বাড়বকুণ্ডে রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন
করেন। নুরুল আলম সরাসরি মুক্তিযােদ্ধাদের কর্মকাণ্ডে জড়িত না থাকলেও পরােক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একজন একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। তিনি রাজাকারমিলিশিয়াদের কার্যক্রম সম্পর্কে মুক্তিযােদ্ধাদের সব সময় অবহিত রাখতেন। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের কোনাে এক দিন। সময় আনুমানিক দুপুর ১টা। সে সময় মুক্তিযােদ্ধারা গুপ্তাখালী গ্রামের ডা. রশীদ আল ফারুকীর বাড়িতে অবস্থান করছিলেন (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক, বর্তমানে প্রয়াত)। সংবাদ পাওয়া মাত্রই হাবিলদার খালেক তার সঙ্গীদের নিয়ে চায়ের দোকানের নিকটবর্তী সেকান্দার বাড়িতে পৌঁছেন। সেকান্দর ছিলেন মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্যদানকারী অন্যতম ব্যক্তি। তার বাড়ি থেকে চায়ের দোকান দেখা যেতাে। নুরুল আলমের সাথে ছিল একটি ছাতা। হাবিলদার খালেক নুরুল আলমকে বলেন, রাজাকার চায়ের দোকানে তখন পর্যন্ত অবস্থান করলে ছাতাটি ওপরে তুলে উত্তর দিকে কাত করবেন; আর তারা ওখানে না থাকলে দক্ষিণ দিকে কাত করবেন। নুরুল আলম অধিনায়ক খালেকের কথামতাে চায়ের দোকানে চলে যান। এবং দেখতে পান, রাজাকাররা তখন পর্যন্ত চায়ের দোকানে বসে গল্প করছে। নির্দেশনামতাে তিনি চায়ের দোকান থেকে একটু দূরে গিয়ে ছাতা ওপরে তুলে উত্তর দিকে কাত করে রাজাকারদের উপস্থিতির সংকেত প্রদান করেন।
অপারেশন
অধিনায়ক খালেক তৎক্ষণাৎ সেকান্দরের বাড়ি থেকে সহযােদ্ধাদের নিয়ে চায়ের দোকানের উদ্দেশ্যে রওনা হন। চায়ের দোকান থেকে ১০০ গজ দূরে ছিল একটি পুকুর। সঙ্গীদের নিয়ে পুকুরের পাড়ে এসে অবস্থান গ্রহণ করে অধিনায়ক খালেক ৩০৩ রাইফেল থেকে রাজাকারদের লক্ষ্য করে ফাকা ফায়ার করেন। উদ্দেশ্য ছিল, দোকানে কোনাে সাধারণ মানুষ থাকলে যেন দৌড়ে দূরে চলে যায় এবং এমতাবস্থায় রাজাকাররাও ওখান থেকে বেরিয়ে আসার সাথে সাথে যেন। মুক্তিযােদ্ধারা ফায়ার করতে পারেন। বাস্তবেও প্রায় তা ঘটেছিল। পরে রাজাকার ও মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে গুলি বিনিময় শুরু হয়ে যায়। রাজাকাররা এক পর্যায়ে ফায়ার করতে করতে মুকবুলুর রহমান জুট মিলের দিকে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য যেতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ধাওয়া করেন। শেষ পর্যন্ত রাজাকাররা তাদের অবস্থান মুকবুলুর রহমান জুট মিলের ভিতরে চলে যায়।
ক্ষয়ক্ষতি
এ অপারেশনের ২-৩ দিন পর নুরুল আলম অধিনায়ক খালেককে জানান যে, নজির আহাম্মদ নামে এক রাজাকারের হাতে গুলি লেগেছে। তা ছাড়া রাজাকারদের ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে আর কোনাে তথ্য পাওয়া যায় নি। অপারেশনের পর পাকিস্তানি সেনারা গাড়ির বহর নিয়ে এসে চায়ের দোকানের নিকটবর্তী বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। কিছু লােকজনকেও ধরে নিয়ে যায়। বিশেষ করে শ্রমিক কলােনিতে অবস্থানরত কিছু শ্রমিকসহ গ্রামের অনেককে ধরে নিয়ে যায়। পরে অবশ্য মারধর করে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
বিশ্লেষণ
এ অপারেশনের মাধ্যমে রাজাকারদের ব্যতিব্যস্ত করা গেলেও এটি ছিল একটি অপরিকল্পিত ও অপরিপক্ক অপারেশন। বর্ণিত তথ্য ও প্রাপ্ত চিত্র থেকে এটাই প্রতীয়মান, কৌশলগত অবস্থান গ্রহণের ক্ষেত্রে তেমন বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে সক্ষম হন নি বলে রাজাকাররা নিরাপদে পশ্চাদপসরণ করতে পেরেছিল। তা ছাড়া মুক্তিযােদ্ধাদের রাজাকার ক্যাম্প উৎখাতের যে উদ্দেশ্য ছিল, তা-ও সফল হয় নি। উপরন্তু পাকিস্তানি সেনারা এসে কিছু বাড়িঘর পুড়িয়ে স্থানীয়দের হয়রানির মুখে ফেলে। তবে গেরিলা যুদ্ধের নীতিমালা ও বৈশিষ্ট্যের বিচারে এ অপারেশনটিকে একটি মােটামুটি কার্যকর অপারেশন বলে আখ্যায়িত করা যায়। কেননা, এতে রাজাকারদের শান্তিতে চলাচল বিঘ্নিত হয়। পাকিস্তানি বাহিনীও এ ধরনের। অপারেশনের মুখােমুখি হওয়ার শঙ্কায় সব সময়ই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকতাে। তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা দিলীপ নাথ, দক্ষিণ কাট্টলী, চট্টগ্রাম।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড