মিরসরাই থানা সদর বাজার থেকে আনুমানিক ৫০০ গজ দক্ষিণে ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রােডের ওপর গােবনিয়া-হেনাপুনি ব্রিজটি অবস্থিত। এটি খুবই পুরাতন একটি ব্রিজ।
উদ্দেশ্য
পাকিস্তানি সেনাদের রসদসামগ্রী, অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ এবং তাদের নির্বিবাদে চলাচলের ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি করার লক্ষ্যে এ অপারেশন পরিচালিত হয়। দল গঠন মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক এ এফ এম নিজামউদ্দিন, সহকারী অধিনায়ক জাহাঙ্গীর (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত), মাে. লােকমান (অন্য একটি অপারেশনে শহীদ), শাহজাহান-১ (মৃত), শাহজাহান-২ (খুলনা), সলিমুদ্দিন, মাে. শফি, নুরুল ইসলাম এবং আরও কয়েকজনসহ মােট ১৫জন।
পর্যবেক্ষণ
১০ জুলাই, ১৯৭১। অধিনায়ক নিজাম ও সহকারী অধিনায়ক জাহাঙ্গীর তাদের আশ্রয় কেন্দ্র আবুতােরাব বাজারের মােস্তফা ডিলারের বাড়ি থেকে রওনা হয়ে মেঠোপথ ধরে গােবনিয়া গ্রামের মধ্য দিয়ে পথচারীর বেশে আনুমানিক বিকাল সাড়ে ৫টায় গােবনিয়া-হেনাপুনি ব্রিজের কাছে পৌছেন। তাদের সাথে ছিল ২টি পিস্তল এবং ২টি ছাতা। ছাতা রাখার উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের বৃষ্টি থেকে রক্ষা করা, স্থানীয় গুপ্তচরদের থেকে নিজেদের যথাসম্ভব আড়াল করা এবং প্রয়ােজনের তাগিদে ব্রিজের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ মেপে এক্সপ্লোসিভের পরিমাণ নির্ণয় করা। এ ব্রিজে কোনাে পাকিস্তানি সেনা বা রাজাকার প্রহরারত ছিল না। তবে প্রায় ৫০০ গজ উত্তরে মিরসরাই হাই স্কুলের দোতলায় আনুমানিক ৩০জন পাকিস্তানি সেনা ও মুজাহিদ ছিল। পর্যবেক্ষণের জন্য তারা দিনের বেলাকেই বেছে নেন। কারণ, দিনের বেলায় সবকিছু ভালােভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় বলে রাতের অন্ধকারে অপারেশন করতে কোনাে সন্দেহ বা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় না। তারা ১০-১৫ মিনিট সময়ে প্রয়ােজনীয় কিছু বিষয় পর্যবেক্ষণ করে আশ্রয় কেন্দ্রে নিরাপদে ফিরে আসেন। সুকৌশলে পর্যবেক্ষণজাত বিষয়গুলাে নিম্নরূপ: ক. ছাতা দিয়ে মাপা ব্রিজের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ছিল যথাক্রমে ২৮ ফুট ও ১৪ ফুট।
খ. ব্রিজের নিচে ২টি গার্ডার আছে।
গ. ব্রিজের নিচের ছড়াটি পূর্ব-পশ্চিমে প্রবহমান এবং বর্ষাকাল হওয়ায় এতে পানির গভীরতা ৫-৬ ফুট।
ঘ. ব্রিজের ওপর দুই পাশে ২টি রেলিং ।
ঙ. অপারেশনের পর পশ্চাদপসরণের জন্য পর্যবেক্ষণ করতে আসা রাস্তাটিই বেশি উপযােগী।
পরিকল্পনা
পর্যবেক্ষণের পর আশ্রয়স্থলে ফিরে গিয়েই তারা অন্যান্য সহযােদ্ধার সাথে রাত আনুমানিক ৯টায় অপারেশনের পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য আলােচনায় বসেন। আলােচনার মাধ্যমে তারা সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ব্রিজটি কার্যকরভাবে ধ্বংস করতে ১২০ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ, ৪টি প্রেসার চার্জ, ১০০ গজ ডিটোনেটর কর্ড এবং ১টি পুল সুইচ মার্ক-৪ প্রয়ােজন হবে। তা ছাড়া পরিকল্পনার আওতায় অস্ত্রশস্ত্রের হিসেবের মধ্যে ১টি এলএমজি, ২টি ৩০৩ রাইফেল, ৪টি স্টেনগান, ২টি পিস্তল এবং সংকেত প্রদানের জন্য ১টি সিগন্যাল পিস্তল রাখা হয়।
দল বিন্যাস
অধিনায়ক নিজাম পরিকল্পনা মােতাবেক অপারেশন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য তার দলকে বিভিন্ন গ্রুপে বিন্যস্ত করেন। এ দল বিন্যাসের আওতায় তিনি নির্ধারণ করেন যে, ২টি বিচ্ছিন্নকর ন বা Cut off party ব্রিজের পশ্চিম দিকে দুই পরে হবে ব্রজের উত্তর পাশের বিচ্ছিন্নকারী দলে ২জন মুক্তিযােদ্ধা থাকবে এবং উনের সাথে দেওয়া হবে ১টি স্টেনগান ও ১টি ৩০৩ রাইফেল। ব্রিজের দক্ষিণ পাশের বিচ্ছিন্নকারী দল ২জন মুক্তিযােদ্ধা এবং তাদের সাথে থাকবে ১টি স্টেনগান ও ১টি .৩০৩ রাইফেল। অ্যামবুশ পার্টি রাখা হবে ব্রিজের পশ্চিম দিকে ছড়ার দক্ষিণ পাড়ে। এ পাটিতে থাকবে ২জন মুক্তিযােদ্ধা এবং তাদের সাথে দেওয়া হবে ১টি এলএমজি ও ১টি স্টেনগান। অধিনায়ক ও সহকারী অধিনায়কের অবস্থান হবে ব্রিজ থেকে ১০০ গজ পশ্চিমে ঠিক ছড়ার উত্তর পাড়ে। তা ছাড়া। একটি প্যাট্রল পার্টি ব্রিজের পশ্চিম দিকে আনুমানিক ২০০ গজ দূরে ছড়ার পাড়ে ১টি স্টেনগান হাতে টহলরত থাকবে।
অপারেশন
অপারেশনের জন্য ১৫জন মুক্তিযােদ্ধা এক্সপ্লোসিভ ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রসহ লক্ষ্যস্থলের দিকে রওনা হন। তন্মধ্যে ৫জন ব্রিজের ওপর এক্সপ্লোসিভ ও প্রয়ােজনীয় সামগ্রী পৌছে দেওয়ার পরই আশ্রয় কেন্দ্রে ফিরে যান। ব্রিজের চার কোণে গার্ডারের পাশে শাবল দিয়ে মাটি গর্ত করে প্রতি গর্তে ৩০ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ স্থাপন করা হয়। তারপর ডিটোনেটর কর্ড দিয়ে ৪টি এক্সপ্লোসিভকে একসাথে সংযােগ করে অধিনায়ক নিজাম প্রধান কর্ডটি তার কাছে রাখেন। পরে তিনি প্রধান কর্ডের সাথে ‘পুল সুইচ’-এর সংযােগ করেন। সময় তখন রাত আড়াইটা। পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু লাগানাে শেষ হলে সবাই নিজ নিজ অবস্থান গ্রহণ করেন। রাত আনুমানিক ৩টায় অধিনায়ক নিজাম পুল সুইচ চেপে ব্রিজটিতে স্থাপিত এক্সপ্লোসিভের বিস্ফোরণ ঘটান। একটু পরই পাকিস্তানি সেনারা মিরসরাই হাই স্কুলের দোতলা ভবন থেকে বিস্ফোরণের’ শব্দের দিক অনুমান করে গুলি চালাতে থাকে। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধারা ততক্ষণে তাদের অস্ত্রের কার্যকর আওতার বাইরে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, মুক্তিযােদ্ধাদের উদ্দেশ্য ছিল, শুধু ব্রিজটি ধ্বংস করা; রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী পাকিস্তানি সেনাদের গাড়ি ধ্বংস করা নয়। বরং তাদের চলাচল ব্যাহত করা। কারণ, ঐ সময় মুক্তিযােদ্ধারা অসম শক্তি। পাকিস্তানি সেনাদের সাথে যুদ্ধ এড়িয়ে চলতেন। ক্ষয়ক্ষতি ব্রিজের স্ল্যাব সম্পূর্ণভাবে ধসে যায় এবং সেটি চলাচলের অনুপযােগী হয়ে পড়ে। পরে বেইলি ব্রিজ তৈরি করে পাকিস্তানি সেনারা ব্রিজটিকে তাদের চলাচলের উপযােগী করে তােলে।
বিশ্লেষণ
এ অপারেশনের পর মুক্তিযােদ্ধাদের যুদ্ধ সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস প্রচণ্ডভাবে বৃদ্ধি পায়। তা ছাড়া দলের ভিতর সবার মধ্যে শৃঙ্খলাবােধ জাগরিত হয় এবং কমান্ড চ্যানেল সুদৃঢ় হয়। অধিনায়ক নিজাম উল্লেখ করেন, তিনি বুঝেছিলেন যে ব্রিজে চার গুণ বেশি এক্সপ্লোসিভ লাগানাে গেলে ক্ষতি আরও ব্যাপক হতাে। তাহলে হয়ত পাকিস্তানি সেনাদের বেইলি ব্রিজের দ্বারা এটি চলাচল উপযােগী করতে বেশি সময় লাগত। এতে বােঝা যায় যে, সে সময় মুক্তিযােদ্ধারা অপারেশনের জন্য যতটুকু এক্সপ্লোসিভ পেতেন, তা ছিল প্রয়ােজনের তুলনায় অপ্রতুল। তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক আ ফ ম নিজামউদ্দিন, মিরসরাই, চট্টগ্রাম। আরও দ্রষ্টব্য: এ গ্রন্থের দ্বাদশ অধ্যায়ের দলিল নম্বর ৪০১।