You dont have javascript enabled! Please enable it!
লিচু বাগান রেললাইন অপারেশন
অবস্থান, প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য
নিজামপুর কলেজ রেল স্টেশন থেকে আনুমানিক ১০০ গজ উত্তরে লিচু বাগান সংলগ্ন রেললাইনের নিচে অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন বসিয়ে একটি গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করা হয়। এর উদ্দেশ্য, রেল যােগাযােগ সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন করে পাকিস্তানি সেনাদের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার মাধ্যমে তাদের মনােবল দুর্বল করে দেওয়া এবং মুক্তিকামী জনগণের মধ্যে শুভদিনের আশার সঞ্চার করে তাদের সহযােগিতার হাতকে আরও প্রসারিত করা।
পর্যবেক্ষণ
মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক নিজাম স্থানীয় চেয়ারম্যান আলী আকবর মিয়া ও তার সহযােগী লােকমানকে সঙ্গে নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্র পােদ্দারপাড়া কাসেম সাহেবের বাড়ি থেকে রওনা দিয়ে আনুমানিক বিকাল ৪-৫টায় লিচু বাগান সংলগ্ন রেললাইনের ওপর উপস্থিত হন। আধ ঘণ্টার মধ্যেই প্রয়ােজনীয় পর্যবেক্ষণ সম্পন্ন। করে আশ্রয় কেন্দ্রে ফেরত আসেন। উল্লেখ করা প্রয়ােজন, চেয়ারম্যান আলী। আকবর প্রশিক্ষিত মুক্তিযােদ্ধা না হলেও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক। তার এলাকাতেই অপারেশনের স্থান অর্থাৎ লিচু বাগান সংলগ্ন রেললাইন। সুতরাং স্থানটি সম্পর্কে তার ভালাে ধারণা থাকায় পর্যবেক্ষণে সুবিধা হয়েছিল। স্থানটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে আরও একটি সুবিধা ছিল যে, এর আশপাশে ২০০ গজের মধ্যে কোনাে বাড়িঘর থাকায় মাইন বিস্ফোরিত হলেও বাড়িঘর বা লােকজনের ক্ষতি হওয়ার কোনাে আশঙ্কা ছিল না। স্থানটি নির্জন থাকায় অপারেশনের ক্ষেত্রেও গােপনীয়তা ও নিরাপত্তা সহজতর ছিল। রেললাইনের নিচে পাথর সরিয়ে মাটি খুঁড়ে মাইন বসানাের জন্য বেলচা, কোদাল, শাবল ইত্যাদি চেয়ারম্যানের সহায়তায় স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা হয়। অপারেশন ১৯৭১ সালের ১৮ জুলাই রাত ১২টায় পােদ্দারপাড়া গ্রামের কাসেম সাহেবের বাড়ি (আশ্রয় কেন্দ্র) থেকে অধিনায়ক নিজাম তার সহযােদ্ধা মাে. শফি, সলিমুদ্দিন, নুরুল ইসলাম, আলী আহমেদ, সাহের আহমেদ (সাের্স) এবং আরও কয়েকজনকে নিয়ে লিচু বাগান সংলগ্ন রেললাইনে পরিকল্পিত অপারেশন করার জন্য রওনা দেন।
তাদের সাথে ছিল ২টি স্টেনগান, ২টি পিস্তল, ১টি গ্রেনেড এবং ২টি অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন। তারা অপারেশন স্থানটিতে পৌছেন রাত আনুমানিক ১টায়। সেখানে  পৌছেই স্লিপারের ওপর থেকে পাথর সরিয়ে শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়ে ২টি অ্যান্টিট্যাংক মাইন উভয় রেললাইনের নিচে স্থাপন করেন। তখন রাত দেড়টা। মাইন স্থাপন শেষে তারা আশ্রয় কেন্দ্রে প্রত্যাবর্তন করেন। পরদিন তারা লােকমুখে জানতে পারেন যে, মাইনগুলাে বিস্ফোরিত হওয়ার পর একটি ট্রেনের ইঞ্জিনসহ ৪৫টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে রেল যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়েছে। পরে অবশ্য পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ বিচ্ছিন্ন রেললাইনের মেরামতকাজ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সম্পন্ন করে ট্রেন চলাচলের জন্য উপযােগী করে তােলে। লাইনচ্যুত বগির ভিতর কী ছিল তা জানা যায় নি বলে হতাহত বা ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ সম্ভব হয় নি।

প্রতিক্রিয়া

ইঞ্জিনসহ ৪-৫টি বগি লাইন চ্যুত হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের পূর্ব অভিজ্ঞতা জাত ভীতিকে হতচকিত করে পাকিস্তানি সেনারা আশপাশের বাড়িঘর জ্বালানাের কোনাে উদ্যোগ নেয় নি।

বিশ্লেষণ এ অপারেশনে

পাকিস্তানি সেনাদের মনােবলে যথেষ্ট ফাটল ধরে। কারণ, ইতােমধ্যেই বিভিন্ন গেরিলা কর্মকাণ্ডে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযােদ্ধাদের অদৃশ্য অথচ শক্তিশালী অবস্থান উপলব্ধি করতে শুরু করে। তাদের মনে আরও ধারণা জন্মে যে, কাঁচা-পাকা রাস্তায় কিংবা ব্রিজে শুধু গেরিলা কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ নয়, রেললাইনেও এ রকম কর্মকাণ্ড নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ফলে, তারা নিজেদের নিরাপদ রাখতে প্রয়ােজনে অতিরিক্ত শক্তি ব্যয় করতে বাধ্য হয়। এটি গেরিলা যুদ্ধের অর্জন। জনগণের বসতি থেকে দূরে অপারেশনের স্থান নির্ধারণ করে এবং স্থানীয় লােকদের কাজে লাগিয়ে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করার ক্ষেত্রে অধিনায়ক। নিজাম বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক আ ফ ম নিজামউদ্দিন, মিরসরাই, চট্টগ্রাম। সম্পাদকের টীকা: দ্রষ্টব্যঃ গ্রন্থের দ্বাদশ অধ্যায়ে দলিল নম্বর ৪০১। 

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!