You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.25 | রামগড়ের যুদ্ধ, চট্টগ্রামের প্রতিরােধ যুদ্ধের তাৎপর্য, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র - সংগ্রামের নোটবুক
রামগড়ের যুদ্ধ
২৫ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে করেরহাটের পতন ঘটে। তারপর পাকিস্তানি বাহিনী তিন দিক দিয়ে রামগড়ের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। করেরহাট-রামগড় সড়কে এক দল, নারায়ণহাট-হিয়াকু-রামগড় পথে দ্বিতীয় দল এবং মহালছড়িরামগড় সড়ক ধরে তৃতীয় দল অগ্রসর হয়। করেরহাট ও রামগড়ের মাঝামাঝি স্থানে ছােট্ট বাজার হিয়াকু। রামগড় দখলের লক্ষ্যে হিয়াকু দখল অপরিহার্য ছিল বিধায় পাকিস্তানি বাহিনী ইতােমধ্যে হিয়াকু দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। হিয়াকুর পতনের পর রামগড়ের পতন অবশ্যম্ভাবী ও ত্বরান্বিত হয়ে পড়ে। ৩০ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী রামগড় পরিদর্শনে আসেন। তিনি রণকৌশলগত প্রয়ােজনে অন্তত ২ দিন রামগড় নিজেদের দখলে রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালানাের জন্য মুক্তিবাহিনীকে নির্দেশ দেন। ১ মে পাকিস্তানি বাহিনী রামগড়ের আশপাশের এলাকার ওপর প্রচণ্ড গােলা বর্ষণ শুরু করে।
পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি দল মূল সড়ক ধরে অগ্রসর হয়। অন্য ১টি দল রামগড়ের দক্ষিণ-পূর্বে পাহাড়ের দিকে এগােতে থাকে। ঐ রাতে পাকিস্ত নি হিন এ হড়ের ভিতরে সৈন্যসমাবেশ করে। ২ মে সকালে পাকিস্তানি। হিন হয়ে গড়ের ওপর আক্রমণ শুরু করে। কামানের প্রচণ্ড গােলা বর্ষণের ছত্রছায়ায় পুস্তিানি সেনারা সড়ক পথে অগ্রসর হয়ে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেঙে ফেলে। শেলের আঘাতে মুক্তিবাহিনীর বাংকারগুলাে ভেঙে পড়তে থাকে। শত্রুর দ্বিতীয় দলটি তাদের সৃষ্ট ধূম্রজালের আড়ালে পাহাড় থেকে নেমে এসে রামগড়ের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান নেয়। সন্ধ্যার কিছু পূর্ব থেকে শহরের মধ্যস্থলে পাকিস্তানি বাহিনী চূড়ান্ত আক্রমণ পরিচালনা করে। রাত অবধি তুল লড়াই চলার পর মুক্তিবাহিনীর গােলাবারুদ শেষ হয়ে গেলে ঐ রাতেই তারা গত পরিত্যাগ করে ভারতের সাবরুমে আশ্রয় গ্রহণ করেন। আর এর সাথে সমগ্র চট্টগ্রাম এলাকা পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে, পতন ঘটে চট্টগ্রামের, সমাপ্তি ঘটে অসমসাহসী মুক্তিযােদ্ধাদের সীমিত শক্তির অনন্যসাধারণ প্রতিরােধ যুদ্ধের বর্ণাঢ্য ইতিহাসখ্যাত প্রথম পর্বের।
চট্টগ্রামের প্রতিরােধ যুদ্ধের তাৎপর্য
বৃহত্তর চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্নে সংঘটিত প্রতিরােধ যুদ্ধ কয়েকটি কারণে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ও বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত। সেগুলাে হলাে:
গণ সচেতনতা
পাকিস্তানি প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে চট্টগ্রাম অগ্রণী ভূমিকা রাখে। মার্চের প্রথম থেকেই চট্টগ্রামে শুরু হয় প্রচণ্ড বিক্ষোভ। চট্টগ্রামের রাজনীতিবিদ, সামরিক ও অসামরিক কর্মচারী ছাড়াও আপামর জনগণই সমন্বিত বিক্ষোভের এক অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তা ছাড়া ২৫ মার্চ কালরাতের পূর্বেই চট্টগ্রামে ‘পাকিস্তানি বাহিনী ঠেকাও মনােবৃত্তি নিয়ে আপামর জনতা যে নজিরবিহীন। ব্যারিকেড তৈরি করে, তা গণ সচেতনতারই এক উজ্জ্বল ও অভূতপূর্ব চিত্র। মুক্তিযুদ্ধ প্রারম্ভিক প্রতিরােধ যুদ্ধে অকুতােভয় চট্টগ্রামবাসী ছাত্র-জনতা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর বাহিনীর দেশপ্রেমিক সেনা সদস্যদের সর্বাত্মকভাবে সহযােগিতা করেছে।
রাজনীতিবিদ ও সামরিক নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ
বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে এ ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের সামরিক ও রাজনীতিবিদেরা অনেক বেশি দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন বলেই চট্টগ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকা শহরের মতাে নিধনযজ্ঞে নেমে তাদের একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তারে ব্যর্থ হয়। এ যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রণয়নে সামরিক নেতৃত্বের সাথে রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে ঘনিষ্ঠ সহযােগিতা ছিল, তা জনযুদ্ধের (Partisan warfare) একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য।
সামরিক প্রস্তুতি
চট্টগ্রামে ইপিআর, ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টসহ অন্যান্য আধা-সামরিক বাহিনী এ ধরনের একটি পরিস্থিতি মােকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়েছিলেন বলেই ইবিআরসির হত্যাকাণ্ড ছাড়া ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইপিআর বাহিনী আক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই তাদের কার্যক্রম শুরু করতে সক্ষম হয়। এক মাত্র চট্টগ্রামেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী আঘাত হানার আগেই তারা আক্রান্ত হয়েছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সুচারু পূর্বপরিকল্পনা বাঙালি অফিসার ও সৈন্যদের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, দূরদর্শিতা ও মরণপণ প্রতিরােধের কারণে সফলতা লাভে ব্যর্থ হয়। এজন্য চট্টগ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর উল্লেখযােগ্য সমর শক্তি এবং সুদৃঢ় অবস্থান থাকা সত্ত্বেও তারা প্রতিরােধ যুদ্ধে বিপর্যয়ের মুখােমুখি হয় ।
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র
প্রতিরােধ যুদ্ধের প্রাথমিক সাফল্যের কারণে ৩০ মার্চ পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহর মুক্তিকামী বাঙালিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এর ফলে চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্রে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়ার কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র পাঠ (বাংলাপিডিয়া: ৮ এবং ১০ খণ্ড, ২০০৩: ২০৫ ও ৩১৫) করা সম্ভব হয়েছিল। এ ঐতিহাসিক ঘােষণা এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য অনুষ্ঠান কর্মসূচি দেশবাসীর মনােবল সংরক্ষণে ও উদ্দীপনা সৃষ্টিতে অসামান্য ভূমিকা রেখেছে এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে অবস্থানরত অন্যান্য সামরিক দলগুলােকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা দিয়েছে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৫টি ব্যাটালিয়ন এ বেতারকেন্দ্রের ঘােষণায় উচ্চ মনােবলে উজ্জীবিত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরােধে কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। এ বেতারকেন্দ্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে এবং জনমত সৃষ্টিতে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। প্রতিরােধ পর্বের পরও স্থানান্ত রিত অবস্থান থেকে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র যুদ্ধরত মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে সমন্বয় যথার্থ দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্লেষণ করলে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, চট্টগ্রামে কর্মরত বাঙালি সামরিক কর্মকর্তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও যুদ্ধ শুরুর অনেক আগেই যুদ্ধের বিভিন্ন দিক নিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং নিজেদের মধ্যে যােগাযােগ অব্যাহত রাখেন। তাদের এ কার্যক্রম ছিল প্রকৃতপক্ষে আত্মঘাতী একটি পদক্ষেপ। কেননা, সামরিক আইনে একে ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যা দেয়া হয় এবং যার শাস্তি সাধারণত ফায়ারিং স্কোয়াডেই সমাধা করা হয়।
এ বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও বিপজ্জনক ঝুঁকি গ্রহণের মাধ্যমে তাদের এ আত্মত্যাগের মনােবৃত্তি এ দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে একটি অনন্য ও বিরল দৃষ্টান্ত। দৃষ্টান্তমূলক দেশপ্রেম পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধমূলক কর্মপন্থা নিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণে ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হলেও ঐতিহাসিক সত্য এ যে, চট্টগ্রামে অবস্থানরত বাঙালি সামরিক কর্মকর্তারা দেশের জন্য তাদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের লক্ষ্যে। মানসিক ও বস্তুগতভাবে প্রস্তুত ছিলেন। তাই এ সময়ে উদ্ভূত মতভেদ ও মতবাদ স্বাভাবিক ও পরিস্থিতি প্রাসঙ্গিক। এ ক্ষেত্রে তাদের সবার আবেগ ও দেশপ্রেম উজ্জ্বল ও শাশ্বতরূপে প্রতিভাত। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পূর্বেই তারা সম্যকরূপে জানতেন যে, এ দেশকে পাকিস্তানি নিগ্রহ ও পাকিস্তানি বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করতে তাদের সশস্ত্র সংগ্রামকেই বেছে নিতে হবে। এ লক্ষ্যেই তারা যথাসম্ভব স্ব স্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং পারস্পরিক সমন্বয়পূর্বক পূর্ব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন।
তাৎক্ষণিক যােগাযােগ ও সমম্বয়হীনতা
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যে-কোনাে বিষয়কে পর্যালােচনা করতে গেলে প্রথমেই তৎকালীন পরিস্থিতিকে হৃদয়ঙ্গম করা অত্যন্ত জরুরি। ইপিআর, ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইবিআরসি’র অফিসার ও সৈন্যরা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মানসিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেও তাদের পক্ষে এককভাবে যুদ্ধ সূচনা করা ছিল। বিদ্রোহ ঘােষণার নামান্তর। রাজনৈতিক দিক নির্দেশনা এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবু এ বিদ্রোহের শুরুর জন্য প্রয়ােজন ছিল যুক্তিসঙ্গত ও উপযুক্ত একটি মুহূর্ত, সামরিক পরিভাষায় যাকে ইংরেজিতে ‘triggering occasion বলা হয়। চট্টগ্রামের বাঙালি সামরিক কর্মকর্তারা এ রকম একটি মুহূর্তে বিদ্রোহ করলেও অভ্যন্তরীণ যােগাযােগ প্রতিষ্ঠা ও তা বজায় রাখতে অনেকাংশে ব্যর্থ হন।
যােগাযােগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা এবং বিক্ষিপ্ত অবস্থান এ ক্ষেত্রে দায়ী হলেও বাস্তবতা ছিল এ যে, ২৫ মার্চের দ্রুত পরিবর্তনশীল ঘটনাপ্রবাহ এবং উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইপিআর, ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইবিআরসি পারস্পরিক সুষ্ঠু যােগাযােগে অনেকাংশেই ব্যর্থ ছিল। ফলে ইবিআরসিতে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে। অবশ্য যুদ্ধ শুরুর মুহূর্তে আশঙ্কা, দ্বিধা, ভীতি প্রভৃতি মানবিক বিষয়গুলাে প্রশিক্ষিত সৈনিকেরাও সাধারণত বিবেচনা করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে এসব মানবিক আবেগগুলাে, যােগাযােগহীনতা ও বিক্ষিপ্ত অবস্থান তাদের প্রাথমিক সমন্বয়হীনতার কারণ বলে প্রতীয়মান। নগর যুদ্ধ। চট্টগ্রামের এ প্রতিরােধ যুদ্ধকে রণকৌশলগত দিক থেকে বিশ্লেষণ করলে লক্ষণীয়। যে, এ যুদ্ধে ‘Fighting in built-up areas (FIBUA)-এর নীতিমালা ও কৌশলের অনুসরণ এবং প্রয়ােগ করা হয়েছিল। বাংলাদেশে নগরায়ণের দ্রুত বৃদ্ধির কারণে ভবিষ্যৎ আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে যে-কোনাে যুদ্ধেই কমবেশি FIBUA যুদ্ধ কৌশল অনুসৃত হবে বলে অনুমিত। তাই চট্টগ্রাম শহরের প্রতিরোধ যুদ্ধের বিশদ অধ্যয়ন থেকে সামরিকবাহিনীর সদস্যদের জন্য শিক্ষণীয় অনেক বিষয় বিদ্যমান।
সার্বিক প্রভাব
চট্টগ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী যে তীব্র প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়, তা তাদের সামগ্রিক যুদ্ধ পরিকল্পনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। মুক্তিযুদ্ধ প্রারম্ভিক চট্টগ্রামকেন্দ্রিক প্রতিরােধ যুদ্ধে পাকিস্তানি সমর নায়কেরা অধিক মনােযােগ দিতে বাধ্য হওয়ায় দেশের অন্যত্র সংঘটিত যুদ্ধে এর গভীর প্রভাব বিস্তারিত হয়। যুদ্ধে পাকিস্তানি। বাহিনীর প্রাথমিক ও সার্বিক লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতার ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের প্রতিরােধ যুদ্ধ। এক নেপথ্য কারণ এবং অন্যতম প্রভাবক।
(প্রতিরােধ যুদ্ধসমূহ ও পাক অগ্রাভিযান-এর নকশাটি দেখুন ১১১৬ পাতায়)

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড