You dont have javascript enabled! Please enable it!
মিঠানালা বাের্ড অফিসের রাজাকার-মিলিশিয়া ক্যাম্প আক্রমণ
অবস্থান
মিরসরাই থানা থেকে আনুমানিক ১ মাইল উত্তরে মিরসরাই থানা ও মিঠাছড়া বাজারের মধ্যবর্তী স্থান থেকে একটি কাঁচা রাস্তা (বর্তমানে পাকা) পশ্চিমে সুফিয়াবাজার পর্যন্ত চলে গেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রােড থেকে এ রাস্তা ধরে আড়াই মাইল পশ্চিমে ১০ নম্বর মিঠানালা বাের্ড (ইউনিয়ন পরিষদ) অফিস। এখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার-মিলিশিয়ারা ক্যাম্প স্থাপন করেছিল।
প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য
এ অপারেশন মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক নিজাম এবং মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক অহিদুল হক যৌথভাবে পরিচালনা করেন। উল্লেখ্য, অধিনায়ক অহিদুল হকের বাড়ি ছিল মিঠানালা বাের্ড অফিস থেকে মাত্র ১ মাইল পশ্চিমে সুফিয়াবাজারের নিকটবর্তী মিঠানালা গ্রামে। তাই তাঁর এ এলাকা সম্পর্কে ভালাে ধারণা থাকায় অধিনায়ক নিজাম এ অপারেশন তাঁর সাথে যৌথভাবে সম্পন্ন করার পরিকল্পনা করেন। তারা প্রায়ই খবর পেতেন যে, এ ক্যাম্পে অবস্থানরত রাজাকার-মিলিশিয়ারা প্রায়ই আশপাশের গ্রামে গিয়ে হাঁস-মুরগি, ছাগল, খাসি, এমনকি গরু ইত্যাদি মূল্য প্রদান করেই গ্রামের লােকদের কাছ থেকে নিয়ে আসত। ক্যাম্পে নারীনির্যাতনও ছিল নৈমিত্তিক বিষয়। ক্যাম্প সংলগ্ন বাজারের দোকানদারদের কাছ থেকেও জিনিসপত্র নিয়ে টাকা পরিশােধ করত না। এমনই পরিস্থিতিতে এ দুই মুক্তিযােদ্ধা উপলব্ধি করেন, রাজাকার-মিলিশিয়াদের অত্যাচার থেকে জনগণকে রক্ষা এবং নিজেদের চলাচল সুগম করার জন্য ঐ স্থান থেকে রাজাকার-মিলিশিয়াদের ক্যাম্প উৎখাত করা আবশ্যক।
পর্যবেক্ষণ
এ অপারেশনকালে অধিনায়ক নিজাম ও অধিনায়ক অহিদুল হকের গ্রুপ অংশ নিয়ে সমন্বিতভাবে আক্রমণ চালানাের জন্য পরিকল্পনা করে। তারা সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি (সঠিক তারিখ সগ্রহ সম্ভব হয় নি) অধিনায়ক অহিদুল হকের বাড়ির পার্শ্ববর্তী একটি বাড়ি (আশ্রয় কেন্দ্র) হতে রওনা হয়ে দুপুর আনুমানিক বারােটায় মিঠানালা বাের্ড অফিস এলাকায় পৌছেন। তাঁরা রাজাকার মিলিশিয়াদের ক্যাম্প থেকে আনুমানিক ১০০ গজ দূরে মিঠানালা গ্রামের দাশবাড়িতে একটি উচু স্থানে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ সম্পন্ন করেন। তারা ঐ রাতেই অপারেশন করার পরিকল্পনা করেন।
 
অপারেশন
 
অধিনায়ক নিজাম ও অধিনায়ক অহিদুল হকের যৌথ গ্রুপ পর্যবেক্ষণের দিন রাতেই অপারেশন পরিচালনা করে। তাদের সাথে অস্ত্র ছিল ২টি এলএমজি, ৪টি এসএলআর, ৫টি স্টেনগান ও ২টি পিস্তল। তাঁরা সবাই তাদের আশ্রয় কেন্দ্র থেকে আনুমানিক রাত ১টায় রওনা হয়ে রাত ২টায় মিঠানালা বাের্ড অফিস রাজাকারমিলিশিয়াদের ক্যাম্প এলাকায় পৌছেন। তাঁরা ২টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী অধিনায়ক অহিদের গ্রুপ ১টি এলএমজিসহ বাের্ড অফিসের পশ্চিম পাশে এবং অধিনায়ক নিজামের গ্রুপ ১টি এলএমজিসহ বোের্ড অফিসের দক্ষিণে অবস্থান গ্রহণ করেন। রাত আনুমানিক ২টায় রাজাকার-মিলিশিয়াদের ক্যাম্পকে লক্ষ্য করে ২টি দলই ফায়ার শুরু করে। অন্যদিকে, রাজাকারমিলিশিয়ারাও প্রত্যুত্তরে ফায়ার শুরু করে দেয়। কিন্তু দেখা যায়, মুক্তিযােদ্ধাদের সব অস্ত্রে ফায়ার হলেও অহিদুল হকের এলএমজি থেকে ফায়ার হচ্ছে না। অনুসন্ধান করে অধিনায়ক নিজাম জানতে পারেন, এলএমজি’র ম্যাগাজিনে যেখানে ২৮ রাউন্ড গুলি ভরার কথা, সেখানে ভুলবশত ৩২ রাউন্ড গুলি ভরা হয়েছে। তাই ম্যাগাজিন জ্যাম হয়ে যাওয়ায় ফায়ার হয় নি। ফলে অধিনায়ক নিজাম অধিনায়ক। অহিদুল হকের সাথে সমন্বয় করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, তারা আর ফায়ার না করে পশ্চাদপসরণ করবেন। তাই তাদের আদেশে অন্য মুক্তিযােদ্ধারা ফায়ার বন্ধ করে স্ব স্ব অবস্থান থেকে পশ্চাদপসরণ করে পূর্বনির্ধারিত নির্দিষ্ট স্থানে মিলিত হন।
ভাের আনুমানিক ৪টায় তারা আশ্রয় কেন্দ্রে প্রত্যাবর্তন করেন। আশ্রয় কেন্দ্রে ফিরেই তারা আবার আলােচনায় বসেন এবং সবার মতামতের। ভিত্তিতে অধিনায়ক নিজাম ও অধিনায়ক অহিদুল হক রাজাকার-মিলিশিয়াদের এ ক্যাম্প থেকে সরানাে না পর্যন্ত আক্রমণ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেন। অধিনায়ক নিজাম পরের অপারেশনের সময় এলএমজি’র ফায়ার যাতে কোনােভাবেই বন্ধ না। হয়, সে জন্য নিজেই ফায়ার করার পরিকল্পনা করেন। পরদিনই উভয় গ্রুপের অধিনায়ক ঐ ক্যাম্প আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সব রকমের প্রস্তুতি সম্পন্ন। করেন। পরে উভয় অধিনায়ক তাদের সহযােদ্ধাদের নিয়ে রাত আনুমানিক ২টায় আশ্রয় কেন্দ্র থেকে রওনা হয়ে রাত ৩টায় মিঠানালা বাের্ড অফিস রাজাকারমিলিশিয়াদের  ক্যাম্প এলাকায় পৌঁছেন। তারপর তারা পূর্বের মতােই ২টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাত আনুমানিক সাড়ে ৩টায় নির্দেশ পেয়েই সবাই নিজ নিজ অস্ত্র থেকে ফায়ার শুরু করেন। রাজাকার-মিলিশিয়ারাও ফায়ারের জবাব দেয়। এবার ২টি এলএমজি ফায়ারে রাজাকার-মিলিশিয়ারা বিপদের সম্মুখীন হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে উপায়ান্তর না দেখে তারা ফায়ার বন্ধ করে ক্যাম্প থেকে গােপনে অন্যত্র পালিয়ে চলে যায়। এদিকে মুক্তিযােদ্ধারাও মনে করেছিলেন যে, ক্যাম্পের  ভিতর প্রবেশ করলে হয়ত তারা বিপদের সম্মুখীন হতে পারেন। সে জন্য তারাও পশ্চাদপসরণ করে আশ্রয় কেন্দ্রে প্রত্যাবর্তন করেন। পরে তারা জানতে পেরেছিলেন, রাজাকার-মিলিশিয়ারা ঐ ক্যাম্প সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করেছে।
 
বিশ্লেষণ
 
মিঠানালা বাের্ড অফিসের রাজাকার-মিলিশিয়াদের ক্যাম্পে অপারেশন মুক্তিযােদ্ধাদের অপারেশন পরিচালনাসংক্রান্ত নতুনতর অভিজ্ঞতা অর্জনে সাহায্য করেছে। অর্জিত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে পরবর্তীকালে পাকিস্তানি সেনাদের দারুণভাবে পর্যদস্ত করেছে। অপারেশনের প্রথম দিন এলএমজি’র ফায়ার সম্ভব না হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযােদ্ধারা ফায়ার বন্ধ করে পশ্চাদপসরণ করে চলে গেলেও তারা মনােবলের দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে পড়েন নি। বরং ভুল সংশােধন করে নতুন উদ্যমে পুনরায় অপারেশনে যান। ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে সতর্কতার সাথে পরিকল্পিত পরবর্তী অপারেশন তাদের জন্য সফলতা বয়ে আনে। এতে মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল আরও সুদৃঢ় হয়েছে এবং অদম্য উদ্যমে কাজ করার। অনুপ্রেরণা পেয়েছে। এ অপারেশনের পর রাজাকার-মিলিশিয়া কিংবা পাকিস্তানি। সেনারা মিঠানালা বাের্ড অফিস ত্যাগ করায় জনগণও তাদের অত্যাচার থেকে রেহাই পেয়েছে। তা ছাড়া এতে মিঠানালার মতাে প্রত্যন্ত এলাকায় তাদের আর কোনাে ক্যাম্প থাকে নি। মুক্তিযােদ্ধারাও স্বস্তিতে দিন কাটাতে সমর্থ হন।
তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক আ ফ ম নিজামউদ্দিন, মিরসরাই, চট্টগ্রাম। সম্পাদকের টীকা: এ অপারেশন সম্পর্কে প্রাপ্ত আরও তথ্য এ গ্রন্থের দ্বাদশ অধ্যায়ে সন্নিবেশিত সাক্ষাঙ্কার প্রদানকারীর যুদ্ধ-উত্তর যুদ্ধ বিবরণীতে। দ্রষ্টব্য: দলিল নম্বর ৪০১।

(মিঠানালা বাের্ড অফিসের রাজাকার-মিলিশিয়া ক্যাম্প আক্রমণের নকশাটি দেখুন।
১১২২ পাতায়)

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড

 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!