রাঙামাটির প্রতিরক্ষা অবস্থান
রাঙামাটিতে ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ৫টি দলে বিভক্ত হয়ে অবস্থান নেয়। মহালছড়িতে ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। রাঙামাটিতে তারা নিমলিখিতভাবে ১৪ এপ্রিল অবস্থান গ্রহণ সম্পন্ন করে। ক, রাঙামাটির ঘাগড়া এলাকায় প্রায় ১ কোম্পানি জনবল নিয়ে অবস্থান নেন। ক্যাপটেন আফতাব; খ, বুড়িঘাটে প্রায় ১ কোম্পানি জনবল নিয়ে অবস্থান নেন ক্যাপটেন খালেকুজ্জামান; বরকলের মধ্যস্থলে প্রায় ১ কোম্পানি জনবল নিয়ে অবস্থান নেন। লেফটেন্যান্ট মাহফুজ এবং কুতুকছড়ি এলাকায় সুবেদার মুতালেব প্রায় ১ কোম্পানি জনবল নিয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৬ এপ্রিল ক্যাপটেন আফতাব ঘাগড়া রেস্ট হাউজে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ১ প্লাটুন জনবলের ওপর অত্যন্ত সফলতার সাথে অপারেশন পরিচালনা করেন। ঐ সংঘর্ষে প্রায় ২০জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং প্ল্যাটুনটি অবস্থান ত্যাগে বাধ্য হয়। ইতােমধ্যে ১৭ এপ্রিল রাঙামাটিতে সমবেত পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি দল সেখান থেকে লঞ্চযােগে পর্যবেক্ষণে বের হয়। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ক্যাপটেন খালেক ১টি যােদ্ধা টহল নিয়ে তাদের অ্যামবুশ করেন। এ সংঘর্ষে কিছু সংখ্যক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং অবশিষ্টরা দ্রুত পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়। ১৮ এপ্রিল চেঙ্গী নদী দিয়ে অগ্রসরমাণ পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি ছােটো দলের সাথে লেফটেন্যান্ট মাহফুজের গুলি বিনিময় হয়। একই দিন আর এম এম কে রােডে (রাঙামাটি-মানিকছড়ি-মহালছড়ি-খাগড়াছড়ি রােড) সুবেদার মুতালেব পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি কনভয়ের ওপর অ্যামবুশ পরিচালনা করেন, এতে প্রায় ৩০জন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। পার্বত্য অঞ্চলে ভূমি প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করার পর এসব অবস্থান থেকে মুক্তিযােদ্ধা টহল দলের সাথে নিয়মিত সংঘর্ষের কারণে পাকিস্তানি বাহিনী এ অক্ষে তাদের চাপ বাড়ানাের পরিকল্পনা করে। এ লক্ষ্যে নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি ১৮ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর ৩ কমান্ডাে ব্যাটালিয়নের ২টি কোম্পানি দ্বারা তাদের শক্তিবৃদ্ধি করে।
রাঙামাটির বুড়িঘাট এলাকায় অবস্থানরত ক্যাপটেন খালেকুজ্জামান পাকিস্তানি বাহিনীর প্ল্যাটুন বােঝাই ১টি লঞ্চ আক্রমণ করে তাদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেন। ১৯ এপ্রিল বেলা ৩টায় ক্যাপটেন খালেকুজ্জামানের বুড়িঘাটস্থ অবস্থানের ওপর পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ পরিচালনা করে। তার কোম্পানি রাঙামাটি-মহালছড়ি নদীপথ প্রহরার দায়িত্বে ছিল। কোম্পানিটি চিংড়ি খাল বরাবর প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত ছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর ৩ কমান্ডাে ব্যাটালিয়নের ২টি কোম্পানি ২টি লঞ্চ ও ৭টি স্পিডবােট সহযােগে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখেও মেশিনগানের দায়িত্বে নিয়ােজিত ইপিআর সিপাহি (পরবর্তীকালে ল্যান্স নায়েক) মুন্সী আবদুর রউফ অকুতােভয়ে অবস্থান আঁকড়ে ধরে রেখে তার এমজি থেকে অগ্রসরমাণ শত্রুর ওপর গুলি বর্ষণ করতে থাকেন। ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর ৭টি স্পিডবােটই ডুবে যায়। এদিকে এ সুযােগে ক্যাপটেন খালেকুজ্জামান কোম্পানির অন্যান্য সৈন্যসহ নিরাপদ স্থানে সরে যেতে সক্ষম হন। শত্রু বাহিনীর লঞ্চ দুটি পিছু হটে মুন্সী আবদুর রউফের এমজি’র রেঞ্জের বাইরে গিয়ে ৩ ইঞ্চি মর্টারযােগে তার অবস্থানের ওপর গােলা বর্ষণ করতে থাকে। এক পর্যায়ে একটি গােলা সিপাহি মুন্সী আবদুর রউফকে আঘাত করলে। তিনি যুদ্ধরত অবস্থায় শাহাদতবরণ করেন। ২০ এপ্রিল লেফটেন্যান্ট মাহফুজ মুন্সী আবদুর রউফের মৃতদেহ উদ্ধার করেন। তাকে যথাযথ সম্মানের সাথে বুড়িঘাটেই চিংড়ি খালের পাড়ে এশটি টিলার উপর সমাহিত করা হয়। যুদ্ধ-পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার মুন্সী আবদুর রউফকে তার বীরত্বের জন্য ‘বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করে।
২৭ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী মহালছড়ি আক্রমণ করে। ২৫ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর ৩টি দল করেরহাট-রামগড়, নারায়ণহাট-রামগড় ও মহালছড়ি-রামগড় রুট ধরে অগ্রসর হয়। এ বাহিনী ১টি মিজো ব্রিগেড (মিজো নেতা লালডেঙ্গার শ্রেষ্ঠ ব্রিগেড যাকে লায়ন ব্রিগেড বলা হতাে) এবং পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি নিয়মিত কমান্ডাে কোম্পানি সমন্বয়ে গঠিত ছিল। দুপুর সাড়ে ১২টায় পাকিস্তানি বাহিনী নানিয়ারচর বাজার এলাকায় ক্যাপটেন খালেকুজ্জামানের অবস্থানের ওপর আক্রমণ করে। মিজোদের সামনে রেখে আক্রমণের কৌশল গ্রহণ করে পাকিস্তানি বাহিনী। আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে লে, মাহফুজ ২টি কোম্পানি নিয়ে ক্যাপটেন খালেকুজ্জামানের সাহায্যে এগিয়ে যান। বহু গুণ শক্তিধর শক্রর বিরুদ্ধে যুদ্ধকালীন ক্যাপটেন খালেকুজ্জামান ও লে. মাহফুজ সামান্য অস্ত্র ও লােকবল নিয়ে সংকটময় অবস্থায় পড়েন। মেজর শওকত ক্যাপটেন কাদেরকে তাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে যেতে নির্দেশ দেন। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী স্বয়ংক্রিয় মারণাস্ত্র ব্যবহার করে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করতে সক্ষম হয়। মহালছড়ির যুদ্ধে ক্যাপটেন আফতাব কাদের শাহাদতবরণ করেন। সামান্য অস্ত্র নিয়ে মহালছড়ি ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়লে মেজর শওকত পিছু হটে খাগড়াছড়িতে নতুন প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তারা রামগড়ে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে যােগ দেন।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড