুদল মােতালেব সে দায়িত্ব সুসম্পন্ন করেন।
ক্ষয়ক্ষতি ও সাফল্য
রাজাকারদের গুলিতে মুক্তিযােদ্ধা রুস্তম আলী শহিদ হন এবং ১জন রাজাকারও মুক্তিযােদ্ধাদের গুলিতে নিহত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা রাজাকারদের ৫টি .৩০৩ রাইফেল হস্তগত করেন।
বিশ্লেষণ
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য ১০ নম্বর বিপৎসংকেত থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযােদ্ধাদের অপারেশনে যাওয়া সঠিক ও সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত হয় নি। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের অপারেশন করার মতাে মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। উপরন্তু আবেগের বশবর্তী হয়ে নিজেদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে অপারেশনে যাওয়া যে সঠিক ছিল না, তা অস্ত্রসহ রুস্তম আলীকে হারানাের মাধ্যমেই প্রমাণিত। তা ছাড়া অপারেশনের পর গ্রুপ তিনটি সুরমা পুকুর পাড়ে মিলিত হওয়ার কথা থাকলেও কোনাে গ্রুপই সেখানে না গিয়ে তৈলারদ্বীপে চলে যায়। এটা ছিল সামরিক নিয়মনীতির এবং রণকৌশলের পরিপন্থী। তাই প্রচুর মুক্তিযােদ্ধা একত্র করে সমন্বয়ে দক্ষতা প্রদর্শিত হলেও ঈপ্সিত ফললাভ করতে পারেন নি। অর্জিত হয় নি সেক্টর নির্দেশিত প্রত্যাশাও। তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা আবদুল মােতালেব, আনােয়ারা।

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!