You dont have javascript enabled! Please enable it! হাদি ফকিরহাটে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের ওপর অ্যামবুশ - সংগ্রামের নোটবুক
হাদি ফকিরহাটে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের ওপর অ্যামবুশ
প্রেক্ষাপট
হাদি ফকিরহাট বাজার সংলগ্ন এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তায় রাজাকাররা প্রায় সময় এসে দোকানপাট লুটপাট ও নিরীহ জনগণকে অত্যাচার করত। মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক নুরুন্নবী ও তাঁর দল সিদ্ধান্ত নেয় রাজাকারদের ওপর অ্যামবুশ করা হবে। তাদের গােপন আস্তানা ছিল হাদি ফকিরহাট বাজার থেকে ৫ কিলােমিটার পশ্চিম দিকে। মিরসরাই সদর থেকে ৪ কিলােমিটার দক্ষিণে এবং নিজামপুর কলেজ থেকে আধা কিলােমিটার উত্তর দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রােডের পূর্ব পাশে হাদি ফকিরহাট অবস্থিত। হাদি ফকিরহাটের পূর্ব পাশে চট্টগ্রামঢাকা রেলপথ এবং তারও পূর্ব দিকে সীতাকুণ্ড রেঞ্জের পাহাড় সারি। চট্টগ্রাম-ঢাকা ট্রাংক রােডের পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর উপকূল। পর্যবেক্ষণ ও পরিকল্পনা সাধারণত স্থানীয়, মুক্তিযােদ্ধাদের মাধ্যমে অধিনায়ক নুরুন্নবী রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের আগমনের সময় এবং তাদের সংখ্যা ও অস্ত্র ইত্যাদি তথ্যসংগ্রহ করেন। সংগৃহীত তথ্যানুযায়ী প্রায়ই ৮-১২জন রাজাকার ঐ এলাকায় যাতায়াত করে। তাদের দুষ্কর্মে সহায়তার জন্য ট্রাকে করে ২০জনের মতাে পাকিস্ত নি সেনা মিরসরাইয়ের ক্যাম্প থেকে আসে। এ তথ্যের ভিত্তিতে একটি গেরিলা আক্রমণ পরিচালনার চিন্তা করা হয়। এ জন্য তিনি তাঁর পুরাে দলকে ২টি ভাগে বিভক্ত করেন: প্রথম দল: নুরুন্নবীর নেতৃত্বে এ দলের সদস্য ছিলেন আনুমানিক ১০জন। শাহ আলমের কাছে ১টি এলএমজি এবং অন্যদের কাছে .৩০৩ রাইফেল ছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী এ দল পজিশন নেবে গাছবাড়িয়া গ্রামের কাছে। এদের কাজ হাদি ফকিরহাট বাজারের দিকে যাওয়ার সময় রাজাকারদের ওপর অ্যামবুশ করা। দ্বিতীয় দল: আলাউদ্দিনের নেতৃত্বে এ দলে ছিলেন ৭জন মুক্তিযােদ্ধা। ১টি এলএমজি ছাড়া বাকি সবার কাছে ছিল .৩০৩ রাইফেল। তাঁদের কাজ নিজামপুর কলেজের পুকুর পাড়ে অবস্থান নিয়ে ১ম গ্রুপকে অপারেশনে সহায়তা করা। রাজাকারদের সাহায্যের জন্য পাকিস্তানি সেনারা এলে তাদের বাধা প্রদান করা।
 
অপারেশন
গােপন সূত্রের ভিত্তিতে মুক্তিযােদ্ধারা নিশ্চিত হন যে, ৯ অক্টোবর সকালবেলা রাজাকার দল হাদি ফকিরহাট বাজারে আসবে। দিনের আলাে ফোটার আগে। অন্ধকারে পুরাে দল গ্রামের মধ্য দিয়ে এসে পরিকল্পনামতাে নুরুন্নবীর নেতৃত্বে প্রথম দল গাছবাড়িয়া গ্রামে এবং আলাউদ্দিনের নেতৃত্বে দ্বিতীয় দল নিজামপুর। কলেজের পাশে অবস্থান নেয়। আশপাশে এবং হাদি ফকিরহাট বাজারে তথ্যসংগ্রহ করার জন্য ছদ্মবেশে কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধাকে পাঠানাে হয়েছিল । ৮টার দিকে ১০১২জনের ১টি রাজাকার দল হাদি ফকিরহাট বাজারে আসে। এ তথ্য পাওয়া মাত্রই নুরুন্নবী তার দল নিয়ে গ্রামের মধ্য দিয়ে হাদি ফকিরহাট বাজারের কাছে পৌছেই গুলি বর্ষণ শুরু করেন। যাওয়ার আগে তিনি লােক মারফত দ্বিতীয় দলের নেতা। আলাউদ্দিনের কাছে তার উদ্দেশ্য জানিয়ে যান। রাজাকাররা সবাই সশস্ত্র থাকায় বাজার ঘেরাও করা সম্ভব ছিল না। এদিকে রাজাকাররা বাজারের বিভিন্ন স্থানে। পজিশন নিয়ে পালটা গুলি করতে থাকে। এক পর্যায়ে রাজাকার দলের কয়েকজন। আহত হলে অন্যরা পালিয়ে যায়।
মুক্তিযােদ্ধারা তাদের গােপন আস্তানায় ফিরে। যাওয়ার জন্য রওনা হন। চট্টগ্রাম-ঢাকা ট্রাংক রােডের কাছে আসার পর তাদের সামনে এসে পড়ে পাকিস্তানি সৈন্যবাহী একটি গাড়ি। চলন্ত গাড়ি থেকে পাকিস্তানি সেনারা গুলি করতে করতে এক সময় রাস্তার দুই পাশে পজিশন নিয়ে ফেলে। এ অবস্থায় মুক্তিযােদ্ধাদের ৩-৪জন ছাড়া বাকি সবাই পিছনে হটে যায়। মুক্তিযােদ্ধা শাহ আলম তার এলএমজি নিয়ে একটি টেলিফোন খুঁটির আড়াল নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর গুলি বর্ষণ করতে থাকেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই শহিদ হন। এ অবস্থায় আলাউদ্দিন গ্রুপ সুলতান উকিলের বাড়ির সামনে পুকুর পাড়ে। পজিশন নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর গুলি বর্ষণ করতে থাকে। তারা পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান আড়াল থেকে স্পষ্ট দেখতে পেলেও পাকিস্তানি সেনারা তাদের অবস্থান শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়। কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে গােলাগুলি করার পর পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে যায়। মুক্তিযােদ্ধাদের দ্বিতীয় দল গােপন আস্তানায় প্রত্যাবর্তন করে। সন্ধ্যার পর খবর পাওয়া যায় যে শাহ আলম শহিদ হয়েছেন। এবং তার লাশ টেলিফোন খুঁটির কাছে পড়ে আছে। মুক্তিযােদ্ধারা তাঁর লাশ আনার জন্য নিজেদেরকে ৩টি দলে বিভক্ত করে এক দল লাশ উদ্ধার করে এবং ২টি দল কভার দিতে থাকে। শহিদ শাহ আলমের এলএমজি পাওয়া যায় নি। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা ঐ এলাকায় ছিল না।
 
বিশ্লেষণ

কিছুটা অপরিণামদর্শী ও আবেগজনিত এ অপারেশনটি গেরিলা যুদ্ধের নিয়মনীতি ছাড়াই পরিচালনা করা হয়। প্রথমত, রাজাকারের সাথে বাজার এলাকায় সরাসরি সংঘর্ষে না গিয়ে তাদের ফেরার রাস্তায় ফাদ পেতে আক্রমণ করলে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ক্ষতি করা যেত। পরবর্তীকালে প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি বাহিনীর পালটা আক্রমণে হতচকিত মুক্তিযােদ্ধাদের পশ্চাদপসরণ এবং কেবল জনাকয়েক মুক্তিযােদ্ধার সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া অপরিণামদর্শিতারই পরিচায়ক। এর মূল্য মুক্তিযােদ্ধারা দিয়েছিলেন শাহ আলমের মৃত্যুতে এবং একটি দরকারি অস্ত্র এলএমজি হারিয়ে। মূলত, নেতৃত্বের দুর্বলতাই এ অপারেশন সফল না হওয়ার প্রধান কারণ বলে গণ্য করা যায়। তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা আলাউদ্দিন। সম্পাদকের টীকা ১. গ্রন্থের একাদশ অধ্যায়ের ৩০৮, ৩১০ ও ৩১৫ ও দ্বাদশ অধ্যায়ের ৪০৫ নম্বর দলিলে এ যুদ্ধ সম্পর্কে তথ্যাদি আছে। অপারেশনের তারিখ বিষয়ে সাক্ষাৎকার দানকারীর তথ্য মতে, এটি সংঘটিত হয়েছে ৯ অক্টোবর। কিন্তু উল্লিখিত প্রথম ৩টি দলিল মােতাবেক তা ২৭ নভেম্বর; শেষ দলিলে ঘটনাটি নভেম্বরের শেষ দিকে সংঘটিত বলে লিপিবদ্ধ। সবকটিতেই শাহ আলমের শহিদ হওয়া প্রসঙ্গ বিধৃত। এ তারিখ দালিলিক বিধায় আমরা এটিকেই যথার্থ বলে গণ্য করেছি। একাদশ অধ্যায়ের ৩১০ নম্বর দলিলে এ অপারেশনের অধিনায়ক হিসেবে ১০০ নম্বর মুক্তিযােদ্ধা গ্রুপ লিডার এস এম শরফুদ্দিনের নাম পাওয়া যায়। ৩১৫ নম্বর দলিলে ২৬ নভেম্বর এ এলাকার একটি যুদ্ধের তথ্য রয়েছে, যার। অধিনায়ক হিসেবে নুরুন্নবীর নাম রয়েছে। এ দলিলে আলােচ্য অপারেশনের স্থান হিসেবে নিজামপুর কলেজের একটু ভিতরের দিকে এ যুদ্ধ এবং শাহ আলমের শহিদ হওয়ার তথ্য আছে। ৪. উল্লেখ্য, অপারেশন পরিকল্পনায় সাক্ষাৎকার দানকারীর অবস্থান ছিল এ এলাকায়। তা ছাড়া হাদি ফকিরহাট অবস্থানগত দিক দিয়ে পরস্পর সন্নিকটে।। ডা. মাহফুজুর রহমানের বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম: মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম শীর্ষক গ্রন্থে এ যুদ্ধ সংঘটনের তারিখ দেওয়া হয়েছে ২৮ নভেম্বর শেষ রাতে। তবে এ যুদ্ধ সম্পর্কে ভিন্ন তথ্য রয়েছে। তার সংকলনে এ যুদ্ধ পাকিস্তানি বাহিনীর মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয় কেন্দ্রে রেইডের ফল। অধিনায়ক হিসেবে নাম রয়েছে শহিদ শাহ আলমের।

(হাদি ফকিরহাটে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের ওপর অ্যামবুশের নকশাটি
দেখুন ১১২৪ পাতায়)