You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৪ই নভেম্বর, বুধবার, ১৯৭৩, ২৮শে কার্তিক, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

শিল্প নগরী গড়ার পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে বসেছে

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থা (বিসিক) কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থা ও ঔদাসিন্যের দরুণ দেশের ১৮টি স্থানে শিল্প নগরী গড়ার পরিকল্পনা বানচাল হবার পথে। গতকাল ‘বাংলার বাণীতে’ প্রকাশিত ‘মাটি কাটতেই গেছে ছ’কোটি টাকা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ‘এক-তৃতীয়াংশ কাজ শেষ হওয়ার পূর্বেই ব্যয় হয়ে গেছে প্রায় ৬ কোটি টাকা। ফলে বিসিকের ১৮টি শিল্প নগরী গড়ার মোট ১৪ কোটি টাকার পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে বসেছে।’
সংবাদে আরো বলা হয়েছে,‘স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার দেশে শিল্পে সার্বিক উন্নতির জন্য নতুন স্কীম নিয়ে প্রায় ১ কোটি টাকা এই প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করেন এবং সরকার দেশে প্রায় ৫ হাজার শিল্প ইউনিট গড়ে তোলার নির্দেশ প্রদান করেন।’ উল্লেখ্য, গত আর্থিক বৎসরে সরকারের দেয়া কোনো টাকাই এখন পর্যন্ত খরচ করা হয়নি। কর্তা ব্যক্তিদের গাফিলতি, টেন্ডার আহ্বানে কারচুপির ফলে এ টাকা খরচ করা হয়নি বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।
বিসিক কর্তৃপক্ষের অবহেলা, অযোগ্যতার জন্যে শুধুমাত্র মাটি কাটতেই ৬ কোটি টাকা খরচ হয়নি, ‘বিসিকের শিল্প প্লট এখন গোচারণ ভূমি’তে পরিণত হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। স্থানীয় অন্য একটি দৈনিক পত্রিকায় উল্লেখিত শিরোনামায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে গত ১০ই নভেম্বর।
প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, ‘রাজবাড়ী ও চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট এলাকায় শিল্পের জন্যে জায়গা কেনা হয়েছে কিন্তু কোনো শিল্প গড়ে তোলা হয়নি। সেগুলোর কিছু কিছু প্লট এখন গোচারণ ভূমি হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ছাড়া বিসিক কর্তৃপক্ষের কয়েকটি লাভজনক শিল্প প্রতিষ্ঠান সাধারণ্যে বিক্রি করে দিয়েছে।’
বিসিক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তা অত্যন্ত গুরুতর। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অব্স্থার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষুদ্র শিল্পের একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভারী শিল্প স্থাপনের সুযোগ সীমিত। যেগুলো রয়েছে সেগুলোকে সঠিকভাবে চালু করতেই সরকার নানান সমস্য ও সংকটের সম্মুখীন হচ্ছেন। তবু সরকার সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছেন শিল্প কারখানাগুলোতে যাতে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এমনি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থা যদি যথাযথ ভূমিকা পালন করতো তাহলে অন্ততঃ পণ্য উৎপাদন, পণ্য মূল্য হ্রাস ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ প্রশস্ত হতো। তাছাড়া দেশের বেকারী সমস্যারও সমাধান হতো অনেকাংশে। সবচেয়ে আশ্চর্য্যের কথা কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নির্বিকার। যদি এমন হতো যে, সরকার এ বিষয়ে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করছেন না তাহলে হয়তো কর্তৃপক্ষ এ সম্পর্কে একটা যুক্তি খাড়া করতে পারতেন। কিন্তু সরকার যেখানে আগ্রহ প্রকাশ করে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করেছেন সেখানে কর্তৃপক্ষের অবহেলা, ঔদাসিন্য ও অযোগ্যতার জন্যে একটি মহতী পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে এমন তো হতে পারে না। আমরা আশা করবো, সরকার এ বিষয়ে যথাযথ তদন্ত করার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করবেন। কতিপয় আমলার অযোগ্যতা আর অবহেলার জন্যে মাটি কাটতে ৬ কোটি টাকা খরচ ও শিল্প প্লট গোচারণ ভূমিতে পরিণত হোক এটা দেশের জনসাধারণ কামনা করে না।

যাত্রীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা

যাত্রীদের তথা দেশের সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার প্রহসন আমাদের দেশে নতুন নয়। বহুবার বহু দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ সম্পর্কে নানান পত্র-পত্রিকায় নানান আলোচনা হয়েছে এবং প্রস্তাবও পেশ করা হয়েছে।
অথচ গোড়া থেকে এ পর্যন্ত অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে, আমরা যতোই অভিযোগ করিনা কেন কিম্বা যতোই হৈ-চৈ করে প্রস্তাব দেইনা কেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এ ব্যাপারে কুম্ভ-নিদ্রা কোনোদিনও ভাঙবেনা কিম্বা যারা প্রতিনিয়ত দেশের মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে তাদের লজ্জার মাথাও কোনোদিন আনতে হবে না।
বিশেষ করে লঞ্চ দুর্ঘটনার কথাই বলা চলে। স্বাধীনতা পূর্ব দিন থেকে এ পর্যন্ত কতো যে লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং অসংখ্য নরনারী, বৃদ্ধ ও শিশুর প্রাণহানি ঘটেছে তার স্বচ্ছ ও সঠিক ইতিহাস অনন্তকালের পাতাও হয়তো ঠিকমতো বলতে পারবে না।
বে-পরোয়া ও বেসামাল যান পরিচালনা, ওভারলোডিং যাত্রী গ্রহণ, হেড লাইটবিহীন যানের যাত্রা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে এ পর্যন্ত বহু দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, অসংখ্য প্রাণহানি ঘটেছে, সমপরিমাণ অভিযোগ ও প্রতিবাদ উঠেছে, অন্যায়কারীকে হাতে-নাতে ধরাও হয়েছে, তবুও সুদূরপ্রসারী ও প্রত্যাশানুযায়ী কিছু ফল হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। বরং দিনের পর দিন দুর্ঘটনাজনিত জানমাল হানির সংখ্যা আমাদের দেশে বেড়েই চলেছে।
কিছুদিন আগে শীতলক্ষ্যা নদীতে দু’টি লঞ্চের মুখোমুখি সংঘর্ষজনিত দুর্ঘটনায় শতাধিক লোকের প্রাণহানির করুণ কাহিনীর স্মৃতি মানুষের মন থেকে মুছে যেতে না যেতেই গত পরশু আবার দু’টি লঞ্চের মুখোমুখি সংঘর্ষের এক দুঃখজনক সংবাদ আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। দুর্ঘটনাটি ঘটে গত সোমবার সন্ধ্যায় বুড়িগঙ্গা নদীতে। দু’টি লঞ্চের মুখোমুখি সংঘর্ষের ফলে ছোট লঞ্চটি ভেঙে চুরমার হয়ে নদীতে তলিয়ে গেছে। এর নাম এম এল বালুচর। এতে মাত্র বিশ থেকে পঁচিশ জন যাত্রী ছিলো যার এগারো জনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। লঞ্চটি ঢাকা থেকে রওয়ানা হয়ে কুমিল্লার রামকৃষ্ণদি যাচ্ছিলো।
পরে ফতুল্লার কাছে অপর লঞ্চ জোনাকীর সাথে তার সংঘর্ষ হয়। জোনাকী আকারে বড় ও শক্ত তাই সে অক্ষত অবস্থায় পুলিশের হেফাজতে আছে। এ লঞ্চটি তালতলা থেকে ঢাকার দিকে আসছিলো। এর যাত্রী সংখ্যা প্রায় ষাটের কাছে ছিলো।
অপরাধ সম্পর্কে যতদূর জানা গেছে তাতে এ দু’টি লঞ্চের কোনোটিরই হেড লাইট ছিলো না। আবার ছোট লঞ্চ বালুচরের কোনো রুট পারমিট ছিলো না। সংঘর্ষের পর যাত্রীরা সব নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং হতাহত হয়নি বলে জানা যায়। তবে জনৈক নিজামুদ্দিন সহ প্রায় এগারো জন নিখোঁজ আছে বলে সংবাদ পাওয়া গেছে। পুলিশ দুই লঞ্চের কেরানী, সারেং ও সুকানী সহ মোট ছ’জনকে গ্রেফতার করেছে। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে দমকল বাহিনী দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজ চালায়।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হেড লাইটবিহীন ট্রেন চলাচলের জন্যে কয়েকটি যাত্রীবাহী ট্রেনও দুর্ঘটনায় কবলে নিপতিত হয়ে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির খেসারত দিয়েছে। আবার, এমন কারণে অন্যান্য সড়ক দুর্ঘটনার উদাহরণও বিরল নয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষের জানমাল নিয়ে অবাধগতিতে এ ছিনিমিনি খেলার অধিকার কে কাকে দিলো? কেন অহরহ এতো দুর্ঘটনা ঘটছে? কার বা কাদের অপরাধের দরুণ ঘটছে। তাদের শাস্তি দেবার বিষয়ে বা তাদের কড়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কতটুকু তৎপর আছেন?
তাই আমরা বিভিন্ন সড়ক ও জল পরিবহন সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে কয়েকটি অনুরোধ করতে চাই, তারা যেন অন্ততঃ মেহেরবানী করে জনস্বার্থে ও সাধারণ মানুষের জানমালের স্বার্থে নিম্নোক্ত কয়েকটি সর্বস্বীকৃত ব্যবস্থার কড়াকড়ি প্রতিপালন করে দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ বাঁচানোর একটি মহান দায়িত্ব পালন করুন।
যে কোনো স্থলপথ ও জলপথের যে কোনো যান বা বাহন যেন বিনা হেডলাইটে বা ক্ষীণ ও অস্পষ্ট হেড লাইটে কোনো যাত্রা করতে না পারে।
এবং কেউ এ নিয়ম পথে ভঙ্গ করলো কিনা তা লক্ষ্য রাখার জন্যে মোবাইল চেকার নিয়োগ সহ কয়েকটি বিশিষ্ট স্থানে চেকপোস্টের ব্যবস্থা করবেন। এ ব্যাপারে একটা ক্লিয়ারেন্স পত্রের ব্যবস্থা করলেও ভালো হয়।
সে ক্লিয়ারেন্স পত্রে শুধুমাত্র হেড লাইটের কথা নয়, নির্ধারিত গতিতে সে যান বা বাহন এসেছে কিনা, কিম্বা বিপদপূর্ণ গতিতে ড্রাইভার যান চালিয়েছে কিনা, কিম্বা যাত্রার পূর্বে যান বা বাহনের সম্পূর্ণ অংশ চেক আপ করে যানটি যাত্রা করানো হয়েছে কিনা ইত্যাদি কথাও উল্লেখ থাকবে।
কারণ, অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, যতো রকমের সড়ক বা জল দুর্ঘটনা ঘটেছে তাদের অন্যতম কারণই হচ্ছে যান পরীক্ষা না করেই অস্বাভাবিক গতিতে যান পরিচালনা করা।
এরপর আছে ওভারলোডিং প্রতিরোধ। কোনো যানেই যেন ঝুলন্ত বাদুড়ের মতো কোনো ওভারলোডের যাত্রী না নেওয়া হয়। এবং ঠিক যে কয়টি সিট বা যে কয়জন স্ট্যান্ডিং ঠিক সেই পরিমাণ টিকিটই যেন ইস্যু করা হয়। এজন্যে প্রত্যেক স্টেশনে বা স্টপেজেই যেন একটি করে সেলিং কাউন্টার বসানো হয় এবং যানের অভ্যন্তরে যেন কোনো টিকিট বিক্রি না হয়। কারণ, তাতে যাত্রীর ভীড় ঠেকানো কখনোই সম্ভব হবে না। আবার একমাত্র টিকিটধারীরা ছাড়া যাতে যানে বা বাহনে কেউ উঠতে না পারে সেজন্যে প্রয়োজন পড়লে পুলিশ প্রহরায় কড়াকড়িও পালন করা যেতে পারে।
নিয়মিতভাবে রুট পারমিট ও ড্রাইভার্স লাইসেন্স পরীক্ষার জন্যও ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
প্রত্যেক চেকপোস্টে একটি লক্ষণীয় স্থানে একটি অভিযোগ খাতা ও অভিযোগ বাক্স রাখা যেতে পারে এবং এ সব রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রত্যেকের একজন রক্ষক থাকলেও ভালো। অনেক যাত্রী আছে লেখাপড়া জানেন না বলে তাদের অসুবিধার কথা জানাতে পারেন না। সেক্ষেত্রে অভিযোগ বাক্সের রক্ষক তার অভিযোগ নিজ দায়িত্বে লিখে রাখবেন। আর এভাবে কয়েকটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে আমাদের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে অনায়াসেই এতো ঘন ঘন দুর্ঘটনার কবল থেকে রক্ষা করা যেতে পারে বলে আমাদের বিশ্বাস।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!