প্রেমতলা পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে অপারেশন
অবস্থান
সীতাকুণ্ড থানা থেকে ২০০ গজ দক্ষিণে ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রােড থেকে একটি রাস্তা পূর্ব দিকে বহমান। ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রােড থেকে এ রাস্তা ধরে ১০০ গজ গেলেই সীতাকুণ্ড ডিগ্রি কলেজ। এ কলেজের ঠিক পূর্ব পাশেই হিন্দুদের একটি মন্দির। এটি তীর্থস্থান হিসেবে সুপরিচিত। এখানে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে হিন্দুরা তীর্থযাত্রী হিসেবে আসে। মন্দিরের পাশে তীর্থযাত্রীদের জন্য নির্মিত ঘরেই পাকিস্তানি সেনারা ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। উদ্দেশ্য মুক্তিযােদ্ধাদের উদ্দেশ্য ছিল এ ক্যাম্প থেকে পাকিস্তানি সেনাদের বিতাড়িত করা। সম্ভব হলে তাদের ধরে হত্যা করা এবং পাকিস্তানি সেনাদের মনে ভয়ানক ভীতি সৃষ্টি করা।
পর্যবেক্ষণ
অধিনায়ক নুরুল হুদা তার সহযােদ্ধা মনিরুজ্জামানকে নিয়ে পর্যবেক্ষণ করার জন্য জুলাই মাসের শেষের দিকে বা আগস্ট মাসের প্রথম দিকে কোনাে এক দিন। (সঠিক তারিখ জানা নেই) তাদের আশ্রয় কেন্দ্র গুইয়াখালী গ্রামের নূর আলমের বাড়ি থেকে রওনা দেন। মুক্তিযােদ্ধা মনিরুজ্জামানের বাড়ি ছিল মন্দিরের পাশের গ্রামে। তাই ক্যাম্প এলাকা সম্পর্কে তার ভালাে জানা ছিল বলে তাকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য অধিনায়ক নুরুল হুদার সহযােগী হিসেবে বাছাই করা হয়। তাঁরা ২জন আশ্রয় কেন্দ্র থেকে রাত ১০টায় রওনা হয়ে রাত ১১টায় প্রেমতলা পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প থেকে ১৫০ গজ দূরত্বের মধ্যে পৌছে যান। ক্যাম্পের আশপাশে গ্রাম থাকায় এবং গ্রামগুলােয় বাড়িঘর ছিল বলে আড়ালের মধ্যে অবস্থান করে খুব কাছ থেকেই রেকি করা সম্ভব হয়েছিল। ক্যাম্পের নিকটবর্তী স্থানে গিয়ে অধিনায়ক নুরুল হুদা পর্যবেক্ষণ করার জন্য মনিরুজ্জামানকে পাঠান। কিন্তু অধিনায়ক নুরুল হুদা সতর্কতা ও নিরাপত্তা বজায় রাখার স্বার্থে স্বয়ং পর্যবেক্ষণ করেন। তখন ছিল রাত সাড়ে ১১টা। পর্যবেক্ষণ করার সময় তিনি দেখতে পান, ক্যাম্পের সাথেই ২জন প্রহরী ডিউটিরত এবং অন্যরা ঘুমিয়ে পড়েছে। তিনি আরও কিছু প্রয়ােজনীয় বিষয় পর্যবেক্ষণ করেন। যেমন: নিরাপদে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প আক্রমণ করা যাবে কি না, ঘরবাড়ির আড়ালে থেকে বা পূর্ব দিকের পাহাড়কে আড়ালে রেখে নিরাপদে ফায়ার করা যাবে।
কি না ইত্যাদি। তিনি নিজের পর্যবেক্ষণ এবং সহযােদ্ধা মনিরুজ্জামানের বক্তব্যের ভিত্তিতে অপারেশনের বিস্তারিত পরিকল্পনা করেন।
সংগঠন
অধিনায়ক নুরুল হুদা অপারেশন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য তাঁর প্ল্যাটুনকে ৪টি গ্রুপে বিভক্ত করেন। প্রথম গ্রুপটি ক্যাম্পের দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং দ্বিতীয় গ্রুপটি অধিনায়ক নুরুল হুদার নেতৃত্বে ক্যাম্প থেকে সােজা দক্ষিণে অবস্থান নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তৃতীয় গ্রুপটি ক্যাম্পের দক্ষিণ-পূর্বে পাহাড়ের পাদদেশে রাখার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। চতুর্থ গ্রুপটি দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্রুপের অবস্থান থেকে একটু দূরে রিজার্ভ হিসেবে রাখা হয়। এ গ্রুপটি রিজার্ভে রাখার উদ্দেশ্য ছিল, যাতে প্রয়ােজনমাফিক অধিনায়কের অর্পিত দায়িত্ব সফলতার সাথে পালন করতে পারে। উত্তর দিকে কোনাে গ্রুপ রাখা হয় নি। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রয়ােজনীয় সংখ্যক গুলিসহ তাঁদের নিজেদের ব্যক্তিগত অস্ত্র হিসেবে পিস্তল, স্টেনগান, এসএলআর, .৩০৩ রাইফেল এবং কিছু সংখ্যক গ্রেনেড দেওয়া হয়।
অপারেশন
পর্যবেক্ষণ ও অপারেশন পরিকল্পনার পর নির্দিষ্ট দিনে (সঠিক তারিখ মনে নেই) অধিনায়ক নুরুল হুদা তাঁর গ্রুপ নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পের ওপর আক্রমণ চালানাের জন্য রাত ১২টায় আশ্রয় কেন্দ্র থেকে রওনা দিয়ে আনুমানিক রাত ১টায় প্রেমতলা পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প এলাকায় পৌছে যান। তাঁর নির্দেশে গ্রুপ অধিনায়করা পরিকল্পনা মােতাবেক নিজ নিজ স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেন। অধিনায়ক নুরুল হুদা গ্রুপগুলােকে স্ব স্ব অবস্থান গ্রহণ করার পূর্বেই নির্দেশ দিয়েছিলেন, তিনি টর্চলাইট ওপরে তুলে ফোকাস করলেই সবাই ফায়ার শুরু করবেন। তবে তিনিই প্রথমে ২-৩ রাউন্ড ফায়ার করবেন। তারপর তিনি তার গ্রুপসহ একটু পিছনে চলে যাবেন এ জন্য যে ফায়ারের শব্দ শুনে হয়ত পাকিস্তানি সেনারা ক্যাম্প থেকে সম্মুখের দিকে অগ্রসর হবে। তিনি আরও নির্দেশ দিয়েছিলেন। যে, তার ফায়ারের আওয়াজ শুনে পাকিস্তানি সেনারা সামনের দিকে অগ্রসর হলে তাদের যেন ঘেরাও করে ফেলা হয়। ঘেরাও করার পর পাকিস্তানি সেনাদের ওপর ফায়ার করা হলে স্বাভাবিকভাবেই ক্রসফায়ারের জালে পড়ে পাকিস্তানি সেনারা সহজেই হতাহত হবে। পরিকল্পনা মােতাবেক প্রথমে অধিনায়ক নুরুল হুদা ২-৩ রাউন্ড ফায়ার করেন। পক্ষান্তরে পাকিস্তানি সেনারাও ফায়ার শুরু করে দেয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, পাকিস্তানি সেনারা ভয়ে আর সম্মুখে অগ্রসর হয় না। এমতাবস্থায় অধিনায়ক নুরুল হুদা ঠিক করেন, ক্যাম্পের ওপর ফায়ার অব্যাহত রেখেই তাদের ক্যাম্প থেকে সরাতে হবে। তাই তিনি টর্চলাইট ওপরে তুলে ফোকাস করলে তার গ্রুপের সবাই ফায়ার শুরু করে দেন। অন্যদিকে, পাকিস্তানি সেনারা সার্বিক অবস্থা নিজেদের প্রতিকূলে দেখে ফায়ার বন্ধ করে দিলে অধিনায়ক নুরুল হুদা মনে করেন, পাকিস্তানি সেনারা হয়ত ক্যাম্প ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। তিনি তার। রিজার্ভ পার্টিকে সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে ক্যাম্পের ভিতর পাকিস্তানি সেনা আছে কি না, নিশ্চিত করার জন্য আদেশ দেন। দেখা যায়, পাকিস্তানি সেনারা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে গেছে। তল্লাশিতে ক্যাম্পের ভিতর কিছু ময়দার বস্তা, ব্যবহৃত গ্লাস, প্লেট ও অন্য আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র পাওয়া যায়। ফেলে যাওয়া অস্ত্রের জন্য পুরাে ক্যাম্প তল্লাশি করা হলেও কোনাে অস্ত্র পাওয়া যায় নি।
ক্ষয়ক্ষতি
পাকিস্তানি সেনাদের কেউ হতাহত হয়েছে কি না, তা জানা যায় নি। মুক্তিযােদ্ধাদের কেউ হতাহত হয় নি।
প্রতিক্রিয়া
এ অপারেশনের পরদিন পাকিস্তানি সেনারা আবার ঐ ক্যাম্প এলাকায় আসে। কিন্তু নিয়মমাফিক কাউকে ধরে নি বা আশপাশের গ্রামের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় নি। তবে মুক্তিযােদ্ধারা জানতে পেরেছিলেন যে, পাকিস্তানি সেনারা ক্যাম্প এলাকায় এসে মুক্তিযােদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য প্রদানের জন্য কয়েকজন গ্রামবাসীকে লাঠি দিয়ে মেরেছে।
বিশ্লেষণ
পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প থেকে বিতাড়িত করাই ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের প্রধান লক্ষ্য। তাই তারা ক্যাম্পের চারদিকে অবস্থান না নিয়ে উত্তর দিক খালি রাখেন, যাতে পাকিস্তানি সেনারা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যেতে পারে। কারণ, মুক্তিযােদ্ধাদের এটা ভালাে করেই জানা ছিল, পাকিস্তানি সেনাদের মতাে শক্তিধর শত্রুদের সাথে সম্মুখসমরে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া যাবে না। তাই আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত আক্রমণের মাধ্যমে তাদের বিস্মিত ও ভীত করে পলায়নপর করে। তােলা অধিকতর বাস্তবসম্মত। এ অপারেশনটি এ বৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক। অধিনায়ক নুরুল হুদা প্রথমে তার সহযােদ্ধাকে পর্যবেক্ষণে পাঠালেও তিনি অতিরিক্ত সতর্কতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে পুনরায় নিজে পর্যবেক্ষণ করেন। এর মাধ্যমে তার অধিনায়কসুলভ দায়িত্ববােধেরই পরিচয় প্রস্ফুটিত হয়েছে। এ অপারেশনের পর পাকিস্তানি সেনারা বুঝতে পারে, তাদের জন্য আর শহর কিংবা উপ শহর এলাকায় অবস্থান করাতেও নিরাপত্তা নেই।
তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক নুরুল হুদা, সীতাকুণ্ড।
(প্রেমতলা পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে অপারেশনের নকশাটি দেখুন ১১২৩ পাতায়)
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড