যুদ্ধ প্রশিক্ষণ : প্রসঙ্গ চট্টগ্রাম
যে-কোনাে যুদ্ধের সফলতা যােদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ওপর অনেকখানি নির্ভর করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে স্বল্প সময়ে সফলতা লাভ করার লক্ষ্যে একটি নিয়মিত ও গেরিলা বাহিনীর যােদ্ধাদের সুপরিকল্পিতভাবে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তােলার জন্য নেতারা নিরলস ও নিরবচ্ছিন্নভাবে তৎপর ছিলেন। যুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তানি সশস্ত্রবাহিনীর স্বাধীনতাকামী বাঙালি সদস্যরা ছাড়া লক্ষ লক্ষ ছাত্র-জনতার কোনাে সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল না। মুক্তিকামী এ জনতার তরুণ অংশকে বিভিন্ন সেক্টরের অধীনে সশস্ত্রবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় প্রশিক্ষিত করে তােলে। প্রশিক্ষণ কর্মকাণ্ডের উদ্দিষ্ট ছিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা। এর প্রয়ােজনে স্বল্প সময়ের জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা যুদ্ধ এবং সীমান্ত এলাকায় সম্মুখসমরে পাঠানাে হয়। তাই যােদ্ধাদের কাছ থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে দুর্বলতার প্রকাশ ছিল একবারেই স্বাভাবিক। এতৎসত্ত্বেও স্বল্প প্রশিক্ষণের যােদ্ধারা সাহসিকতা ও নৈপুণ্য প্রদর্শন করার ফলে অল্প সময়ে চূড়ান্ত সফলতা অর্জন সম্ভব হয়েছিল। সফলতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণ প্রদানকারী ও তাদের সুপরিকল্পিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বিরাট অবদান রেখেছিল। ২৫ মার্চের পর জনগণ রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হয়ে সম্ভাব্য সশস্ত্র সংগ্রামের লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিচ্ছিন্নভাবে প্রশিক্ষণের কাজ শুরু করলেও পরিকল্পিতভাবে প্রশিক্ষণ শুরু হয় প্রতিরােধ যুদ্ধের পরে।
প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে ২৫ মার্চের পূর্ব ও পরবর্তী- এ দুই পর্যায়ে বিভক্ত করে আলােচিত হবে। ২৫ মার্চের পূর্বের প্রশিক্ষণ প্রতিরােধ যুদ্ধে পিছিয়ে আসার পটভূমিতে সংঘবদ্ধ প্রশিক্ষণ কর্মকাণ্ড শুরু হলেও মুক্তিকামী জনতা ২৫ মার্চের ‘আগেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেন। ১৯৬৬ সালের ৬-দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন অনেক ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতাদের মনে এ ধারণা বদ্ধমূল হতে থাকে। যে, এ অঞ্চলের জনগণের স্বাধীকার আন্দোলনের অনিবার্য পরিণতি হবে একটি সশস্ত্র ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ সম্ভাব্য সশস্ত্র সংগ্রামকে উপলক্ষ্য করে ছাত্ররাজনৈতিক নেতাদের অনেকে সশস্ত্র আন্দোলনের জন্য সামগ্রিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে তখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে এ ধারণা আলােচিত না হলেও ১৯৭০ সালের নির্বাচন পরবর্তী ঘটনাবলি জনগণের সামনেও এ কথা প্রমাণ করে দেয় যে, একটা সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া শুধু গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক পন্থায় মৌলিক দাবি আদায় করা সম্ভব নয়। সম্ভাব্য সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি হিসেবে মার্চ মাস থেকেই চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে ওঠে। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলাের অধিকাংশ ছিল চট্টগ্রাম শহরকেন্দ্রিক।
নিচে এ রকম কয়েকটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলাে: ক, মেডিক্যাল কলেজ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র: চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা সশস্ত্র সংগ্রামের লক্ষ্যে মার্চ মাসে কলেজ চত্বরে সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তােলেন। এঁদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে এবং পরবর্তীকালে গেরিলা কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ছাত্রনেতাদের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন সাবের আহম্মদ চৌধুরী, মাহফুজুর। রহমান, ওমর সাফায়াত কায়সার প্রমুখ। ৭০-৭৫জনকে ৩টি প্লাটুনে। বিভক্ত করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্লাটুনগুলাের নাম ছিল দুর্জয়, দুর্গম, শাল। এ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ফাহিম উদ্দিন প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কাকলী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র: চট্টগ্রাম শহরের নাসিরাবাদ এলাকায় এনায়েত মওলা ও মিসেস মওলার মালিকানাধীন কাকলী নামের এ বাড়িতে ২৫ মার্চের পূর্বেই অনেক ছাত্র-যুবকের আগ্রহে প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু হয়ে যায়। অ্যাডভােকেট আজিজুল হক চৌধুরী, এনায়েত মাওলা ও মিসেস মাওলা এবং এয়ার ফোর্সের প্রাক্তন কর্মকর্তা নুরুল হুদা প্রশিক্ষণ দিতেন। বিভিন্নজনের লাইসেন্সধারী বন্দুক এবং অবাঙালিদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া অস্ত্রের সাহায্যে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়। এখান থেকে উৎসাহীদের সংগঠিত করে প্রথমে কুমিরা অঞ্চলের অধিবাসী করিম সাহেবের খামারবাড়িতে প্রশিক্ষণ প্রদানের আয়ােজন করা হয়। পরে দূরত্বের কারণে সেটি বন্ধ করে অ্যাডভােকেট আজিজুল হক চৌধুরীর নাসিরাবাদস্থ বাড়ির কাছে পাহাড়ের পাদদেশে শুরু হয়। এখানে। মহিলাদের জন্যও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তা ছাড়া কাকলীতে প্রদত্ত প্রশিক্ষণ এবং সংগৃহীত অস্ত্রসংক্রান্ত উদ্ভূত নানাবিধ সমস্যা ও প্রশ্নের সমাধান ও উত্তর দিতে হতাে (এনায়েত মওলা, ১৯৯৯: পৃ. ১৭ ২০)। গ, সিটি কলেজ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র: মার্চ মাস থেকেই মৌলৰি সৈয়দ আহমদের সহযােগিতায় সিটি কলেজের ছাত্র সংসদের ক্রীড়া সম্পাদক জাহাঙ্গীর চৌধুরী ছাত্রদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। মৌলবি সৈয়দকে প্রধান এবং জাহাঙ্গীর চৌধুরীকে উপদেষ্টা করে এখানে প্রশিক্ষিত ছাত্রদের নিয়ে। ১৯৭১ সালের ৪ মার্চ বাংলা বাহিনী গঠন করা হয়। ২৩ মার্চ এ বাহিনী সার্কিট হাউজ থেকে মার্চ-পাস্ট করে লালদিঘিতে এসে জমায়েত হয় (সাপ্তাহিক মুক্তিযােদ্ধা সংখ্যা-৩, পৃ. ১৪)।
প্রশিক্ষণের অস্ত্র সংগ্রহ পদ্ধতি
চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে অস্ত্র লুট করে এসব প্রশিক্ষণের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ করা হতাে। উদাহরণ হিসেবে ১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ আন্দরকিল্লার একটি বন্দুকের দোকান লুটের কথা উল্লেখ করা যায়। এ সম্পর্কে মুক্তিযােদ্ধা ও প্রশিক্ষক ফাহিম উদ্দিনের বক্তব্য উদ্ধৃতিযােগ্য: .অনেক তরুণ প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য নাম লেখাতে লাগল। সাধারণ মানুষের দেওয়া অস্ত্র দিয়ে দুই শতাধিক তরুণকে প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। আমরা ঠিক করলাম, ১২০ আন্দরকিল্লা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ অফিসের নিচতলায় বিভিন্ন অস্ত্র বিক্রির দোকান থেকে অস্ত্র লুট করা হবে। যদিও দোকানের সামনে পুলিশ প্রহরা ছিল। আমরা সুকৌশলে পিছনের ভেন্টিলেটার দিয়ে দোকানে প্রবেশ করে বেশ কিছু অস্ত্র জোগাড় করে ফেললাম (সাপ্তাহিক মুক্তিযোেদ্ধা: সংখ্যা-২, পৃ: ১৩)। চট্টগ্রাম কলেজের ইউটিসি কেন্দ্রের রাইফেল, কলেজিয়েট স্কুল, মাদারবাড়ি গোডাউন, রাইফেল ক্লাব, ফরেস্ট গােডাউন, কোর্ট বিল্ডিংয়ের মালখানা, নালাপাড়া। স্টেট ব্যাংকের গােডাউন, চকবাজার পুলিশ বিট, এ কে খান ফ্যাক্টরি ইত্যাদি স্থান হতেও লুট করার মাধ্যমে অস্ত্র সংগৃহীত হয়। ২৫ মার্চের পরের প্রশিক্ষণ। ক. রাঙামাটি সদরে: ২০-২৫জন ছাত্র, স্থানীয় পুলিশ এবং আনসার বাহিনীর। সদস্যদের নিয়ে ২৫ মার্চের পর রাঙামাটি সদরে অস্থায়ী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখনকার পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক এইচটি ইমাম এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং এখানে প্রশিক্ষণ নেন। (৩০৫ পদাতিক ব্রিগ্রেড কর্তৃক প্রস্তুতকৃত বুকলেট)। রামগড়ে: রামগড় পােস্ট অফিসের দ্বিতীয় তলায় মেজর জিয়াউর রহমান এবং ক্যাপটেন রফিকের তত্ত্বাবধানে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য একটি কেন্দ্র গড়ে তােলা হয়। সামরিকবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এবং সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য এটাই প্রথম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল ক্যাপটেন আফতাব কাদের এ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পুলিশের হাবিলদার আবুল কাশেম এখানে প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়ােজিত ছিলেন (সাপ্তাহিক মুক্তিযােদ্ধা: সংখ্যা-৩, ১৯৯৯ পৃ. ২৭)।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড