You dont have javascript enabled! Please enable it!
মিরসরাইয়ের যুদ্ধ
১৪ এপ্রিল ক্যাপটেন অলি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, আনসার ও পুলিশের সমন্বয়ে গঠিত ১টি কোম্পানি নিয়ে মিরসরাইতে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেন। এ প্রতিরক্ষার মূল লক্ষ্য ছিল রামগড় অভিমুখে যে-কোনাে পাকিস্তানি অগ্রাভিযান বন্ধ করা। এখানে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে একটি উল্লেখযােগ্য যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ অবস্থানে ক্যাপটেন অলির সাথে প্রায় ১০০ জনবলের একটি শক্তিশালী দল ছিল। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের মধ্যে ছিল ১টি মেশিনগান ও ১২টি হালকা মেশিনগান, ১টি ৩ ইঞ্চি মর্টার, ১টি রিকয়েললেস রাইফেল। তিনি সম্পূর্ণ দলটিকে ৩টি উপদলে বিভক্ত করেন। ১টি দল থেকে অন্য দলের অবস্থানগত দূরত্ব ছিল ৫০০-৭০০ গজ। প্রথম দলটি মিরসরাই থানার প্রায় ১০০০ গজ দক্ষিণে খালপাড় বরাবর অবস্থান গ্রহণ করে। দ্বিতীয় দলটি থানার ঠিক দক্ষিণে অবস্থান গ্রহণ করে। তৃতীয়। দলটি থানার উত্তর পাশের খালের ওপরের অছি মিয়ার ব্রিজ এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করে। ৩টি দলই অবস্থান গ্রহণ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম প্রধান রাস্তাকে অন্তর্ভুক্ত করে। ক্যাপটেন অলি তাঁর সমস্ত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র প্রথম প্লাটুনের সম্মুখ ভাগে স্থাপন করেন। আক্রমণ এলে প্রথম প্ল্যাটুনটি শত্রুকে প্রয়ােজনীয় প্রতিরােধ ও ক্ষতিসাধন করবে। অনুরূপভাবে দ্বিতীয় দলটিকেও পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিরােধের শেষ পর্যায়ে প্লাটুন ২টি তৃতীয় প্ল্যাটুনের সঙ্গে সমবেত হয়ে এক সাথে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করবে বলে স্থির হয়। উল্লেখ্য, ৩টি দলই ৩টি খালের পিছনে অবস্থান গ্রহণ করে। এ পরিকল্পনা নেয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল, শত্রুকে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন স্থানে প্রতিরােধ করা, একই দলকে ২-৩টি স্থানে ব্যবহার করা এবং তৃতীয় অবস্থানে অগ্রসর হওয়ার পূর্বেই শত্রুর যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করা।
তা ছাড়া এ অবস্থানগুলাের মধ্যে থানা সদর ও বাজারকেন্দ্রিক বাড়িঘর ও স্থাপনার প্রতিবন্ধকতাও পরিকল্পনায় বিবেচ্য ছিল। এতে শক্রর আগুয়ান হওয়া বিলম্বিত এবং তাদের ওপর আক্রমণের সুযােগ সৃষ্টি হবে। ২০ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি বড় কনভয় দক্ষিণ দিক থেকে ক্যাপটেন অলির প্রতিরক্ষার দিকে অগ্রসর হয়। প্রতিরক্ষা অবস্থানের স্বয়ংক্রিয় সব অস্ত্র তাঁর নির্দেশে শক্রর দিকে দ্রুত গুলি বর্ষণ শুরু করে। এতদূপ্রাসঙ্গিক যুদ্ধের নিমের বর্ণনাটি উল্লেখযােগ্য…অলি যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন, সেখান থেকে ৫০ গজ দূরেই মেশিনগান নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন ১জন। তাঁকে তিনি নির্দেশ দিলেন, পাকিস্তানি বহরের সবচেয়ে পিছনের গাড়িটি লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে। ৫ গজের মধ্যে ছিল ১টি লাইট মেশিনগান। তাকে নির্দেশ দেওয়া হলাে সামনের জিপটির ওপর গুলি করতে। গজ বিশেক দূরে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার সিদ্দিক তৈরি ছিলেন মর্টার নিয়ে। তাকে বলা হলাে মাঝের ট্রাকগুলােয় গােলা বর্ষণের জন্য। অলি নিজে ছুটে গেলেন ৩০০ গজ পিছনের দ্বিতীয় অবস্থানে সেখান থেকে ইপিআর-এর সুবেদার সাইদুল হকের নেতৃত্বে আরও ৩০জনকে পাঠিয়ে দিলেন সামনের প্রথম অবস্থানে অলি ১টি রিকয়েললেস রাইফেল থেকে আঘাত হানার উদ্যোগ নেন পাকিস্তানিদের ওপর এতে ছিল ২টি মাত্র গুলি। প্রথম গুলিটি একটি আমগাছের ডালে লেগে ডাল ভেঙে নিচে পড়ে। এতে কোনাে ক্ষতি হয় না শত্রুপক্ষের। দ্বিতীয় গুলিটি সরাসরি আঘাত হানে ট্রাক বহরে। সঙ্গে সঙ্গে ট্রাকে আত্মগােপন করে অবস্থান নিয়ে থাকা পাকিস্তানি সৈন্যরা লাফিয়ে পড়তে শুরু করে রাস্তার দুই দিকে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটতে থাকে এদিক-ওদিক। এ সময় দুই দিক থেকে গর্জে উঠল বাঙালি সৈন্যদের মেশিনগান। অন্তত ১৫০জন পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হলাে এখানে (ডা. মাহফুজুর রহমান, ১৯৯৩: ৩৮৯ ৯০)। 
U আকৃতির প্রতিরক্ষা অবস্থানের খুব কাছে চলে আসা শত্ৰু সে সময় প্রায় তিন দিকে মুক্তিযােদ্ধাদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টায় ব্যস্ত ছিল। তা ছাড়া এ যুদ্ধে ক্যাপটেন অলি আহমদের কোম্পানি প্রতিরক্ষায় বিভিন্ন প্রাকৃতিক সুবিধাজনক স্থানের ও বিদ্যমান স্থাপনার যথােপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে শত্রুর প্রায় ১৫০জন সৈন্যকে হতাহত করেন। প্রায় ১২ ঘণ্টা স্থায়ী সংঘর্ষে পাকিস্তানি বাহিনীর কোম্পানিটি নিশ্চিহ্ন হলেও এটা অবশ্যম্ভাবী ছিল যে সূর্যোদয়ের পূর্বেই তারা ক্যাপটেন অলির প্রতিরক্ষা অবস্থানে নতুন সৈন্য নিয়ে আঘাত হানবে। তাই বিপজ্জনকভাবে কাছাকাছি শত্রুকে রেখে এ প্রতিরক্ষায় না থেকে ক্যাপটেন অলি তার সম্পূর্ণ দল নিয়ে কিছুটা পশ্চাদপসরণ করে মস্তাননগরে অবস্থান নেন। এ যুদ্ধে ইপিআর-এর ল্যান্স নায়েক কালাম অসমসাহসিকতার সাথে হালকা মেশিনগান নিয়ে শত্রুর মােকাবিলা করার জন্য অস্ত্রের পরিখা ত্যাগ করে অরক্ষিত অবস্থায় শক্রর সাথে সম্মুখযুদ্ধে নিয়ােজিত হন এবং শত্রুর মর্টারের গােলায় শাহাদতবরণ করেন। তা ছাড়া হাবিলদার সিদ্দিকও বুকে বুলেটবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর পর প্রতিরােধ পর্যায়ে মুখােমুখি লড়াইয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর অন্যতম এক বড়াে আঘাত বলে অনেকে মনে করেন। এ যুদ্ধে মিরসরাইবাসী মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য-সহযােগিতায় আন্তরিকতা, সাহস ও দেশপ্রেমের ঐকান্তিক পরিচয় প্রদান করেছেন।

(মিরসরাইয়ের যুদ্ধের নকশাটি দেখুন ১১১৫ পাতায়)

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!