You dont have javascript enabled! Please enable it!
মিরসরাই-বারতাকিয়া রেললাইনে অপারেশন
অবস্থান
ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রােডের ওপর মিরসরাই থানার বারতাকিয়া বাজারের দক্ষিণপূর্ব পাশে বারতাকিয়া রেল স্টেশন অবস্থিত। এ স্টেশন এবং উত্তরে মিরসরাই রেল স্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানে রেললাইনের নিচে অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন বসিয়ে রেললাইন অপারেশন করা হয়।
উদ্দেশ্য
এ অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিল রেল যােগাযােগ সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন করে পাকিস্তানি সেনাদের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা, এতে তাদের মনােবল দুর্বল করে দেওয়া এবং মুক্তিকামী জনগণের মধ্যে শুভদিনের আশার সঞ্চার করে তাদের সহযােগিতার হাতকে আরও প্রসারিত করা।
পর্যবেক্ষণ
অধিনায়ক এ এফ এম নিজাম স্থানীয় মেম্বার জহুরুল হক ও তার সহযােগী লােকমানকে সঙ্গে নিয়ে তাদের আশ্রয় কেন্দ্র খৈয়াছড়া গ্রামের হরিমােহন চৌধুরীর বাড়ি থেকে রওনা হয়ে বারতাকিয়া বাজার হয়ে আনুমানিক বিকাল ৩-৪টায়। বারতাকিয়া রেল স্টেশন ও মিরসরাই রেল স্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানের রেললাইনের ওপর পর্যবেক্ষণ করার জন্য যান আধ ঘণ্টার মধ্যেই সম্ভাব্য অপারেশনের জন্য প্রয়ােজনীয় পর্যবেক্ষণ সম্পন্ন করে নিজেদের আশ্রয় কেন্দ্রে ফিরে আসেন। উল্লেখ্য, মেম্বার জহুরুল হক সক্রিয় মুক্তিযােদ্ধা না হলেও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক অপারেশনের নির্দিষ্ট স্থানটি তার এলাকায় অবস্থিত। সুতরাং স্থানটি সম্পর্কে তার ভালাে ধারণা থাকায় পর্যবেক্ষণে সুবিধা হয়েছিল। স্থানটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে আরও একটি সুবিধা ছিল এ যে, এর আশপাশে ২০০ গজের মধ্যে কোনাে বাড়িঘর না থাকায় মাইন বিস্ফোরিত হলেও বাড়িঘর বা লােকজনের ক্ষতি হওয়ার কোনাে আশঙ্কা ছিল না। স্থানটি নির্জন থাকায় অপারেশন করার জন্য গােপনীয়তা এবং মুক্তিযােদ্ধাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও খুব সহজ ছিল। রেললাইনের নিচে পাথর সরিয়ে মাটি খুঁড়ে মাইন বসানাের জন্য বেলচা, কোদাল, শাবল ইত্যাদি স্থানীয়ভাবে জহরুল হক মেম্বারের সহায়তায় সংগ্রহ করা হয়।
অপারেশন
১৯৭১ সালের ২৩ জুলাই দিবাগত রাত ১টায় হরিমােহন চৌধুরীর বাড়ি থেকে অধিনায়ক নিজাম সহযােদ্ধা মাে. শফি, সলিমুদ্দিন, নুরুল ইসলাম, আলী আহমেদ, সাহের আহমেদ (সাের্স), লােকমান এবং আরও কয়েকজনকে নিয়ে এ অপারেশন করার জন্য রওনা হন। তাঁদের সাথে ছিল ২টি স্টেনগান, ২টি পিস্তল, ১টি গ্রেনেড এবং ২টি অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন। তারা অপারেশন স্থানটিতে পেীছেন রাত আনুমানিক ২টায়। তারা সেখানে পৌছেই স্লিপারের ওপর থেকে পাথর সরিয়ে শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়ে ২টি অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন উভয় রেললাইনের নিচে স্থাপন করেন। রাত আড়াইটায় মাইন স্থাপন শেষে তারা আশ্রয় কেন্দ্রে প্রত্যাবর্তন করেন। পরদিন তারা লােকমুখে জানতে পারেন, মাইনগুলাে বিস্ফোরিত হওয়ার। পর ১টি ট্রেনের ইঞ্জিনসহ ৩টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে রেল যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়েছে। পরে অবশ্য পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ বিচ্ছিন্ন রেললাইনের মেরামত কাজ ১০ | ঘণ্টার মধ্যে সম্পন্ন করে ট্রেন চলাচলের জন্য উপযােগী করে তােলে। লাইনচ্যুত বগির ভিতর কী ছিল, তা না জানায় হতাহত বা ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে সঠিক তথ্য। পাওয়া যায় নি। উল্লেখ্য, অ্যান্টি-ট্যাংক মাইনগুলাের ওপর ৪০ পাউন্ড ওজন। পড়লেই বিস্ফোরিত হতাে।
প্রতিক্রিয়া
ইঞ্জিনসহ ৩টি বগি লাইনচ্যুত হওয়ায় অপারেশনের পরদিন পাকিস্তানি সেনারা মেম্বার জহুরুল হকের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। পাকিস্তানি সেনারা রাজাকারদের মাধ্যমে  জানতে পেরেছিল যে, মেম্বার জহুরুল হক মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা দানকারী একজন সক্রিয় কর্মী পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারজনিত আতঙ্ক সত্ত্বেও মুক্তিকামী স্থানীয় জনসাধারণের মাঝে আনন্দ ও প্রত্যাশা বৃদ্ধি পেয়েছিল, এ তথ্যও মুক্তিযােদ্ধারা জেনেছিলেন।
বিশ্লেষণ
এ অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের মনােবলে ফাটল ধরে। তারা বুঝতে পারে শুধু কাঁচাপাকা রাস্তায় কিংবা ব্রিজে গেরিলা কর্মকাণ্ড চলে না, রেললাইনেও তা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ফলে তারা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য অতিরিক্ত শক্তি ব্যয় করতে বাধ্য হয়। শক্রর অস্ত্র ও সেনা শক্তি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়া ছিল গেরিলা যুদ্ধের একটি অন্যতম লক্ষ্য জনগণের বসতি থেকে দূরে অপারেশনের স্থান নির্ধারণ করে এবং স্থানীয় লােকদের কাজে লাগিয়ে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করার ক্ষেত্রে অধিনায়ক নিজাম যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। তথ্যসুক সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক আ ফ ম নিজামউদ্দিন, মিরসরাই, চট্টগ্রাম। দ্রষ্টব্য: গ্রন্থের দ্বাদশ অধ্যায়ে দলিল নম্বর ৪০১। 

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!