You dont have javascript enabled! Please enable it! অপারেশন হােটেল আগ্রাবাদ - সংগ্রামের নোটবুক
অপারেশন হােটেল আগ্রাবাদ
প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য
পাকিস্তান সরকার রেডিও-টিভিতে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলে ব্যাপক প্রচারের পাশাপাশি জাতিসংঘে পাকিস্তানের বিশেষ দূতও একই প্রসঙ্গে অভিন্ন বক্তব্য প্রদান করেন। উদ্দেশ্য, পূর্ব পাকিস্তানে তাদের অত্যাচার ও নির্যাতনের এবং বাঙালির স্বাধীনতার চেতনাকে বহির্বিশ্বের কাছে গােপন রাখা। পাকিস্তানি প্রতিনিধির কথার সত্যতা যাচাই করতে জাতিসংঘের একটি পর্যবেক্ষক দল চট্টগ্রাম আসে। তাদের আগমন উপলক্ষে হােটেল আগ্রাবাদসহ পুরাে চট্টগ্রামে  নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়। এ জন্য হােটেল আগ্রাবাদে পাকিস্তানি বাহিনী অবস্থান নিয়ে একটি বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা তৈরি করে। মুক্তিযােদ্ধারা সিদ্ধান্ত নেন, জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলের কাছে প্রমাণ করে দিতে হবে যে পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে।
অবস্থান ও পর্যবেক্ষণ
আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় কমার্স কলেজের উত্তরপশ্চিম পাশে এবং মােগলটুলি বাজারের দক্ষিণ পাশে হােটেল আগ্রাবাদের অবস্থান। বিদেশি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল, সরকারি ও সামরিক প্রতিনিধি, পর্যটক, বিদেশি সাংবাদিকেরা চট্টগ্রাম। অবস্থানকালীন এখানে থাকতেন। মুক্তিযােদ্ধা সাইফুদ্দিন খালেদ, ফয়েজ, গরিবুল্লাহ ও জাফরউল্লা বােরহান ছদ্মবেশে পুরাে এলাকা রেকি করেন। বাড়ির কাছাকাছি। হওয়ায় গরিবুল্লাহ পুরাে এলাকা চিনতেন এবং এতে অনেক তথ্য জানা সহজতর। হয়। পর্যবেক্ষণ করার সময় তারা নিচের বিষয়গুলাে লক্ষ্য করেন:
ক, আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা পার্শ্ববর্তী হওয়ায় পুরাে এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি ছিল। হােটেল আগ্রাবাদের সামনে সব সময়ে পাকিস্তানি সৈন্য অবস্থান করত। ভিতরেও নিরাপত্তাব্যবস্থা কড়া ছিল। খ, হােটেলের পিছন দিকে কোনাে প্রহরী ছিল না। পাশেই ছিল একটি কচুরিপানাপূর্ণ ডােবা এদিকে কোনাে আলাের ব্যবস্থাও ছিল না। পিছন দিকের এ স্থানকেই যাওয়া আসার পথ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
 
পরিকল্পনা
তথ্য বিশ্লেষণ করে এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, হােটেলের চতুর্দিকে সেনা সদস্যদের কড়া প্রহরা রয়েছে। প্রহরীকে এড়িয়ে হােটেলের অভ্যন্তরে বিস্ফোরক নিয়ে প্রবেশ এবং অপারেশন শেষে বের হয়ে আসা প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ ছাড়া সম্ভব নয়। সার্বিক বিবেচনায় সিদ্ধান্ত হয়, কোনােপ্রকার রক্তপাত না ঘটিয়ে হােটেল আগ্রাবাদে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী ট্রান্সফর্মারটি উড়িয়ে দেওয়া হবে। এ অভিযান চালানাে হবে মােগলটুলিতে গরিবুল্লাহর বাড়িতে স্থাপিত কেসি-৩-এর শেল্টার থেকে। তারপর সংশ্লিষ্ট মুক্তিযােদ্ধাদের অপারেশন বিষয়ে মৌখিক আদেশ দিয়ে স্ব স্ব দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়। আশপাশের কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থায় এ অভিযান ছিল। বিপজ্জনক। তাই সবাইকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে, যদি নিরাপত্তায় নিয়ােজিত প্রহরী অপারেশন দলকে আগেই চিহ্নিত করে ফেলে, তবে পুরাে দল ডােবায় ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে আসবে।
 
অপারেশন
সে সময় রােজা চলছিল। সে জন্য অপারেশনের জন্য তারাবি নামাজে ব্যস্ত থাকার সময়কেই নির্দিষ্ট করা হয়। নির্দিষ্ট দিনে সন্ধ্যার পর মুক্তিযােদ্ধা সাইফুদ্দিন খালেদ, ফয়েজ, গরিবুল্লাহ ও জাফরউল্লা বােরহান ছদ্মবেশে কেসি-৩-এর নিকটবর্তী শেল্টার মােগলটুলিস্থ গরিবুল্লাহর বাড়ি থেকে রওনা হন। তাদের সাথে ছিল বিস্ফোরক, ১টি ৯ মিলিমিটার এসএমসি এবং ২টি পিস্তল। সবার সাথে ১টি করে গ্রেনেড রাখা হয়। তারা সরাসরি প্রধান রাস্তা ধরে না গিয়ে অলিগলি ধরে হােটেলের পিছন দিকে এসে পৌছায়। পূর্বপরিকল্পনা মতাে হােটেলের উত্তর পাশের একটি রুমে অবস্থানরত ড্রাইভারদের অস্ত্রের মুখে বসিয়ে রাখেন জাফর। তারপর ফয়েজসহ ২জন দ্রুত বিস্ফোরক স্থাপন করেন। বিস্ফোরক স্থাপন করতে গিয়ে তিনি বিদ্যুতের শক খেয়ে একবার নিচে পড়ে যান। কিন্তু সাহস, দৃঢ়তা ও অবিচলতা তাকে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারে নি। সাইফুদ্দিন ১টি রিভলভার। নিয়ে বিস্ফোরক স্থাপনকারী ফয়েজের কভারিংয়ের জন্য ডােবার পাশে পজিশন নেন। সাইফুদ্দিনের কভারিংয়ের জন্য এর পিছনে ১টি স্টেনগান নিয়ে পজিশন নেন গরিবুল্লাহ। বিস্ফোরক স্থাপন শেষে ফিউজে আগুন দিয়ে তারা দ্রুত মােগলটুলি বাজারের দিকে চলে যান। অল্পক্ষণ পরেই বিস্ফোরণ ঘটে এবং পুরাে আগ্রাবাদ এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।
 
বিশ্লেষণ
হােটেল আগ্রাবাদের মতাে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা প্রদানের সব আয়ােজন সম্পন্ন করা হলেও এর পেছনের অংশ ছিল অরক্ষিত এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন। পাকিস্তানি সেনাদের এ দুর্বল দিকটি উদ্ঘাটন করে মুক্তিযােদ্ধারা সাহস ও বুদ্ধিমত্তার সাথে একে কাজে লাগান। ফলাফল, মুক্তিযােদ্ধাদের সফলতা। এ ঘটনার পর জাতিসংঘ প্রতিনিধিদলের চট্টগ্রাম সফর উপলক্ষে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল হয়ে যায়। তারাও পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধাবস্থার বাস্তব চিত্র অবলােকন করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা-ব্যবস্থার মধ্যে এ জাতীয় তৎপরতা পাকিস্তানি প্রশাসনকে প্রচণ্ড রকমের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা স্বাভাবিক বলে যে প্রচারণা পাকিস্তানি সরকার চালাচ্ছিল, তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এ ঘটনা স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র ও বিবিসি হতেও প্রচারিত হয় বলে সাক্ষাঙ্কার সূত্রে জানা যায়।
তথ্যসুত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা সাইফুদ্দিন খালেদ, মুক্তিযোেদ্ধা গরিবুল্লাহ। (অপারেশন হােটেল আগ্রাবাদের নকশাটি ১১২৮ পাতায়)

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড