You dont have javascript enabled! Please enable it!
নিউ মার্কেটের মােড়ে তাৎক্ষণিক অপারেশন
প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য
মুক্তিযােদ্ধারা পুরাে চট্টগ্রাম শহরে তৎপরতা অব্যাহত রাখেন। সে জন্য সময় বিশেষে পরিকল্পিত অপারেশনে ব্যর্থ হলেও তাতে হতাশ না হয়ে এবং পূর্বাপর না ভেবে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে অপারেশন করা হতাে বিপজ্জনক হলেও স্বাধীনতা মন্ত্রে উদ্দীপ্ত মুক্তিযােদ্ধারা তা থেকে পিছপা হতেন না। এমনি একটি অপারেশন হলাে। নিউ মার্কেটের মােড়ে পুলিশ সার্জেন্ট হত্যা। প্রকৃতপক্ষে এদিন ভিন্ন একটি অপারেশনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। দৈনন্দিন ব্যয়, অস্ত্র ও গােলাবারুদ সংগ্রহ এবং লজিস্টিক সাপাের্ট’ (যুদ্ধকালীন রসদ ভাণ্ডার) বাবদ প্রচুর অর্থের প্রয়ােজন হয়, কিন্তু সেক্টর সদর দপ্তর থেকে সরবরাহের পরিমাণ প্রয়ােজনের তুলনায় নগণ্য এ রকম অবস্থায় মুক্তিযােদ্ধারা কাস্টমস্ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বহনকারী পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়ির ওপর হামলা করার সিদ্ধান্ত নেন উদ্দেশ্য, মুক্তিবাহিনীর জন্য অর্থসংগ্রহ।
পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণ
কাস্টমস্ অফিসে চাকরি করে এমন একজন বাঙালি কর্মচারী মারফত খবর পাওয়া। যায় যে, ১ নভেম্বর কর্মচারীদের বেতন দেওয়া হবে। সে বেতন তােলা হবে। কোতােয়ালির মােড়ে অবস্থিত তত্ত্বালীন স্টেট ব্যাংক অব ইস্ট পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক) থেকে। সাের্স থেকে আরও জানা যায়, কাস্টমসের একটি গাড়িতে করে কোতােয়ালির মােড় হয়ে নিউ মার্কেটের পাশ দিয়ে স্টেশন। রােড হয়ে গাড়িটি টাকা নিয়ে ফেরত যাবে। সেই তথ্য মােতাবেক কেসি-১ দল নেতা মাহবুব ও মুক্তিযােদ্ধা অমল মিত্র, সফিউল বশর, রফিক (শহিদ) ও ফজলুল হক এ হামলার পরিকল্পনা করেন। এ রাস্তা এবং এলাকা পূর্বপরিচিত বিধায় রেকির প্রয়ােজন হয় নি।
অপারেশন
নূর মােহাম্মদ মিন্টু বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংকের পুরােনাে বিল্ডিংয়ের (তখনকার স্টেট ব্যাংক অব পূর্ব পাকিস্তান) পাশে লুঙ্গি পরে হাতে ছাতা নিয়ে ছদ্মবেশে অবস্থান নেন। অন্য একজন মুক্তিযােদ্ধাও বর্তমান কোতােয়ালি থানার মােড়ে ছাতা হাতে লুঙ্গিপরা অবস্থায় অবস্থান নেন। মূল দল ১টি ফিয়াট গাড়ি নিয়ে বর্তমান জিপিও-এর বিপরীতে নিউ মার্কেটের দিকে মুখ করে দাড়িয়ে প্রথম দুজনের কাছ থেকে সংকেতের জন্য অপেক্ষায় থাকে। প্রথম ২জন ও মূল দলের দূরত্ব দৃষ্টিসীমার মধ্যে ছিল মূল দলের কাছে তখন ২টি এসএমসি, ৪টি রিভলভার ও ২টি হ্যান্ড গ্রেনেড ছিল। প্রথম ২জনের উদ্দেশ্য ছিল, যে গাড়িতে করে টাকাগুলাে নেয়া হবে সেটাকে ইশারায় দেখিয়ে দেয়া অর্থাৎ টাকা বহনকারী গাড়ি ব্যাংক থেকে বের হলেই প্রথম ব্যক্তি তার কাছে থাকা ছাতাটি খুলে ধরবেন, যার অর্থ হবে, গাড়িটি রওনা হয়েছে। সাথে সাথে কোতােয়ালির সামনে দাঁড়ানাে ব্যক্তিটিও একইভাবে ছাতা খুলে ইশারা করবেন। তথ্যানুযায়ী, টাকা বহনকারী গাড়িটি আসার সম্ভাব্য সময় ছিল সকাল ১০-১১টার মধ্যে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে গাড়িটি আসে নি। বেলা সােয়া ১১টায় মূল দল অপেক্ষার অস্থিরতায় ভুগে ঐ এলাকা ত্যাগ করে নিউ মার্কেট চত্বর হয়ে সিটি কলেজের দিকে যেতে থাকে। মাঝপথে গ্রুপ লিডার মাহবুব গাড়ি থেকে নেমে যান। অবশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধারা গাড়ি নিয়ে সিটি কলেজের দিকে যাওয়ার রাস্তার মােড়ে অবস্থান নেন। 
পূর্ব পরিকল্পিত অপারেশনটি করতে না পেরে মুক্তিযােদ্ধা রফিক যে-কোনাে একটা অপারেশন করার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন। মুক্তিযােদ্ধারা সিটি কলেজের দিকে আসার সময় নিউ মার্কেটের মােড়ে একটা বুক স্টলের সামনে পুলিশের একজন সার্জেন্টকে দেখতে পান। এ অবস্থায় তারা সার্জেন্টকে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। তৎক্ষণাৎ রফিক গাড়ি থেকে নেমে নিউ মার্কেটের দিকে গিয়ে কর্তব্যরত পুলিশ সার্জেন্টকে রিভলভার দিয়ে গুলি করে দ্রুত গাড়িতে উঠে আসেন। সার্জেন্ট সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে প্রকাশ্য দিবালােকের এ ঘটনার সময় নিউ মার্কেট এলাকায় অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিযােদ্ধাদের শনাক্ত করে ফেলে বিলম্ব না করে তারা তাদের গাড়ি নিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের পিছু ধাওয়া করে। উপায়ান্তর না দেখে মুক্তিযােদ্ধারা গাড়ি নিয়ে সদর ঘাটের দিকে পালিয়ে যেতে থাকেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা নিজেদের গাড়ি থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। মুক্তিযােদ্ধারাও পালটা গুলি ছুড়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকেন। মুক্তিযােদ্ধাদের গুলি বর্ষণের ফলে তাদের পিছনের পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়ি সম্ভবত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্ভাগ্যবশত সদর ঘাটের দিক থেকে হঠাৎ আরেকটি পাকিস্তানি বাহিনীর টহল যান এসে পড়ে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অপারেশন দল গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে রাস্তার পাশে পজিশন নেয়। ইতােমধ্যে প্রায় ১৫ মিনিট প্রচণ্ড গােলাগুলি হয়। এ সময় মুক্তিযােদ্ধা রফিক গুলিবিদ্ধ হন। এক পর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধাদের গুলি নিঃশেষ হয়ে গেলে পিছু হটে যান এবং পার্শ্ববর্তী ড্রেন দিয়ে কোনােরকমে নিরাপদ স্থানে চলে যান।
 
ক্ষয়ক্ষতি
এ সংঘর্ষে পাকিস্তানি বাহিনীর ২টি গাড়িই মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে জানা যায় গুলিবিদ্ধ পুলিশ সার্জেন্ট নিহত এবং ৪জন পাকিস্তানি সৈন্য মারাত্মক আহত হয় মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে রফিক ঘটনাস্থলেই শহিদ হন। তা ছাড়া সফিউল বশর গুরুতর আহত ও গ্রেপ্তার হন। মুক্তিযােদ্ধাদের গাড়ির ড্রাইভারও আহত হন ফজলুল হক গুলিতে আহত হয়েও পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
বিশ্লেষণ
পরিকল্পনাকারীরা গাড়ি যথাসময়ে না পৌছানাে, পথিমধ্যে যে-কোনাে ধরনের প্রতিবন্ধকতা এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের হস্তক্ষেপের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করতে ব্যর্থ হন। লক্ষণীয়, অপারেশন করতে ব্যর্থ হয়ে মুক্তিযােদ্ধা রফিক যে-কোনাে উপায়ে একটা ঘটনা ঘটানাের জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন। এক পর্যায়ে অধিনায়কের অনুপস্থিতিতে সম্ভাব্য বিপদের কথা চিন্তা না করে নিজেরাই এ অপারেশনটি পরিচালনা করেন। এর পরিণামও হয়েছিল ভয়াবহ তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে এটি অনভিপ্রেত। তবে অধিনায়কের পরিকল্পনার বাইরে যুদ্ধের পরিণাম সম্পর্কে মুক্তিযোেদ্ধারা শিক্ষা লাভ করেন। উল্লেখ্য, বিবিসি’র মাধ্যমে এ সংঘর্ষের খবর সারা বাংলাদেশ ও পৃথিবীর লােকজন জানতে পারে। দিবালােকে মুক্তিযােদ্ধাদের এ দুঃসাহসিক হামলা সাধারণ জনগণের মনােবলও বাড়িয়ে দেয়।
তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা ফজলুল হক। সম্পাদকের টীকা: এ গ্রন্থের দশম অধ্যায়ে সংকলিত দলিল নম্বর ২২২-এর তথ্য মতে দেখা যায়, ২ নভেম্বর সাড়ে ১২টায় গেরিলারা নিউ মার্কেটের সামনে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর অ্যামবুশ করেন। ২ ঘণ্টা বন্দুক যুদ্ধে একজন মেজর পদবির অফিসারসহ ৪জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং ৭জন আহত হয়। ১ নভেম্বরের ঘটনার সাথে এর তথ্যের সম্পৃক্তি আছে কি না, জানা যায় নি। তবে প্রতীয়মান, এটিই সেই ঘটনা তৎকালীন পরিস্থিতিতে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের তথ্য বিনিময়ের জটিল ও কঠিন পদ্ধতিতে তারিখ বিভ্রাট অস্বাভাবিক নয়। এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযােগ্য যে, সাক্ষাৎকার প্রদানকারীগণ ঘটনার বর্ণনা। দিয়েছেন সুদীর্ঘ ৩১ বছর পর। (নিউমার্কেটের মােড়ে তাৎক্ষণিক অপারেশনের নকশাটি ১১৩১ পাতায়)

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!