You dont have javascript enabled! Please enable it!
অপারেশন কৈবল্যধাম রেলসেতু
অবস্থান কর্নেলহাট থেকে আনুমানিক ১০০০ গজ উত্তরে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পূর্ব। পাশে এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের ওপর কৈবল্যধাম রেলসেতু অবস্থিত। রেললাইনের পূর্ব দিকে রয়েছে সীতাকুণ্ড পাহাড় সারিতে বিস্তৃত। এ পাহাড় থেকে অসংখ্য পাহাড়ি ঝরনা, নালা বঙ্গোপসাগরের দিকে বহমান। এ রকম একটি পাহাড়ি নালার ওপর অবস্থিত কৈবল্যধাম রেলসেতু। এ নালার পাশ দিয়ে সকালবেলা কাইলি এলাকার রাখাল দল গবাদি পশু নিয়ে এবং অন্যান্যরা বিবিধ জীবিকার সন্ধানে পাহাড়ে যায় এবং সন্ধ্যাবেলা ফেরত আসে। রেললাইনের পশ্চিম দিকে সমগ্র অঞ্চল সমতল ভূমি। রেলসেতুর উত্তর পাশে ছিল বেঙ্গল গােল্ডেন টোব্যাকো কোম্পানি।
উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপট
মুক্তিযােদ্ধারা বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারেন যে, কয়েক দিন ধরে নিয়মিতভাবে একটি ট্রেন চট্টগ্রাম রেল স্টেশন থেকে সন্ধ্যার সময় মিরসরাই পন্তি যাতায়াত করে। এ ট্রেনে এক দল পাকিস্তানি সৈন্য অবস্থান করে এবং সাথে কয়েকটি মালবাহী বগি সংযুক্ত থাকে। সম্ভবত ট্রেনটি মিরসরাই, সীতাকুণ্ড, কুমিরা এলাকায় অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনাদের জন্য রসদ বহন করত। এ সম্পর্কে ভিন্নমতও পাওয়া যায়।  ভিন্নমত পােষণকারীদের মতে, এটি একটি টহল ট্রেন। আবার তাদেরই কারাে কারাে মতে, এ ট্রেনে করে পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে চট্টগ্রাম শহরে নিয়ে আসা হতাে। কারণ, চট্টগ্রাম শহরে মুক্তিযােদ্ধাদের ক্রমবর্ধমান গেরিলা তৎপরতা পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষকে বিচলিত করে তােলে। তাই শহরে শক্তিবৃদ্ধির জন্য পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ সীতাকুণ্ড ও মিরসরাই হতে সৈন্য আনার জন্য ট্রেনটি ব্যবহার করছিল। তবে পরিস্থিতি, বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনাদের সংখ্যা এবং ট্রেনটির নিয়মিত চলাচলকে বিবেচনায় এনে তৃতীয় মতকে অপেক্ষাকৃত কম গ্রহণযােগ্য মনে হয়। ট্রেনটির চলাচলের উদ্দেশ্য যা-ই হােক না কেন, কেসি-৩এর অধিনায়ক ডা. মাহফুজ ট্রেনটিতে অপারেশন পরিচালনার পরিকল্পনা করেন। উদ্দেশ্য ছিল, মুক্তিযােদ্ধারা যে পাকিস্তানি সেনাদের চলাচল এবং রসদ পরিবহনে বাধা সৃষ্টি করতে পারে, সে কথা প্রমাণ করা। এজন্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে চিহ্নিত ও নির্ধারণ করা হয় কৈবল্যধাম রেলসেতুকে। কারণ, উত্তর কাট্টলি এলাকা মুক্তিযােদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র ছিল।
 
পর্যবেক্ষণ ও পরিকল্পনা
কেসি-৩ দল কর্তৃক পরিকল্পনা করা হলেও কেসি-৪-এর সদস্য মুক্তিযােদ্ধা রইসুল। হক বাহারকে এ অপারেশন করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি ভারতের জাফলং প্রশিক্ষণ শিবির থেকে বিস্ফোরক ব্যবহারের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ছিলেন। রইসুল প্রথমে উত্তর কাট্টলি এলাকার স্থানীয় এক বাড়িতে লজিং মাস্টার হিসেবে অবস্থান নেন। স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে যােগাযােগ করে মুক্তিযােদ্ধা মুসা ও শফিকে তার সহযােগী হিসেবে তৈরি করেন। এ এলাকায় তার অবস্থান ও উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ গােপন রাখা হয়। এ দুজনকে নিয়ে তিনি কয়েক দিন গ্রামের রাখাল বালকদের সাথে মিশে কিংবা বৈকালিক ভ্রমণের নামে নির্দিষ্ট এলাকার বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ সম্পন্ন করেন এবং নিম্নে বর্ণিত ধারণা লাভ করেন: ক. অপারেশনস্থলে যাওয়ার জন্য পথ হিসেবে ক্ষেতের আইল বা মেঠো পথ ব্যবহার করা যাবে। ধরা পড়ার আশঙ্কা এড়ানাের উদ্দেশ্যে বিস্ফোরণের পর ফেরত আসার জন্য ভিন্ন পথ নির্দিষ্ট করা হয়। তাই কর্নেলহাটের দক্ষিণ পাশের। (বর্তমানে জনতা ব্যাংকের পাশ দিয়ে) রাস্তা দিয়েই ফেরত আসার পথ নির্দিষ্ট করা হয়, যাতে প্রয়ােজনে দৌড়ে ফেরত আসতেও কোনাে অসুবিধা না হয়। হাটের দিন মানুষের সাথে মিশে অপারেশনস্থলে যাওয়া সহজ হবে। প্রতিদিন সন্ধ্যা প্রায় ছয়টায় ট্রেনটি কৈবল্যধাম সেতু অতিক্রম করে। উ, এলাকার ভূমির গঠন সমতল, মুক্তিযােদ্ধাদের চলাচলের উপযােগী এবং আড়াআড়ি চলাচলযােগ্য। চ, ব্যবহার্য বিস্ফোরকের প্রকার ও পরিমাণ, বিস্ফোরক স্থাপনের স্থান। নির্দিষ্টকরণ, কভারিং পার্টির অবস্থান ইত্যাদিও চিহ্নিত করা হয়। পর্যবেক্ষণ শেষে রইসুল হক বাহার কর্নেলহাটের হাটবারকে অপারেশন পরিচালনার দিন হিসেবে ঠিক করেন। এতে হাটের মানুষের সাথে ছদ্মবেশে অপারেশন স্থলে গমন করা সম্ভব হবে। তাঁর সাথে কেসি-৩-এর অধিনায়ক ডা. মাহফুজ এতৎসংক্রান্ত তথ্য নিয়মিতভাবে আদান-প্রদান করতেন। ডা. মাহফুজ অপারেশনের পরিকল্পনা অনুমােদন করে প্রয়ােজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও বিস্ফোরক রইসুল হককে সরবরাহ করেন। এসব অস্ত্রশস্ত্র ও বিস্ফোরক বিভিন্ন গােপন আস্তানায় রাখা হয়। সরাইপাড়ায় অবস্থিত গােপন আস্তানা থেকেও কিছু অস্ত্রশস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহ করা হয়।
 
অপারেশন
রইসুল হক বাহারের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধা তােফাজ্জল, আনােয়ার, পাশা, মুছা, বাদল, বেলায়েত আলী, মাে. ইলিয়াস বিকাল সাড়ে ৪টার সময় কর্নেলহাটে বাজার করতে যাওয়া হাটুরেদের সাথে সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশে কাট্টলির গােপন আস্তানা হতে রওনা হন। এর আগে যার যার দায়িত্ব মৌখিক আদেশের মাধ্যমে ভালােভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। অপারেশন শেষে সবাই একটি মিলন স্থানে (নাম। পাওয়া যায় নি) একত্র হয়ে প্রত্যাবর্তন করার এবং উপস্থিতভাবে মিলন স্থানটিও বুঝিয়ে দেওয়া হয়। গন্তব্যে যাত্রার সময় সবাই আলাদা আলাদাভাবে পথ চলেন এবং সবার হাতে বাজারের ব্যাগ ও পরনে লুঙ্গি। প্রকৃতপক্ষে, বাজারের ব্যাগে অস্ত্র ও বিস্ফোরক বহন করা হয়। কৈবল্যধাম রেলসেতু এলাকায় পেীছে প্রথমেই ৪জন মুক্তিযােদ্ধা ৪টি স্টেনগান নিয়ে সেতুর দুই দিকে রেললাইনের দুই পাশে পজিশন নেন। অবশিষ্ট দল সেতুর গার্ডারে ১টি টিএনটি স্লাব ও সেতুর দুই পাশে ১০০ গজের মধ্যে ২টি জিসি স্ল্যাব স্থাপন করে। বিস্ফোরণ ঘটানাের জন্য বিস্ফোরকগুলােকে লম্বা কর্ড দিয়ে সংযুক্ত করে পার্শ্ববর্তী ঝােপজঙ্গল পর্যন্ত টেনে নেয়া হয়। বিস্ফোরকের সাথে এমন ডিভাইস সংযুক্ত করা হয়, যাতে কর্ডে টান দিলেই ডিটোনেটরে আগুন ধরে যায়। বিস্ফোরক স্থাপন করার সময় আকস্মিকভাবে দূর থেকে ট্রেনের শব্দ শােনা যায়। প্রকৃতপক্ষে সেদিন ট্রেন সময়ের প্রায় আধ ঘন্টা আগে চলে আসে। তাই বিপদের আশঙ্কা সত্ত্বেও নির্ভয়ে দ্রুততার সাথে ট্রেনের চালকের দৃষ্টিসীমার মধ্যেই বিস্ফোরক স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হয়। ট্রেন খুবই নিকটে এসে পড়তেই কভারিংয়ের জন্য দায়িত্ব প্রাপ্ত ৪জন মুক্তিযােদ্ধা দৌড়ে তাদের অবস্থান থেকে সরে আসেন। ট্রেনের ইঞ্জিন সেতুর ওপর আসামাত্রই ঝােপের মধ্যে অবস্থানরত বিস্ফোরক দল কর্ডে টান দেয়। প্রচণ্ড শব্দে ব্রিজ ও সংলগ্ন রেললাইন উড়ে যায়। লাইনের পাথর তীব্র গতিতে বুলেটের মতাে চারদিকে ছুটে যায়। ছুটন্ত পাথরের কারণে পুরাে অপারেশন দল প্রথমে মাটিতে শুয়ে পড়ে। অভাবিত এ ঘটনায় ভীত ও বিভ্রান্ত কয়েকজন নিজেদের অস্ত্র রেখেই স্থান ত্যাগ করেন। এতে ২টি স্টেনগান হারিয়ে যায় এবং পরদিন খোঁজ করেও এসব অস্ত্র পাওয়া যায় নি।
 
ক্ষয়ক্ষতি
পাকিস্তানি সৈন্য ও মালবাহী ট্রেনের ২টি বগি প্রচণ্ড বিস্ফোরণে উড়ে যায় এবং উল্লেখযােগ্য সংখ্যক পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। সম্পূর্ণ রেলসেতু ও পার্শ্ববর্তী রেললাইন প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে বেশ কয়েকদিন ঐ পথে ট্রেন চলাচল করে নি।
 
বিশ্লেষণ
এটি একটি সুপরিকল্পিত ও সুসম্পাদিত সাহসী অপারেশন। মুক্তিযােদ্ধারা পার্শ্ববর্তী জঙ্গলাকীর্ণ এলাকাকে উপযুক্তভাবে কভার হিসেবে ব্যবহার করে রেকি ও অপারেশন সম্পন্ন করেন। হাটের সাধারণ ও স্বাভাবিক মানুষের মতাে ছদ্মবেশ ধারণ করায় তাদের চলাচলের সময় কোনাে সন্দেহের সৃষ্টি হয় নি। পূর্বে প্রাপ্ত তথ্য ও পর্যবেক্ষণ করার সময় ট্রেনের কৈবল্যধাম রেলসেতুতে পৌছার সময় সন্ধ্যা ৬টা ধরা হলেও অপারেশনের দিন আধ ঘন্টা আগে আসে। সময় নির্ধারণের ক্ষেত্রে | দেখা যাচ্ছে, পরিকল্পনার সময়ে অপারেশন পরিচালনার সময়ের হিসাব খুব আঁটসাট করে করা হয়েছে। প্রতিক্রিয়া বা ভিন্ন উপায় গ্রহণের জন্য পর্যাপ্ত সময় ছিল না। বিস্ফোরক দল ও অন্যান্য দলের অবস্থান বিপজ্জনক দূরত্বের মধ্যে ছিল। বলেই প্রতীয়মান। ফলে পাকিস্তানি সৈন্যবাহী ট্রেনের সামনেই বিস্ফোরক স্থাপন করতে হয়। এতে বিপদের সমূহ আশঙ্কা ছিল। তা ছাড়া তারা সবাই প্রয়ােজনীয় কভার নেয় নি বলেই ছুটন্ত পাথরের আঘাতের শিকার হয়। এটা মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণের দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে এবং ছুটন্ত পাথরের ভয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের কয়েকজন ভীত ও বিভ্রান্ত হয়ে স্বীয় অস্ত্র ফেলে স্থান ত্যাগ করেন। বােঝা যায়, এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য সহনশীল মানসিক অবস্থা তাদের ছিল না। অপারেশনের পূর্বেই মুক্তিযােদ্ধা সদস্যদের বিস্ফোরণ এবং এর পরবর্তী পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয় নি বলেই এমন ঘটেছে। ফলে মূল্যবান ২টি স্টেনগান হারাতে হয়েছে। এভাবে পলায়নে অপ্রত্যাশিত বিবিধ। বিপদের আশঙ্কাও ছিল।
তবু এ অপারেশন একটি সুপরিকল্পিত অ্যামবুশ। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রণীত নীতিমালার সম্পূর্ণ অনুসরণে এ অপারেশনে রাজাকার বাহিনীর পরিবর্তে পাকিস্তানি বাহিনীর টহল দলকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নির্বাচন করা হয়। লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে নিখুঁত ও যথাসম্ভব বিস্তারিত তথ্যসহ এ অপারেশনের সার্বিক সাফল্যের গতিকে ত্বরান্বিত করেছে। লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে আলােচ্য স্থান নির্বাচন বিচক্ষণতার পরিচায়ক। একটি ব্রিজকে মাঝামাঝি অবস্থানে রেখে অল্প পরিমাণ বিস্ফোরক ব্যবহারের মাধ্যমে প্রয়ােজনীয় ফলাফল লাভ করার বিষয়টি মুক্তিযােদ্ধাদের পরিকল্পনার একটি অত্যন্ত সফল দিক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।  সার্বিক বিচারে এ অপারেশনটি সাহসী, সুপরিকল্পিত ও সফল একটি অপারেশন। প্রশিক্ষণ, সরঞ্জাম ও চলাচলের সীমবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও এ ধরনের অপারেশন নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। এ অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের চলাচলে বিঘ্ন ঘটে এবং চলাচলের ক্ষেত্রে তারা অধিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে, যা কৌশলগত স্থানে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় শক্তি হ্রাসের কারণ হয়। এ ঘটনার মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাদের মনােবল ক্ষুন্ন হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতার ওপর জনমনে আস্থা সুদৃঢ় হয়। তা ছাড়া যে-কোনাে যুদ্ধক্ষেত্রের একটি সফল ঘটনা আরও অনেক সফল ঘটনার সূতিকাগার- সে বিবেচনাতেও এ অপারেশন একটি উল্লেখযােগ্য প্রাপ্তি বলে প্রতীয়মান।

 
তথ্যসূত্র:
১. সাক্ষাৎকার- মুক্তিযােদ্ধা রইসুল হক বাহার। ২. ডা. মাহফুজুর রহমান প্রণীত বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম
গ্রন্থের পৃষ্ঠা ৩৬৩। (অপারেশন কৈবল্যধাম রেলসেতুর নকশাটি দেখুন ১১২৬ পাতায়)

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড

 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!