ভােরের বাজার পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প অপারেশন
অবস্থান বারৈয়াঢালা রেল স্টেশনের খানিকটা দক্ষিণ পাশ দিয়ে পশ্চিম দিকে বহমান কাঁচা রাস্তাটির ওপরে ভােরের বাজার অবস্থিত। এ বাজারের উত্তরপশ্চিম কোণে টিনের বেড়া ও চালের তৈরি একটি মন্দির। মন্দিরটি সে সময় ছিল ফাঁকা। জুলাইয়ের শেষ দিকে অথবা আগস্টের প্রথম দিকে (অপারেশনের সঠিক তারিখ সগ্রহ করা যায় নি) ভােরের বাজার মন্দিরে পাকিস্তানি সেনারা ক্যাম্প স্থাপন করে। ঐ এলাকায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চলাচলের পথে বিশ্রামের স্থান হিসেবে ক্যাম্পটি ব্যবহৃত হতাে। তাদের সহযােগী রাজাকার, আলবদর ও আলশামসসহ এখানে কমবেশি ২০জনের একটি শত্রু দল থাকত। মুক্তিযােদ্ধারা ক্যাম্পটি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। উদ্দেশ্য মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক এস এম খুরশিদ আলম সাের্সের মাধ্যমে জানতে পারেন যে, পাকিস্তানি সেনারা আশপাশের এবং দূরদূরান্তের গ্রাম থেকে নারীদের ধরে এনে মন্দিরে রেখে পাশবিক নির্যাতন করছে। পাকিস্তানি সেনাদের নারীনির্যাতন বন্ধ এবং ক্যাম্পটি ঐ স্থান থেকে অন্যত্র সরানাের মাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধাদের চলাচল সুবিধাজনক করে তােলার উদ্দেশ্যে মন্দিরে আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। পর্যবেক্ষণ আক্রমণ পরিচালনার পরিকল্পনার জন্য এক দিন রাত আনুমানিক ১১টায় অধিনায়ক এস এম খুরশিদ আলম, মুক্তিযােদ্ধা শামসুল আলম টিপু, আবদুল জলিল ভূইয়া এবং আব্দুল লতিফকে সঙ্গে নিয়ে মহালঙ্কা গ্রামের আশ্রয় কেন্দ্র থেকে দারােগা বাজারের দক্ষিণ পাশ দিয়ে ট্রাংক রােডে ওঠেন। পরে ভােরের বাজারের পশ্চিম পাশে সরে যান। মন্দিরের সাথেই ছিল একটি বড়াে বটগাছ।
গাছটির একটি দীর্ঘ শাখা খুব নিচু হয়ে পশ্চিম দিকে খােলা মাঠ পর্যন্ত প্রসারিত। অধিনায়ক খুরশিদ গাছটির ডাল বেয়ে মন্দিরের ওপর টিনের চাল পর্যন্ত যান। সেখান থেকে টিনের বেড়া ও চালের মাঝখানের ফাক দিয়ে দেখতে পান যে, মন্দিরের ভিতর সাধারণ পােশাক পরিহিত ৪-৫জন লােক কলকি দিয়ে সম্ভবত নেশা করছে। ২জন লােক উর্দুতে কথাবার্তা বলছিল। অন্যদিকে, খাকি পােশাক পরা ২জন পাকিস্তানি সেনা একটি মেয়ের ওপর পাশবিক নির্যাতন করছিল। তখন রাত আনুমানিক দেড়টা। অধিনায়ক খুরশিদের সাথে ছিল ১টি রিভলভার ও ২টি হ্যান্ড গ্রেনেড। তিনি আগেই তার সহযােদ্ধা শামসুল আলমকে মন্দিরের উত্তরপশ্চিম কোণে, আবদুল জলিল ভূঁইয়াকে মন্দিরের পশ্চিম পাশে এবং আবদুল লতিফকে মন্দিরের দক্ষিণপশ্চিম কোণে রাস্তার ওপর পুকুরের পাড়ে অবস্থান নিতে বলেছিলেন। তাঁদের সাথে যথাক্রমে ৪টি হ্যান্ড গ্রেনেড, ১টি এসএমসি এবং ১টি ৩০৩ রাইফেল ছিল। অধিনায়ক খুরশিদ বুঝতে পারেন যে, অন্যান্য অপকর্মের সাথে এ ক্যাম্পটি নারীনির্যাতন কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। এ পৈশাচিক দৃশ্যে ভীষণ ক্ষুব্ধ হলেও তখনই আক্রমণ না করে যথাসম্ভব বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ শেষে তিনি অন্য ৩জন সহযােদ্ধাকে নিয়ে ভােররাতের মধ্যে আশ্রয় কেন্দ্রে ফিরে যান।
পর্যবেক্ষণ-পরবর্তী প্রস্তুতি
আশ্রয় কেন্দ্রে মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক খুরশিদ তার সহযােদ্ধাদের নিয়ে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আলােচনায় বসেন। আলােচনায় সিদ্ধান্ত হয় যে, তারা পাকিস্তানি সেনাদের ভােরের বাজার মন্দিরের ক্যাম্প বান্দরওলা’ (মিরসরাইয়ের আঞ্চলিক ভাষায় বান্দরওলা একটি বুনাে গাছের ফল বিশেষ ফলটি দেখতে বুনাে তেঁতুলের মতাে আঙুল খানেক লম্বা। এর গায়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কেশর রয়েছে। এগুলাে শরীরে লাগলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রচণ্ড ও অবিরাম চুলকানি শুরু হয়। শরীরও লাল হয়ে ফুলে যায়) দিয়ে অপারেশন পরিচালনা করবেন। কারণ, বিমান অস্ত্র দিয়ে শত্রুদের সাথে মােকাবিলা করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া এতে সীমিত গােলাবারুদেরও সাশ্রয় হবে। ২ দিন পর বড়াে কমলদহ গ্রামের রিয়াজ উদ্দিন ভূঁইয়ার ছেলে আবুল কাসেমের সহযােগিতায় পার্শ্ববর্তী পাহাড় থেকে ‘বান্দরওলা সংগ্রহ করা হয়। পরে অধিনায়ক খুরশিদ গ্লাভস পরে বান্দরওলা থেকে কেশরগুলাে পলিথিনের ওপরে জমা করে পরে জর্দার কৌটার মধ্যে রাখেন। রেকি শেষে এভাবে সিদ্ধান্ত ও প্রয়ােজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করার ৪ দিন পর তারা ক্যাম্পটিতে অপারেশন করার জন্য যান।
অপারেশন
অপারেশনের জন্য নির্দিষ্ট রাতের আকাশ ছিল মেঘলা মাঝে মাঝে থেমে থেমে ঝড়াে হাওয়াও বইছিল। পরিকল্পিত এ অপারেশনের জন্য অত্যন্ত উপযােগী আবহাওয়া অধিনায়ক এস এম খুরশিদ তার সহযােদ্ধাদের নিয়ে অপারেশন করার জন্য পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প এলাকায় পৌছেন। অধিনায়কের নির্দেশে আগের মতাে ১জন মন্দিরের উত্তরপশ্চিম কোণে ২টি হ্যান্ড গ্রেনেড, ১জন মন্দিরের পশ্চিম পাশে ১টি এসএমসি ও ২টি হ্যান্ড গ্রেনেড এবং ১জন মন্দিরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ১টি .৩০৩ রাইফেল ও ২টি হ্যান্ড গ্রেনেডসহ পুকুরের পাড়ে অবস্থান নেন। অধিনায়ক খুরশিদ ১টি রিভলভার, বান্দরওলার কেশর ভরতি জর্দার কৌটা ও ১টি ম্যাচ বক্স নিয়ে বটগাছের ডাল বেয়ে মন্দিরের ওপর ওঠেন। অধিনায়ক খুরশিদ তাঁর সহযােদ্ধাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, তিনি যদি কোনাে বিপদের সম্মুখীন হন, তাহলে তিনি ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে সংকেত দেবার সাথে সাথে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে পুকুরের পাড়ে অবস্থানরত সহযােদ্ধারা কভারিং ফায়ার দিতে থাকবেন। একইভাবে মন্দিরের উত্তরপশ্চিম কোণে অবস্থানরত সহযােদ্ধা ১টি হ্যান্ড গ্রেনেড ভিতরে নিক্ষেপ করবেন। তা ছাড়া মন্দিরের পশ্চিম পাশে অবস্থানরত সহযােদ্ধাও তার এসএমসি থেকে কভারিং ফায়ার দিতে থাকবেন। বটগাছের ডাল বেয়ে উঠে অধিনায়ক খুরশিদ মন্দিরের টিনের চালা ও বেড়ার ফাক দিয়ে দেখতে পান যে, ৬-৭জন খাকি পােশাক পরা পাকিস্তানি সেনা ফ্লাস্ক থেকে সিলভারের গ্লাসে চা ঢেলে পাউরুটি দিয়ে খাচ্ছে। তাদের পাশে ৪-৫টি চাইনিজ রাইফেল রয়েছে। তাদেরই পাশে কালাে পােশাক পরা ৪-৫জন বসে ৩০৩ রাইফেল পরিষ্কার করছে। মন্দিরের উত্তরপশ্চিম কোণে খাকি ড্রেস পরা।
৪জন দুই অসহায় নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতনরত। তা ছাড়া তাদের পাশে অবস্থানরত ৩-৪জন তাদেরকে একটি বােতল থেকে গ্লাসে ঢেলে কিছু একটা। খাওয়াচ্ছে। উল্লেখ্য, অস্ত্র পরিষ্কারক ও নারীনির্যাতনকারী পাকিস্তানি সেনারা কিছুটা নেশাগ্রস্ত ছিল। অধিনায়ক খুরশিদ এ সময় জর্দার কৌটার মুখ খুলে ম্যাচের কাঠি দিয়ে আস্তে আস্তে দক্ষিণ দিক থেকে আসা দমকা হাওয়ার গতিপথে ‘বান্দরওলার কেশরগুলাে ছিটাতে শুরু করেন। কেশরগুলাে বাতাসে উড়ে মন্দিরের মেঝেতে ও পাকিস্তানি সেনাদের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় সাথে সাথেই পাকিস্তানি সেনারা। নিজেদের ঘাড় ও সমস্ত শরীর চুলকাতে শুরু করে। এক পর্যায়ে জর্দার কৌটা থেকে সব কেশর বাতাসের গতির দিকে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। ২০ মিনিটের মধ্যেই। দেখা যায়, পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের সহযােগীরা যার যার অবস্থান থেকে দাড়িয়ে গায়ের কাপড় খুলে ফেলছে। কয়েকজন শরীরের সম্পূর্ণ পােশাকই খুলে ফেলে। তারা পরস্পরের দিকে এবং চারদিকে তাকাতে শুরু করে। এক পর্যায়ে তাদের একজন বাঙালি সহযােগী বলে ওঠে, “বান্দরওলা কৈতুন আইলাে।” শুনে অধিনায়ক খুরশিদ নিঃশব্দে হাসলেন। পরে দেখা গেল, চুলকানির তীব্রতায় অস্থির পাকিস্তানি সেনাদের কেউ কেউ মন্দিরের ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়েছে। তাদের কেউ কেউ মেঝের ওপর গড়াগড়ি দিতে থাকে। এমতাবস্থায় অধিনায়ক খুরশিদ ওখানে আর দেরি করা ঠিক হবে না ভেবে ডাল বেয়ে মাটিতে নেমে সবাইকে নিয়ে গোপন আশ্রয় কেন্দ্রে প্রত্যাবর্তন করেন। সাের্সের মাধ্যমে পরে জানা যায়, পাকিস্তানি সেনারা পরদিন ওখান থেকে সবকিছু গুটিয়ে চলে গিয়েছিল।
প্রতিক্রিয়া
এই অপ্রত্যাশিত ও অভূতপূর্ব ঘটনায় পাকিস্তানি সেনাদের মনে মানসিক উদবেগ। ও ভীতির সৃষ্টি হয়। ভীত সন্ত্রস্ত পাকিস্তানি সেনারা আর মন্দির এলাকায় যায় নি। ফলে গ্রামবাসী তাদের দুর্বিষহ অত্যাচার ও জ্বালানােপােড়ানাের হাত থেকে রক্ষা পায়। মুক্তিযােদ্ধাদেরও মনােবল সুদৃঢ় হয়।
বিশ্লেষণ
সম্পূর্ণ অভিনব কৌশলের মাধ্যমে এ অপারেশনটি সম্পন্ন হয়। পর্যবেক্ষণজাত তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ ক্যাম্পটিতে নিরাপত্তার জন্য তেমন কোনাে ব্যবস্থা ছিল না। যে-কোনাে সামরিক স্থাপনায় যুদ্ধকালীন প্রহরার ব্যবস্থা রাখা একটি অপরিহার্য বিষয়। অথচ এ ক্ষেত্রে প্রহরীরাও ঘরের ভিতর আলস্য ও ভােগবিলাসে মত্ত ছিল। এ ধরনের লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করা অত্যন্ত সহজতর। কেননা, এ রকম পরিস্থিতিতে আকস্মিক বিজয় অর্জন করা ছিল অত্যন্ত সহজ একটি কাজ। মুক্তিযােদ্ধাদের উদ্দেশ্য ছিল এ মন্দির থেকে পাকিস্তানি সেনাদের বিতাড়ন। তাই কম জনবল নিয়ে সরাসরি ক্যাম্প আক্রমণের ঝুঁকি না নিলেও ব্যক্তিগতভাবে অধিনায়ক খুরশিদ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও সাহসিকতার সাথে তাঁর উদ্ভাবিত প্রাকৃতিক ও অভিনব ‘বান্দরওলা’ পদ্ধতি ব্যবহার করতে সক্ষম হন। তবে লক্ষ্যবস্তুর বেসামাল অবস্থায় সুযােগ পরিপূর্ণভাবে নিতে কিছুটা সিদ্ধান্তহীনতার ছাপ পাওয়া
যায়। সৈনিকেরা মন্দিরের বাইরে বেসামাল অবস্থায় বেরিয়ে আসার পর গ্রেনেড ব্যবহার করলে হয়তাে এ অপারেশনের মাধ্যমে আরও সাফল্য অর্জন সম্ভব হতাে। তবু স্বল্প প্রচেষ্টার মাধ্যমে শুধু বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে এ অপারেশনের সাফল্য অপ্রতুল। নয়। তদুপরি গােলাবারুদ ব্যয় না করে স্থানীয় প্রাকৃতিক উদ্ভিদ ব্যবহারের মাধ্যমে এ রকম একটি অপারেশন পরিচালনা করাও মুক্তিযােদ্ধাদের অনন্য কৃতিত্ব – এ মন্তব্য বাহুল্য হবে না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এ রকম অসংখ্য বুদ্ধিদীপ্ত ঘটনা সম্ভবত এখনাে অনুঘটিত। তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক এস এম খুরশিদ আলম, মিরসরাই, চট্টগ্রাম।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড