You dont have javascript enabled! Please enable it!
ইপিআর সংগঠিত প্রতিরােধ যুদ্ধের ধারাক্রমিক প্রধান ঘটনাবলি
২৬ মার্চ বিভিন্ন বিওপি থেকে কয়েকটি প্লাটুনের চট্টগ্রাম শহরে আগমন পাহাড়তলি রেলওয়ে ভবনে অবস্থিত ইপিআর প্ল্যাটুনের ওপর পাকিস্তানি। যুদ্ধজাহাজ পিএনএস জাহাঙ্গীর থেকে ব্যাপক গােলা বর্ষণ। পরে ২৭ মার্চ প্লাটুনটির স্টেট ব্যাংক ও কোতােয়ালি এলাকায় নতুন প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ। হালিশহরে মােতায়েনকৃত ইপিআর দলের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১টি কমান্ডাে কোম্পানির আক্রমণ প্রতিহতকরণ। হালিশহরের প্রতিরক্ষা ব্যুহ পাের্ট এলাকা ও সেনানিবাসস্থ পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে সংযােগ স্থাপনে কার্যকর প্রতিবন্ধকতারূপে দেখা দেয়া। চট্টগ্রামের বাইরে থেকে ইপিআর সৈন্যদের শহরে পৌছার পর বিমানবন্দর, পাের্ট এলাকা ও নৌ সদর দপ্তর আক্রমণের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু তারা পথিমধ্যে কালুরঘাট থেকে যাওয়ায় তা সম্ভব হয়ে ওঠে নি। রেলওয়ে হিলের ইপিআর ট্যাকটিক্যাল সদর দপ্তরের বিপরীত দিকের পাহাড় এবং সামনের মসজিদ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেপরােয়া গােলা বর্ষণ। রেলওয়ে হিলের প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর টাইগার পাস থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর আর্টিলারির গােলা বর্ষণ । ইপিআর বাহিনীর পালটা আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে তাদের মূল প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে আক্রমণ অব্যাহত রাখে।
পাকিস্তানি সেনারা ট্যাংকের সাহায্যে রেলওয়ে পাহাড় ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। পাকিস্তানি বাহিনীর ক্রমাগত গােলা বর্ষণের দরুণ ক্যাপটেন রফিক রেলওয়ে পাহাড়ের সদর দপ্তরের প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে তার বাহিনীকে প্রত্যাহার করে কোতােয়ালি থানা এলাকায় চলে। যেতে বাধ্য হন। কাপ্তাই থেকে ক্যাপটেন হারুন ১টি ইপিআর কোম্পানি এবং কক্সবাজার থেকে সুবেদার মফিজ অপর ১টি ইপিআর কোম্পানি নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে আসার পথে কালুরঘাটে ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে যােগ দেন। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামবাসীর প্রবল প্রতিরােধের সংবাদ পাকিস্তানি বাহিনীর সমর নায়কদের বিচলিত করে তােলে। ফলে চট্টগ্রামস্থ পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ২৫ মার্চ রাতেই কুমিল্লা থেকে একটি শক্তিশালী পাকিস্তানি সৈন্যদল চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামের দিকে আগত পাকিস্তানি বাহিনীর ঐ সৈন্যদল ১টি ইপিআর কোম্পানি কর্তৃক কুমিরায় বাধাপ্রাপ্ত হয়। কুমিরার এ প্রতিরােধ যুদ্ধ ২৮ মার্চ পর্যন্ত চলে। ২৭ মার্চ সি-১৩০ বিমানে করে পাকিস্তানি সৈন্যদল ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের সৈন্যদের সাহায্যকল্পে ২৬-২৭ মার্চ আসতে শুরু করে।  ২৭ মার্চ সকালে বিমান বােঝাই করে ঢাকা থেকে উড়ে আসে পাকিস্তানিদের ২য় কমান্ডাে ব্যাটালিয়ন।
 
চট্টগ্রামের পরিস্থিতিতে উদবিগ্ন পাকিস্তানি সমর নায়কেরা ২৭ মার্চ জেনারেল মিঠঠাকে নতুন যুদ্ধ পরিকল্পনা তৈরির জন্য চট্টগ্রামে পাঠান। তাকে বহনকারী হেলিকপটারটি বিদ্রোহী বাঙালি সৈন্যরা গুলি করে ফুটো করে দিতে সক্ষম হন। | দেওয়ানহাট থেকে পাকিস্তানি সেনাদের ৪টি গাড়ি হালিশহরের দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রয়াসকে হালিশহরে মােতায়েনকৃত ইপিআর দল কর্তৃক নস্যাৎ করে সামরিক যানবাহন ধ্বংস ও প্রচুর গােলাবারুদ দখল। ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অপর ১টি কোম্পানি হালিশহরের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করলে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। হালিশহরে মােতায়েনকৃত ইপিআর দলের ওপর ১টি পাকিস্তানি কমান্ডাে কোম্পানির পুনরাক্রমণ প্রতিহত করা হয়। ২৮ মার্চ ইদগা মােড়ে ঢাকা ট্রাংক রােডের একদিকে রেডিও পাকিস্তানের (বর্তমানেও বিদ্যমান) স্টোর হাউজ এবং অন্যদিকে নাহার মঞ্জিল। যুদ্ধের শুরু থেকেই ইপিআর সৈনিকেরা এখানে প্রতিরােধ ব্যুহ রচনা করে অবস্থান গ্রহণ করেন। ২৮ মার্চ বিকাল ৩টায় শহরের দিক হতে পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি বড়াে দল ইদগা মােড়ে পৌছাতেই প্রথম আক্রমণ শুরু করেন স্টোর হাউজে অবস্থানরত ইপিআর সদস্যরা। এমন আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত আক্রমণে দিশেহারা হলেও তড়িৎ গতিতে পাকিস্তানি বাহিনী গাড়ি হতে নেমে সামনের মাঠে পজিশন নিয়ে পালটা আক্রমণ করে।
প্রচণ্ড আক্রমণের মুখেও স্টোর হাউজের ইপিআর সৈনিকেরা দৃঢ় মনােবলে শত্রুপক্ষের দিকে গুলি বর্ষণ করতে থাকেন। এদিকে পিছনে নাহার মঞ্জিলে অবস্থান  গ্রহণকারী অন্য ইপিআর সেনারা প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে প্রথমে হতভম্ব হয়ে যায় এবং পরে রণকৌশলগত প্রয়ােজনে নীরব ছিল। তারা যুদ্ধের এক বিশেষ মুহূর্তের সুযােগ নিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। একই সাথে এলএমজি ও মর্টারের সাহায্যে। শক্রর ওপর আক্রমণ শুরু করেন। এ অপ্রত্যাশিত আক্রমণের জন্য শত্রুরা মােটেও প্রস্তুত ছিল না। এবার মাত্র ৭-৮জন ইপিআর সৈন্যের আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী পযুদস্ত হয়ে পড়ে। প্রাণ হারায় অফিসারসহ ৩০-৪০জন পাকিস্তানি সৈন্য। বাকিরা কোনােমতে প্রাণ নিয়ে পলায়ন করে। ঘটনাস্থলে ৩জন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করে এলাকাবাসী। এ যুদ্ধে শহিদ হন সিপাহি মনু মিয়া, ল্যান্স নায়েক আবদুস সাত্তার, সিপাহি বাচ্চু মিয়া প্রমুখ।
 
চট্টগ্রাম থেকে কুমিরায় আটকে পড়া পাকিস্তানি বাহিনীকে সাহায্যের জন্য প্রেরিত একটি পাকিস্তানি কোম্পানি ফৌজদারহাটে অ্যামবুশে পড়ে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। কুমিল্লা থেকে অগ্রাভিযানরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট চট্টগ্রামের পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সংযােগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়। ২৯ মার্চ ২৯ মার্চ আগ্রাবাদের পতন। পাকিস্তানি সেনাদের একটি দলের নিউ মার্কেট এলাকায় অবস্থান গ্রহণ। ১ প্লাটুন ইপিআর সৈন্যের চট্টগ্রাম কোর্ট ভবনে অবস্থান গ্রহণ। ইপিআর সৈন্যরা ক্রমেই হালিশহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়তে থাকে। আগ্রাবাদ এলাকা থেকে ইপিআর সৈন্যরা মূল ঘাঁটি হালিশহরে চলে যেতে বাধ্য হয়। ৩০ মার্চ রেলওয়ে হিল, টাইগার পাস, দেওয়ানহাট, আগ্রাবাদ এলাকা, মেডিক্যাল কলেজ পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ইপিআর প্লাটুন কর্তৃক কোতােয়ালি এলাকায় পাকিস্তানি কমান্ডাে প্ল্যাটুনের ওপর সফল হামলা পরিচালনা। হালিশহরের ইপিআর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর ট্যাংকসহ পাকিস্তানি বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণ।
আর্টিলারি, যুদ্ধজাহাজ বাবর ও জাহাঙ্গীর থেকে ক্রমাগত গােলা বর্ষণ। বীরত্বপূর্ণ প্রতিরােধ যুদ্ধ শেষে বেলা ২টায় ইপিআর সদর দপ্তরের পতন। ৩০ মার্চ-২ এপ্রিল এ সময়ে অমিতবিক্ৰমে ইপিআর বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হন। তারমধ্যে উল্লেখযােগ্য পরির পাহাড়ের বা কোর্ট হিলের যুদ্ধ। মাত্র ৩০জন ইপিআর সৈন্য উপযুপরি ৩ দিন শক্রর ট্যাংকসহ আক্রমণকারী পাকিস্তানি সৈন্যদের ঠেকিয়ে রেখেছিলেন অসীম সাহসে। কোনাে অফিসারের কমান্ড ছাড়াই ইপিআর-এর ক্ষুদ্র দলটি ৪-৫ দিন বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে। এতে হতাহত হয়েছিল প্রচুর পাকিস্তানি সৈন্য। ২ এপ্রিল দুপুর ১২টায় কোর্ট হিলের পতন ঘটে। এ সময় অসম শক্তির যুদ্ধে টিকতে না পেরে ইপিআর সৈন্যরা শহর ছেড়ে গ্রামাঞ্চলে চলে যান এবং নতুন করে সংগঠিত হয়ে কয়েক দিনের মধ্যেই নতুন উদ্যমে যুদ্ধ শুরু করেন। এদিকে ক্যাপটেন রফিক অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ২ এপ্রিল। ভারতের আগরতলা গমন করেন। মেজর জিয়াউর রহমানের অনুরােধে আগত ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানি উদালিয়া চা-বাগান এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করে। 

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!