You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.05 | পাকিস্তান শিপিং কোম্পানি অফিস সংলগ্ন বিদ্যুৎ সাব-স্টেশনে অপারেশন - সংগ্রামের নোটবুক

পাকিস্তান শিপিং কোম্পানি অফিস সংলগ্ন বিদ্যুৎ সাব-স্টেশনে অপারেশন

প্রেক্ষাপট
১৯৭১ সালের ৫ আগস্ট পাকিস্তান শিপিং কোম্পানির আগ্রাবাদ অফিসে (বর্তমানে বাংলাদেশ শিপিং করপােরেশন) ঐ কোম্পানি ও পাকিস্তান নৌবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। এ তথ্য বিশ্বস্তসূত্রে মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে পৌছায়। এ সভায় এক দল জাপানি প্রতিনিধি উপস্থিত থাকারও কথা ছিল। সভার উদ্দেশ্য ছিল, নৌবাণিজ্য সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করা। এ সভাকে জমজমাট ও আকর্ষণীয় করার জন্য আগ্রাবাদের পামভিউ ভবন থেকে শিপিং করপােরেশন অফিস পর্যন্ত সাজানাে হয়।
পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণ
কেসি-৩ দলের অধিনায়ক ডা. মাহফুজুর রহমান অপারেশনের পরিকল্পনা করেন। প্রাথমিক অবস্থায় তিনি শিপিং কোম্পানির সার্বিক অবস্থান সম্পর্কে তথ্যসংগ্রহ করেন। অন্য মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে পরামর্শ করে সভাস্থলে অপারেশন করা সমীচীন। হবে না বলে তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কারণ, তাতে প্রচুর প্রাণহানি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তা ছাড়া সভাস্থলের পূর্ণ নিরাপত্তাব্যবস্থা অতিক্রম করে আক্রমণ পরিচালনা করতে যে জনবল ও অস্ত্র দরকার হবে, তা মুক্তিযােদ্ধাদের ছিল না। এর বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে শিপিং কোম্পানি অফিস সংলগ্ন বিদ্যুৎ সাব-স্টেশনে অপারেশন চালানাের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এতে কোনাে নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটবে না। বরং বিদেশিদের সামনে পাকিস্তানি সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে। সর্বোপরি, এ দেশে যে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছে এবং সুরক্ষিত শহরেও তার ব্যতিক্রম নেই, তা প্রমাণিত হবে। মুক্তিযােদ্ধা গরিবুল্লাহ ট্রান্সফর্মারের অবস্থানে গিয়ে বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ করেন। পর্যবেক্ষণ করার সময় তিনি লক্ষ্য করেন, সাবস্টেশনে ২জ’ প্রহরী থাকে। সমাবেশ স্থল থেকে সাব-স্টেশন দৃষ্টিগােচর হয় না। তারপর অপারেশনের তারিখ ও সময় স্থির করা হয় ৫ আগস্ট সকাল ১০টায় ।
অপারেশন

নির্দিষ্ট দিনে অপারেশন গ্রুপ ট্যাক্সিতে করে মােগলটুলির গােপন আস্তানা হতে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এ দলে ছিলেন মুক্তিযােদ্ধা ফয়জুর রহমান, গরিবুল্লাহ, মাে. শফি, তােফাজ্জল হােসেন প্রমুখ। অপারেশনকালীন ব্যবহারের জন্য জুতার প্যাকেটে করে বিস্ফোরক বহন করা হয়; যাতে পথিমধ্যে তল্লাশি করা হলেও কোনাে অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত না হয়। বিদ্যুৎ সাব-স্টেশনের পাশে এসে তারা দেখতে পান, এক দল পাকিস্তানি সৈন্য আশপাশের এলাকায় টহল দিচ্ছে। মূলত সভাকে কেন্দ্র করেই বিদ্যুৎ সাব-স্টেশনের আশপাশে সৈন্য মােতায়েন করা হয়েছিল। রেকি করার সময় তা না জানায় পরিকল্পনাকালীন এ বিষয়ে ভাবা হয় নি। তাই এ অবস্থার জন্য তাঁরা মােটেও প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মুক্তিযােদ্ধারা অপারেশন না করে ফেরত যাবেন না এ সংকল্পে উজ্জীবিত। একপর্যায়ে টহলরত সৈন্যদের চোখ ফাকি দিয়ে তারা বিদ্যুৎ সাবস্টেশনে প্রবেশ করেন। অতি দ্রুত ও নিঃশব্দে তাঁরা সাব-স্টেশনে ১জন বাঙালি এবং ১জন পাকিস্তানি গাউকে আটক করে গার্ড রুমে আবদ্ধ করে রাখেন। যাতে কোনাে শব্দ কিংবা চিৎকার করতে না পারে, সে জন্য ২জন গেরিলা তাদের প্রহরায় নিয়ােজিত থাকেন। দলের অবশিষ্ট সদস্যরা দক্ষতার সাথে দ্রুত সাব-স্টেশনে বিস্ফোরক স্থাপন করেন। বিস্ফোরক স্থাপনের পর কর্ডে আগুন দিয়ে অপারেশন দল স্থান ত্যাগ করে মগপাড়াস্থ গােপন আস্তানায় চলে যান। যথাসময়ে বিস্ফোরণ। ঘটে।প্রতিক্রিয়া

সাব-স্টেশনে বিস্ফোরণের ফলে শিপিং করপােরেশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং ভয়ে এদিক-ওদিক ছােটাছুটি করতে থাকে। এতে শিপিং করপােরেশনের অফিসে নৌবাণিজ্য সংক্রান্ত সভা পণ্ড হয়ে যায়। বিদ্যুৎ সাব-স্টেশনের ভবনের কাচ ভেঙে টুকরাে টুকরাে হয়ে যায়। জাপানি প্রতিনিধিদল পাকিস্তানের যুদ্ধাবস্থার চিত্র এবং মুক্তিযােদ্ধাদের সাহসী তৎপরতা উপলব্ধি করেন।

বিশ্লেষণ

পরিকল্পনায় বিদ্যুৎ সাব-স্টেশনের কাছে সভাকালীন পাকিস্তানি সৈন্যের টহল মােকাবিলার নির্দেশনা না থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযােদ্ধারা তাতে হতােদ্যম হন নি। এতে তাদের দৃঢ় মনােবল ও উদ্দেশ্য সাধনে স্থিরসংকল্পের পরিচয় পাওয়া যায়। এজন্যই তারা আকস্মিক উদ্ভূত পরিস্থিতি সত্ত্বেও লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়েছিলেন। তা ছাড়া এ রকম গুরুত্বপূর্ণ একটি সভা পণ্ড করে বিশ্ববাসীর কাছেও এ দেশের যুদ্ধচিত্র তুলে ধরতে সক্ষম হন।

তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা গরিবুল্লাহ। (পাকিস্তান শিপিং কোম্পানি অফিস সংলগ্ন বিদ্যুৎ সাব-স্টেশনে অপারেশনের নকশাটি ১১৩৮ পাতায়)

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড