You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
১৭ই মে, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৩, ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

এশীয় শান্তি সম্মেলন প্রসঙ্গে

এশীয় শান্তি সম্মেলনের আর ছ’দিন বাকী। এই উপলক্ষে গত পরশু ঢাকায় এসেছেন বিশ্বশান্তি পরিষদের সম্পাদক মিঃ ও.পি. পালিওয়াল। এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য এই এশীয় শান্তি সম্মেলনের গুরুত্ব এবং তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর গতিশীল নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলাদেশের জনগণ ও সরকার সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, বর্ণবৈষম্য ও নয়া উপনিবেশবাদবিরোধী বিশ্বের শান্তিকামী শক্তিকে আরো জোরদার করেছে। সম্মেলনে যোগদানকারী সকল দেশ তাই বাঙালী জাতি ও এই জাতি। বিশ্বনন্দিত মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি নিবেদন করবে তাদের প্রাণঢালা শ্রদ্ধা।
বাংলাদেশের মানুষ তথা তাদের প্রাণপ্রতিম নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গতিশীল নেতৃত্ব তথা সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, বর্ণবৈষম্যবাদ এবং নয়া উপনিবেশবাদ বিরোধী আমাদের সংগ্রামের কথা আজ বিশ্বনন্দিত। সুদীর্ঘকালের সংগ্রাম এবং সাধনার মাধ্যমে আমরা নিজেরাও এক সাম্রাজ্যবাদী চক্রের নিকট থেকে আমাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছি। লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছে; প্রাণ-সম্পদহানির এমন দৃষ্টান্ত বিরল। সেই সংগ্রামকে আজ চূড়ান্ত পর্যায়ে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য বাংলাদেশে চলছে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন এবং সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের কাজ। বিশ্বের শান্তিকামী সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মানুষের সাহায্য এবং সহযোগিতা লাভ করে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে তার লক্ষ্য অর্জনের পথে।
নয়া সমাজ গঠনের এই কঠোরতম দিনগুলোতে ভ্রাতৃপ্রতিম দেশসমূহের প্রতিনিধিরা মিলিত হচ্ছেন ঢাকায়। এখানে অনুষ্ঠিতব্য এই সম্মেলনে সাতটি নির্ধারিত বিষয় ছাড়াও পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের বিচার, পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের ফিরিয়ে আনা প্রভৃতি বিষয় গুরুত্ব পাবে বলে মিঃ পালিওয়াল জানিয়েছেন। আমরা শান্তি চাই, শান্তির লক্ষ্যকে সামনে রেখেই আমাদের সকল নীতি নির্ধারিত হয়ে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যে বিষয়গুলো প্রতিবন্ধক বলে বিবেচিত হয়ে থাকে সে সকল বিষয়ে আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি স্থাপনে একের পর এক যে সমস্যাগুলো সৃষ্টি করে চলেছে, ইতিমধ্যে তা নিন্দা কুড়িয়েছে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের কাছে। এশীয় শান্তি সম্মেলনে উপমহাদেশে শান্তি স্থাপনের অন্তরায় এমন বিষয় সমূহ নিয়ে যে আলোচনা হবে তা শান্তি বিরোধী শক্তির উপর কি প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে তা আমরা জানিনা; কিন্তু একটা কথা আমরা বিশ্বাস করি যে, শান্তিকামী মানুষের একতা এবং সংঘবদ্ধ অগ্রাভিযানের মুখে সাম্রাজ্যবাদের ক্ষয়িষ্ণু অস্তিত্ব একদিন সম্পূর্ণরূপে ধসে পড়বে। শান্তি পরিষদ এশীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের স্থান হিসেবে ঢাকাকে নির্বাচিত করে বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামী চেতনাকে যে মর্যাদার আসনে বসিয়েছে সেজন্য আমরা তাদের ধন্যবাদ জানাই। গোটা জাতি এই সম্মেলনের পূর্ণ সাফল্য আশা করে। শান্তিকামী মানুষের এই একতা আরো ব্যাপক এবং দৃঢ় হোক।

সোজা পথে আসতে হবে

গ্রাম বাংলার চালু বহুল প্রচলিত প্রবাদ হলো-বেহায়া বলে রাজাই আমার। পাকিস্তানের বর্তমানে হয়েছে সেই দশা। অসার যুক্তি ধোপে টিকুক আর নাই-ই টিকুকু একটা কিছু বলা চাই। অন্ততঃ বলার জন্যে বলতে হয়। পাকিস্তান চার লক্ষ নিরীহ বাঙালীদের আটক রাখার পরও ন্যায়, সত্য, মানবতা ও মানবাধিকার নিয়ে গলার সুর চড়িয়ে বাংলাদেশবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে শুরু থেকেই। তা করতে গিয়ে কিন্তু পদে পদেই নাজেহাল হচ্ছে পাকিস্তান। সংবাদে প্রকাশ, জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের বিশেষ কমিটিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধির বক্তৃতাদান ঠেকিয়ে রাখার পাকিস্তানী অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। কমিটিতে যুদ্ধবন্দী ও যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রশ্নে পাকিস্তান বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করেছে তার জবাব দানের জন্যই বাংলাদেশের প্রতিনিধির বক্তৃতার প্রয়োজন ঘটে।
কমিটির চেয়ারম্যানে বাংলাদেশের স্থায়ী পর্যবেক্ষক জনাব মোহাম্মদ আলীকে তাঁর বক্তব্য উত্থাপন করতে বললে পাকিস্তানী প্রতিনিধির মর্যাদার প্রশ্ন তুলে তাঁকে বাঁধা দেন। পাকিস্তানী প্রতিনিধি বলেন, জনাব আলী যদি ব্যক্তি হিসেবে বক্তব্য রাখেন তবে তাতে তাঁর আপত্তি নেই; কিন্তু তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখতে চাইলে তাঁর আপত্তি রয়েছে।
পাকিস্তানী প্রতিনিধির আপত্তির প্রশ্নে জাতিসংঘের আইন উপদেষ্টা বলেন, জাতিসংঘের স্থায়ী পর্যবেক্ষক হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে তাঁর বক্তব্য পেশের জন্যে আহ্বান জানানোর কোন অসুবিধা থাকতে পারে না। বাংলাদেশ প্রতিনিধিকে বক্তব্য উপস্থাপিত করতে না দেয়ার মধ্যে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চিরন্তন কায়দাটিই নিহিত। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত কোন ঢাক ঢাক গুড় গুড় নীতিকে অবলম্বন না করে স্পষ্ট কন্ঠে বক্তব্য রেখেছে বিভিন্ন প্রশ্নে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্যই হলো- সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়। এবং জোটনিরপেক্ষতা ও শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের নীতিতে বিশ্বাসী। বিশ্বাসী বলেই যুদ্ধবন্দী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে স্বচ্ছ বক্তব্য রেখেছে। পাকিস্তান যদি বিশেষ উদ্দেশ্যে ও অন্যের হাতে তামাক না খেতো, তাহলে বাংলাদেশ-ভারত যুক্ত ঘোষণাকে সানন্দে অভিনন্দনই জানাতো। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
পাকিস্তান আজ সোজা পথে না গিয়ে উল্টো পথেই যাচ্ছে আর তারই ফলে বাংলাদেশবিরোধী ভূমিকার জন্ম। আর এ কারণেই জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের বিশেষ কমিটিতে বাংলাদেশ প্রতিনিধির বক্তৃতাদান ঠেকিয়ে রাখার ব্যর্থ অপচেষ্টা। কিন্তু পাকিস্তান আজ যে পথেই থাক না কেন সোজা পথে একদিন না একদিন আসতেই হবে। সম্ভবতঃ এ উপমহাদেশের বাস্তব ঘটনাবলী তাই বলে। সত্য, ন্যায় ও মানবতাকে উপেক্ষা করা পাকিস্তানের পক্ষে কোনদিনই সম্ভব হবে না।

ছাত্রভাইদের আন্দোলন সফল হোক

কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে শহীদ মিনার পাদদেশে অনুষ্ঠিত সভায় ছাত্রনেতৃবৃন্দ স্বাধীনতা এবং জাতীয়করণ বিরোধীদেরকে রুখবার দৃঢ়সংকল্পের কথা ঘোষণা করেছেন এবং এজন্যে ছাত্রদের সঙ্গে কৃষক-শ্রমিক আপামর জনতাকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।
মুষ্টিমেয় অসৎ ব্যবসায়ী ও কালো টাকায় ফুলে ফেঁপে ওঠা কিছু সংখ্যক চোরাচালানকারী, মুনাফাখোর ও দুর্নীতিবাজরা সুপরিকল্পিত উপায়ে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙে দেবার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সে কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এদের সঙ্গে স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষিতে জাতীয়করণ কর্মসূচীকে বানচাল করার কাজে দেশী ও বিদেশী চক্রান্ত যে লিপ্ত রয়েছে সে বিষয়েও কোন সন্দেহ নেই। কয়েকদিন আগের স্থানীয় বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় স্বাধীনতা নস্যাৎ করার কাজে একটা চক্র অত্যন্ত তৎপর রয়েছে এবং সে চক্র বিদেশেও সক্রিয় রয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই চক্রান্তে লিপ্ত পাঁচ ব্যক্তিকে পাক প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর চিঠিসহ গ্রেফতার করা হয়েছে বলেও পত্রিকান্তরে জানা গেছে। ভুট্টো সাহেব জেনে শুনে অন্যায়ের সমর্থনে বাংলাদেশ-ভারত উপমহাদেশে অশান্তি জিইয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। এদিকে দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার সুযোগে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সাহায্যের নামে এদেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি বাস্তবায়নে আঘাত হেনে পুঁজিবাদের স্বপক্ষে জনমত গড়ে তোলার কাজে যে সক্রিয় নেই সে কথাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। কেননা পুঁজিবাদী ও সমাজবাদ গোষ্ঠীর আসল লক্ষ্যই তাই। বাংলাদেশর ইতিহাসে দেশের প্রতি ছাত্রদের সংগ্রামী ও ঐতিহ্যপূর্ণ ভূমিকা স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। অতীতে এদেশের ছাত্র সমাজ দেশের সবচাইতে বিপদসঙ্কুল নাজুক পরিস্থিতিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চালিয়ে দেশকে অথৈ সাগর থেকে তীরে ভিড়িয়েছেন। স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানও ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ দুর্বার আন্দোলনের স্রোতে ভেসে গেছেন। সর্বশেষ সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের কথা চির-অক্ষয় হয়ে থাকবে।
আমরা তাই ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ডাককে একটি শুভ আহ্বান বলে মনে করি। তবে সেই সঙ্গে একথাও বলে রাখতে চাই, ইদানীং ছাত্র নামধারী কিছু সংখ্যক যুবক হাইজ্যাকিং, লুটতরাজ ইত্যাদির মাধ্যমে ছাত্রদের যশ যেভাবে বিনষ্ট করছে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে গঠনমূলক পদ্ধতিতে সংগ্রামে এগিয়ে যেতে হবে। বিশৃঙ্খলা কিংবা জনগণের মধ্যে ত্রাসের রাজস্ব কায়েমের মাধ্যমে নয়, সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এই সংগ্রাম এগিয়ে নিতে পারলে আমাদের বিশ্বাস অতীতের ন্যায় এবারের আন্দোলনেও ছাত্র সমাজ বিজয়ের গৌরব লাভ করবেন। দেশ ও জনগণের কল্যাণের স্বার্থে ছাত্র ভাইদের এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সাফল্য আমাদেরও কাম্য।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!