(একটি ঐতিহাসিক প্রতিরােধ)
প্রস্তুতির প্রেক্ষাপট ২৬ মার্চ থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহর এলাকায় ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিভিন্ন দল তৎপরতা বজায় রাখলেও পাকিস্তানি বাহিনী ততদিনে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন পথে ও স্থানে পর্যাপ্ত সৈন্য সমাবেশ ঘটাতে সক্ষম হয়। চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও স্থানীয় জনগণ পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রাথমিক পর্যায়ে অত্যন্ত সফলতার সাথে প্রতিরােধ করার ঘটনায় পাকিস্তানি বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামকে নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। তাই যে-কোনাে মূল্যে চট্টগ্রামের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্থল ও আকাশপথে সৈন্য প্রেরণ অব্যাহত রাখে এদিকে যুদ্ধরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর বাহিনীর প্রধান সমস্যা ছিল যুদ্ধের প্রয়ােজনীয় জনবল ও রসদের অপ্রতুলতা প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি বাহিনীর সম্মিলিত (পদাতিক, গােলন্দাজ, সাঁজোয়া, বিমান ও নৌ) আক্রমণের মুখে সীমিত সংখ্যক প্রশিক্ষিত সৈন্য নিয়ে পর্যাপ্ত অস্ত্র, গােলাবারুদ ও অন্যান্য সহায়তাসরবরাহ (সাঁজোয়া, গােলন্দাজ, বিমান) ছাড়া বেশি দিন যুদ্ধ করা আত্মহত্যারই নামান্তর। প্রকৃতপক্ষে, এ থেকে সুদূরপ্রসারী কোনাে ইতিবাচক ফলাফল প্রত্যাশা করা সম্ভব নয়। যুদ্ধরত দূরদর্শী সকল সামরিক অফিসারই বিষয়টি উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। তা ছাড়া এ কথা বিদিত যে, বাংলাদেশে অবস্থানরত শুধু ৫টি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টেরই যুদ্ধবিদ্যায় পর্যাপ্ত ধারণা ও অভিজ্ঞতা ছিল। ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও স্বেচ্ছাসেবকেরা অস্ত্রধারী ও আত্মত্যাগী মনােভাবাপন্ন হলেও বাস্তব সত্য এ যে, প্রচলিত যুদ্ধ বা Conventional war সম্পর্কে তাদের প্রশিক্ষণ ছিল সীমিত।
গােলন্দাজ, সঁজোয়া ও বিমান সহায়তাবিহীন স্বল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে চট্টগ্রাম শহরের ওপর তাৎক্ষণিক আধিপত্য বিস্তার সম্ভব হলেও দীর্ঘকালীন আধিপত্য বজায় রাখা ছিল অসম্ভব একটি ব্যাপার। সুতরাং ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, অন্যান্য ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক ও ইপিআর-এর যৌথ দল প্রাথমিকভাবে শহরে সফল যুদ্ধ করলেও ক্রমেই শহর। ছাড়তে বাধ্য হন। তারা শহরের পার্শ্ববর্তী অবস্থানে গিয়ে সমবেত হতে থাকেন। ২৯ মার্চ থেকেই ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কালুরঘাটে তাদের শক্তিবৃদ্ধি করতে থাকে এবং প্রচলিত প্রতিরক্ষা বা Conventional defence নীতি অনুসরণ করে প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে আগ্রাসী ক্ষুদ্র অভিযান বা Minor operation পরিচালনায় নিয়ােজিত হয়।
৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কালুরঘাট যাত্রা ২৫ মার্চ মধ্যরাতে মেজর জিয়াউর রহমান ইউনিটে সমবেত প্রায় ২৫০জন সদস্যের মাঝে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন এবং বিদ্রোহের ঘােষণা প্রদান করেন। বিদ্রোহ ঘােষণার পর ২৫ মার্চ রাতে ষােলশহর ছেড়ে ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কালুরঘাট সেতু অতিক্রম করে করলডাঙ্গা পাহাড়ে সমবেত হয়। ২৬ মার্চ প্রত্যুষে কাপ্তাই ও কক্সবাজার থেকে আসা ইপিআর সৈনিকেরা ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে যােগ দিয়ে মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিরােধ যুদ্ধের জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্রতী হন। ক্যাপটেন রফিকের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে অবস্থানরত ইপিআর বাহিনী ততক্ষণে পাকিস্তানি বাহিনীর, প্রধানত ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সাথে খণ্ডযুদ্ধে লিপ্ত।
৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তাৎক্ষণিক প্রণীত প্রতিরােধ যুদ্ধের পরিকল্পনার রূপরেখা ছিল নিমরূপ: ক. একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ। খ. প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরির মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর আধিপত্য বিস্তার রােধ। গ, প্রতিরক্ষা যুদ্ধের উপযােগী ও প্রাকৃতিক বাধাসংবলিত এলাকা কালুরঘাটে প্রতিরক্ষা তৈরি করা। ঘ, শহর এলাকায় খণ্ডযুদ্ধের মাধ্যমে শত্রুকে ব্যতিব্যস্ত ও পর্যদস্ত করা। উ, দেশে ও বহির্বিশ্বে স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে দ্রুত জনমত সৃষ্টি করা। এই রূপরেখা বাস্তবায়নে ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর-এর সম্মিলিত বাহিনীর একাংশকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে ভাগ করে শহরের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ। করা হয়। তা ছাড়া মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতারের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ সাপেক্ষে অভ্যন্তরীণ ও বহির্বিশ্বে ব্যাপক জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বীয় কণ্ঠে ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করেন। (বাংলাপিডিয়া: ৮ ও ১০ খণ্ড, ২০০৩: ২০৫ ও ৩১৫)। তার এ ঘােষণা পাঠটি রেকড করে বার বার বেতারে প্রচার করা হয়। এর ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ব্যাপক উদ্দীপনার সৃষ্টি হয় এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ আনসারসহ সব শ্রেণির প্রতিরােধ যােদ্ধারা প্রথম বারের মতাে প্রতিরােধ যুদ্ধের ব্যাপকতা, গুরুত্ব, প্রয়ােজনীয়তা ও সামরিকত্ব অনুধাবনে সক্ষম হন।
চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্ষুদ্র দলগুলাে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ থেকে তাদের কার্যক্রম শুরু করে এবং বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সংঘাতে লিপ্ত হয়। ক্যাপটেন হারুন, লে, শমসের প্রমুখ অফিসাররা শহরের চট্টেশ্বরী রােড, চকবাজার প্রভৃতি স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তা ছাড়া প্রতিরােধযুদ্ধের শুরুতে ইপিআর বাহিনী চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা অব্যাহত রাখেন। মুক্তিযােদ্ধাদের অসীম সাহস, দৃঢ়তা ও কঠিন সংকল্প শহর এলাকায় শত্রুকে প্রতিরােধ করলেও তাদের অস্ত্র ও গােলাবারুদের অপ্রতুলতা, সমন্বয়হীনতা, যােগাযােগ যন্ত্রের শূন্যতায় তারা ক্রমশ কঠিন চাপের সম্মুখীন হন এবং শহর ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। ২৯-৩০ মার্চের দিকে কালুরঘাট এলাকা ছাড়া শহরের অন্যান্য এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের শক্তি সীমিত হয়ে পড়ে। সমুদ্রতীরবর্তী কক্সবাজারের ব্যাপক এলাকায় উপস্থিতি বজায় রাখতে মেজর মীর শওকত আলীর ১টি প্ল্যাটুন ২৮ মার্চ কক্সবাজার রওনা হয়। অবশ্য পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম এলাকায় উপস্থিতি অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হওয়ায় কক্সবাজার থেকে প্রত্যাহৃত হয়ে ৭ এপ্রিল তাঁদেরকে পুনরায় কালুরঘাটে যােগ দিতে হয়।
কালুরঘাটে অবস্থান গ্রহণ ও রণকৌশল
কর্ণফুলি নদীর ওপর নির্মিত কালুরঘাট রেলসেতুর দুই পাশেই ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ ও আনসারের সম্মিলিত বাহিনী প্রচলিত প্রতিরক্ষা বা Conventional defence-এর পদ্ধতি অনুসরণ করে অবস্থান গ্রহণ করে। মূল। দল নদীর দক্ষিণ পাড়ে অর্থাৎ কক্সবাজার অংশে চৌধুরী খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে অবস্থান গ্রহণ করে। নদীর উত্তর পাড়ে বা চট্টগ্রাম অংশে সামরিক অভিধায় ‘ব্যাটালিয়নের পর্দা বা Screen হিসেবে প্রায় ৩৫জনের ১টি দল স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রসহ অবস্থান নেয়। এ দলের নেতৃত্বে থাকেন ক্যাপটেন হারুন ও লে, শমসের মবিন। Screen-এর প্রায় ১ মাইল উত্তরে অর্থাৎ চট্টগ্রামের দিকে সুবেদার মজিদের নেতৃত্বে ১টি ইপিআর কোম্পানি (জনবল প্রাধিকারের তুলনায় কম ছিল) অগ্রবর্তী অবস্থান বা Advance position হিসেবে অবস্থান নেয়।
কালুরঘাটে প্রতিরক্ষা ও বিভিন্ন কার্যক্রম
৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর-এর সম্মিলিত বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ কালুরঘাটে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণের কাজ শুরু করে। নদীভিত্তিক প্রতিরক্ষা অবস্থানটি অবস্থানগতভাবে অত্যন্ত আদর্শ ও মানসম্মত হলেও প্রতিরক্ষার অন্যান্য উপাদানগুলাে যেমন: স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ও বেতার যােগাযােগ অপ্রতুল ছিল। তা ছাড়া প্রতিরক্ষা যুদ্ধ পরিচালনার প্রধান ও কার্যকর অস্ত্র হিসেবে বিবেচিত গােলন্দাজ সহায়তা এ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় অনুপস্থিত ছিল। তাই সার্বিক বিশ্লেষণে এটিকে আদর্শ প্রতিরক্ষা অবস্থান হিসেবে উল্লেখ করা গেলেও প্রতিরক্ষা যুদ্ধের সরঞ্জামের বিচারে প্রকৃতপক্ষে সুদৃঢ় ছিল না। ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিরক্ষা যুদ্ধের অংশ হিসেবে কালুরঘাট অবস্থানকে মূলত একটি ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে সেখান থেকে বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনা করা হয়। | ২৯ মার্চ প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করার পর সেদিন রাত ৮টায় ১টি মােটর লঞ্চে করে পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি দল ঐ এলাকায় তল্লাশি চালায়। লঞ্চটি সার্চ লাইটের আলাে দিয়ে নদীর উভয় পাশ নিরীক্ষণ করে। এক পর্যায়ে লঞ্চটি নদীর পূর্ব দিকের পাড়ে ভেড়ে এবং কিছুক্ষণ পর ঐ স্থান ত্যাগ করে। তা ছাড়া সেদিন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সি-১৩০ বিমান ঐ এলাকা দিয়ে উড়ে যায়। এ লঞ্চ থেকে পাকিস্তানি কমান্ডােদের ১ট প্লাটুন সেখানে অবতরণ করে। অবশ্য কারাে কারাে মতে প্ল্যাটুনটি বিমান থেকে প্যারাশুট দিয়ে অবতরণ করে। ঐ রাতে সাড়ে ৪টায় মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর বিক্ষিপ্ত গুলি বর্ষণ করা হয়। পরদিন ভােরে মাে. আসফ নামক স্থানীয় এক বাসিন্দা মেজর জিয়াউর রহমান ও লেফটেন্যান্ট মাহফুজকে প্রতিরক্ষা অবস্থানের আওতার মধ্যেই শত্রুর উপস্থিতি সম্পর্কে সংবাদ প্রদান করেন। সংবাদ মতে, শত্রু সৈন্যরা যেখানে অবস্থান নিয়েছিল সেটি একটি কৃষি খামার ভবন। এ ভবনটি তিনতলাবিশিষ্ট একটি পাকিস্তানি বাড়ি। স্থানীয় জনগণের কাছে ভবনটি ‘কৃষিভবন’ হিসেবে সুপরিচিত। ইউনিট অধিনায়কের নির্দেশক্রমে লেফটেন্যান্ট মাহফুজ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর-এর সৈনিক সমন্বয়ে গঠিত একটি মিশ্র প্ল্যাটুন নিয়ে শত্রুর অবস্থানে আঘাত হানার জন্য দ্রুত রওনা হন। প্ল্যাটুনটিকে বহনকারী গাড়ি শক্রর ফায়ারের আওতায় প্রবেশ করা মাত্র শত্রুরা হালকা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের মাধ্যমে তাদের ওপর গুলি বর্ষণ শুরু করে।
লেফটেন্যান্ট মাহফুজ তার প্ল্যাটুনকে গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত অবস্থান গ্রহণের নির্দেশ দেন। তারা শত্রুর অবস্থান অর্থাৎ খামার ভবন থেকে ৪০০-৫০০ গজ দূরে বিক্ষিপ্তভাবে অবস্থান গ্রহণ করেন। লেফটেন্যান্ট মাহফুজ তার অবস্থানগুলাে সংঘবদ্ধ ও সুসংহত করে শক্রর অবস্থানের চারদিকে একটি বেষ্টনী তৈরির চেষ্টা করেন। এমতাবস্থায় রকেট লঞ্চার ও মেশিনগান দ্বারা শত্রুপক্ষ তাদের ওপর গুলি বর্ষণ অব্যাহত রাখে। লেফটেন্যান্ট মাহফুজ তার রকেট লঞ্চার দিয়ে শত্রুর ওপর কার্যকর আক্রমণ করার চেষ্টা করেন। | বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তাদের অবস্থানের ওপর দিয়ে পাকিস্তান। বিমানবাহিনীর ২টি জঙ্গিবিমান (স্যাবর জেট) উড়ে গিয়ে কালুরঘাট রেডিও স্টেশনের ওপর আক্রমণ চালায়। সেখানে সুবেদার সাহেব আলী এক প্লাটুন জনবল নিয়ে অবস্থান করছিলেন। এদিকে লেফটেন্যান্ট মাহফুজের প্ল্যাটুন কৃষিভবন এলাকায় তাদের অবস্থান পুনর্বিন্যাস করছিলেন। তবে শত্রুর কঠিন বেষ্টনী দিবালােকে ভেঙে ফেলা ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় লেফটেন্যান্ট মাহফুজ সারাদিন শত্রুকে সেখানে অবরুদ্ধ করে রাখেন এবং সন্ধ্যার ঠিক পর পরই ভবনটির তিন দিক ঘিরে ফেলেন। ভাের হওয়ার কিছু পূর্বেই তারা অত্যন্ত সন্তর্পণে তাদের বেষ্টনীকে আরও ছােটো করে গুটিয়ে আনেন। শত্রু সে সময় গুলি বর্ষণ করছিল এমতাবস্থায় তারা ভবনটিতে প্রবেশ করে দেখতে পান আহত ও নিহতদের। ফেলে শত্রু আগেই অবস্থান পরিত্যাগ করেছে। এ অপারেশন ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম সফল অপারেশন।
এ সংঘর্ষে ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর বাহিনীর কোনাে ক্ষয়ক্ষতি না হলেও পাকিস্তানি বাহিনীর (৩য় এসএসজি) কমান্ডাে ব্যাটালিয়নের ৩০জনের যে প্লাটুনটি ক্যাপটেন সাজ্জাদের নেতৃত্বে কালুরঘাট সেতু ধ্বংসের উদ্দেশ্যে এসেছিল, তা সফল হয় নি। বরং তাদের প্রভূত ক্ষতি হয়। এ যুদ্ধে শত্রুপক্ষের ৫জনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। তা ছাড়া আহত ২জন পাকিস্তানি সৈনিক রক্তক্ষরণে পরে। মারা যায়। এ সংঘর্ষে ১টি ৭.৬২ এলএমজি, ২টি জি-৩ রাইফেল, ২টি এসএমজি, ৩টি রকেট লঞ্চার, ১টি পিস্তল ওয়ালথার, ২টি ভেরি লাইট পিস্তল, ১টি ওয়্যারলেস, প্রচুর গােলাবারুদ ও বিস্ফোরক দ্রব্য লেফটেন্যান্ট মাহফুজের দলের হস্তগত হয়। মদুনাঘাটে প্রতিরক্ষা সুসংহতকরণ কালুরঘাট এলাকায় প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির পাশাপাশি মদুনাঘাট সেতুকে কেন্দ্র করেও একটি প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি শুরু হয়। এ উদ্দেশ্যে ইপিআর-এর সৈন্যসহ লেফটেন্যান্ট মাহফুজের নেতৃত্বে ২টি দল কালুরঘাট সম্মুখবর্তী এলাকায় অবস্থান নেয়। ১টি দল ইপিআর-এর সুবেদার সাহেব আলীর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই। সড়কের সংযোগ মােড়ে অবস্থান নেয়। অপর দলটি লে, মাহফুজের নেতৃত্বে তার উত্তরে ক্যান্টনমেন্টের দিক মুখ করে অবস্থান গ্রহণ করে। ৭ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী ১ ব্যাটালিয়ন শক্তি নিয়ে আক্রমণ করে সুবেদার সাহেব আলীর অবস্থান দখল করে নিতে সক্ষম হয়। এ পরিস্থিতিতে মেজর শওকতের নির্দেশে লে, মাহফুজ অগ্রবর্তী অবস্থানগুলাে নতুনভাবে সমন্বয় ও বিন্যস্ত করে মদুনাঘাট সেতুর উত্তর পাশে অবস্থান গ্রহণ করেন। নিমােক্ত কারণে মদুনাঘাট সেতু এলাকায় প্রতিরক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল: ক, কালুরঘাট সেতু প্রতিরক্ষার সাথে মদুনাঘাট প্রতিরক্ষার মাধ্যমে একটি সাধারণ প্রতিরক্ষা বলয় সৃষ্টি। খ, চট্টগ্রাম থেকে কাপ্তাই বরাবর পাকিস্তানি বাহিনীর দ্রুত অগ্রাভিযান প্রতিহতকরণ।
গ. কালুরঘাটে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর পশ্চাদপসরণের দরকার হলে তাদের প্রয়ােজনীয় নিরাপত্তা প্রদান করা। কেননা, কালুরঘাট থেকে প্রত্যাহৃত হলে পরবর্তীকালে রাঙামাটি এলাকায় একত্র হওয়ার প্রয়ােজনীয়তা তারা আগেই অনুধাবনে সক্ষম হন। চট্টগ্রাম থেকে কাপ্তাই বরাবর পাকিস্তানি বাহিনীর দ্রুত অগ্রাভিযান প্রতিহত করা। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ প্রস্তুতি ৭ এপ্রিল বিদ্রোহী বাঙালি সৈনিকদের অগ্রবর্তী প্রতিরক্ষা অবস্থানগুলাে দখলের পর পাকিস্তানি বাহিনী ক্রমান্বয়ে কালুরঘাট সেতুর দিকে অগ্রসর হয়। তাদের এ অগ্রাভিযান নদীপথে নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে গােলা বর্ষণ ও গােলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় পরিচালিত হয়। ৮ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী কালুরঘাট সেতুর ১ মাইলের মধ্যে তাদের অবস্থান সুসংহত করে। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রস্তুতিতে বিঘ্ন সৃষ্টির লক্ষ্যে মেজর শওকতের নির্দেশে লে, শমসের মবিন পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ওপর একটি ক্ষুদ্র ও সীমিত আক্রমণ পরিচালনা করলেও তেমন কোনাে সাফল্য অর্জিত হয় নি। ৯ এপ্রিল সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে মেজর শওকত সেকশন জনবলের একটি দল নিয়ে কালুরঘাটের ১ মাইল উত্তরে কৃষিভবনে আরেকটি হানা দিয়ে সেখানে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে হতাহত ও বিতাড়িত করেন।
এ সংঘর্ষে পাকিস্তানি বাহিনীর একজন অফিসারসহ প্রায় ২০জন মারা যায়। নিজ দলের নায়েক নায়েব আলী এ সংঘর্ষে শহিদ হন। চূড়ান্ত যুদ্ধ ও পশ্চাদপসরণ ১১ এপ্রিল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কালুরঘাট যুদ্ধে দুই পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময় অব্যাহত থাকে। ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যােদ্ধাদের সীমিত গােলাবারুদ তখন প্রায় নিঃশেষিত। পাকিস্তানি বাহিনী তখন পর্যন্ত কালুরঘাট ব্রিজের উত্তর পাড়ে অবস্থান করলেও এটা নিশ্চিত ছিল যে, পরদিন তারা নতুন উদ্যমে দক্ষিণ পাড় দখলের জন্য জোর প্রচেষ্টা গ্রহণ করবে। এমতাবস্থায় ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসাররা সিদ্ধান্ত নেন যে রাতের অন্ধকারে পশ্চাদপসরণ করাই হবে সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত। কেননা গােলাবারুদবিহীন অবস্থায় শত্রুর মােকাবিলা আত্মহত্যারই শামিল। পরিকল্পনা মােতাবেক তারা প্রাথমিকভাবে পশ্চাদপসরণ করে বান্দরবানে একত্র হয়ে সড়ক পথে চন্দ্রঘােনা হয়ে কাপ্তাই পৌছেন। কাপ্তাই থেকে লঞ্চযােগে ১২ এপ্রিল রাঙামাটি উপস্থিত হন। লে, মাহফুজের দল কাপ্তাই রােডের মদুনাঘাটে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রথম আক্রমণ নস্যাৎ করেন এবং কিছুটা পিছু হটে নােয়াপাড়াতে নতুন অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি এ অবস্থান নিয়েছিলেন মূলত এ জন্য যে, মূল দলের পশ্চাদপসরণের পূর্বেই পাকিস্তানি বাহিনী যাতে কাপ্তাই এলাকায় পৌছাতে না পারে। লে, মাহফুজ সংবাদ পান যে ব্যাটালিয়নের মূল দলটি কাপ্তাইতে পৌঁছেছে। এ সংবাদের ভিত্তিতে তিনি মূল দলের সাথে পরবর্তী করণীয় নিয়ে আলােচনার জন্য কাপ্তাই যান। কাপ্তাই থেকে ততক্ষণে মূল দল রাঙামাটি রওনা হয়ে যাওয়ায় তিনি তাদের সাথে যােগাযােগ স্থাপনে ব্যর্থ হন। বিফল মনােরথে তিনি নােয়াপাড়া ফেরার পথে বুঝতে ও জানতে পারেন, তাঁর অবর্তমানে নােয়াপাড়ায় পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ পরিচালনা করে তার প্রতিরক্ষা অবস্থান দখল করে নিয়েছে। নেতৃত্বহীন নােয়াপাড়া প্রতিরক্ষা অবস্থান পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তেমন কোনাে প্রতিরােধ গড়তে সক্ষম হয় নি। অনন্যোপায় হয়ে তিনি রণে ভঙ্গ সৈনিকদের যথাসম্ভব একত্র করে রাঙামাটিতে মূল দলের সাথে। যােগ দেন।
(কালুরঘাট যুদ্ধের নকশাটি দেখুন ১১১৪ পাতায়)
প্রতিরােধ যুদ্ধের ক্রমবিকাশ
ক. ৪ এপ্রিলের মধ্যে চট্টগ্রাম শহরের কর্তৃত্ব পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। খ. পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি বাহিনী কালুরঘাট এলাকায় তাদের মনােযােগ নিবদ্ধ করে। গ. ১১ এপ্রিলের মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে কালুরঘাটেরও পতন ঘটে। ঘ, ইতােমধ্যে ৩০ মার্চ কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র বিমান আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে রেডিও ট্রান্সমিটারটি কালুরঘাট থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেটি ৩ এপ্রিল থেকে পুনঃপ্রচার শুরু করে। পরবর্তীকালে তা ভারতে স্থানান্তর করা হয়। অতঃপর পাকিস্তানি বাহিনী বিস্তীর্ণ পার্বত্য এলাকায় তাদের আধিপত্য। বিস্তারে ব্রতী হয়। বিভিন্ন সূত্রে পাকিস্তানি বাহিনী নিশ্চিত হয় যে, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে মুক্তিযােদ্ধাদের অপারেশনগুলাে রামগড় থেকেই পরিচালনা করা হয়। বস্তুত, মেজর জিয়াউর রহমান রামগড় থেকেই এতদঞ্চলের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন। ছ, পাকিস্তানি বাহিনী রামগড় আক্রমণের লক্ষ্যে বিভিন্ন পথে যেমন: চট্টগ্রাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম-রাঙামাটি, চট্টগ্রাম-কাপ্তাই, চট্টগ্রাম-মিরসরাই পথে তাদের অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখে। এসব পথে তাদের অগ্রাভিযান নস্যাৎ ও বিলম্বিত করার জন্য ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর বাহিনীর সদস্যরা দৃঢ় প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। ঝ. ২৫ এপ্রিলের পর তারা মিরসরাই-করেরহাট-রামগড়, হাটহাজারী নারায়ণহাট-রামগড় ও মহালছড়ি-রামগড় অক্ষে ত্রিমুখী চাপ সৃষ্টি করে। ঞ. পাকিস্তানি বাহিনীর ক্রমবর্ধমান শক্তিশালী চাপে ২৯ এপ্রিল হিয়াকুর প্রতিরক্ষা ও প্রতিরােধের পতন ঘটে। ট, ৩০ এপ্রিলের মধ্যে মহালছড়িতে অবশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধারা রামগড়ে প্রত্যাবর্তন করেন। ঠ, ১ মে ব্যাপক গােলন্দাজ আক্রমণের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনী রামগড়ে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান দুর্বল করার প্রয়াস চালায়। ড, ২ মে সকালে পদাতিক ও সাঁজোয়া সহযােগে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্রিগেড শক্তির সেনা দল দিনব্যাপী যুদ্ধের পর রামগড়ে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরােধ ভেঙে ঐ অবস্থান দখল করতে সক্ষম হয়।
২ ও ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২টি কোম্পানির চট্টগ্রাম রণক্ষেত্রে যােগদান মেজর জিয়ার অনুরােধে মেজর সফিউল্লাহর আদেশে ক্যাপটেন এজাজ ও ক্যাপটেন মতিন যথাক্রমে ২ ও ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২টি কোম্পানি নিয়ে ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হন। তারা আগরতলা হয়ে বিএসএফ-এর গাড়ি ও ১টি আরআর জিপ নিয়ে রামগড়ে মেজর জিয়াউর রহমানের কাছে পৌছেন। মেজর জিয়ার নির্দেশে ক্যাপটেন মতিন ১টি কোম্পানি নিয়ে ভাটিয়ারী-সীতাকুণ্ড এলাকায় প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। ক্যাপটেন এজাজ অন্য কোম্পানিকে নিয়ে হাটহাজারী রােডে চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে ৩ মাইল উত্তরে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। এ প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ ৬ এপ্রিলের মধ্যে সম্পন্ন হয়। | ৭-৮ এপ্রিলে পাকিস্তানি বাহিনী ২ কোম্পানি জনবল নিয়ে ক্যাপটেন এজাজের অবস্থানে আক্রমণ করে। পাকিস্তানি আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে ক্যাপটেন এজাজ তার বাহিনী নিয়ে নারায়ণহাটে পশ্চাদপসরণ করেন। রাতের বেলায় তিনি পুনরায় সংগঠিত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ‘রওশন আরা হাউজ’ অবস্থানে আক্রমণ রচনা করেন। তাদের আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী অবস্থান পরিত্যাগ করলেও তারা দ্রুত পালটা আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। এমতাবস্থায় ক্যাপটেন এজাজ তার বাহিনী নিয়ে পশ্চাদপসরণ করে উদালিয়া চা-বাগানে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেন। এখানে ক্যাপটেন রফিকও তার প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি ও সমন্বয়সাধনে সহায়তা করেন। | পাকিস্তানি বাহিনী ১২-১৩ এপ্রিল উদালিয়ার এ অবস্থানে ভারী আর্টিলারি অস্ত্র সহযােগে আক্রমণ চালালে ক্যাপটেন এজাজ পুনরায় তার বাহিনী নিয়ে। পশ্চাদপসরণ করে নারায়ণহাট হয়ে হিয়াকুতে, তারপর বাগানবাড়িতে এবং সর্বশেষ রামগড়ে অবস্থান নেন। অবশেষে রামগড়ের পতন হলে তারা ভারতে প্রবেশ করেন এবং পরবর্তীকালে নিজ ব্যাটালিয়নে যােগ দেন। ক্যাপটেন মতিনের কোম্পানি ৬ এপ্রিল ভাটিয়ারী এলাকায় চট্টগ্রামমুখী হয়ে অবস্থান নেন এবং ১৬ এপ্রিলের পূর্বেই প্রত্যাহারপূর্বক সীতাকুণ্ডে তাদের অবস্থান সুসংহত করেন। ১৬ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী সীতাকুণ্ডে ব্যাপক আক্রমণ রচনা করলে তারা যথাসাধ্য তা প্রতিরােধ করেন এবং ১৮ এপ্রিল করেরহাট এলাকায় পশ্চাদপসরণ করেন। পরবর্তী সময়ে কোম্পানিটি নিজ ব্যাটালিয়নের অপারেশনাল প্রয়ােজনে রামগড় যুদ্ধ শুরুর পূর্বেই চট্টগ্রাম রণক্ষেত্র ত্যাগ করে নিজ ব্যাটালিয়নে যােগ দেয়।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড