You dont have javascript enabled! Please enable it!
মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয় কেন্দ্র
ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযােদ্ধাদের দেশের অভ্যন্তরে আসার পর শক্রর ওপর আক্রমণ পরিচালনা করা এবং আক্রমণের পর পুনরায় ফিরে আসার জন্য নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রের প্রয়ােজন ছিল। শক্রর দৃষ্টি এড়িয়ে এসব স্থানে বসে তারা অপারেশনের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করার জন্য প্রয়ােজনীয় সংবাদ সংগ্রহ, রসদ সরবরাহ, গ্রহণ এবং অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিরাপদে লুকিয়ে রাখতে পারছেন। গেরিলা যুদ্ধের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, যে অঞ্চলে তারা যুদ্ধ করছে, সে অঞ্চলের জনগণের মনস্তাত্ত্বিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক সহায়তাসহ সার্বিক সহায়তা অর্জন। চট্টগ্রামের মুক্তিযােদ্ধাদেরও একই প্রকৃতির সহায়তার প্রয়ােজনকে সামনে রেখে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি প্রণয়ন ও সে অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় নেতারা দীর্ঘস্থায়ী একটি গেরিলা যুদ্ধকে সামনে রেখে বেইজ কর্মী গঠনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এসব প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বেইজ কর্মী ও স্থানীয় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সহায়তা চট্টগ্রামের গেরিলা যােদ্ধাদের নির্ভয়ে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছিল।
দেশের অভ্যন্তরে এসব আশ্রয়দাতা মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য রসদ সরবরাহ করার পাশাপাশি নিজেরাও অনেক সময় যুদ্ধ করেছেন আশ্রয় কেন্দ্রের বৈশিষ্ট্য প্রথমত: আশ্রয়দাতারা নিজেরাই অধিকাংশ সময় মুক্তিযােদ্ধাদের খাবার সরবরাহ করতেন। এজন্য মুক্তিযােদ্ধাদের কোনাে অর্থ পরিশােধ করতে হতাে না। সে রকম অর্থ মুক্তিযােদ্ধাদের সামর্থ্যের মধ্যেও ছিল না। কারণ, নিজেদের সব কিছু ত্যাগ করে মুক্তিযােদ্ধারা যুদ্ধে যােগ দিয়েছিলেন। সেক্টর থেকে যােদ্ধাদের যে ভাতা দেওয়া হতাে, তা ছিল প্রয়ােজনের তুলনায় অতি নগণ্য। ভাতা সম্পর্কে তথ্য বিধৃত এ গ্রন্থের দলিলপত্র পর্বের নবম অধ্যায়ে প্রাপ্য। আশ্রয়দাতারা নিজেরা কিংবা জনগণ থেকে সংগ্রহ করে গেরিলাদের জন্য অর্থের জোগান দিয়েছিলেন। সে সময় গেরিলাদের সাহায্যে আসতে পারলে লােকজন সম্মানিত ও গর্ব বােধ করতেন। গেরিলাদের খাদ্য ও আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে পাকিস্তানিরা বহু লােককে হত্যা করেছে।  দ্বিতীয়ত: আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করার সময় নিজের উপস্থিতি শত্রুর কাছে গােপন রাখা এবং একই সাথে শত্রুর গতিবিধির ওপর নজর রাখা দরকার ছিল।
বাস্তবিক, জনবহুল এলাকায় অধিকাংশ আশ্রয়স্থল হওয়ার পরও মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি জনগণের সহানুভূতি ও অগাধ সমর্থনের কারণে শত্রু বাহিনী এগুলাে সম্পর্কে প্রায় অজ্ঞাত ছিল। পাশাপাশি শত্রুর গতিবিধি ও স্থাপনা সম্পর্কে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের তথ্য সরবরাহ করতেন। সরকারি প্রশাসনসহ বিভিন্ন স্থানে কর্মরত অসংখ্য বাঙালি পাকিস্তানি বাহিনীর তৎপরতা সম্পর্কে এসব কেন্দ্রে সংবাদ আদান-প্রদান করতেন (এ সম্পর্কে এনায়েত মওলা রচিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ মুক্তিযুদ্ধের ভিন্ন ছবি ‘চট্টগ্রামের কাকলী’-তে একজন পুলিশ অফিসারের কথা বিধৃত)। তৃতীয়ত: ভারত থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বেইজ কর্মীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা অনেকেই বেইজ কর্মী হিসেবে কাজ করেছিলেন। তারা সংবাদ আদান-প্রদান, অস্ত্রশস্ত্র বহন করা ছাড়াও অনেক সময় যােদ্ধাদের সাথে মিলে যুদ্ধও করতেন। চতুর্থত: সেক্টর থেকে প্রেরিত বিভিন্ন দলের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনাে আশ্রয় কেন্দ্র ছিল না। বিভিন্ন দল ও উপদলের যােদ্ধা একই আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করতেন। পারস্পরিক সহায়তা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের মহৎ উদ্দেশ্য ছিল এ সহাবস্থানের ভিত্তি নেতাদের মধ্যে বিভক্তি দেখা গেলেও সাধারণ মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের মহান উদ্দেশ্য সম্পর্কে ঐকমত্য লক্ষণীয়। 
পঞ্চমত: নিরাপত্তা ও নিজেদের অবস্থানের গােপনীয়তা রক্ষা করার স্বার্থে একই মুক্তিযােদ্ধা একটি কেন্দ্রে দীর্ঘদিন থাকতেন না। পাকিস্তানি বাহিনীর উপস্থিতি ও নজরদারি বেশি হওয়ায় শহরের মুক্তিযােদ্ধারা প্রায়ই নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করতেন। গ্রামাঞ্চলের মুক্তিযােদ্ধারা বিপদের আশঙ্কা আঁচ করতে পারলেই কেবল নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করতেন।  ষষ্ঠত: মুক্তিযােদ্ধাদের আসা-যাওয়ার পথে যে-সব আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল, সেগুলােয় মুক্তিযােদ্ধারা অতি স্বল্প সময়ের জন্য অবস্থান করতেন। সব আশ্রয় কেন্দ্রের অবস্থান যাতে শত্রুর কাছে প্রকাশিত না হয়ে যায়, সে জন্য এক আশ্রয় কেন্দ্রের অবস্থান অন্য আশ্রয় কেন্দ্রের কাছে গােপন রাখা হতাে। শুধু যাতায়াতের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা নিকটস্থ আশ্রয়কেন্দ্রের অবস্থান সম্পর্কে জানতেন।  সন্তমতঃ অনেক আশ্রয় কেন্দ্রের অবস্থানের খবর পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে পৌছালে তাদের সহযােগীরা কিংবা পাকিস্তানি বাহিনী নিজে এসব আশ্রয় কেন্দ্রের মালিকদের ওপর নির্যাতন চালায় এবং অনেককে ধরে নিয়ে যায়। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযােগীরা অনেক অঞ্চলের আশ্রয়কেন্দ্রের খােজ পাওয়ার পর সেগুলােয় আগুন লাগিয়ে দেয়।

চট্টগ্রামের সমগ্র অঞ্চলে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অসংখ্য আশ্রয়স্থল তৈরি করা হয়েছিল। নিচে অঞ্চলভিক্তিক কয়েকটি আশ্রয় কেন্দ্র সম্পর্কে কিছু তথ্য উপস্থাপন করা হলাে: ক. চট্টগ্রাম শহর: চট্টগ্রাম শহরের কয়েকটি আশ্রয় কেন্দ্রের বিবরণ নিম্নরূপ:  কবির তােরণ: মােগলটুলি বাজারের পাশে মহিবুল্লা মাতবরের বাড়িতে অবস্থিত এ কেন্দ্রটি ছিল কেসি-৩ দলের প্রধান কার্যালয়। এখানে অস্ত্র, গােলাবারুদ ও বিস্ফোরক রাখা ছাড়াও অনেক মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতাে। ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী এ কেন্দ্রটি ঘেরাও করে আশ্রয়দাতাদের ওপর নির্যাতন চালায়, কিন্তু কোনাে মুক্তিযােদ্ধা ও অস্ত্রশস্ত্র খুঁজে বের করতে পারে নি। এ কেন্দ্রে অবস্থান নিয়ে। মুক্তিযােদ্ধাদের অনেকে আগ্রাবাদ, মােগলটুলি, পাঠানটুলি, সদরঘাট ও এর আশপাশের এলাকায় গেরিলা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। সবুজবাগ-পানওয়ালা পাড়া: চারদিকে ডােবা-নালা ও গ্রাম ঘেরা আবদুল হাই সওদাগরের বাড়িতে এ আশ্রয় কেন্দ্রটি মৌলবি সৈয়দের নেতৃত্বে শহর মুক্তিযােদ্ধাদের প্রধান সদর দপ্তরে পরিণত হয়েছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী কয়েক বার এ কেন্দ্রটি ঘেরাও করে কাউকে পায় নি। মূলত মুক্তিযােদ্ধারা নির্দিষ্ট সময়ে মিলিত হয়ে অধিকাংশ সময় অন্য আশ্রয়ে চলে যেতেন। ওসমান কোর্ট: নুরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত সে সময় হােন্ডা প্যালেস’ হিসেবেও সর্বাধিক পরিচিত এ কেন্দ্রটি মুক্তিযােদ্ধারা তথ্য আদান-প্রদান ও সমন্বয় সাধনের জন্য ব্যবহার করতেন। এখানে বসে আগ্রাবাদ এলাকায় অনেক গেরিলা অপারেশনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এখানে অবস্থানরত যােদ্ধাদের জন্য অর্থের জোগান দিতেন নুরুল ইসলাম এবং এক পর্যায়ে তিনি তার স্ত্রীর স্বর্ণালংকারও বিক্রি করে দিয়েছিলেন। ওসমান কোর্ট আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার কেন্দ্রে অবস্থিত হওয়ায় এখান থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় সব তৎপরতা লক্ষ্য করা যেত। পাকিস্তানি সেনারা এটিকে সন্দেহের আওতা মুক্ত রাখলেও মুক্তিযােদ্ধারা যে-কোনাে সময়ে পাকিস্তানি সেনাদের অভিযানের আশঙ্কা চিন্তার মধ্যে রেখেছিলেন।
 
এক দিনের ঘটনা সম্পর্কে নুরুল ইসলামের কাছ থেকে জানা যায়, আগস্ট মাসের এক দিন এক দল মুক্তিযােদ্ধা ওসমান কোর্টে বসে আসন্ন নৌকমান্ডাে অপারেশনের জন্য অস্ত্রশস্ত্র ও বিস্ফোরক ইত্যাদি নদীর অপর পারে নেয়ার জন্য প্রস্তুত করছিলেন। সেখানকার কাঁচের দরজা দিয়ে এমন সময় তিনি দেখেন, পাকিস্তানি  সেনাবাহী একটি গাড়ি এসে ওসমান কোর্টের সামনে থামে। সবার দৃঢ় বিশ্বাস হলাে যে নিশ্চয় পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযােদ্ধাদের সম্পর্কে খোঁজ পেয়েছে। কিন্তু সেখান থেকে দ্রুত পালানাের কোনাে পথ ছিল না। পাকিস্তানি সেনা অফিসারটি এসে নক করার পূর্বমুহূর্তেই নুরুল ইসলাম স্বয়ং দরজা খুলে তাকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, “Hello Lieutenant, what can I do for you?’ নুরুল ইসলামের বর্ণনা মতে, তবুও তার গলা শুকিয়ে আসে। পাকিস্তানি অফিসারটি উর্দুতে জিজ্ঞাসা করলেন, ৮১ নম্বর বিল্ডিংটা কোথায়? নুরুল ইসলাম সেটি দেখিয়ে দিলে অফিসারটি চলে যায়। ভিতরের সব মুক্তিযােদ্ধার বুকে প্রশান্তি নেমে আসে। প্রকৃতপক্ষে, যুদ্ধকালীন সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে বাংলা সাইনবাের্ডের ওপর উর্দুতে লেখার সময় ভুলক্রমে ৭০ নম্বরের পরিবর্তে ৮০ লেখা হয়। পাকিস্তানি অফিসারটি সেটি পড়েই এখানে এসেছিলেন ৮১ নম্বরের খোঁজে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলােয় প্রতিনিয়ত ছিল এ রকমই বিপদ ঘটার ও নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা। কিন্তু জনগণের একনিষ্ঠ সহযােগিতা যােদ্ধাদের নিরাপদে চলতে ও থাকতে সাহায্য করছিল। কাকলী: নাসিরাবাদে, বর্তমান জিইসি’র মােড়ের সন্নিকটে ‘কাকলী নামের বাড়িতে অবস্থিত এ আশ্রয় কেন্দ্রের মালিক ছিলেন এনায়েত মওলা ও মিসেস মওলা। কোনাে রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত না থাকলেও ২৫ মার্চ পূর্ব সময়ে দুজন সক্রিয়ভাবে মুক্তিসংগ্রামের প্রস্তুতিতে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব থেকেই এখানে আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হতাে।
ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আগত যােদ্ধারাও এ কেন্দ্রে থাকতে শুরু করেন। চট্টগ্রাম বন্দরে অভিযান করার জন্য নৌকমান্ডােরা এখানেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেপটেম্বরে এ আশ্রয় কেন্দ্র ঘেরাও করে অনেক মুক্তিযােদ্ধাকে পাকিস্তানি সেনারা ধরে নিয়ে যায়। এসব বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে এনায়েত মওলা রচিত স্মৃতিকথা মুক্তিযুদ্ধের ভিন্ন ছবি ‘চট্টগ্রামের কাকলী’ শিরােনামের গ্রন্থে।  ফিরিঙ্গিবাজার চার্চের আর চৌধুরীর বাসা: এ বাসার মালিক হেনরি রিবাের্ড চৌধুরী, মিসেস চৌধুরী ও ছেলে রবিনসন মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। কেসি-৩ দলের অনেক সদস্য এখানে আশ্রয় নিয়ে নিকটবর্তী বিভিন্ন ট্রান্সফর্মার, পেট্রোল পাম্পে বিস্ফোরক স্থাপন করে সেগুলাে ধ্বংস করে দেওয়ার অপারেশন পরিচালনা করতেন। অন্য দলের সদস্যরা এ আশ্রয় কেন্দ্রটি ব্যবহার করে আশপাশের এলাকায় গ্রেনেড নিক্ষেপ করতেন। খ, মিরসরাই-সীতাকুণ্ড: মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয় প্রদানে মিরসরাই-সীতাকুণ্ড ও সংলগ্ন অঞ্চল এক গৌরবময়, অনন্য ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভূমিকা পালন করে। এ অঞ্চলের অধিকাংশ বাড়ি মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। এসব আশ্রয় কেন্দ্রের মুখ্য ভূমিকা ছিল ভারত ফেরত গেরিলাদের দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশে সহায়তা, আহার ও বিশ্রাম প্রদান এবং অস্ত্রশস্ত্র নিরাপদে রাখা। পাশাপাশি এলাকার মুক্তিযােদ্ধাদের সব অভিযান-অপারেশনের সময় বাস্তব ও নৈতিক সাহায্য-সহযােগিতা প্রদান করা হতাে এ আশ্রয় কেন্দ্রগুলাে থেকে। পরবর্তীকালে চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে এখান থেকে যােদ্ধারা গমন করতেন। অক্টোবর-নভেম্বর মাসের দিকে এ অঞ্চলের আশ্রয় কেন্দ্রগুলো এমনই সংঘবদ্ধ রূপ ধারণ করে যে সেক্টর থেকে স্বল্প সময়ের নােটিশে যােদ্ধা দলকে চট্টগ্রাম পাঠানাে সম্ভব হতাে ফেনী থেকে মুক্তিযােদ্ধারা মিরসরাই পৌছানাের পর তাদেরকে শহরের উদ্দেশ্যে কয়েকটি পথ ধরে পাঠানাে হতাে পাকিস্তানি বাহিনীর দৃষ্টি এড়ানাের জন্য কেবল রাতের অন্ধকারে গেরিলা যােদ্ধারা চলাচল করতেন। গােপনীয়তা রক্ষা করা ও নিরাপত্তার জন্য শুধু তার সামনের এবং পিছনের আশ্রয় কেন্দ্রের অবস্থান জানলেও দূরবর্তী আশ্রয় কেন্দ্র সম্পর্কে চলাচলকারী মুক্তিযােদ্ধারা জানতেন না।
গেরিলা যােদ্ধাদের পরনে সাধারণ জনতা ও কৃষকদের মতাে পােশাক থাকার। ফলে পাকিস্তানি বাহিনী তাদেরকে সহজে শনাক্ত করতে পারত না। কোনাে কোনাে আশ্রয় কেন্দ্রে প্রশিক্ষণও প্রদান করা হতাে। মাতব্বরহাটের অনেক বাড়িতে উল্লেখযােগ্য সংখ্যক মুক্তিযােদ্ধার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহারের খবর জেনে পাকিস্তানি বাহিনী এ অঞ্চলে বিভিন্ন সময় ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও লুটতরাজ চালায়। কিন্তু তাতেও আশ্রয়দাতারা হতােদ্যম না হয়ে বিজয় অর্জন পর্যন্ত এ গৌরবময় ভূমিকা পালন করে গেছেন। গ, ফটিকছড়ি: এ এলাকায় জনগণের সহায়তা ছাড়া বিভিন্ন পাহাড়ি বনজঙ্গল। ও চা-বাগানে মুক্তিযােদ্ধারা আশ্রয় নিয়েছিলেন। খিরাম জঙ্গলে মেজর রফিকসহ অনেক নেতা বেশ কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন। স্থানীয় জনগণ তাদের খাবার সরবরাহ করত। প্রতিরােধ যুদ্ধের শেষ দিকে এ অঞ্চলে অনেক আশ্রয় কেন্দ্র ছিল। নভেম্বর মাস থেকে পুনরায় মুক্তিযােদ্ধারা এ অঞ্চলে আশ্রয় নিতে থাকেন। হাটহাজারীঃ এতদঞ্চলের উদালিয়া চা-বাগান ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের প্রধান আশ্রয় কেন্দ্র। তা ছাড়া উত্তর মাদার্শা ও ফতেয়াবাদে মুক্তিযােদ্ধাদের অনেক আশ্রয় কেন্দ্র ছিল। অনেকে একই সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সম্পর্ক রাখতেন, পাশাপাশি মুক্তিযােদ্ধাদেরও আশ্রয় দিতেন।
তারমধ্যে অন্যতম ছিলেন ফতেয়াবাদের সৈয়দ আহমদ মিয়া চেয়ারম্যান। ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে গেরিলা কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে মুক্তিযােদ্ধারা চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবেশ করেন। সাধারণ জনতা কিংবা মুক্তিযােদ্ধা কারাে জন্যই চট্টগ্রাম থেকে ভারতে যাওয়া-আসার সহজ কোনাে পথ ছিল না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে চট্টগ্রাম অঞ্চলের মুক্তিযােদ্ধাদেরই সবচেয়ে বেশি কষ্টসহিষ্ণু হয়ে বিপৎসংকুল দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে যাওয়া-আসা করতে হতাে। কারণ, চট্টগ্রাম থেকে ভারত যাওয়ার পথে ছিল সারি সারি পাহাড়। যুদ্ধের বীভৎসতার চেয়ে দুর্গম পথের ক্লান্তি ও বিপদ কোনােভাবেই কম ছিল না। দীর্ঘ পথপরিক্রমার মাধ্যমে শারীরিক, মানসিক ও ভৌগােলিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রমের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত তাদেরকে শত্রুর তীক্ষ্ণ নজরও এড়িয়ে চলতে হয়েছে। কখনাে বা শত্রুর আক্রমণের শিকারে পরিণত হতে হয়েছে। আবার তাদের শত্রুর মােকাবিলা করতে হয়েছে। এসব প্রতিকূলতা উত্তরণে মুক্তিযােদ্ধারা স্ব উদ্ভাবিত বিভিন্ন কলাকৌশল অবলম্বন করেছিলেন। শত্রু পরিবেষ্টিত দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার পর পথক্লান্ত যােদ্ধাদের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়ােজন ছিল নিরাপদ আশ্রয়স্থল। সেই সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য প্রয়ােজনীয় মৌলিক চাহিদার সরবরাহ (লজিস্টিক সাপাের্ট)। চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে আপামর জনতা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও মুক্তিযােদ্ধাদের রসদপত্র সরবরাহ এবং প্রয়ােজনীয় আশ্রয় ও সহায়তা প্রদান করেছিলেন। এসব আশ্রয় ও সহায়তা না পেলে মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে দক্ষতার সাথে গেরিলা তৎপরতা পরিচালনা করা সম্ভব। হতাে না – এ বক্তব্যে অত্যুক্তি নেই। 

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড

 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!