ধলঘাট রেলস্টেশন অপারেশন
প্রেক্ষাপট
যে-কোনাে যুদ্ধের সময় যােগাযােগ ব্যবস্থা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচল বাধাগ্রস্ত করার জন্য অথবা তাদেরকে বিপর্যস্ত করার কৌশল হিসেবে যােগাযােগের বিভিন্ন মাধ্যমের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করেছিলেন। ধলঘাট রেল স্টেশনে ট্রেন আক্রমণ এ রকমই একটি গেরিলা অপারেশন।
উদ্দেশ্য
ট্রেন আক্রমণ করে যােগাযােগ বিপর্যস্ত করা, সিকিউরিটি ফোর্সের কাছে থেকে যথাসম্ভব অস্ত্র দখল করা এবং পাকিস্তানি সেনাদের মনােবলে আঘাত হানা ছিল এ অপারেশনের মূল উদ্দেশ্য।
পর্যবেক্ষণ
স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধারা প্রতিদিন লক্ষ্য করতেন, হাটহাজারী-দোহাজারি লাইনে চলাচলকারী ট্রেনে নিয়ােজিত নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে উল্লেখযােগ্য সংখ্যক অস্ত্র থাকত। তারা ঐ লাইনে চলাচল করে এমন সব ট্রেনের সার্বিক দিক পর্যবেক্ষণ করেন। বিশেষ করে, ট্রেনের সময়সূচি, গতি, প্রকার, ধলঘাট স্টেশনে স্টপেজের বৃত্তান্ত ইত্যাদি।
পরিকল্পনা
পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে গেরিলা মুক্তিযােদ্ধারা ধলঘাট রেল স্টেশনে ট্রেনে আক্রমণ পরিচালনা করার পরিকল্পনা করেন। ২৮ সেপটেম্বর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিদ্ধান্ত মােতাবেক ২০জনের ১টি দল ৩ ভাগে বিভক্ত হয়ে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে। প্রথম ২ দলে ৫জন করে রেল স্টেশনের উত্তর ও দক্ষিণ পাশে অবস্থান নেবেন এবং ১০জনের ১টি দল পূর্ব পাশের ধানক্ষেতে রেললাইন বরাবর অবস্থান নেবে বলে ঠিক হয়। আরও ঠিক হয়, আক্রমণকারী দলের অধিনায়ক ক্যাপটেন করিমের নেতৃত্বে প্রথম ২ দলের অগ্রগামী দল রেল স্টেশনের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করবে। দ্বিতীয় দল ট্রেন আক্রমণ করে নিরাপত্তা প্রহরীদের নিরস্ত্র করে তাদের অস্ত্র হস্তগত করবে। তৃতীয় দল কভারিং দল হিসেবে বাইরের আক্রমণ প্রতিহত করবে।
অপারেশন
পরিকল্পনা মাফিক তিনটি দল ২৮ সেপটেম্বর নির্ধারিত সময়ের বেশ কিছু আগে তাদের স্ব স্ব অবস্থান গ্রহণ করে। অবস্থান নেয়ার পর তারা ট্রেন আসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। নৈমিত্তিক সূচি অনুসারে ট্রেনটি স্টেশনে এসে থামা মাত্রই। স্টেশনের পিছনে উত্তর দক্ষিণে অবস্থানরত ২টি গেরিলা দল গুলি বর্ষণ শুরু করে। গুলি বর্ষণ করতে করতে তারা ট্রেনের দিকে এগিয়ে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে তারা। ট্রেনের নিরাপত্তা বাহিনীর ৯জন সদস্যকে নিরস্ত্র করে বন্দি করে। এরা সবাই বাঙালি রাজাকার। এদের কাছ থেকে গুলিসহ ৯টি .৩০৩ রাইফেল উদ্ধার করা হয়। বন্দিদের মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। ক্যাম্পে তাদের যথাযথ খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তাদের মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও এ পর্যায়ে বন্দি রাজাকার সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেওয়ার জন্য তাদের প্রত্যয় ব্যক্ত করলে তাদেরকে দল নেতার নির্দেশে প্রশিক্ষণের জন্য পার্শ্ববর্তী দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
বিশ্লেষণ
এটি একটি সফল গেরিলা অপারেশন। কেননা, এটি ছিল একটি সুপরিকল্পিত ও বাস্তবায়িত তা ছাড়া এ অপারেশনের উদ্দেশ্যও অর্জিত হয়েছিল। এতে অস্ত্রসহ শত্রুদের বন্দি করার পাশাপাশি তাদেরকে পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষ ত্যাগ করানাে এবং এর মাধ্যমে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের প্রত্যয়ে চিড় ধরানাে গিয়েছিল ।
তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: প্রদ্যুৎ কুমার পাল। সম্পাদকের টীকা: এ গ্রন্থের একাদশ অধ্যায়ে সন্নিবেশিত ৩২৬ নম্বর দলিলে এ অপারেশনের দল নেতা ক্যাপটেন করিমের পত্রে ধলঘাট রেল স্টেশনে আক্রমণের তারিখ ও সময় হিসেবে যথাক্রমে ২৭ সেপটেম্বর ও ভাের ৫টা পাওয়া যায়। তিনি টার্গেটকে মিলিটারি টহল ট্রেন এবং এতে রাজাকার অধিনায়কসহ ২৫জন শক্রর মৃত্যু হয়েছে বলে। উল্লেখ করেছেন। (ধলঘাট রেলস্টেশন অপারেশনের নকশাটি ১১৩৯ পাতায়)
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড