You dont have javascript enabled! Please enable it! অপারেশন আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংক - সংগ্রামের নোটবুক
অপারেশন আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংক
 
প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য আগস্টের দিকে শহরে মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু গেরিলা অপারেশন পরিচালনায় বেশ কিছু সমস্যা প্রায়ই তাদের কর্মকাণ্ডকে সীমিত করে দিত। তারমধ্যে অন্যতম আর্থিক সমস্যা। সেই পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযােদ্ধা নেতারা ব্যাংকে অপারেশন করে প্রয়ােজনীয় অর্থসংগ্রহের চিন্তা পােষণ করেন। প্রাথমিকভাবে আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংকটিকে অপারেশনের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। অর্থসগ্রহের প্রচেষ্টার পাশাপাশি বিদেশিদের দৃষ্টি মুক্তিযুদ্ধের দিকে আকর্ষিত করার উদ্দেশ্যও এতে ছিল। বিশেষ করে, আমেরিকার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশের বিষয়ও এ অপারেশনের উদ্দেশ্যের মধ্যে ছিল, বলেছেন মুক্তিযােদ্ধা এনামুল হক দানু। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন এবং সাহায্য করে। সুতরাং মার্কিন স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠানে গেরিলা অপারেশন করার পরিকল্পনা গৃহীত হয়। এ অপারেশন পরিকল্পনায় সম্পৃক্ত ছিলেন কেসি-১-এর অধিনায়ক আবদুল্লাহ-আল-হারুন, কেসি-২-এর অধিনায়ক দলনেতাসহ জালালউদ্দীন আহমেদ।
 
অবস্থান
আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার কেন্দ্রস্থলে কমার্স কলেজের এবং সিজিও বিল্ডিংয়ের মাঝামাঝি ছিল আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংকের অবস্থান। এর দক্ষিণ পাশে ছিল বড়াে একটি ডােবা। অনেক সড়ক উত্তর দিক হতে ব্যাংকের সামনের রাস্তার সাথে মিলিত হয়েছে। বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে এটা ছিল স্পর্শকাতর। তাই এর আশপাশেই পাকিস্তানি সেনাদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়।
 
পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণ ওসমান কোর্টের হােন্ডা প্যালেস আগ্রাবাদ এলাকার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত ছিল। প্রতিদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনী এর পাশ দিয়ে যাতায়াত করে। মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র, গােলাবারুদ এ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানেই রাখা হতাে। একটি চালু বাণিজ্যিক কেন্দ্র বলে এটিকে মুক্তিযােদ্ধাদের ঘাঁটি হিসেবে কেউ তখন পর্যন্ত সন্দেহ করে উঠতে পারে নি। এখান থেকে অপারেশনসংক্রান্ত প্রয়ােজনীয় তথ্যসংগ্রহ করা হয়। আবদুল্লাহ-আল-হারুন ছদ্মবেশে আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ। করেন। রেকি করার সময় ব্যাংকের ভিতরের অবস্থান, কর্মচারীদের গতিবিধি, নিরাপত্তা প্রহরীদের সংখ্যা ও অবস্থান, ক্যাশ কাউন্টার, প্রবেশ এবং প্রস্থানের পথ দেখে নেয়া হয়। নিমলিখিত বিষয়গুলাের ওপর ভিত্তি করে অপারেশন পরিকল্পনা করা হয়:

ক, অস্ত্রের ধরন ও সংখ্যা। খ, অপারেশন সাফল্যের জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের সঠিক সংখ্যা। গ. নির্বাচিত মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন। ঘ, অপারেশন সমাপ্তিতে নিরাপদ প্রত্যাবর্তন। ঙ. অপারেশনের পূর্বে বা যে-কোনাে সময় সামান্যতম বিপদের সম্ভাবনায় তা বাতিলের পদ্ধতি। চ. সার্বিক আলােচনার পর অপারেশনের সময় নির্ধারিত হয়, অফিস শুরুর আধ ঘণ্টার মধ্যে অর্থাৎ সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে। সে অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট সবার ঘড়ির সময় মিলিয়ে নেয়া হয়।
অপারেশন
নির্দিষ্ট দিনে সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটের দিকে অপারেশনের জন্য নির্বাচিত গ্রুপ ২টি দলে বিভক্ত হয়ে ট্যাক্সিতে করে ব্যাংকে এসে পৌছায়। প্রয়ােজনীয় অস্ত্র ও গােলাবারুদ আলাদাভাবে অন্য ১টি ট্যাক্সিতে এলে তাৎক্ষণিকভাবে বিতরণ করা হয়। সবাই ব্যাংকের সামনে উপস্থিত সাধারণ জনতার মাঝে মিশে যান। আবদুল্লাহ-আল-হারুন ইতােমধ্যে ব্যাংকে আগমনকারী একজন গ্রাহকের গাড়ি হাইজ্যাক করে এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। তাৎক্ষণিক প্রয়ােজনে কিংবা অপারেশন। শেষে দ্রুত সরে পড়ার জন্য ট্যাক্সি ২টি নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেয়। অপারেশন শুরু করার সংকেত পাওয়া মাত্র অপারেশনের ১টি গ্রুপ দারােয়ানকে কাবু করে ফেলে এবং ভিতরে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অস্ত্রের মুখে বসিয়ে রাখে। ফজলুল হক ক্যাশ থেকে ২টি বাক্স নিয়ে দ্রুত চলে আসেন। তবে উত্তেজনার মুখে ব্যাংকের অভ্যন্তরে টাকা রাখার ভল্ট খুঁজে দেখার কথা কারাে মনে পড়ে নি। তাই মাত্র ১৭,০০০.০০ টাকা তাদের হস্তগত হয়। পরে ব্যাংকের স্টেটমেন্টে ৩৫,০০০.০০ টাকা খােয়া যাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। আশপাশে কেউ কিছু বােঝার আগেই অপারেশনের কাজ শেষ হয়। এ অপারেশনে অংশ নেন আবদুল্লাহ-আল-হারুন, ফজলুল হক, এনামুল হক দানু, সফিউল হক বশর, আজিজ, মনিসহ মােট ৭জন।
প্রতিক্রিয়া
পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত বাণিজ্যিক কেন্দ্রে একটি আন্তর্জাতিক ব্যাংকে প্রকাশ্য দিবালােকে এ ধরনের অপারেশন প্রশাসনকে ব্ৰিত ও উদৃবিগ্ন করে তােলে। অন্যদিকে, মুক্তিযােদ্ধাদের আরও দৃঢ় মনােবল নিয়ে অভিযান পরিচালনায় উৎসাহিত করে। প্রাপ্ত টাকা দিয়ে ২টি ট্যাক্সি ক্রয় করে ২জন মুক্তিযােদ্ধাকে দেওয়া হয়, যাতে কোনাে অপারেশনে প্রয়ােজনে ব্যবহার করা যায়। এঁরাই আগে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য ভাড়া করে ট্যাক্সি নিয়ে আসতেন স্বাধীনতার পরও তারা এগুলাে চালাতেন।
তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা আবদুল্লাহ-আল-হারুন, মুক্তিযােদ্ধা ফজলুল হক, মুক্তিযােদ্ধা এনামুল হক দানু। (অপারেশন আমেরিকা এক্সপ্রেস ব্যাংকের নকশাটি ১১৩৩ পাতায়)

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড