আবুতােরাব বাজারে পাকিস্তানি সেনাদের প্যাট্রলের ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ
অবস্থান
ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রােডের ওপর বারতাকিয়া বাজার হতে একটি রাস্তা (ঐ সময় কাঁচা ছিল, বর্তমানে পাকা) পশ্চিম দিকে চলে গেছে। এ রাস্তার ওপর বারতাকিয়া বাজার হতে আনুমানিক মাইল দুয়েক পশ্চিমে আবুতােরাব বাজার। এ বাজারে প্রতি শুক্র ও সােমবার হাট বসে। বাজারটি একটি ব্যস্ত ব্যাবসায়িক কেন্দ্র। এর আশপাশে স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা ও ইউনিয়ন পরিষদ অফিস বিদ্যমান।
উদ্দেশ্য
পাকিস্তানি সেনাদের ১৫-২০জনের ১টি প্যাট্রল দলের ওপর গ্রেনেড ‘থ্রো’ করে তাদের হতাহত করা এবং মনােবলে আঘাত হানা।
প্রেক্ষাপট
১৯৭১ সালের ১৪ জুই, সময় সকাল ১০টা। মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক নিজাম হতে বছরে অবস্থান করছিলেন। এ সময় তিনি লােক মারফত খবর পান যে, পুস্তিানি সেনাদের ১০-১৫জনের ১টি প্যাট্রল দল বাজারটির দিকে আসছে। উদ্দেশ্য, লুটপাট করা। তৎক্ষণাৎ অধিনায়ক নিজাম বাজার থেকে খানিকটা দূরে তাদের আশ্রয় কেন্দ্র মােস্তফা ডিলারের বাড়ি থেকে ১টি গ্রেনেড নিয়ে আসেন। উল্লেখ্য, বাজার থেকে তাদের আশ্রয় কেন্দ্রের দূরত্ব প্রায় ১০ মিনিটের পথ। তিনি এ ব্যাপারটি তার সহযােদ্ধাদের অবহিত করেন। কিন্তু নিরাপত্তা ও গােপনীয়তা বজায় রাখার স্বার্থে তিনি একাই অপারেশন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
অপারেশন
অধিনায়ক নিজাম গ্রেনেডটি নিয়ে বাজারের পূর্ব পাশে ভােজন সওদাগরের চায়ের দোকানের কোণে নিজেকে আড়াল করে পাকিস্তানি সেনাদের প্যাট্রলের আগমনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকেন। তখন বেলা আনুমানিক সাড়ে ১১টা। এভাবে অপেক্ষায় থেকে দুপুর প্রায় ১২টার দিকে দেখতে পান, পাকিস্তানি সেনাদের প্যাট্রলটি তাঁর। অবস্থান থেকে আনুমানিক ৫০ গজ দূরে এসে উপস্থিত হয়েছে। তিনি লক্ষ্য করেন, পাকিস্তানি সেনারা হেঁটে এলােমেলােভাবে আসছে। তাদের কেউ কেউ রাস্তার পাশের দোকান থেকে কলা, পাউরুটি, সিগারেট ইত্যাদি নিয়ে পথে খেতে খেতে শিথিল ভঙ্গিতে সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছে। এক পর্যায়ে তিনি দেখেন, কয়েকজন
পাকিস্তানি সেনা একসাথে তার অবস্থানের দিকে এগােচ্ছে। দলটি গ্রেনেড গ্রো করার রেঞ্জের মধ্যে আসামাত্রই তাদের লক্ষ্য করে তিনি হাতের গ্রেনেডটি নিক্ষেপ করেন। গ্রেনেড ছুড়েই অধিনায়ক নিজাম বাজারের পশ্চিম পাশের স্কুলের রাস্তা ধরে পশ্চিম দিকে গিয়ে নিজের ক্যাম্পে না উঠে জহুরুল হক সওদাগরের বাড়িতে চলে যান। ঐ বাড়িতে বিশ্রাম নিয়ে পরে তাদের আশ্রয় কেন্দ্রে ফেরত আসেন। পরে জানা যায়, গ্রেনেড নিক্ষেপে ২জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়েছে। পাকিস্তানি সেনারা চলে যাওয়ার সময় এ আহত ও নিহত সঙ্গীদের রিকশা, বেবিট্যাক্সি ইত্যাদিতে তুলে নিয়ে গেছে।
প্রতিক্রিয়া
ঘটনার দিন কোনাে কিছু না করলেও পাকিস্তানি সেনারা অপারেশনের ২ দিন পর আবার গাড়ি নিয়ে আবুতােরাব বাজারে আসে এবং বাজারটি জ্বালিয়ে দেয়। তারা পাশের গ্রামে প্রবেশ করে এবং সেকান্দর মাস্টারকে (স্কুলের শিক্ষক) গুলি করে হত্যা করে।
বিশ্লেষণ
অধিনায়ক নিজামের গ্রেনেড নিক্ষেপে পাকিস্তানি সেনাদের ক্ষতিগ্রস্ত করে বিতাড়িত করা একটি প্রয়ােজনীয় ও সাহসী পদক্ষেপ ছিল। এর মাধ্যমে তিনি প্রকাশ্য দিবালােকেও পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরােধ করার দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, প্রত্যন্তেও তারা নিরাপদ নয়। আর এভাবে প্রতিরােধ না করলে হয়ত তারা বহু নিরীহ ব্যবসায়ীর দোকানপাট লুট, হত্যা ইত্যাদি করত। তার একা গ্রেনেড নিক্ষেপ করা একটি সঠিক সিদ্ধান্ত। এতে যেমন গােপনীয়তা রক্ষিত হয়েছে; পাশাপাশি নিজেদের সম্ভাব্য হতাহতের বিষয়টিকেও তিনি সীমিত করতে পেরেছেন। আপাতভাবে নির্মম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও পাকিস্তানি বাহিনীর। মনােবলের দুর্বলতা তাদের পরবর্তী কার্যক্রম থেকে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিল। অধিনায়ক নিজাম এ গেরিলা অপারেশনের ক্ষেত্রে যে সাহস ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন, তা প্রশংসনীয়। তথ্যসুত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক আ ফ ম নিজামউদ্দিন, মিরসরাই, চট্টগ্রাম। সম্পাদকের টীকা: দ্রষ্টব্যঃ গ্রন্থের দ্বাদশ অধ্যায়ে দলিল নম্বর ৪০১।