কোতােয়ালি থানার সামনের ট্রান্সফর্মার বিস্ফোরণ
প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য
ডিসেম্বরের প্রথম দিকে চট্টগ্রাম শহরের কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ায় মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল খানিকটা ভেঙে পড়ে। এ অবস্থায় মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল চাঙ্গা করা অত্যাবশ্যকীয় ও জরুরি হয়ে পড়ে। সেই সাথে মুক্তিযােদ্ধারা নিজেদের উপস্থিতি ও শক্তির প্রকাশ ঘটিয়ে চট্টগ্রামে ত্রাস সৃষ্টি করে শত্রুর মনােবলও ভেঙে দিতে চান। অবশ্য তখন মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর উপর্যুপরি আক্রমণে শত্রুরা শক্তি ও মনােবলের দিক থেকে ভীষণ রকম বিপর্যস্ত।
পরিকল্পনা
ডা, মাহফুজ, ইঞ্জিনিয়ার হারুন ও নুরুল আলম মন্টু সেক্টর সদর দপ্তরের নির্দেশে মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিকল্পনা করেন যে, চট্টগ্রামের মুক্তিযােদ্ধারা ছােটো ছােটো গ্রুপে ভাগ হয়ে একটি নির্দিষ্ট দিনে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে সব গ্রুপ একযােগে ফাঁকা গুলি বর্ষণ শুরু করবেন। আর সুযােগ পেলে দুই-একটি ছােটোখাটো অপারেশন করবেন। এ লক্ষ্যে তারা কতকগুলাে টার্গেট পূর্ব থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন। মুক্তিযােদ্ধাদের এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কোতােয়ালি থানার সামনের ট্রান্সফর্মারটি ছিল একটি টার্গেট।
পর্যবেক্ষণ
কোতােয়ালি থানার সামনের ট্রান্সফর্মারটির অবস্থানসহ অন্যান্য তথ্যাদি জোগাড় করার জন্য নুরুল আলম মন্টু বেশ কয়েকবার ঐ এলাকা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করেন এবং বিস্তারিত তথ্য জোগাড় করে তার ভিত্তিতে ট্রান্সফর্মার অপারেশনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
অপারেশন
পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবে অপারেশনের দিন কোতােয়ালি থানার সামনের অবস্থান থেকে গুলি বর্ষণ ও পার্শ্ববর্তী ট্রান্সফর্মারটির ওপর অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয় মুক্তিযােদ্ধা নুরউদ্দিনকে। অপারেশনের দিন নুরউদ্দিনের নেতৃত্বে অন্য আরও ৩জন মুক্তিযােদ্ধা ফিরিঙ্গিবাজার এলাকার ক্যাথলিক চার্চের বেইজ থেকে মধ্যরাতে অপারেশন স্থলের দিকে যাত্রা শুরু করেন। অল্পক্ষণ পরেই তারা ঐ স্থানে পৌছে অবস্থান নেন। তারপর পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী থানাটির চারদিকে অবস্থান নিয়ে প্রচণ্ডভাবে গুলি ছুড়তে শুরু করেন। হঠাৎ করে শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্যাপক গুলি বর্ষণ হতে থাকলে কোতােয়ালি থানার সামনের পাহারারত প্রহরীরা (আলবদর ও রাজাকার) ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। এ সুযােগে। নুরুউদ্দিন আর ১জন সহযােদ্ধার সহযােগিতায় দ্রুত বৈদ্যুতিক পাইলনটিতে বিস্ফোরক লাগিয়ে অগ্নিসংযােগ করেন। ২-৩ মিনিট পর বিকট শব্দে ট্রান্সফর্মারটি বিস্ফোরিত হয়। তারপর মুক্তিযােদ্ধারা ত্বরিত গতিতে নিরাপদে চার্চে ফিরে আসেন।
বিশ্লেষণ
এ অপারেশনে একই দিনে শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে একযােগে যে গুলি শুরু হয়, তা পাকিস্তানি সেনা ও সহযােগীদের মনে ভীতির সৃষ্টি করে। আদর্শিক দুর্বলতা ও সাহসের অভাবে তারা মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য এক ধরনের সুযােগ সৃষ্টি করে দিলে মুক্তিযােদ্ধারা সেই সুযােগকে যথাযথ কাজে লাগিয়ে কোতােয়ালি থানার সামনের ট্রান্সফর্মারটির ওপর অপারেশন চালিয়ে তাদের পূর্বপরিকল্পিত লক্ষ্য। অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন।
তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা নুরুল আলম মন্টু। সম্পাদকের টীকা: সাক্ষাৎকার ছাড়া এ অপারেশন সম্পর্কিত ডা. মাহফুজুর রহমান রচিত ‘বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বইয়ের ৩৬৫ পৃষ্ঠায় প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী। কোতােয়ালি থানার সংলগ্ন ট্রান্সফর্মারটি ধ্বংস করেন সাব্বির, রফিক, এয়াকুব ও টুনু।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড