প্রশিক্ষণ শেষে গেরিলাদের দেশের অভ্যন্তরে প্রেরণ এবং চট্টগ্রামের মুক্তিযোেদ্ধাদের অনুপ্রবেশ
গেরিলা যােদ্ধাদেরকে এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে তাদের করণীয় সম্পর্কে নির্দেশ প্রদান করে চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে পাঠানাে হতাে। প্রতিটি দলকে অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ ও হাতখরচ দেওয়া হলেও তা ছিল প্রয়ােজনের তুলনায় অতি সামান্য (গ্রন্থের নবম অধ্যায়, দলিল নম্বর ১০৪; দশম অধ্যায়, দলিল নম্বর ২২১)। প্রতিটি দলকে দেশের অভ্যন্তরে পাঠানাের জন্য যাতায়াত পথ নির্দিষ্ট করে এসব পথের আশপাশের শত্রুর গতিবিধির ওপর নজর রাখা হতাে। শক্রর টহল দল স্থান পরিবর্তন করার কারণে সর্বশেষ খবরেও পরিবর্তন ঘটত। প্রতিটি দলের। সাথে গাইড থাকত যারা নিরাপদ রাস্তা ধরে নিকটবর্তী আশ্রয় কেন্দ্রে পৌছে দিত। খাবার ও আশ্রয়ের জন্য এসব আশ্রয় কেন্দ্রে সম্ভবত অনেক ক্ষেত্রে আগেই খবর। দিয়ে রাখা হতাে। কিন্তু এসব আশ্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা সীমিত থাকায় এবং পর্যাপ্ত যােগাযােগ ব্যবস্থার অভাবে যাতায়াতকারী দলকে কঠিন সমস্যার মুখােমুখি হতে হতাে। প্রতিটি নলের সাথে নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র, জনসংখ্যা, গতিপথ ইত্যাদির বিস্তত রণ এক যুদ্ধের জন্য নির্বাচিত ও প্রশিক্ষিত যােদ্ধাদের জন্য ভারত সরকার যে অস্ত্রের ব্যবস্থা করেছিল, তাতে ৫০% মুক্তিযােদ্ধাদের দেওয়া সম্ভব হলেও বাকিদের খালি। হাতে যুদ্ধের জন্য পাঠানাে হয়েছিল। সেক্টরের পরিকল্পনামতাে দুই গ্রুপের অস্ত্র দিয়ে তিন গ্রুপকে পাঠানাে সত্ত্বেও অনেক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধাকে ক্যাম্পে রেখে দিতে হয়েছিল। এর ফলে ক্যাম্পে খাবার ও অন্য সরঞ্জামের ওপর বাড়তি চাপ পড়ত। ভারতীয় সেনা সদরের নির্দেশ ছিল, প্রশিক্ষণ শেষে গেরিলাদের ৩-৪ নিরে মধ্যে দেশে পাঠাতে হবে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সদর দপ্তরের নির্দেশ ছিল গেরদের অস্ত্র দিয়ে পাঠাতে হবে (এ সংক্রান্ত দালিলিক তথ্য গ্রন্থের নবম অধ্যায়ে উপস্থাপিত)। প্রতিটি গেরিলা দল নির্দিষ্ট দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় পৌছার পর তাদের সাথে বিভিন্ন পদ্ধতিতে, বিশেষত কুরিয়ারের মাধ্যমে সেক্টরের সাথে যােগাযােগ রক্ষা করার চেষ্টা থাকত।
দলগুলােরও দায়িত্ব ছিল সেক্টর কিংবা সাব-সেক্টরের সাথে যােগাযােগ রক্ষা করা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অনেক দলই দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার পর সেক্টর কিংবা সাব-সেক্টরের সাথে কোনাে যােগাযােগ রাখে নি বা অনিবার্য কারণে তা করতে পারে নি। এ সময় অনেকে ব্যক্তিগত কোন্দলেও জড়িয়ে পড়েন। অনেকে আবার নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। তা সত্ত্বেও দেশের অভ্যন্তরে। প্রেরিত দলগুলাের অনেকেই সেক্টরের সাথে যােগাযােগ রক্ষা করে চলত। এদের দ্বারা পরিচালিত অপারেশনের খবর সেক্টর ও সাব-সেক্টরে পাঠানাে হতাে। ১ নম্বর সেক্টরে ও সাব-সেক্টরে তিনটি গােপন ওয়্যারলেস সেট স্থাপন করা। হলেও এটা ছিল প্রয়ােজনের তুলনায় অপ্রতুল। গেরিলাদের প্রেরিত খবর ও বিভিন্ন তথ্য এবং সেক্টর থেকে প্রেরিত নির্দেশিকা বার্তাবাহক মারফতে সম্পন্ন করা হতাে। এর জন্য একটি যােগাযােগ নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছিল। সংবাদ আদান-প্রদানের কাজে নিয়ােজিত ব্যক্তিরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ আদান-প্রদান করতেন (রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম, ১৯৯৯: পৃ. ২৩৫-৩৬)। গ্রন্থের দলিলপত্র নবম অধ্যায়ে এ বিষয়ে বহু নতুন ও বৈচিত্র্যমণ্ডিত দালিলিক তথ্য-উপাত্ত সন্নিবেশিত।
ভারতে যাওয়া-আসার রাস্তা
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর জনগণ দলে দলে ভারত পাড়ি জমায়। প্রথম দিকে বিচ্ছিন্নভাবে তারা যাতায়াত করতে থাকে। প্রতিরােধ যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি | বাহিনী চট্টগ্রাম শহর হতে সীতাকুণ্ড-মিরসরাই, করেরহাট-রামগড় রােড এবং চট্টগ্রাম শহর হতে হাটহাজারী, নাজিরহাট, বিবিরহাট, কাজীরহাট, নারায়ণহাট, দাদমারা, হিয়াকু, বাগানবাজার দিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে রামগড় আক্রমণ করে। তা ছাড়া রাঙ্গুনিয়ার পথে পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু অংশে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানে আক্রমণ করে। অবশেষে প্রতিরােধকারী যােদ্ধারা প্রতিরােধ ও আক্রমণ রচনা করতে করতে ভারতের সাবরুমে আশ্রয় নেয়। প্রতিরােধযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে। পাকিস্তানি বাহিনী সীমান্তসহ বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি চালানােয় ভারতে যাওয়া-আসার কাজ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সংগ্রহ এবং সেক্টরের নির্দেশনার জন্য চট্টগ্রাম থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের হরিণা, সাবরুম, আগরতলাসহ বিভিন্ন স্থানে। মুক্তিযােদ্ধাদের যাতায়াত করতে হতাে। ক্রমান্বয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের গমনাগমন একটি সংগঠিত রূপ লাভ করে। চট্টগ্রামের জনতা ও যােদ্ধাগণ মূলত ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরা, মিজোরাম, মণিপুরসহ পার্শ্ববর্তী পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থান নেন। চট্টগ্রাম থেকে এসব অঞ্চলে গমন এবং ফেরত আসা প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতাজনিত কারণে এমনিতেই কষ্টসাধ্য। তার ওপর মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে। নিরাপত্তার প্রয়ােজনে চলতে হতাে অপ্রচলিত পাহাড়ি পথ ধরে। দীর্ঘ এ। পথপরিক্রমায় বিশ্রাম ও খাবার সরবরাহ ছিল সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। এসব এলকায় পথপ্রদর্শক বা গাইডের সাহায্য নিয়েই চলতে হত। সমতল এলাকাতে যেমন ফেনী, মিরসরাই, সীতাকুণ্ড, ফটিকছড়ি ও হাটহাজারী অঞ্চলে ছিল আশ্রয়স্থল ও বেইজ এক এলাকার সংগঠকেরা পার্শ্ববর্তী এলাকার সংগঠকদের সাথে যােগাযােগ করেই এসব আশ্রয়স্থল বেইজ তৈরি করে নিয়েছিলেন।
সীতাকুণ্ড-মিরসরাই-ছাগলনাইয়ার পথ
চট্টগ্রাম শহর, সীতাকুণ্ড ও মিরসরাইয়ের মুক্তিযােদ্ধারা প্রধানত এ পথ ব্যবহার করে মিরসরাই, করইয়া বাজার, দারােগা বাজার, দরগাহ গেইট দিয়ে ভারতে পৌছাতেন। তা ছাড়া কর্ণফুলি নদীর দক্ষিণ অঞ্চলের যথা: রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারীর জনগণ ও মুক্তিযােদ্ধারা সময়বিশেষে এ পথ ব্যবহার করতেন। নিরাপদ ও সন্দেহ মুক্ত রাখার প্রয়ােজনে এ পথের আশপাশে প্রথম দিকে অপারেশনের তীব্রতা কম রাখা হয়। কিন্তু অক্টোবরের শেষ দিকে পাকিস্তানি বাহিনী। এ রুটের খবর জানতে পেরে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ফলে এটি সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। তখন থেকে সীতাকুণ্ড-মিরসরাই পথের আশপাশের অঞ্চলে অনেক অপারেশন পরিচালিত হয়। শহর: মিরসরাই-করেরহাট-রামগড়, রােড: করইয়ার টিলা-আম্বলিঘাট পথটি তুলনামূলকভাবে নিরাপদ বিবেচিত হওয়ায় ভারত যাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হতাে। এ পথের মধ্যে আবার তিনটি চলাচল পথ ছিল উপকূল ধরে। মুক্তিযােদ্ধারা নৌকায় করে ফেনী নদী থেকে সন্দ্বীপ চ্যানেল হয়ে শহরে পৌছতেন। এ পথ দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ বেশি বহন করা হতাে। আরেকটি পথ ছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পশ্চিমে গ্রামের ভিতর দিয়ে। এ পথ ধরে চলাচলের সময় আশ্রয় কেন্দ্রের সহায়তা অপরিহার্য ছিল। আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করে গেরিলা যােদ্ধারা কখনাে কখনাে চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কে পাবলিক বাসে ছদ্মবেশে যাতায়াত করতেন। চট্টগ্রাম-ঢাকা রেলপথের পূর্ব পাশের পাহাড়ের পাদদেশ হয়েও ক্ষেত্রবিশেষে মুক্তিযােদ্ধারা যাতায়াত করতেন। এসব পথ দিয়ে অনুপ্রবেশের একটি ঘটনা নিচে উল্লেখ করা হলাে: .আগস্ট মাসে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের একটি দল। চট্টগ্রাম শহরে আসার জন্য হরিণা থেকে রওনা হয়ে ফেনীর সীমান্ত অতিক্রম করার পর পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক স্থাপিত বুবি ট্র্যাপে পড়ে।
এ দলে ছিল ইলিয়াছ গ্রুপ, জিন্নাহ গ্রুপ, ইপিআর-এর কিছু সদস্য এবং মিরসরাইয়ের ১টি দল। বুবি ট্র্যাপে পড়ার পর দলটি আবার হরিণায় ফেরত যায়। ভারতীয় বাহিনীর সহযােগিতায় মুক্তিযােদ্ধাদের এ দলটি পুনরায় সীমান্ত অতিক্রম করে স্থানীয় গাইডের সাহায্যে মিরসরাইয়ের। আবুতােরাব বাজারে পৌছালে পাকিস্তানি বাহিনী দলটির ওপর হঠাৎ আক্রমণ চালায়। মুক্তিযােদ্ধারা এ রকম সম্মুখযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে ১জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন এবং পুরাে দলটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া দলের একটি অংশ সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়ীয়া হয়ে স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগিতায় শহরে মৌলবী সৈয়দের বাকলিয়াস্থ একটি আশ্রয়কেন্দ্রে পৌছায় (সাপ্তাহিক মুক্তিযােদ্ধা সংখ্যা-১, পৃষ্ঠা ১৬; সংখ্যা-২, পৃষ্ঠা ৯ এবং সাক্ষাকার: মুক্তিযােদ্ধা ইলিয়াস)। মুক্তিযােদ্ধাদের অনুপ্রবেশের এ ঘটনা থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের অনুপ্রবেশ ঠেকানাে এবং চলাচলের ওপর নজরদারি করার জন্য বুবি ট্র্যাপসহ পথিমধ্যে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা স্থাপন করেছিল। মুক্তিযােদ্ধাদের উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্রই তারা আক্রমণ করত। প্রয়ােজনের ও শক্রর তুলনায়। সীমিত সংখ্যার ও শক্তির হওয়ায় মুক্তিযােদ্ধারা অনুপ্রবেশের সময় সম্মুখযুদ্ধ এড়িয়ে চললেও কেবল আত্মরক্ষা ও দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরে পড়ার জন্য কখনাে কখনাে যুদ্ধে লিপ্ত হতেন।
শহর-হাটহাজারী-রাউজান-ফটিকছড়ির পথ
সমগ্র দক্ষিণ চট্টগ্রাম জেলা, হাটহাজারী, রাউজান, ফটিকছড়ির যােদ্ধারা সাধারণত ভারত গমন করার জন্য এ পথ ব্যবহার করতেন। শহরের অনেক যােদ্ধাও বিশেষ ক্ষেত্রে এ পথ ব্যবহার করতেন। শরণার্থীদের ভারত যাওয়া-আসার প্রধান পথ ছিল। এটি। পথিমধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে চলতে গিয়ে এদের সবাইকে জঙ্গলাকীর্ণ দুর্গম গিরিপথ ধরে চলতে হতাে। ফটিকছড়ি পর্যন্ত এ পথ সমতল হলেও তারপর ভারত পর্যন্ত পাহাড়ি এলাকা অতিক্রম করতে হতাে বলে এ পথ ধরে চলাচল খুবই শ্রম ও কষ্টসাধ্য ছিল। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে এ পথ ধরে দেশের অভ্যন্তরে বিপজ্জনক ও কষ্টকর আগমনকালীন মুক্তিযােদ্ধাদের যাত্রাপথের বিবরণ উল্লেখযােগ্য। ঐ। বিবরণটির প্রয়ােজনীয় অংশের সংক্ষিপ্তসার নিম্নরূপ: ২০ অক্টোবর প্রশিক্ষণ শেষে হরিণা ক্যাম্পে কয়েকটি দলকে দেশের অভ্যন্তরে পাঠানাের জন্য প্রস্তুত করা হয়। এ দলে ছিল মির্জা আবু মনসুর গ্রুপ, সিরু বাঙালি গ্রুপ, নবী গ্রুপ, বশর গ্রুপ, আবছার গ্রুপ। নির্বাচকমণ্ডলী কমান্ডার নির্বাচন করার সময় শিক্ষাগত যােগ্যতা, প্রশিক্ষণ যােগ্যতা, কমান্ড করার যােগ্যতা, শারীরিক যােগ্যতা এবং সর্বোপরি দেশে তার রাজনৈতিক নির্ভরযােগ্যতা বিবেচনা করতেন। অনেকে গ্রুপের নেতৃত্ব মানতে চাইতেন না ফলে এঁদেরকে অন্য দলে অন্তর্ভুক্ত করা হতাে। কখনাে কখনাে সদস্যদের অনেকে অন্য দলেও চলে যেতেন, নেতৃত্ব নিয়ে অনেক সময় কোন্দলও হতাে। প্রতিটি দলকে কিছু অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ, খাবার, টাকাপয়সা দেওয়া হতাে। সিরু বাঙালির ১৯জনের দলের জন্য প্রদত্ত অস্ত্রের পরিমাণ ছিল নিম্নরূপ: এলএমজি ১টি এবং ম্যাগাজিন ৫টি, বিডিএফ রাইফেল ৬টি, ৩০৩ রাইফেল ৬টি, এসএলআর ৪টি, ৯ মিলিমিটার স্টেনগান ১টি এবং গুলি ২০০ রাউন্ড, .৩০৩ ও ৭.৬২ গুলি ২,০০০ রাউন্ড, হ্যান্ড গ্রেনেড ৩৬টি, প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ ২০ পাউন্ড ও ২০টি ডেটোনেটর, অ্যান্টি-পার্সোনেল মাইন ৭টি, বেয়নেট ৬টি।
২০ অক্টোবর রাত ৮টায় ১২০জনের এ রকম ১টি বৃহৎ দল ২জন চাকমাকে গাইড হিসেবে নিয়ে ভারতের সাবরুম বর্ডার পেরিয়ে বাংলাদেশের খাগড়াছড়িতে প্রবেশ করে। পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে কাঁধে অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে পুরাে দল সারারাত অবিশ্রান্তভাবে গন্তব্যের দিকে চলতে থাকে। রাতের বেলায় উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ আর উলুখাগড়ার বন ডিঙিয়ে পথচলা ছিল কষ্টসাধ্য। যারা সচরাচর কায়িক শ্রমের সাথে জড়িত ছিলেন, তাঁদের জন্য এ পথচলা খুবই কষ্টসাধ্য ছিল না। কিন্তু যে-সকল মুক্তিযােদ্ধা এমন পরিবার থেকে এসেছেন, যারা কখনােই কায়িক শ্রমে সম্পৃক্ত ছিলেন না, তাদের কষ্ট ছিল বর্ণনাতীত। মির্জা আবু মনসুর এমপিএ এবং নটরডেম কলেজের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক গােবিন্দ মিত্রের জন্য এ পথচলা ছিল অসহনীয়। তার হাঁটু থেকে পায়ের গােড়ালি। পর্যন্ত ফুলে দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল। জীবনে যিনি ২ মাইলও হাঁটেন নি, এখন হাঁটছেন ১০০ মাইল। সারারাত হেঁটে দলটি ভাের হওয়ার আগেই যাত্রাবিরতি করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার কুমারী নামক একটি গহীন বনে। একটি দোচালা বেড়ার ঘরে ১২০জন পথশ্রান্ত মুক্তিযােদ্ধা সূর্য উঠা পর্যন্ত এখানে অপেক্ষা করতে কোনােরকমে গাদাগাদি করে বসে পড়লেন। চাকমা গাইড ২জন পথের সন্ধানে আরও সামনে অগ্রসর হয়েছে। এর ফাঁকে ক্লান্ত শরীরে সবাই ঘুমিয়ে পড়েন।
২জন গাইড ফিরতে বেশ সকাল হয়ে পড়ে। সাবরুম ট্রানজিট ক্যাম্প থেকে পুরাে দলের জন্য দেওয়া সকালের নাস্তা খাওয়ার জন্য বের করলে দেখা গেল, সব খাবার অযােগ্য হয়ে পড়েছে। কিন্তু ক্ষুধার্ত এক দল লােকের পক্ষে দীর্ঘ ও দুর্গম পাহাড়ি পথ অতিক্রম করা খুবই কঠিন হওয়া সত্ত্বেও সবাই সামনের দিকে রওনা হলেন। মাইল তিনেক হাঁটার পর আশপাশে কিছু চাকমা বাড়িঘর লক্ষ্য করে সবাই যাত্রাবিরতি করলেন। সেক্টর হেডকোয়ার্টারস থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের বেতনের জন্য যে টাকা দেয়া হয়েছিল, তা থেকে কিছু টাকা দিয়ে ২জন গাইড এলাকায় গিয়ে কিছু চাল-ডাল ও একটি রান্নার পাত্রও নিয়ে এল কিন্তু লবণ পাওয়া গেল পাহাড়ি সবজি, শসা ইত্যাদি মিলিয়ে এক বিচিত্র খাদ্য তৈরি করে সবাই গােগ্রাসে খেয়ে ফেললেন। বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় যাত্রা শুরু করেন। একনাগাড়ে ৩০ মাইল পথ অতিক্রম করে যােগ্যছলা নামক স্থানে পৌছান। যােগ্যছলা বাজারে পৌঁছার পর পরই অভুক্ত, পথক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। যােদ্ধাদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনী অতর্কিত হামলা চালায়। এ অবস্থায় সবাই হতভম্ব হয়ে পড়লেও দৃঢ়চিত্ত মুক্তিযােদ্ধারা দিশেহারা হন নি। দ্রুততার সাথে শত্রুকে মােকাবিলা করতে থাকেন। পাকিস্তানি বাহিনী। মুক্তিযােদ্ধাদের বিন্দুমাত্র টলাতে না পেরে দুজন সৈন্যকে মৃত রেখে পিছু হটে যায় (এ আক্রমণ সম্পর্কে এ গ্রন্থের গেরিলা যুদ্ধ পর্ব দেখুন)। এ অবস্থায় মুক্তিযোেদ্ধারা তাদের অসুস্থ ও আহত যােদ্ধাদের নিয়ে পুনরায় যাত্রা করে রাত ২টার সময় রাউজানের কোদালা চা-বাগানে গিয়ে পৌছান। দিন সন্ধ্যায় পুরাে দল আবার রওনা হলাে বােয়ালখালীর দিকে। ততক্ষণে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। রাস্তা ধরে যাওয়া নিরাপদ মনে করে গ্রামের পথ, মেঠোপথ ও জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। চলতে চলতে দলটি নােয়াপাড়া হাটের কাছে কর্ণফুলি নদীর তীরে এসে। পৌছায়। এখানে স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধারা তাদের খাওয়া ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করেন (সিরু বাঙালি, ১৯৯৭: ২১৫-২১৭)।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড