You dont have javascript enabled! Please enable it! ভারতে চট্টগ্রামের মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ - সংগ্রামের নোটবুক
ভারতে চট্টগ্রামের মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ
প্রেক্ষাপট স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর পর বাংলাদেশ থেকে রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে এবং সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা ভারতে গমন করেন মূলত অস্ত্র সংগ্রহ ও সামরিকভাবে সংগঠিত হওয়ার উদ্দেশ্যে। এভাবে তারা প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার অভিন্ন লক্ষ্যকে সামনে রেখেই ভারতীয় সামরিকবাহিনী ও সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সহযােগিতায় মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। সুনির্দিষ্টভাবে মুক্তিযুদ্ধকে সুসংহত ও সশস্ত্র মুক্তিযােদ্ধা তৈরির লক্ষ্যে সুপরিকল্পিত প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে বেশ কিছু যুদ্ধ শিবির ও মুক্তিযােদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। বিভিন্ন সেক্টর গঠনের সাথে সাথে সমাজের বিভিন্ন অবস্থান থেকে আসা হাজার হাজার স্বাধীনতাকামী স্বেচ্ছাসেবক তরুণকে সেক্টরের সরাসরি তত্ত্বাবধানে আনয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। তারপর সুপরিকল্পনা মােতাবেক অভীষ্ট লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধকে পরিচালিত করার প্রয়ােজনে এসব যুব শিবির ও প্রশিক্ষণ শিবিরের জন্য সুসংগঠিত একটি কমান্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য এ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করার নেপথ্যের কারণগুলাে নিমরূপ: ক. বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিরােধ পরিচালনাকারী সব ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, মুজাহিদ, আনসার বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়সাধন করে প্রয়ােজনে আরও প্রশিক্ষণ দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ।
খ. পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তি, উদ্দেশ্য ও কৌশল যাচাই করে সে অনুযায়ী মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষিত করে একটি বাস্তবভিত্তিক কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ। গ. নেতৃস্থানীয় বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান। ঘ, বিপুল সংখ্যক অসামরিক উদ্দীপ্ত যুবককে প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধে | নিয়ােজিতকরণ। , অস্ত্র ও গােলাবারুদ সংগ্রহ করে যুদ্ধে সেগুলাের সর্বোত্তম ব্যবহার। বাংলাদেশের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতারা মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করলেও ভারতীয় সামরিক সহায়তা ভিন্ন তা চালিয়ে যাওয়া সম্ভবপর ছিল না। কিন্তু প্রথম দিকে ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা প্রদানে সিদ্ধান্তহীনতায় ভােগে। এর কারণ ছিল: ক. ভারতের রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের জনগণের দুর্দশা লাঘবে সামরিক হস্তক্ষেপ না করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংসতার বিরুদ্ধে বিশ্বে জনমত গড়ে তােলা। পাকিস্তান দীর্ঘকাল ধরে প্রচারণা চালিয়ে আসছিল যে, ভারত মুসলমানদের রাজ্য নয়।
 
তাই ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের সামরিক তৎপরতায় জড়িয়ে পড়লে এটিকে ভারতীয় হস্তক্ষেপ বিবেচনায় বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভুল ব্যাখ্যা প্রসূত মতভেদের সৃষ্টি হতে পারে। গ, তখনকার পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে সামরিক অভিযান পরিচালনার মতাে সামরিক প্রতি ভারতীয় সেনাবাহিনীর ছিল না। ঘ, ভারতীয় সেনাবাহিনীর ডিভিশনগুলাে চীন ও পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে মােতায়েন ছিল। তাই কোনাে সামরিক অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে ভারতীয় বাহিনীর পুনর্বিন্যাস অত্যাবশ্যক ছিল (মেজর রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম, ১৯৯৯: ২১৫-১৬)। পরিবর্তিত অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামরিক ঘটনাবলির উপযুক্ত সমাধান অন্বেষণকালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। প্রতিরােধ সংগ্রাম যাতে সম্পূর্ণভাবে থেমে না যায়, এজন্য ন্যূনতম ব্যবস্থা হিসেবে ছাত্র-যুবকদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দানের প্রয়ােজন ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক স্বীকৃত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল দায়িত্ব দেওয়া হয়। ৯ মে তাদের হাতে ন্যস্ত হয় মুক্তিযুদ্ধে যােগদানে ইচ্ছুক বাংলাদেশের তরুণদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রদানের দায়িত্ব।
এতদিন বিএসএফ বিক্ষিপ্তভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের যে প্রশিক্ষণ প্রদান করছিল এপ্রিল মাস থেকে তা একটি সাংগঠনিক রূপ পায়। এতৎসত্ত্বেও তরুণদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারে ভারতীয় প্রশাসনের সব অংশের সমান উৎসাহ ছিল না। এর অন্যতম প্রধান কারণ। ছিল নাগা, মিজো প্রভৃতি সশস্ত্র বিদ্রোহীদের তৎপরতার কারণে ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা সম্পর্কে এদের উদ্‌বেগ। তাই প্রথম দিকে রিক্রুটিং সীমাবদ্ধ ছিল শুধু আওয়ামী লীগ দলীয় যুবকদের মধ্যে (মাইদুল হাসান, ১৯৮৬: ১৯)। মুক্তিযােদ্ধা নির্বাচন প্রক্রিয়া দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানিদের নির্যাতন গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়লে এবং তা প্রধানত তরুণ সমপ্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত হতে থাকলে দেশ থেকে হাজার হাজার ছাত্র ও যুবক যুদ্ধ প্রশিক্ষণ লাভের আশায় ভারতে এসে ভিড় করতে থাকেন। ছাত্র, যুবক ও জনতা ভারতে আশ্রয় গ্রহণের ক্রমবর্ধমান হারের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন স্থানে অনেক আশ্রয় শিবির নির্মাণ করা হলেও প্রয়ােজনের তুলনায় সেগুলাে ছিল অপ্রতুল। এসব উদ্বাস্তুদের মধ্য থেকে তরুণ-যুবকদের প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে। দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধ করার জন্য গড়ে তােলা হয়েছিল প্রশিক্ষণ শিবির। প্রথম দিকে গড়ে ৫০০-১০০০ তরুণ এসব শিবিরে অবস্থান করতেন। ভারত সরকার প্রতিটি যুব শিবিরে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক তরুণ ও যুবকদের খাদ্য ও অন্যান্য রসদ সরবরাহের ব্যবস্থা করলেও তা প্রশিক্ষণার্থীদের সংখ্যা অনুযায়ী পর্যাপ্ত ছিল না।
 
এসব শরণার্থী ও যুব শিবির থেকেই ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণের জন্য যাচাই-বাছাই করে রিক্রুট করার আয়ােজন করা হয়। | আওয়ামী লীগ পরিষদ সদস্যদের দ্বারা শনাক্তকৃত তরুণদেরই ভর্তি হওয়ার অনুমতি দেওয়া হতাে (এ সংক্রা যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশ ফোর্সের্স-এর প্রামাণ্য দলিল এ গ্রন্থের ২য় পর্বের প্রথম অধ্যায়ে সন্নিবেশিত এবং বিষয়বস্তুর সারসংক্ষেপ প্রদত্ত)। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের আধিপত্যের নীতি প্রথম থেকেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত রাজনৈতিক পরিকল্পনার পরিপন্থি ছিল। তার ইচ্ছা ছিল আওয়ামী লীগের নির্ধারিত সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত মন্ত্রিসভার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও সরকারকে সমর্থন দানকারী সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একটি মাের্চা বা ফ্রন্ট গঠন করে। দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও সংগঠনের দায়িত্ব প্রদান করা (মাইদুল হাসান, ১৯৮৬: ২২)। প্রশিক্ষণ-প্রক্রিয়া এবং চট্টগ্রামের মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলাের জন্য ক্রমান্বয়ে একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রাতষ্ঠা করা হয়েছিল। ক্যাম্প পরিচালিত হতাে ১জন করে ক্যাম্প ইনচার্জ, ডেপুটি ইনচার্জ, ক্যাম্প সুপারভাইজার, ছাত্র প্রতিনিধি, স্বাস্থ্য অফিসার সমন্বয়ে গঠিত। কমিটি দ্বারা। ইয়ুথ ক্যাম্প পরিচালিত হতাে ১জন করে ক্যাম্প প্রধান, ডেপুটি ক্যাম্প প্রধান, ২৫০জন প্রশিক্ষণার্থীর জন্য ১জন রাজনৈতিক প্রশিক্ষক ও ১জন মেডিক্যাল অফিসার দ্বারা। ক্যাম্প প্রধান ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং উপপ্রধান নিযুক্ত হন ইয়ুথ ক্যাম্প ডিরেক্টরেট দ্বারা। ক্যাম্প প্রধান অন্য সদস্যদের নিয়ােগ করতেন। ক্যাম্প সুপারভাইজার অথবা ক্যাম্প উপপ্রধান সাপ্তাহিক খরচের হিসাব এবং অর্থপ্রাপ্তির হিসাব ডাইরেক্টরেটে দাখিল করতেন। পাশাপাশি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সদর দপ্তরও স্থাপিত হয় (হাসান হাফিজুর রহমান: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিল পত্র, ৩য় খণ্ড, ১৯৮২: পৃ. ৩৭৩-৭৫)। এসব কেন্দ্রে সামরিক ও রাজনৈতিক উভয় ধরনের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হতাে।
 
যুব শিবির পরিচালনা বাের্ড কর্তৃক ছাত্র-যুবকদের স্বল্প সময়ে একটি কার্যকর প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য প্রয়ােজনীয় নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হয়। এ নির্দেশিকায় যুব অভ্যর্থনা ক্যাম্প ও নিয়মিত ক্যাম্প নামে দুই ধরনের ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করার কথা। বলা হয়। সীমান্ত থেকে ৫ মাইল দূরে যুব অভ্যর্থনা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এসব ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল দীর্ঘ পথ অতিক্রমের ফলে ক্লান্ত যুবকদের বিশ্রাম ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা, তাদের পরিচয় পরীক্ষা করা, শত্রুর এজেন্টদের অনুপ্রবেশ রােধ করা, নিয়মিত ক্যাম্পে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত অবস্থানের নিশ্চয়তা বিধান করা ইত্যাদি। ত্রিপুরায় স্থাপিত এ ধরনের ১৬টি অভ্যর্থনা ক্যাম্পে প্রাথমিক বিশ্রাম ও পরিচিতি, রাজনৈতিক নেতাদের কর্তৃক নিরাপত্তা চেক আপ শেষে নিয়মিত ক্যাম্পে প্রেরণের পূর্বে কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। তা ছাড়া সীমান্তের আরও অভ্যন্তরে নিয়মিত ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়, যাতে কোনাে সমস্যা ছাড়াই প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ সম্পন্ন করা যায়। আগরতলা থেকে ৩০ মাইল দূরে ত্রিপুরায় স্থাপিত ১০টি ইয়ুথ ক্যাম্পের প্রতিটিতে ১,০০০জনের থাকার ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। এসব ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করার কারণ সম্পর্কে প্রাগুক্ত নির্দেশিকায় বলা হয় যে পাকিস্তানিদের নিষ্ঠুর অত্যাচারের ফলে ক্রমবর্ধমান হারে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পালিয়ে আসা যুবকশ্রেণিকে প্রশিক্ষিত ও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করে মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ প্রয়ােজন মেটানাে সম্ভব। এরা তাদের শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক মনােবলকে গঠনমূলক খাতে প্রবাহিত করে উদ্বাস্তুদের মুক্ত দেশে ফেরার পথ প্রশস্ত করতে সক্ষম হবে। পাশাপাশি এসব ক্যাম্প থেকে তাদেরকে বিশেষ প্রয়ােজনে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য রিক্রুট করা হবে (প্রাগুক্ত: ৫৮১)।
 
প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলােয় প্রণীত কর্মসূচি অনুযায়ী লক্ষ্য ছিল গড়ে মাসে-প্রতি ২৪,০০০জন করে সংগ্রহের মাধ্যমে ৬ মাসে ১,০০,০০০ বেইজ কর্মী এবং ৩৬,০০০জন বাছাইকৃত ব্যক্তিকে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা। যাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, তাদের জন্য প্রথম ১৫ দিন প্রণােদনা কোর্স এবং পরবর্তী ১৫ দিন শুধু সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় । নিচে চট্টগ্রামের মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য পরিচালিত বিভিন্ন ক্যাম্পের বর্ণনা দেওয়া হলাে: ক, হরিণা ক্যাম্প: দক্ষিণ-পূর্ব জোনের মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য প্রতিষ্ঠিত এ ক্যাম্পে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের তরুণ-যুবকেরা আসতেন এবং পরবর্তীকালে শনাক্তকরণ ও বাছাই পর্বের পর তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শিবিরে পাঠান হতাে। সেসব শিবিরে প্রশিক্ষণ শেষে যােদ্ধারা এ ক্যাম্পের মাধ্যমেই পুনরায় দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতেন। চট্টগ্রাম অঞ্চলের মুক্তিকামী মানুষের ট্রানজিট ক্যাম্প, প্রশিক্ষণ ও গেরিলা কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে এটা গড়ে উঠেছিল। এ ক্যাম্পে ১,০০০জন প্রশিক্ষণার্থী ছিলেন। হরিণা ক্যাম্পের দায়িত্বে নিয়ােজিত ব্যক্তিরা হলেন: ১. ক্যাম্প প্রধান। এম এ মান্নান। ২. ক্যাম্প উপপ্রধান | মােশাররফ হােসেন, এমএনএ ৩. ক্যাম্প সুপারভাইজার জিতেন্দ্র প্রসাদ নাথ। ৪. রাজনৈতিক প্রশিক্ষক। আজিজুল হক চৌধুরী ৫. রাজনৈতিক প্রশিক্ষক প্রফেসর নুর মােহাম্মদ। ৬. রাজনৈতিক প্রশিক্ষক প্রফেসর নুরুল আবসার ৭. রাজনৈতিক প্রশিক্ষক প্রফেসর আবদুল্লাহ আল মামুন। ৮. শরীর চর্চা প্রশিক্ষক। ৪জন (নাম উল্লেখ নেই)। ৯, ছাত্র প্রতিনিধি আবু মাে, হাশেম। ১০. মেডিক্যাল অফিসার ডা. এখলাসউদ্দিন, এলএমএফ ১১. মেডিক্যাল সহকারী হামিদুল্লাহ (প্যারা মেডিক্যাল)।
 
(প্রাগুক্ত: ৭৩০) খ. উদয়পুর ইয়ুথ ক্যাম্প: এ ক্যাম্পের প্রধান ছিলেন মনসুর আলী এবং উপপ্রধান ছিলেন আবদুল্লাহ-আল-হারুন। এ ক্যাম্পে মােট প্রশিক্ষণার্থী ছিল ১,৫০০জন। উদয়পুর ইয়ুথ রিলিফ ক্যাম্পের কর্মকর্তা ও প্রশিক্ষকদের নাম নিচে উল্লেখ করা হলাে: ১. ক্যাম্প প্রধান। ক্যাপটেন এম এস আলী, এমএনএ ২. ক্যাম্প উপপ্রধান আবদুল্লাহ-আল-হারুন, এমপিএ ৩, রাজনৈতিক প্রশিক্ষক প্রফেসর মিহির কুমার দত্ত ৫. রাজনৈতিক প্রশিক্ষক প্রিন্সিপাল গােপালচন্দ্র দাস ৬. রাজনৈতিক প্রশিক্ষক। প্রফেসর মাে. রফিজুর রাসুল চৌধুরী ৭. শরীর চর্চা প্রশিক্ষক। আবদুল বারী খানসহ মােট ৪জন ৮, ছাত্র প্রতিনিধি। নাম নেই। ৯. মেডিক্যাল অফিসার ডা. এস এল দে (এমবিবিএস)। (প্রাগুক্ত: ৭৩১) গ, বগাফা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র: হরিণা ক্যাম্পের সাথে এ ক্যাম্প ছিল। এটি হরিণা ক্যাম্পের সম্পূরক হিসেবে কাজ করে। অসংখ্য যােদ্ধা এ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। এ কেন্দ্রের প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক মাহবুব-উল-আলম বলেন: দুই দিন পর পৌছি এক গভীর জঙ্গলে। সেখানে প্রায় ২০০ ছেলে। সেটাই বাগফা ট্রেনিং সেন্টার। আরও ভিতরে ছােট্ট একটি ক্যান্টনমেন্ট। কমান্ডার শাহ আলম বীর-উত্তম, রণবিক্রম তাতু, কাশেম চিশতি, নাসির উদ্দিন চৌধুরী এফএফ গ্রুপ। তাঁরা ট্রেনিংয়ে প্রশিক্ষণে আছেন। ওখান থেকে আমরা ১২-১৪ দিন পর অস্পিনগরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে চলে যাই। প্রথমে জঙ্গল পরিষ্কার করে ক্যাম্প চালু করি। ওখানে। প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের নিয়ে আসা হয় আগরতলায়। সেখান থেকে। আসি হরিণা ক্যাম্পে (সাপ্তাহিক মুক্তিযােদ্ধা: সংখ্যা-২, পৃ: ১০)। ঘ. অস্পিনগর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র: প্রশিক্ষণার্থীদের কাজে লাগিয়ে এবং জঙ্গল পরিষ্কার করে এ ক্যাম্পটি প্রস্তুত করা হয়। এখানে ছিলেন নুরুল আবসার, শাহ আলম, মিহির চৌধুরী, মাহফজুল বারী, রণবিক্রম তাতু, আবুল কালাম আজাদ, কাশেম চিশতি, আহসান উল্লাহ, নাজিম উদ্দিন চৌং, ইউসুফ খান, কে এম কামাল উদ্দিন, এ টি এম নুরুল আমিন, ইলিয়াস, আবদুল করিম চৌধুরী প্রমুখ নেতা ও যােদ্ধা (ডা. মাহফুজুর রহমান, ১৯৯৩: ৩৩৯)। ঙ. ডিমগিরি যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র: এখানে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং বাঙালি সেনা সদস্যরা প্রশিক্ষণ দিতেন। ফলে এ কেন্দ্রের প্রশিক্ষণের মান ছিল উন্নত।
 
এ কেন্দ্রের প্রশিক্ষণে সুস্পষ্ট নিয়মাবলি অনসুরণ করার ফলে এখানকার প্রশিক্ষণার্থীরা সফলতার সাথে দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা তৎপরতা পরিচালনা করতে সক্ষম হন। এ কেন্দ্রে চট্টগ্রামের অসংখ্য শরণার্থী আশ্রয় গ্রহণ করার ফলে প্রশিক্ষণার্থীদের অনেককে এ ক্যাম্প হতে রিক্রুট করা হয়েছিল। বিএলএফদের জন্য একটি স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এখানে করা হয়েছিল। এ ক্যাম্পে যারা ছিলেন তাদের। মধ্যে অন্যতম হলেন আবু সালেহ, ভূপেন বাবু, সরওয়ার জামাল, মােখতার আহমদ, গােলাম রব্বানী প্রমুখ (প্রাগুক্ত)। চ, শ্রীনগর ক্যাম্প: পােয়াংবাড়ি সার্জেন্ট জহুরুল হক ইয়ুথ ক্যাম্প নামে এটি পরিচিত। এ কেন্দ্রে মূলত মিরসরাই এলাকার ছাত্র-যুবকেরা একত্র হতেন। কাজী জাফর, দেবেন সিকদার প্রমুখের দ্বারা প্রভাবিত এ কেন্দ্র চীন পন্থিদের ঘাঁটি বলে পরিচিত ছিল। এ ক্যাম্পে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করা যায়। এ ক্যাম্প হতে প্রথম প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন চট্টগ্রাম শহর অধিনায়ক ডা. জাহাঙ্গীর কবির। এখান থেকে। প্রশিক্ষণ নিয়ে দলবলসহ মিরসরাই প্রবেশ করেন মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক কাশেম রাজা। এ ক্যাম্পের প্রশাসনে নিয়ােজিত ব্যক্তিরা ছিলেন: ১. ক্যাম্প প্রধান খায়ের উদ্দিন আহমেদ, এমপিএ ২. ক্যাম্প উপপ্রধান মির্জা ফিরােজ আহমেদ ৩, ক্যাম্প সুপারভাইজার মাে. মােস্তফা ৪. রাজনৈতিক প্রশিক্ষক মােশাররফ হােসেন। ৫. রাজনৈতিক প্রশিক্ষক আলী আহমেদ মাস্টার ৬. রাজনৈতিক প্রশিক্ষক মােজাফফর আহমেদ। ৭. শরীর চর্চা প্রশিক্ষক খােরশেদ আলম প্রমুখ।
 
৮. ছাত্র প্রতিনিধি দিলীপ কুমার চৌধুরী ৯. মেডিক্যাল অফিসার মাে. মজিবুল হক। (প্রাগুক্ত: ৬৬৪) উপরি-উক্ত ক্যাম্প ছাড়া অন্য যে-সব ক্যাম্পে চট্টগ্রামের মুক্তিযােদ্ধারা অবস্থান করতেন, সেগুলাে হলাে: শ্রীনগর বাজার অনুপ্রবেশ ক্যাম্প, চাকুরিয়া ট্রেনিং ক্যাম্প, রুশপন্থি কমিউনিস্ট পার্টি ও সহযােগীদের অবস্থান, ডিমাতলি ক্যাম্প, এনপিসিসি রেস্ট হাউজ, শ্রীধর ভিলা, ৪ নম্বর প্রিন্সেস স্ট্রিট, আগরতলা কলেজ টিলা, বাধারঘাট গ্লাস ফ্যাক্টরি, আসামের মাসিমপুর, লায়ালপুর ক্যান্টনমেন্ট ট্রেনিং ক্যাম্প, ঋষ্টমুখ ক্যাম্প, পানছড়ি ক্যাম্প, তেফানিয়া ক্যাম্প, মনু ক্যাম্প, পালাটোনা ট্রেনিং ক্যাম্প, বগা পাহাড় ক্যাম্প, তেইল্যা মােড়া ক্যাম্প, বতিসা ক্যাম্প প্রভৃতি। চট্টগ্রামের মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শিবিরের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হতে এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে মােট ৯টি প্রশাসনিক জোন প্রতিষ্ঠার ঘােষণা দেওয়া হয়। সাবরুমে সদর দপ্তর স্থাপন করে পূর্বাঞ্চলীয় জোন গঠিত ছিল চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, ফেনী সাব-ডিভিশনকে নিয়ে (হাসান হাফিজুর রহমান: বাংলাদেশের। স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিল পত্র, ৩য় খণ্ড, ১৯৮২: ৮৬)। প্রথম দিকে এ জোনের পরিচালক ছিলেন এম এ আলম। পরিচালক প্রশাসন প্রফেসর নুরুল ইসলাম, প্রশিক্ষণ অফিসার খালেদ মােহাম্মদ আলী, সাপ্লাই অফিসার বজলুর রহমান ও সার্ভিস অফিসার ছিলেন মােশাররফ হােসেন। মে মাসে আহমদ আলীকে চেয়ারম্যান করে যুব শিবিরগুলাের জন্য একটি জোনাল উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়। এ সময় প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির গঠন ছিল নিম্নরূপ: প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর মাহবুবুল আলম ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর ডা, আবু ইউছুপ প্রশাসক প্রফেসর নুরুল ইসলাম চৌধুরী পরিচালক চলাচল মােজাফফর আহমদ পরিচালক মােটিভেশন। খালেদ মােহাম্মদ আলী উপপরিচালক বজুলর রহমান। উপপরিচালক অর্থমােশাররফ হােসেন উপ কো-অর্ডিনেটর রাজনৈতিক দেব্রত দত্তগুপ্ত ।
 
(ডা. মাহফুজুর রহমান, ১৯৯৩: ৩৩৪) জুন মাসে এ অঞ্চলে জহুর আহমদ চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির নাম ছিল ‘Bengal Liberation Council’। এর সদস্য ছিলেন জহুর আহমদ চৌধুরী, নুরুল হক, শামসুজ্জোহা, আবদুল কুদুস মাখন, জহুরুল কাইয়ুম, মিজানুর রহমান চৌধুরী। প্রমুখ। সেপটেম্বর মাসে ট্রানজিট ও যুব শিবির পরিদর্শনের জন্য লিবারেশন কাউন্সিল আলী আহমদকে চেয়ারম্যান, গাজী গােলাম মােস্তফা, মাে. ইলিয়াস, মাে. আলী, আবদুল্লাহ-আল-হারুনকে সদস্য করে একটি কমিটি গঠন করে। অক্টোবরে পূর্বাঞ্চলীয় জোনকে কয়েকটি সাব-জোনে ভাগ করা হয়। প্রশিক্ষণ ও কর্মসূচি বাংলাদেশ সরকার যুব শিবির পরিচালনা বাের্ড কর্তৃক শক্রর বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে যুদ্ধ করার জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য নিমরূপভাবে বিস্তারিত প্রশিক্ষণ পাঠ্যক্রম ও কর্মসূচি প্রস্তুত করা হয়েছিল। ঐ কর্মসূচির সংক্ষিপ্তসার নিমে প্রদত্ত হলাে: ক, কোর্স সিলেবাসের রূপরেখা: নিজেদের এককভাবেই স্বাধীনতার জন্য লড়াই চালাতে হবে। বিদেশের ওপর নির্ভর না করে সব কষ্ট ও সংঘাত নিজেদেরই সহ্য করতে হবে। এর জন্য তরুণদের গেরিলা যুদ্ধের কৌশলে প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। যে-সব তরুণ প্রশিক্ষণের আওতায় আসবেন না, তাঁদের বেইজ কর্মী হিসেবে নিয়ােগ করতে হবে অথবা অগ্রবর্তী ও পশ্চাৎ রক্ষাকারী দল হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। যারা দেশের অভ্যন্তরে অবস্থান ও বসবাস এবং স্বাধীনতার আকাঙক্ষা পােষণ করছেন, তাদেরও যুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত করা হবে। গ্রাম পঞ্চায়েত গঠন করে প্রতিটি গ্রামকে স্বাবলম্বী করা হবে, যাতে তাদের পাকিস্তানি সরকারের দ্বারস্থ হতে না হয়। এসব গ্রামে নিরাপদ বেইজ করে বেইজ। কর্মী বাহিনী গঠন করা হবে। জনগণকে সম্পৃক্ত করে একটি সর্বাত্মক জনযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হবে। হাতেকলমে বাস্তব প্রশিক্ষণের কর্মসূচি: উদ্দেশ্য, শিক্ষিত বাঙালিদের দৈহিক শ্রমের প্রতি অনাগ্রহকে ভেঙে দিয়ে দৈহিক শ্রমের প্রশিক্ষণ প্রদান। ১. এলােমেলাে চলার অভ্যাস পরিত্যাগের লক্ষ্যে সারিবদ্ধভাবে চলা। ২. প্রতিদিন সকালবেলা ক্যাম্পিং এবং বিকালে খেলাধুলা।
৩. প্রতিদিন ক্যাম্পের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি। ৪. বিভিন্ন টিম ও সেলের পালাক্রমে ক্যাম্পে নিমলিখিত কাজ করা:
ক, ক্যাম্প স্যানিটেশন, উচ্ছিষ্ট পরিষ্কার ও ব্যবহার। খ, অন্য ক্যাম্পের সাথে যােগাযােগ রক্ষা। গ, ক্যাম্পের পানি সরবরাহ এবং গােসল ও ধােয়ার কাজের জন্য। | পানি জমিয়ে রাখা। ঘ, জ্বালানি কাঠ ক্রয় ও সংগ্রহ। ঙ. থাকার ব্যবস্থা, হাসপাতাল, মসজিদ, মন্দির পরিষ্কার ও | উন্নয়নের ব্যবস্থা। চ. রান্না, বিতরণ এবং বিভিন্ন স্থানে নিয়ােজিত প্রশিক্ষণ দলের জন্য খাবার বহন। ছ, পয়ঃ নিষ্কাশন, বন্যা, খরা নিয়ন্ত্রণ। জ, চুল কাটা এবং ধোপা তদারক। ৫. গ্রামাঞ্চলে কাজের প্রশিক্ষণ: ক, কোদাল ব্যবহার করে খনন, মাথায় করে মাটি বহন, বাঁধ ও রাস্তা নির্মাণ। খ, লাঙলের ব্যবহার। গ. ফল ও সবজি চাষাবাদ প্রশিক্ষণ ইত্যাদি। গ, প্রশিক্ষণ চলাকালীন অবশ্য অনুধাবনীয় ও পালনীয় বিষয়: আলােচ্য প্রশিক্ষণ নির্দেশিকার ভাষ্যে সেগুলাে নিম্নরূপ: ১. আমরা যুদ্ধাবস্থায়। তাই কঠোর শৃঙ্খলা ব্যতীত যুদ্ধ করা এবং বিজয় অর্জনও সম্ভব নয়। সবাইকে একসাথে নেতৃত্ব প্রদান সম্ভব নয়। নির্বাচিত নেতাকেই অনুসরণ করতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে যথাসম্ভব গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসৃত হলেও গৃহীত যে-কোনাে সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক। ৪. সুনির্দিষ্টভাবে নিজেদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে। শুধু কাজ সমাপ্ত করার জন্য কাজ না করে প্রত্যেকের কাজের প্রকৃত উদ্দেশ্য অনুধাবন করা উচিত। ৫. যে-কোনাে বিষয়ে সমালােচনা না করে উন্নতির বিষয়ে পরামর্শ দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের সমস্যার জন্য আমরা সবাই দায়ী এবং আমাদের পারস্পরিক সহযােগিতাই আগামী দিনগুলােকে সুখময় করবে। 
 
 
উপযুক্ত প্রশিক্ষণ সিলেবাস, পরিকল্পনা ও কার্যক্রম পর্যালােচনা করে বলা যায়। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকেরা একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের পরিকল্পনা করেছিলেন। স্বল্প সময়ের যুদ্ধে দেশকে শত্রুমুক্ত করার চিন্তা ছিল উচ্চাভিলাষী স্বপ্ন। তাই প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে রাজনৈতিক প্রণােদনা ও সামরিক প্রশিক্ষণের সাথে সাথে গ্রাম পঞ্চায়েত গঠন, দেশের অর্থনীতির মূলভাগ, কৃষি ও ক্ষুদ্র কুটিরশিল্পের উন্নয়নের প্রশিক্ষণ প্রদানের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, যাতে প্রয়ােজনে জনগণ পাকিস্তানি সরকারের। মুখাপেক্ষী না হয়ে স্বাবলম্বী হতে এবং গেরিলা যােদ্ধারা জনগণের মাঝে মিশে স্বচ্ছন্দে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারেন। এ কথা সত্য যে যুদ্ধকালীন। প্রয়ােজনে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণসূচি অনুযায়ী প্রশিক্ষণ প্রদান করা সম্ভব হয় নি। শুধু স্বল্প সময়ে হালকা অস্ত্র চালনা, বিস্ফোরক প্রস্তুত ও স্থাপন এবং শারীরিক সামর্থ্য অর্জনের প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেয়া হয়। পরিকল্পনা অনুসারে প্রশিক্ষণ প্রদান করলে স্বাধীন বাংলাদেশের টেকসই অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় মুক্তিযােদ্ধারা প্রচুর অবদান রাখতে পারতেন। | প্রবাসী সরকারের নেতারা সময় সময় প্রশিক্ষণ শিবির পরিদর্শন করে। শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করতেন। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে পরিদর্শনকালীন যুব শিবিরে প্রদত্ত বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামরুজ্জামানের এক ভাষণে শিবিরে আগত যুবকদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানা যায়: …all of them have come with the same plea, the plea to train them up as soon as possible in the art of modern military practice in this crisis period of our country. তিনি প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে বলেন, We must remember nobody ever makes a gift to you of your freedom, you have to earn it. If we think somebody else will win our freedom for us, we shall commit utter folly. সবশেষে তার ভাষণে উল্লিখিত হয়, এখানকার প্রশিক্ষণার্থীরাই স্বাধীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।
তার ভাষ্য মতে …I want to infrom you on behalf of my Government that the basis for the future army of the country will be you. Those who shall excell in the freedom fight, those who will prove themselves to be the finest fighters, they will give the leadership to our future army. Leadership you cannot pick up in the street. Remember, one has to earn leadership as well. (হাসান হাফিজুর রহমান: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিল পত্র, ৩য় খণ্ড, ১৯৮২: ৭৩-৭৫) 
 
প্রশিক্ষণের সময় ও প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি
 
শুরুতে গেরিলাদের দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দেয়া হতাে। কিন্তু এ প্রশিক্ষণ যথেষ্ট ছিল না। পরে তিন সপ্তাহের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যুদ্ধের জন্য সর্বাধিক সংখ্যক লােককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে রাইফেল, স্টেনগান, গ্রেনেড, বিস্ফোরক প্রভৃতির ব্যবহার শেখানাে হতাে। রণকৌশল হিসেবে প্রধানত অ্যামবুশের কায়দাকানুন শেখানাে হতাে। প্রশিক্ষণের লক্ষ্য ছিল গুণগত মানের চেয়ে পরিমাণগত দিক দিয়ে অধিকসংখ্যক লােক গড়ে তােলা। প্রশিক্ষণের প্রয়ােজনীয় সব দ্রব্য ও সরঞ্জামের জন্য ভারতীয় প্রশাসনের ওপর নির্ভর করতে হতাে। প্রশিক্ষণার্থীর বিবরণে ভারতে মুক্তিযুদ্ধ প্রশিক্ষণ চট্টগ্রাম অঞ্চলের একজন প্রশিক্ষণার্থীর বিবরণ থেকে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলাের অবস্থা, প্রশিক্ষণের স্বরূপ ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে জানা যায়:
২ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার আমাদের বহু প্রতীক্ষিত সেই দিনটি এল। এদিন আমরা ট্রেনিংয়ের জন্য যাত্রা করতে প্রস্তুত হলাম। যারা ট্রেনিংয়ের। জন্য নির্বাচিত হলাে, তাদের প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে সেক্টর অধিনায়ক মেজর রফিকুল ইসলামের সামনে দাঁড়াতে হলাে। তিনি নিজেই সবার ডাক্তারি ফিটনেস পরীক্ষা করলেন। এর আগে ২৬ মার্চ প্রথম যেদিন মেজর (তখন তিনি ক্যাপটেন ছিলেন) রফিকুল ইসলামকে আমি চট্টগ্রাম টাইগার পাস পাহাড়ের ওপর তার সাময়িক সামরিক সদর দপ্তরে দেখি, তখন তিনি ছিলেন উজ্জ্বল, উজ্জীবিত টগবগে এক তরুণ। শাণিত দৃষ্টির কালাে ব্যাব্রাশ করা সেদিনের সেই উচ্ছল যুবকটি আজকের ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডিং অফিসার মেজর রফিকুল ইসলামের মধ্যে সম্পূর্ণই অনুপস্থিত। …২ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার ৩টি টাটা ট্রাকে গাদাগাদি করে আমরা এক দল স্বাধীনতা পাগল যুবককে হরিণা ইয়ুথ ক্যাম্প থেকে রাতের অন্ধকারে উদয়পুর মহকুমার পালাটানা নামক একটি সীমান্তবর্তী গভীর জঙ্গলের ট্রেনিং ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। …স্থানীয় সময় রাত প্রায় একটার সময় আমরা পালাটানা ট্রেনিং ক্যাম্পে গিয়ে পৌছলাম। সে রাত এবং তার পরদিন আমরা পূর্ণ বিশ্রামের সুযােগ পেলাম। এর পরদিন।
বিভিন্ন ট্রেনিং গ্রুপে আমাদের ভাগ করা হলাে। প্রতি ৪০জনকে নিয়ে একটি কোম্পানি গঠন করা হলাে। আমি ‘বি’ কোম্পানির কমান্ডার নিযুক্ত হলাম। আমার কোম্পানিকে আবার দুটি গ্রুপে বিভক্ত করা হয়েছিল। এদের এক গ্রুপের কমান্ডার নিযুক্ত হলাে ফটিকছড়ির নুরুল আবছার নামে এক যুবক। অন্য গ্রুপের কমান্ডার নিযুক্ত হন আমার বন্ধু এম. এ বশর। …ট্রেনিংয়ের প্রথম ১০ দিন আমাদের ফিজিক্যাল ট্রেনিং বা শারীরিক কসরত শিক্ষা নিতে হলাে। এটা ছিল অনেকের জন্য খুবই কষ্টকর ব্যাপার। বিশেষ করে যারা বড়ােলােকের আদুরে ছেলে ছিল, তাদের জন্য। খুব ভােরে উঠে পার্বত্য এলাকার বিপৎসংকুল পাহাড়ি রাস্তায় ডাবল মার্চ করা, পাহাড় বেয়ে ওপরের দিকে ওঠা, আবার দ্রুত নিচের দিকে নামা, এসব কিছু কিছু ছেলের জন্য একবারে প্রাণান্তকর অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। তারা না পারছিল এখান থেকে পালিয়ে যেতে, না পারছিল এসব করতে। ফিজিক্যাল ট্রেনিংয়ের পর, ১০ দিন আমাদের প্রশিক্ষণ চলল বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র খােলা-বাধার এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ করার পদ্ধতি নিয়ে। কোন অস্ত্র কীভাবে ব্যবহার করা হয় এবং কত রকমভাবে ব্যবহার করা যায়, তার পদ্ধতির প্রশিক্ষণও এর সাথে দেয়া হয়। অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন, অ্যান্টি-পার্সোনেল মাইন ও অন্যান্য স্থল মাইন কীভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে বিছানাে হয়, কীভাবে তা আবার নিরাপদে তুলে ফেলা যায়, তার প্রশিক্ষণও দেওয়া হয় এর সাথে। এ প্রশিক্ষণ চলাকালীন সবচেয়ে বেশি কষ্ট করতে হয়েছে আমাকে। প্রতিটি অস্ত্রের পার্টস খুলে খুলে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় রাখা হতাে। আর সেসব বিচ্ছিন্ন পার্টসের এক একটি, ট্রেনার মি, জোয়ে হাতে নিয়ে আমাদের দেখাতেন এবং সেই পার্টসের নাম বলতেন। আমরা সবাই তার সাথে কোরাস করে সেই পার্টসের নাম মুখস্থ করতাম। সমস্যাটা দেখা দিত তারপর। এবার আমাকে সেসব পার্টসের বাংলা অনুবাদ করে সবাইকে বলতে হতাে।
কিন্তু আমাদের ছেলেদের অনেকেই সেসব পার্টস বা অংশের নাম দুই মিনিট পর ভুলে যেত অথবা উলটাপাল্টা বলত। এ রকম হলেই মি. জোয়ে আমাকে আবার প্রথম থেকে সবকিছু শুরু করতে নির্দেশ দিতেন। …এ রকম আমাদের প্রশিক্ষণ দলে বহু প্রশিক্ষণার্থী ছিলেন, যারা বিভিন্ন অস্ত্রের ফায়ারিং রেঞ্জের মাত্রা বার বার শিখিয়ে দেওয়ার পরও মনে রাখতে পারত না। এলএমজি, .৩০৩, এসএলআর, বিডিএফ রাইফেলস- এসব অস্ত্রের ফায়ারিং রেঞ্জ প্রায় সমান। ত্রিশ বার করে প্রত্যেকটি অস্ত্রের রেঞ্জ বিশদভাবে সবাইকে বাংলায় বােঝানাে হয়েছে। কিন্তু পরদিন মি. জোয়ে যখন যাচাই করতে শুরু করলেন, তখন দেখা গেল, অনেকেই তালগােল পাকিয়ে ফেলেছেন। অনেকেই মনে করত, এলএমজি যখন নামটি শুনতে বড়াে, নিশ্চয় তার রেঞ্জও বেশি হবে। তাই অনেককে এ রকমও বলতে দেখেছি যে, .৩০৩ রাইফেলের রেঞ্জ বলছে ২০০ গজ, আর এলএমজি’র রেঞ্জ বলেছে ২,০০০ গজ। …তৃতীয় ১০ দিনের ট্রেনিং শুরু হলাে ফায়ারিং দিয়ে। প্রথমে ফায়ারিং হলাে পিস্তলের। তারপর হলাে ৯ মিলিমিটার স্টেনগানের। তারপর ৩০৩ রাইফেল, এসএলআর ও লাইট মেশিনগানের ফায়ারিং দিয়ে শেষ হলাে ফায়ারিং ট্রেনিং। গ্রেনেড ফায়ারিংটি ছিল ভয়ংকর প্রশিক্ষণ। গ্রেনেড ফাটার পর এর স্প্লিন্টারগুলাে যখন ছি ছি শব্দে ওপর দিকে ওঠে, তখন মনে হতাে সেগুলাে আমার নিজের মাথায় এসেই বােধ হয় পড়ছে। …এর পরের পাঁচ দিন হলাে সবকিছুর পর্যালােচনা এবং পলিটিক্যাল মােটিভেশন। রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদানকালীন এ সময় একদিন আমি পাকিস্তানি পাঞ্জাবিদের বিরুদ্ধে রূঢ় মন্তব্য করলে আমাদের ট্রেনার মি. জোয়ে আমাকে পাঞ্জাবি জাতিকে গালাগাল না করার জন্য সতর্ক করে। দেন। …১০ অক্টোবর রবিবার আমরা পালাটানা ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে আবার আমাদের স্টেশন হেডকোয়ার্টারস হরিণায় ফিরে এলাম (সিরু বাঙালি, ১৯৯৭: ২০২-২০৭)। 

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড