You dont have javascript enabled! Please enable it!
দক্ষিণ চট্টগ্রাম জেলা-রাঙ্গুনিয়া-বান্দরবান-মিজোরাম
মুক্তিযােদ্ধাদের ভারত যাতায়াত পথের মধ্যে রাঙ্গুনিয়া-বান্দরবান-মিজোরাম ছিল সবচেয়ে কষ্টসাধ্য। দক্ষিণ জেলা, রাঙ্গুনিয়া-রাউজানের যােদ্ধাদের এক অংশ এ পথ ব্যবহার করত। অন্য দুটি পথ সম্পূর্ণ বিপৎসংকুল হয়ে পড়লে অন্য অঞ্চলের যােদ্ধাগণ এবং অধিক তৎপর ও পরিচিত মুক্তিযােদ্ধারা এ পথ ধরে যাতায়াত করতেন। দুর্গম ও বন্ধুর পাহাড়-পর্বতমালা, জঙ্গল ও পাকিস্তানি সহযােগী পাহাড়িদের বিরােধিতা ছিল তাদের এখানকার নিত্যসঙ্গী। যে-সকল মুক্তিযােদ্ধা ভারত গমন এবং দেশে প্রবেশের জন্য এ পথ ব্যবহার করেছিলেন, তাদের সবাইকে কমবেশি বিপদের মুখােমুখি হতে হয়েছিল। চলাচলের সময় শত্রুর চোখকে ফাকি দেওয়ার জন্য তারা মূলত রাতের অন্ধকারকে কভার হিসেবে ব্যবহার করতেন। এ রকম একটি ঘটনা নিচে উল্লেখ করা হলাে: ..দক্ষিণ চট্টগ্রামের একদল মুক্তিযােদ্ধা ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বিভিন্ন অপারেশনের পর পুনরায় অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের জন্য ভারত যাওয়ার জন্য মনস্থির করেন। তাদের সাথে কয়েকজন নতুন। মুক্তিযােদ্ধাকে ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য নেয়া হচ্ছিল। অধ্যাপক শামছুল ইসলামের নেতৃত্বে এ দলে সদস্য ছিলেন গােলাম কিবরিয়া, আবদুল লতিফসহ ২১জন। পটিয়া থেকে তারা বেলা ৩টার দিকে হেঁটে পাহাড়ি পথ ধরে তিন থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা হাঁটার পর যখন একজন পাহাড়ি উপজাতির সাহায্যে কাপ্তাইয়ের রাজস্থলী পৌছেন, তখন সন্ধ্যা।
একজন উপজাতি টাকার বিনিময়ে মুক্তিযােদ্ধাদের পথ দেখিয়ে বরকল সীমান্ত পর্যন্ত পৌছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। উপজাতি পথপ্রদর্শক সন্ধ্যার পর মুক্তিযােদ্ধাদের রাজস্থলীস্থ একটি প্রাইমারি স্কুলে রেখে শেষ রাতে পুনরায় ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে যায়। উপজাতি পথপদর্শক ১৬ পাঞ্জাব কমান্ডাে রেজিমেন্টের ক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের তথ্য জানায়। এ খবর পেয়ে পাকিস্তানি সেনারা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে স্কুলটিতে আক্রমণ করে, সে সময় মুক্তিযােদ্ধারা ঘুমানাের আয়ােজন করছিলেন। কেউ কেউ গল্পগুজব করছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ টের পেয়ে অনেকে টেবিল ও বেঞ্চের ওপর থেকে নেমে মাটিতে শুয়ে পড়েন। কেউ কেউ নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে হামাগুড়ি বা ক্রলিং করে এদিক-সেদিক ছড়িয়ে পড়েন। স্কুলের ভিতর থেকে সাড়াশব্দ না পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনী প্রায় চারদিক থেকেই হালকা মেশিনগানের সাহায্যে গুলি বর্ষণ করতে থাকে। স্কুলে অবস্থানরত অবশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধারা পাল্টা গুলি বর্ষণ কিংবা প্রতিরােধের চেষ্টা না করে নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র জানালা দিয়ে বাইরে জঙ্গলের মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন। যাতে ধরা পড়লে কোনাে অস্ত্রশস্ত্র তারা না পায়।

 
অবশ্য যযাদ্ধাদের সবাই মেঝেতে শুয়ে থাকায় কারাে গায়ে গুলি লাগে নি। এভাবে প্রায় ৩০-৫০ মিনিট ব্যাপক গুলি বর্ষণের পর পাকিস্তানি সৈন্যরা রুমের ভিতর প্রবেশ করলে উপস্থিত সবাই আত্মসমর্পণ করেন। পাকিস্তানি সেনারা সবাইকে বেঁধে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং পরদিন সকালে একজন একজন করে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। মুক্তিযােদ্ধারা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, পথিমধ্যে পাকিস্তানি সেনারা জিজ্ঞাসাবাদ করলে সবাই বলবে, তারা গরু ব্যবসায়ী হিসেবে এলাকায় এসেছেন। এভাবে সবাই একই কথা বলতে থাকলে পাকিস্তানি সেনারা মান্নান, আবদুল লতিফ ও গােলাম কিবরিয়াকে রেখে বাকি সবাইকে ছেড়ে দেয়। তারপর ৩জনকে রাজস্থলী থেকে লঞ্চে করে কাপ্তাই ক্যাম্পে এবং সেখান থেকে রাঙামাটি সদর ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে এঁদেরকে আটকে রেখে প্রায় দু’মাস নির্যাতন করার পর ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে সাধারণ ক্ষমার আওতায় তাদের ছেড়ে দেয় (তথ্যসূত্র: মুক্তিযােদ্ধা গােলাম কিবরিয়া বাবুল)। দক্ষিণ চট্টগ্রামের মুক্তিযােদ্ধাদের ভারত গমনের অন্য একটি ঘটনা থেকে এ পথের বিপদ এবং মুক্তিযােদ্ধাদের যাতায়াত পথের বিপৎসংকুল পরিবেশের চিত্র ফুটে ওঠে। পটিয়ার ধােপাছড়িতে দক্ষিণ চট্টগ্রামের এক দল মুক্তিযােদ্ধা পটিয়া সুলতান আহমদ কুসুমপুরী এমপিএ-এর নেতৃত্বে অবস্থান নেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, ২-১ দিন অবস্থান করে প্রশিক্ষণ ও গােলাবারুদ সংগ্রহের জন্য ভারতের উদ্দেশ্যে গমন করা। কিন্তু ধােপাছড়িতে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের পর পুরাে দলটি আর অপেক্ষা করে ভারতের উদ্দেশ্যে গমন করার সিদ্ধান্ত নেয়। সন্ধ্যার পর পর পুরাে দল হেঁটে পটিয়া থেকে পাহাড়ি পথ ধরে রাঙ্গুনিয়ার দিকে রওনা হন। দুপুর থেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে দলের অধিকাংশ সদস্য ক্লান্ত হলেও পথ চলতে থাকে যাতে রাত থাকতে থাকতে একটি নিরাপদ আশ্রয়ে পৌছানাে যায়।
 
আনুমানিক ৬০জনের দলটি রাঙ্গুনিয়া পৌছার পর এ এলাকায় অপারেশন পরিচালনাকারী সুবেদার টি এম আলী তাদের সাথে যােগ দেন। পুরাে দল সারারাত হাঁটার পর ভােররাতের দিকে সবাই এতই ক্লান্ত হয়ে পড়ে যে, অনেকেই আর হাঁটতে পারছিলেন না। বিশেষ করে সুলতান আহমদ এমপিএ-এর অবস্থা ছিল বিপজ্জনক পথ চলতে হচ্ছিল। স্থানীয় জনগণকে জিজ্ঞেস করে করে। অবশেষে সবাই বিপজ্জনক হলেও খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন সুলতান আহমদ, সুবেদার টি এম আলী, হাবিলদার আবু ইসলামসহ নেতৃস্থানীয় যােদ্ধারা পরামর্শ করে যােদ্ধাদের নিয়ে একটি কেয়াং ঘরে বিশ্রাম নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পাকিস্তানি বাহিনী যে অতি সন্নিকটে এটা সবাই আঁচ করতে পারলেও তখন বিশ্রাম নেয়া ছাড়া তাদের অন্য কোনাে উপায় ছিল না। সম্ভাব্য আক্রমণের স্থানে দুজন প্রহরীর ব্যবস্থা করা হয়। দুজন প্রহরীর মধ্যে একজন নতুন ও অন্যজন পুরােনাে রাখা হয়, যাতে নতুন প্রহরীর কোনাে অসুবিধা না হয়। ক্লান্ত যােদ্ধারা মাটি, গাছ, দেয়াল যে যেখানে সম্ভব পিঠ ঠেকাতেই গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। ভাের হওয়ার কিছুক্ষণ আগে পাকিস্তানি বাহিনী তিন দিক থেকে হামলা শুরু করে। সম্ভবত পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের দলটিকে অনুসরণ করছিল এবং ভাের হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী তিন দিক থেকে প্রচণ্ডভাবে মর্টারের গােলা বর্ষণ করতে থাকে।
মর্টারের একটি গােলা এসে সুবেদার টি এম আলীর দলের ওপর পড়লে তিনি সঙ্গে সঙ্গে মারা যান। মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিল না। দু-একজন পালটা গুলি বর্ষণের ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালালেও অধিকাংশ যােদ্ধা নিরাপদ স্থানে চলে যেতে সমর্থ হন। আহত যােদ্ধাদের মধ্যে যারা হাঁটতে পারছিলেন না, কেবল তাঁরা পড়ে থাকেন। আগেই সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে পাকিস্তানি বাহিনী হামলা করলে প্রতিহত করার চেষ্টা না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে হবে। কারণ, পাহাড়ি জনাকীর্ণ এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে পিছু অনুসরণ করা সম্ভব নয়। সম্ভব হলে একসাথে কিংবা দল করে সরে যেতে হবে এবং গাছের পাতায় পাতায় গিট বেঁধে রাখতে হবে যাতে অন্য দলের পক্ষে গমন পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়। হাবিলদার আবু ইসলাম হাতে গুলিবিদ্ধ হয়েও ৭-৮জন নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে সরে এসে কচ্ছপতলী বাজারে পৌছান। স্থানীয় লােকদের মারফত তাঁরা কাছেই পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প রয়েছে, এ কথা জানার পর দ্রুত স্থান ত্যাগ করে পাহাড়ের দিকে চলে যান। তখন দিনের বেলা হওয়ায় কিছুদূর চলার পর তারা দেখতে পান, গাছের পাতায় পাতায় গিট দেওয়া আছে। এসব পথ ধরে কিছু দূর চলার পর তারা ৩০-৩২জনের একটি দলকে দেখতে পান। এরপর প্রায় ৪০জনের দলটি পুনরায় সংগঠিত হয়ে যাত্রা শুরু করেন। ৬০জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে গঠিত দলের বাকি সদস্যদের কোনাে খোঁজ পাওয়া যায় নি। দুই দিন দুই রাত পথ চলার পর দলটি মিজোরামের সীমান্তে পৌছায়। পথে তাদের খাবারের কোনাে ব্যবস্থা না থাকায় পাহাড়ি ফলমূল ইত্যাদি খেয়ে দুই দিন কাটিয়ে দেন। মিজোরাম পৌছে সবাই ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর কাছে আশ্রয় গ্রহণ করার পর তাদের হরিণায় পাঠানাে হয় (তথ্যসূত্র: হাবিলদার আবু ইসলাম)। 

 

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!