You dont have javascript enabled! Please enable it!
কুমিরার যুদ্ধ
(মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরােধযুদ্ধ, ২৬-২৮ মার্চ, ১৯৭১)
স্বাধীনতা যুদ্ধের উষালগ্নে ২৫ মার্চের কালরাতেই ক্যাপটেন রফিকের নেতৃত্বে দেশপ্রেমিক ও দুর্জয় সাহসী ইপিআর সদস্যরা ছাত্র-জনতার সাহায্যে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে হালিশহর ও পাহাড়তলি এলাকায় গড়ে তােলে প্রথম সফল প্রতিরােধ। একই সময়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের কোম্পানি। অধিনায়ক ক্যাপটেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া পাহাড়তলিতে এসে ক্যাপটেন রফিকের ইপিআর বাহিনীর সাথে যােগ দেন। অন্যদিকে, মােলশহরে অবস্থিত ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টও মেজর জিয়ার নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধে শামিল হলে মুক্তিকামী জনতার মনােবল সমুন্নত হয়ে ওঠে। কৌশলগত কারণে বন্দরনগর চট্টগ্রামের সামরিক গুরুত্ব অপরিসীম। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামবাসীর প্রবল প্রতিরােধের সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তানি বাহিনীর একটি শক্তিশালী সৈন্যদল চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে কুমিল্লা ত্যাগ করে। কুমিল্লা থেকে ক্যাপটেন বাহার টেলিফোন অপারেটরের মাধ্যমে ক্যাপটেন। রফিককে জানান যে, পাকিস্তানি বাহিনীর ৮০-১০০টি যানবাহন নিয়ে এক বিরাট কনভয় বন্দরনগর চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে।

পাকিস্তানি বাহিনীর উদ্দেশ্য। সুস্পষ্ট, বাঙালিদের সশস্ত্র প্রতিরােধের প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামস্থ পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিবৃদ্ধি এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চট্টগ্রামে তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। এ সংবাদ পাওয়া মাত্র ক্যাপটেন রফিক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কলামটিকে অ্যামবুশ করার জন্য সুবেদার মুসার নেতৃত্বে হালিশহর থেকে এক কোম্পানি সৈন্য কুমিরায় প্রেরণ করেন। সুবেদার মুসার সহকারী ছিলেন হাবিলদার মােশতাক চৌধুরী। এদিকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের কোম্পানি অধিনায়ক ক্যাপটেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া ক্যাপটেন রফিকের পরামর্শক্রমে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআরএর কিছু সৈন্য নিয়ে কুমিরার দিকে অগ্রসর হন। তা ছাড়া কালুরঘাট এলাকা থেকে ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ছােটো দল রওনা দিয়ে পথিমধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্যাপটেন সাদেক আহত হয়ে কুমিরা পৌছাতে ব্যর্থ হলেও ঐ দলের সৈনিকেরা সরাসরি কুমিরা এলাকায় রণাঙ্গনে যােগদান করে। হানাদার বাহিনীর অগ্রাভিযান প্রতিরােধের উদ্দেশ্যে ক্যাপটেন রফিকের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় ইপিআর ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক দল অকুতােভয় সৈনিক কুমিরায় প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। ফলে এখানে তিন দিনব্যাপী পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর সংঘটিত যুদ্ধ এবং স্থানীয় মুক্তিকামী মানুষের দুর্দম সাহস আর দেশপ্রেমের ইতিবৃত্ত চির অক্ষয় হয়ে থাকবে।

 
কুমিরা পরিচিতি
 
চট্টগ্রাম শহর থেকে ১৪ মাইল দূরে উত্তরে অবস্থিত সাগর বিধৌত পাহাড় দুহিতা কুমিরা সীতাকুণ্ড উপজেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ জনবসতি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনুপম হলেও প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনার জন্য কুমিরা এক আদর্শ অবস্থান। পশ্চিমে সাগর আর পূর্বে পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বহমান ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে ধরে চলমান পাকিস্তানি সেনা দলকে ফাঁদে ফেলার জন্য বাস্তবিকই এটি একটি আদর্শ স্থান। কারণ, শক্রর ডানে ও বায়ে প্রতিবন্ধকতা। এগােতে হলে সামনের রাস্তা দিয়েই। আসতে হবে। তা ছাড়া সেখানে রয়েছে বাকানাে সংকীর্ণ পথ। ১৯৭১ সালে কুমিরায় ছিল একটি হাই স্কুল, একটি রেল স্টেশন, পাহাড় চূড়ায় অবস্থিত যক্ষ্মা হাসপাতাল এবং বেশ কয়েকটি মিল ও ফ্যাক্টরি। উপকূল প্রায় ভােলা হলেও পাহাড় নিবিড় গাছপালায় আবৃত। বেশ কয়েকটি শিল্পকারখানা থাকায় সে সময়। থেকেই কুমিরা ছিল ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকা।
 
কুমিরাবাসীদের প্রতিরােধ
 
মার্চের শুরু থেকেই এলাকার জনগণ দেশবাসীর সাথে একাত্ম হয়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তানি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ আর মৃত্যু তাণ্ডব এবং ইপিআর ও ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহ ও প্রতিরােধের সংবাদ সীতাকুণ্ডে পৌছুলে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। কুমিল্লা থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর চট্টগ্রাম অভিমুখে যাত্রার খবরও বিদ্যুৎবেগে জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে এলাকাবাসী বাড়বকুণ্ড থেকে কুমিরা পর্যন্ত মহাসড়কের ওপর বাড়বকুণ্ড কেমিক্যালস্ ফ্যাক্টরি, বাঁশবাড়িয়া এবং ছােট কুমিরায় কয়েকটি ব্যারিকেড তৈরি করে। সীতাকুণ্ড এলাকার বিভিন্ন মিল-ফ্যাক্টরিতে নিরাপত্তা বিভাগের অস্ত্র, বিভিন্ন ব্যক্তির লাইসেন্সধারী অস্ত্র এবং স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত কিছু অস্ত্র দিয়ে জনগণ পাকিস্তানি বাহিনীর মােকাবিলায় তৈরি হতে থাকে এমনকি শুধু বাঁশের লাঠি নিয়েও শত শত গ্রামবাসী হানাদারদের মােকাবিলায় এগিয়ে এসেছিলেন। বাড়বকুণ্ড কেমিক্যালস্ ফ্যাক্টরি এলাকায় কুমিল্লা থেকে আগত পাকিস্তানি বাহিনীর কনভয় পথের ঐ ব্যারিকেড সরানাের জন্য থামলে স্থানীয় কতিপয় যুবক পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর বন্দুক, দা-লাঠি ও কেমিক্যালস ফ্যাক্টরি থেকে সংগৃহীত অ্যাসিড দিয়ে আক্রমণ করেন। এখানে বাদশা মিয়া নামে এক যুবক রামদা হাতে এক পাকিস্তানি সেনার ওপর ঝাপিয়ে পড়লে পাকিস্তানি সেনাদের বেয়নেটের আঘাতে তিনি শহিদ হন। কুমিরার যুদ্ধে তিনিই প্রথম শহিদরূপে গণ্য হন। সেখানে তাঁর সমাধি এখনাে বিদ্যমান স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা গণ প্রতিরােধ মােকাবিলা করে ছােটো কুমিরা পর্যন্ত পথ অতিক্রম করতে পাকিস্তানি কনভয়ের বেশ সময় লেগেছিল। যযুদ্ধের তাত্ত্বিক মূল্যায়নে এ কালক্ষেপণ ছিল অত্যন্ত প্রয়ােজনীয়, গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। বাস্তবিক, স্থানীয় জনগণের প্রতিরােধের কারণে পাওয়া এ সময়টুকু ইপিআর দলকে কুমিরায় প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণের এবং প্রয়ােজনীয় পরিকল্পনা তৈরির সুযােগ করে দিয়েছিল।
 
প্রতিরােধ যুদ্ধকালীন সংগঠন
 
ক. পাকিস্তানি বাহিনী: কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামগামী শত্রুপক্ষের সৈন্যদল নিম্নরূপ: ১, ২৪ ফ্রন্টিয়ার্স ফোর্স; ২. ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ার ডিটাচমেন্ট; ৩. ৮৮ মর্টার ব্যাটারি (১২০ মিলিমিটার মর্টারবাহী); ৪. অধিনায়ক: ৫৩ ব্রিগেড অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি। মুক্তিবাহিনী: সুসজ্জিত ও সুসংগঠিত হানাদার বাহিনীর মােকাবিলায় মুক্তিবাহিনীর শক্তি ছিল নিতান্তই অপ্রতুল। নিচে বিবৃত তথ্যবিবরণী বিষয়টিকে সুস্পষ্ট করবে: ১. জনবল: ক. ১০২জন সৈন্য (ইপিআর ও ইবিআরসি রিক্রুট); খ. স্থানীয় কয়েক শত সহযােদ্ধা। সক্রিয় যুদ্ধে তারা অংশগ্রহণ না করলেও প্রচণ্ড প্রতিরােধ সৃষ্টিতে সক্রিয় ছিলেন। ২. অস্ত্র: ১টি মেশিনগান, ১টি ৩ ইঞ্চি মর্টার, এলএমজি, রাইফেল, গাদাবন্দুক ইত্যাদি। অধিনায়ক। ক. ২৬ মার্চ: ক্যাপটেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া; খ. ২৭-২৮ মার্চ: সুবেদার মুসা।
 
মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ও প্রতিরােধ প্রস্তুতি
 
ইপিআর সদস্যরা এলাকার একটি খালের ৫০০-৬০০ গজ সামনে রাস্তার দুই দিকে বিভক্ত হয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। এ ধরনের খাল অবশ্য পদাতিক বাহিনীর জন্য বড়াে কোনাে বাধা নয়। কিন্তু এতে প্রয়ােজনে খালের অপর পাড়ে গিয়ে। মুক্তিবাহিনীর জন্য নতুন পজিশন নেয়ার সুযােগ থাকে। তাদের একমাত্র ভারী মেশিনগানটি পাহাড়ের ঢালুতে সামনের মহাসড়ক দিয়ে আগুয়ান শত্রু সৈন্যের দিকে তাক করে মােতায়েন করা হয়। সুবেদার মুসা নিজেই এ গুরুত্বপূর্ণ পজিশনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রাস্তার উভয় পাশে অবস্থিত দুটি গভীর পুকুরের (যাদু পুকুর ও ফকিরা পুকুর নামে পরিচিত, এগুলাে এখনাে বিদ্যমান) ঢালে এলএমজি মােতায়েন করা হয়েছিল। অন্যদিকে, ইপিআর-এর পজিশনের সামনে ৭০-৮০ গজ দূরে বড়াে বড়াে গাছ কেটে এবং আশপাশ থেকে ইট-পাথর এনে পাকিস্তানি সেনাদের আগমনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। ইতােমধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর খবর সংগ্রহের। জন্য স্থানীয় এক যুবককে মােটরসাইকেলযােগে সীতাকুণ্ডের দিকে পাঠানাে হয়। তার মাধ্যমে সংগৃহীত সংবাদে জানা গেল, পাকিস্তানি বাহিনীর কনভয় বেশি দূরে নেই। মুক্তিযােদ্ধারা প্রয়ােজনীয় প্রতিরক্ষা ও প্রতিরােধ প্রস্তুতি নিয়ে অধীর আগ্রহে পাকিস্তানি কনভয় কলামের আগমনের অপেক্ষায় থাকেন স্থানীয় জনসাধারণের সাহায্য কুমিরা যাত্রা ও উপস্থিতির শুরু থেকেই আলােচ্য প্রতিরােধ যুদ্ধের সব পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীকে সর্বতােভাবে সাহায্য করেছে সংশ্লিষ্ট এলাকার মুক্তিকামী দেশপ্রেমিক জনসাধারণ। জনতার সংগ্রহ করে দেওয়া পাঁচটি সাধারণ পরিবহণ ট্রাকে শতাধিক মুক্তিযােদ্ধার অভিযান যাত্রা শুরু হয়।
যাত্রা পথে হাজারাে মানুষের স্লোগান মুখরিত শুভকামনা আর পাকিস্তানিদের প্রতি ধিক্কার প্রদান সম্পর্কিত তথ্য কিংবদন্তিতুল্য। এবং পরম শ্রদ্ধায় স্মরণযােগ্য। ইতােমধ্যেই এলাকাবাসীর জানা হয়ে গেছে, পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরােচিত কর্মকাণ্ডের ইতিবৃত্ত। জন্মভূমি শত্রুমুক্ত করার দৃপ্ত শপথে নতুন করে উজ্জীবিত হলেন তারা মহাসড়কের ওপর ব্যারিকেড তৈরিতে এবং ঐকান্তিক ভালােবাসায় খাদ্যসামগ্রী সরবরাহসহ বিভিন্নভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন কুমিরাবাসী। তাদের সাহায্য ছাড়া অল্প সময়ের মধ্যে গাছের বৃহৎ কাণ্ড ও ডাল কেটে ব্যারিকেড তৈরি করা অসম্ভব ছিল। কুমিরায় প্রথম দিনের যুদ্ধ।
 
২৬ মার্চ বিকাল ৫টায় পাকিস্তানি বাহিনীর সামরিক কলাম বা সৈন্য বহর বিনা বাধায় শুভপুর ব্রিজ, মিরসরাই-সীতাকুণ্ড এলাকা অতিক্রম করে কুমিরা গিরিসংকটের দিকে এগিয়ে আসে। তখন সন্ধ্যা সােয়া ৭টা। সামনে ব্যারিকেড  দেখে পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রতিবন্ধকতা সরানাের জন্য কনভয় থামাতে বাধ্য হয়। সম্ভবত পাকিস্তানি ব্রিগেড অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার শফি পথিমধ্যে এ ধরনের বড়াে কোনাে সমস্যা বা বিপদ আশঙ্কা করেন নি। সামরিক যান থেকে নেমে পাকিস্তানি সৈন্যরা ব্যারিকেড সরানাের উদ্যোগ নেয়া মাত্রই অন্ধকারের নিস্তব্ধতা ভেঙে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী হানাদারদের ওপর একযােগে ভারী মেশিনগান, মর্টার আর অন্যান্য হালকা অস্ত্রের গােলা বর্ষণ শুরু হয়। ভারী মেশিনগান থেকে মাঝে মাঝে ট্রেসার রাউন্ডও বর্ষিত হয়।  আকস্মিক এ তীব্র আক্রমণে হতভম্ব, ভীত সন্ত্রস্ত শত্রু সৈন্যরা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটোছুটি শুরু করে।
ব্রিগেডিয়ার শফি নিজের প্রাণ বাঁচার জন্য পাহাড়ের দিকে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে যান। পলায়নপর বিক্ষিপ্ত পাকিস্তানি। সেনাদের ওপর গ্রামবাসীর চোরাগােপ্তা হামলা তাদের আরও সন্ত্রস্ত করে তােলে। স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানি সেনারা ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়ে। অবশ্য প্রাথমিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে পাকিস্তানি সেনারা সংগঠিত হয়ে পালটা আক্রমণের চেষ্টা করে। শুরু করে মেশিনগান, মর্টার ও আর্টিলারির গােলা বর্ষণ। উভয়পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। আর্টিলারি ফায়ারের সাহায্যে মুক্তিবাহিনীর মেশিনগান ধ্বংস করার প্রয়াস ব্যর্থ হয়। প্রায় ২ ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চলে। ইতােমধ্যে শক্রর ৩টি ট্রাকে আগুন। লেগে যায়। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও হানাদার বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরােধ ব্যুহ ভেদ করতে সক্ষম হয় নি। ফলে যুদ্ধের পরিস্থিতি মুক্তিবাহিনীর অনুকূলে থেকে যায়। এমতাবস্থায় পশ্চাদপসরণ করে পাকিস্তানি বাহিনী যক্ষ্মা হাসপাতালসহ আশপাশের পাহাড়ি এলাকায় প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। প্রায় ২ ঘণ্টা প্রাণপণ লড়াই করে অবশেষে সুসজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনী পরাজয় স্বীকার করে পিছু হটতে বাধ্য হয়। ফেলে যায় ২ ট্রাক অস্ত্র ও গােলাবারুদ। প্রথম দিনের যুদ্ধে ২৪ ফ্রন্টিয়ার্স ফোর্সের অধিনায়ক লে. কর্নেল শাহনুর খানসহ হানাদার বাহিনীর বিভিন্ন পদবির প্রায় ১৫২জন সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর ১৪জন বীর সৈনিক শাহাদতবরণ করেন।
 
কুমিরা যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায় (২৭-২৮ মার্চ)
 

প্রথম দিনের যুদ্ধ শেষে মুক্তিবাহিনীর সীমিত গােলাবারুদ প্রায় ফুরিয়ে আসে ক্যাপটেন সুবেদ আলী ভূইয়া গােলাবারুদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম শহরে আসেন। কিন্তু উদ্ভূত প্রতিকূল অবস্থার কারণে তিনি আর রণাঙ্গনে ফিরে যেতে পারেন নি। ইতােমধ্যে কুমিরার অ্যামবুশ পুরােপুরি যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা নেতৃত্বহীন অবস্থায় অসীম সাহসিকতার সাথে লড়াই করতে থাকেন। স্থানীয় অনেক যুবক মুক্তিযােদ্ধাদের সক্রিয় সহায়তায় এগিয়ে এসেছিলেন বলেই মাত্র ১০০জন মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে তিন দিন পর্যন্ত শক্তিশালী পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরােধ করে রাখা সম্ভব হয়েছিল। পাকিস্তানিরা মুক্তিযােদ্ধাদের ব্যুহ ভেদ করার জন্য ২৬ তারিখ থেকেই আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে। শক্তিবৃদ্ধির লক্ষ্যে তারা গােলন্দাজ সাপাের্ট এবং নিকটবর্তী উপকূল বরাবর সমুদ্রপথে গানবােট ফায়ার সাপাের্টের ব্যবস্থা করে। নতুনভাবে প্রস্তুত হয়ে অবশেষে ২৮ মার্চ পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর ত্রিমুখী আক্রমণ পরিচালনা করে। এ পর্যায়ে হালকা অস্ত্রে সজ্জিত এবং সীমিত গােলাবারুদ নিয়ে স্বল্পসংখ্যক মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে অনেক গুণ শক্তিশালী পাকিস্তানি বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণ প্রতিহত করা। অসম্ভব হয়ে পড়লে তারা পিছু হটতে বাধ্য হন। তবে এ তথ্য বাহুল্য নয় যে, পশ্চাদপসরণের আগে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর বিপুল ক্ষতি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অস্ত্র ও দর্প শক্তিতে বলীয়ান পাকিস্তানি বাহিনীর মনস্তাত্ত্বিকভাবে সৃষ্ট ক্ষতিই এর মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

(কুমিরার যুদ্ধের নকশাটি দেখুন ১১১৩ পাতায়)
 

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড

 

 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!