You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ৩রা নভেম্বর, রোববার, ১৯৭৪, ১৬ই কার্ত্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

কর্তাব্যক্তিদের দায়িত্বহীনতা এবং গাফিলতি

কে শোনে কার কথা? দেশের অনেক অঘটন সম্পর্কেই তো আগে ভাগে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছিল। কিন্তু গা করবার লোকটি কোথায়? কেন্দ্র থেকে থানা প্রশাসন পর্যন্ত একই অবস্থা। মওজুত, চোরাচালান প্রতিরোধ এমনকি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয়করণ নীতি কার্যকরী করার ব্যাপারে বিভিন্ন সময় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে নানা পরামর্শ অভিজ্ঞ মহল থেকে দেয়া হলেও সরকারী প্রশাসন যন্ত্র সেদিকে খেয়াল করার ফুরসৎ পায়নি। ফলে দিনের পর দিন জটিলতা বেড়েছে, সমস্যা সংকটের রূপ ধারণ করেছে আর সরকারী তহবিলকে গুণতে হয়েছে গচ্চার হিসেব।
ভেড়ামারা জি.কে. প্রজেক্টের একটি ক্যানেলে বহুদিন ধরেই ফাটল ধরেছিল। মাস তিনেক আগে বাংলার বাণীতে এই সম্পর্কিত একটা প্রতিবেদন অবিলম্বে সে ফাটল মেরামতের দিকে দৃষ্টি দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদনও জানানো হয়েছিল। কিন্তু তিন বছরের সেই পুরনো রীতি রেওয়াজ অনুযায়ী ফাটল মেরামতের কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। গত পরশু ভেড়ামারা থেকে আমাদের সংবাদদাতা লিখেছেন সেই ‘ক্যানেল’ পুরোটাই ধসে পড়েছে। রক্ষে এই ক্যানেলে পানি সরবরাহ বন্ধ ছিল। নইলে ক্যানেলের পার্শ্ববর্তী এলাকার বিস্তীর্ণ শস্যক্ষেত জলে ডুবে যেতো।
এটি এমন অসংখ্য ঘটনার একটি। সময় মতো যে কাজ করলে হয়তো স্বল্প ব্যয়েই সম্ভব হতো অসময়ে সেই কাজ করতে গিয়ে অযথা অর্থের অপব্যয় এবং জনগণের দুর্ভোগকেই বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। আসলে উচ্চ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের দায়িত্বহীনতা এবং কর্তব্যে অবহেলার জন্য জনসাধারণকে যে কি পরিমাণ মাশুল যোগাতে হচ্ছে তা প্রতিদিনের খবর থেকেই কিছু না কিছু আঁচ করা যায়।
প্রশাসনিক এই গাফিলতি এবং দায়িত্বহীনতা দূর করবার জন্য গোড়া থেকেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত ছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আজ পর্যন্ত সরকারের তরফ থেকে এ ব্যাপারে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিদান অথবা কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কাগুজে হুমকি যে ফলপ্রসূ হয়নি তা বর্তমান প্রশাসনিক কর্মকান্ড থেকে তারা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পারছেন। আর শুধু সরকারী ব্যবস্থাই যে যথেষ্ট এটাও আমরা বলিনা। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অবশ্যই মানসিক দিক থেকে উন্নত হয়ে গড়ে উঠতে হবে। জনগণের সম্পদ, তাদের স্বার্থে যে দায়িত্বে তিনি অধিষ্ঠিত সে দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে সচেতন থাকা ইত্যাদি মানসিক যোগ্যতা তাকে অবশ্যই রপ্ত করতে হবে। সর্বোপরি থাকতে হবে দেশপ্রেম। এই চেতনা বর্জিত যে সকল ব্যক্তি এখনো নানা দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত আছেন তাদের অনতিবিলম্বে বহিষ্কার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান অন্যান্যদের জন্য নাজির হিসেবে কাজ করতে পারে।

রেল ইঞ্জিন বিকল প্রসঙ্গে

গতকাল বাংলার বাণীতে প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, দেশের সর্বমোট তিনশত পঞ্চাশটি রেল ইঞ্জিনের মধ্যে দুইশত পঁচিশটিই বিকল হয়ে পড়ে রয়েছে। এই বিপুল সংখ্যক ইঞ্জিন অকেজো হয়ে পড়ায় দেশে রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক নিদারুণ অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সংবাদে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের মোট দুইশ’টি স্টীম ও একশ’ পঞ্চাশটি ডিজেল ইঞ্জিন রয়েছে। এর মধ্যে বিকল হয়ে রয়েছে একশ’ চল্লিশটি স্টীম ও পঁচাশিটি ডিজেল ইঞ্জিন। বিভিন্ন প্রকার খুচরা যন্ত্রাংশের অভাবেই ইঞ্জিনগুলো চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। যে সকল যন্ত্রাংশের অভাব সবচেয়ে প্রকট তার মধ্যে রয়েছে, অয়েল বার্ণার, ভেকুয়াম চেম্বার, বিয়ারিং ব্রাশ, তামার পাইপ, কানেকশন, কাউন্টি ব্রাশ ও টেন্ডার। বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষীয় সূত্র উদ্ধৃত করে সংবাদে আরো বলা হয়েছে যে, অকেজো বা বিকল এই বিপুল সংখ্যক ইঞ্জিন চালু করতে হলে কমপক্ষে পাঁচ কোটি টাকার খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানী করতে হবে। অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কিছু যন্ত্রাংশ সময়মতো আমদানী করা হয়নি বলে বর্তমানের চালু ইঞ্জিনগুলোও ক্রমান্বয়ে বিকল হয়ে যাওয়ার পথে রয়েছে। সংবাদে আশংকা করা হয়েছে যদি অবিলম্বে খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানী করে ইঞ্জিনগুলো চালু করা বা চালু রাখা না হয় তাহলে গোটা রেলওয়ে ব্যবস্থা পর্যুদস্ত হয়ে পড়তে পারে। উল্লেখিত সংবাদটি নিঃসন্দেহে একটি নিদারুণ উদ্বেগের ব্যাপার। স্বাধীনতার পর বহু কষ্ট করে দেশের বিপর্যস্ত রেল যোগাযোগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছিল। দেশবাসীর মনে সে কারণে একটি আশাবাদও ফিরে এসেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে নানা কারণে রেল ব্যবস্থায় প্রতিকূল হাওয়া বইতে শুরু করেছে। ইতিপূর্বে বহু রেল দুর্ঘটনা ঘটার জন্যে যাত্রী সাধারণের মনে রেলযাত্রার বিষয়টি আশংকায় পর্যবসিত হয়েছে। তাছাড়া রেলযাত্রার সময়সূচীর কোনো নিয়ম যেমন নেই তেমনি তাতে নিরাপত্তারও বিরাট অভাব রয়েছে। তাই রেল ইঞ্জিনের বিকল হওয়ার ঘটনা একটা সাধারণ ঘটনা বলে যাত্রী সাধারণ আজ মনে করে। বস্তুতঃ দেশের সবচেয়ে বড় যোগাযোগ মাধ্যম হলো রেলওয়ে। এই বিভাগটির যে কোনো বিপর্যয়ই গোটা জাতীয় জীবনের গতিময়তার উপর সরাসরি আঘাত হিসেবে বিবেচিত। কর্তৃপক্ষও এ ব্যাপারে সচেতন বলে আমরা জানতাম। যে কোনো মূল্যেই রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রাখার প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব সম্পর্কেও কর্তৃপক্ষ নিঃসন্দেহে ওয়াকিবহাল রয়েছেন। এতদসত্ত্বেও কেন আজ এই বিপুল সংখ্যক রেল ইঞ্জিন অকেজো হয়ে পড়েছে বরং বাকীগুলোও বিকল হয়ে পড়ার পথে রয়েছে—তা আজ জনমনের জিজ্ঞাসা। খুচরা যন্ত্রাংশের আমদানীর বিষয়টি কর্তৃপক্ষ যদি সময় থাকতে বিবেচনা করতেন তাহলে হয়তো এতো বিপুল সংখ্যক ইঞ্জিন সম্পূর্ণ বিকল হয়ে পড়ে থাকতো না। অন্যদিকে রেল বিভাগটিকে যদি কর্তৃপক্ষ একটি অত্যাবশ্যকীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ বলে মনে করতেন তাহলে নিশ্চয়ই এর প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আমদানীর ব্যাপারে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিকল্পনা নিতেন। কিন্তু উল্লেখিত সংবাদ পড়ে মনে হয়নি কর্তৃপক্ষ তেমন কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমরা তবু আশা করছি রেল কর্তৃপক্ষ যন্ত্রাংশ আমদানী সময়মতো করা সম্ভব হয়নি এই ধরনের অজুহাতের আড়ালে না থেকে গোটা জাতীয় জীবনের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়ার পূর্বেই একটা কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। বর্তমানে উদ্ভূত হাজারো সমস্যায় জর্জরিত জনসাধারণ রেলযাত্রার অবশিষ্ট সুযোগটুকু থেকেও বঞ্চিত হোক এটা আমরা যেমন চাইনা, তেমনি কর্তৃপক্ষও নিশ্চয়ই চান না।

সমবায় দিবসের জিজ্ঞাসা

সমবায় মন্ত্রী জনাব আবদুস সামাদ কর্তৃক সাতরঙা পতাকা উত্তোলন, প্রতিমন্ত্রীর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় সমবায়ীদের যোগদান, রাষ্ট্রপতি, সমবায় মন্ত্রী, উপমন্ত্রী এবং নেতৃস্থানীয় সমবায়ীদের প্রাণবন্ত বাণী ও সারগর্ভ নিবন্ধ সম্বলিত ক্রোড়পত্র প্রকাশ, অধিকন্তু আগের দিন বেতার ও টেলিভিশনে বিভাগীয় মন্ত্রীর সমবায় সম্পর্কে মূল্যবান ও চোখা চোখা কথা বলা—সব মিলিয়ে অন্যান্য বছরের মতো এবারও সংশ্লিষ্ট বিভাগ জাতীয় সমবায় দিবস পালনের ব্যাপারে পূর্ব ঐতিহ্য যে অক্ষুন্ন রেখেছেন তাতে সন্দেহ করার আপাততঃ কোনো অবকাশ ঘটেনি। কারণ এ দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালনের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিভাগের মন্ত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মী পর্যন্ত সবাই অনেক খেটেছেন, বেশ পরিশ্রম যে করেছেন সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় তার সুস্পষ্ট স্বাক্ষর বহন করছে।
স্বাধীনতার বহু পূর্ব থেকে যে সমবায়ের কেতাবী অস্তিত্ব আমরা দেখে এসেছি, স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশের প্রারম্ভ থেকে খবরের কাগজে নেতৃবৃন্দের ভাষণ, অতিকথন এবং সমবায় দিবসে বিভিন্ন ধরনের আনুষ্ঠানিকতার বহর ছাড়া আমরা কার্যকরী কোনো ভূমিকা এ যাবত দেখিনি বলে মুশকিলে পড়েছি আমরা অর্থাৎ গোটা দেশবাসী। কারণ সারা বছরে জাতীয় অগ্রগতির ক্ষেত্রে অশেষ গুরুত্বপূর্ণ এই বিভাগটির কর্মহীনতায় আমরা এর গোটা অস্তিত্বই যখন ভুলতে বসি, তখনই হঠাৎ তড়িঘড়ি করে এসে হাজির হয় সমবায় দিবস। আনুষ্ঠানিকতার জাঁকজমক আর ঠাট বাটে চক্ষু চমকিত হয়ে উঠলে নতুন করে ভাবতে শুরু করি সমবায়ের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে এবং অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য যে, সমবায় নামক কুম্ভকর্ণ বছরের প্রায় অবশিষ্ট কালই গভীর নিদ্রায় অচেতন থাকে।
জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে কৃষি এবং শিল্পের প্রসারের ক্ষেত্রে আজো কোনো দৃষ্টান্তমূলক কর্মতৎপরতা সমবায় বিভাগ প্রদর্শন করতে পারলো না। ব্যাপকভিত্তিক একটা আন্দোলনে কেন সমবায় রূপ নিতে পারছেনা আমাদের পক্ষে বুঝা তা দুষ্কর। তবে আমরা জানি, চাষীদের জমিতে ফলন বৃদ্ধি এবং শিল্পের প্রসারে বাংলাদেশের সমবায় একটা বৈপ্লবিক ভূমিকা গ্রহণ করতে পারতো এই তিনটি বছরেই। কিন্তু তা যখন পারেনি, দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত বাংলাদেশের সমবায় দিবসে সমবায়ীরা আগামী বছরের জন্য তাদের কেতাবী কর্মপদ্ধতির আওতামুক্ত হয়ে একটা সুষ্ঠু কার্যবিধি প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়নে সক্ষম হবেন বলে আমরা আশা রাখি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!