মার্চ পূর্ব ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অভ্যন্তরীণ অবস্থা
চট্টগ্রামের ষােলশহরে অবস্থানরত ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পশ্চিম পাকিস্তানে বদলি হয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সেনাবাহিনীর স্বাভাবিক পরিকল্পনার অংশ হিসাবে এক কোম্পানি জনবলের অগ্রগামী দল সে। সময় পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে নতুন কার্যস্থলে স্বীয় দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। অন্য তিনটি রাইফেল কোম্পানি ও সদর কোম্পানি মােলশহরে অবস্থান করছিল। রাইফেল কোম্পানিগুলাের প্রতিটিতে প্রাধিকৃত জনবলের তুলনায় ৩০-৩৫জন সৈন্য কম ছিল। তা ছাড়া স্বাভাবিকভাবে ছুটি ভােগরত কিছু সৈনিকও ইউনিটে হাজির ছিল না। ইউনিটে সশরীরে অবস্থান করছিল সর্বসাকুল্যে ৩০০জনের মতাে সৈনিক। ইউনিটে অবস্থানরত বিভিন্ন পদবির মধ্যে স্বল্পসংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসার বা সৈনিক উপস্থিত ছিল। ইউনিট অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ রশিদ জানজুয়া ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসার। ইউনিটের দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠতম। অফিসার ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। চট্টগ্রামে অবস্থানরত ইউনিটের ৩টি রাইফেল কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন যথাক্রমে ক্যাপটেন চৌধুরী খালেকুজ্জামান, ক্যাপটেন সাদেক হােসেন ও ক্যাপটেন আহমেদ দীন (অবাঙালি)। তা ছাড়া অন্য অফিসারদের মধ্যে মেজর মীর শওকত আলী (ভারপ্রাপ্ত অ্যাডজুটেন্ট), ক্যাপটেন। অলি আহমদ, লেফটেন্যান্ট এ.ওয়াই মাহফুজুর রহমান, লেফটেন্যান্ট শমসের মবিন চৌধুরী এবং লে, হুমায়ুনও (অবাঙালি) উপস্থিত ছিলেন। স্বাভাবিক নিয়মে বদলির কারণে কোনাে ইউনিটের নতুন কর্মস্থলে যাওয়ার আগে ভারী অস্ত্র পুরাতন কর্মস্থলে গচ্ছিত রেখে যাওয়া হতাে। নিয়ম অনুযায়ী এ ইউনিটের ভারী অস্ত্রগুলাে ততদিনে জমা দেওয়া হয়েছিল। প্রশিক্ষণ কার্যক্রম যাতে ব্যাহত না হয়, সে জন্য ইউনিটে ১টি আরআর, ২টি ৩ ইঞ্চি মর্টার ছাড়া শুধু সৈনিকদের ব্যক্তিগত অস্ত্র হিসেবে প্রায় ১৫০টি ৩০৩ রাইফেল ছিল। তা ছাড়া সৈনিকদের জন্য কেবল প্রথম সারির গােলাবারুদ (Pouch ammunition) ইউনিটে মজুত ছিল। বাস্তবিক, এর পরিমাণ ছিল নিতান্ত অপ্রতুল।
সূত্র: ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস, পৃ. ৩
চট্টগ্রাম শহরে ২৫ মার্চে ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পূর্বে বহমান ও ঘটমান বিভিন্ন কার্যকারণে বিক্ষুব্ধ চট্টগ্রামবাসী ২৪ মার্চ রাতেই শহর জুড়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যারিকেড সৃষ্টি করেছিল। বিশেষত, ক্যান্টনমেন্টগামী ও বন্দর সংযােগকারী সড়কের অসংখ্য স্থানে ব্যারিকেড তৈরি করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য, ইতােমধ্যে পাকিস্তান থেকে আগত ‘সােয়াত’ নামক জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে না দেওয়া এবং যেকোনােরকমে খালাস করা অস্ত্র ক্যান্টনমেন্টে পরিবহণে বিঘ্ন সৃষ্টি করা। ২৫ মার্চ খুব ভােরে ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবদুর রশীদ জানজুয়া ক্যাপটেন সাদেক হােসেনের কোম্পানিকে ষােলশহর রেললাইনের জংশন স্থলে পৌছে রেলগাড়ি দ্বারা সৃষ্ট ব্যারিকেড সরানাের নির্দেশ দেন। এ রেজিমেন্টের অন্য অফিসারদেরও ব্যারিকেডস্থলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার ও সৈনিকেরা নিছক আদেশ পালনের জন্য সেখানে উপস্থিত হলেও ব্যারিকেড সরানােতে অহেতুক কালক্ষেপণ করছিলেন। লে. কর্নেল জানজুয়া সৈনিকদের মনােভাব বুঝতে পেরে ক্যান্টনমেন্টে ট্যাংক ট্রপের সাথে সংশ্লিষ্ট টেকনিশিয়ানদের ডেকে পাঠান এবং তাদের সহায়তায় শেষ পর্যন্ত রেলগাড়ির ব্যারিকেড সরানাের কাজ সম্পন্ন করেন। তা ছাড়া তিনি ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়কসহ অন্য বাঙালি অফিসারদের ওপর আস্থা রাখতে না পেরে ইউনিটের অফিসার-সৈনিকদের বিভিন্ন উপদলে ভাগ করে তাদের শক্তি দুর্বল করার প্রয়াস গ্রহণ করেন। সেই লক্ষ্যে বিকাল ৪টায় তিনি নিজে মেজর শওকতসহ ৫০-৬০জনের ১টি দলকে অস্ত্রবিহীনভাবে চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে যান। মেজর শওকতকে তার সাথে ফিরিয়ে নিয়ে এলেও সৈনিকদের সেখানেই রেখে আসেন।
১টি কোম্পানিকে মােলশহর থেকে ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত এলাকায় দায়িত্ব পালনের জন্য লেফটেন্যান্ট মাহফুজ, লেফটেন্যান্ট শমসের মবিন ও সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হুমায়ুন কবিরের অধীনে নিয়ােজিত করেন। বন্দর থেকেই তিনি সংবাদ প্রেরণ করেন, যাতে উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান প্রয়ােজনে বন্দরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকেন। মেজর জিয়াকে বন্দরে প্রেরণ নিশ্চিত করার জন্য তিনি নিজেই ইউনিটে ফিরে এসে নৌবাহিনীর একটি গাড়িতে করে পাকিস্তানি ১জন অফিসার ও কিছু সৈন্যসহ রাত সাড়ে ১১টায় মেজর জিয়ার বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া নিশ্চিত করেন। ক্যাপটেন চৌধুরী খালেকুজ্জামানকেও ইতঃপূর্বে ইউনিটের ডিউটি ব্যতিরেকে অবশিষ্ট সৈন্যসহ এমবারকেশন ইউনিটে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ফলে কর্তব্যরত মুষ্টিমেয় কিছু সৈন্য ছাড়া ষােলশহরের ইউনিট লাইনে অধিকাংশ সৈন্যই অনুপস্থিত ছিল।
চট্টগ্রাম শহরে ২৫ মার্চে ইপিআর-এর অবস্থান এবং গৃহীত কার্যক্রম
মার্চ মাসের প্রথম থেকে ইপিআর বাহিনীকে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্থানে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য মােতায়েন করা হয়। তাদের মূল অবস্থান ছিল: পাঁচলাইশ, রেল স্টেশন, ওয়্যাবলেস কলােনি, আমবাগান কলােনি, পাহাড়তলি রেলওয়ে হাই স্কুল, ওয়ার্কশপ, ভিক্টোরিয়া জুট মিল, আমিন জুট মিল, হালিশহর অবাঙালি কলােনি, এয়ারপাের্ট, ফিরােজশাহ কলােনি, সার্কিট হাউজ, স্টেডিয়াম ইত্যাদি এলাকাতে। প্রকৃতপক্ষে, ৩ মার্চ থেকে ক্যাপটেন রফিক সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সম্ভাবনা এবং সে ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে চট্টগ্রামের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতাদের সাথে যােগাযােগ শুরু এবং পরিকল্পনা জানার চেষ্টা করেন। কিন্তু ২৫ মার্চ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনাে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা পাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় নি। ক্যাপটেন রফিক মার্চের শুরু থেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অশুভ তৎপরতাকে নস্যাৎ করার লক্ষ্যে কয়েকজন বিশ্বস্ত জেসিও ও এনসিও-এর। সহযােগিতায় প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এ জন্য তিনি সন্তর্পণে বিশ্বস্ত সৈনিকদের বেশ কিছু দায়িত্বও দিয়েছিলেন এবং ২টি কোড ওয়ার্ড বা সাংকেতিক বার্তা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। প্রথমটি ছিল ‘Arrange some wood for me.’ অর্থাৎ ‘পাকিস্তানি অফিসার ও সৈন্যদের আক্রমণের প্রস্তুতি নাও।’ দ্বিতীয়টি ছিল ‘Bring some wood for me.’ অর্থাৎ যুদ্ধ শুরু হয়েছে, পাকিস্তানি অফিসার ও সৈন্যদের নিরস্ত্র ও বন্দি করে চট্টগ্রামে আমার সাথে যোগ দাও’ (রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম, ১৯৯৬: ৬৭)।
এ ধরনের প্রস্তুতি ২৫ মার্চের অব্যবহিতপরবর্তী প্রতিরােধ যুদ্ধের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এজন্যই চট্টগ্রামে ২৫ মার্চেই পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা অনায়াস ছিল না। বাঙালি সেনা অফিসারদের প্রস্তুতি বৈঠক মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর অগ্রণী ভূমিকা ছিল, এটি একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। মার্চের প্রারম্ভ থেকেই চট্টগ্রামে অবস্থানরত সশস্ত্রবাহিনীর দেশপ্রেমিক বাঙালি অফিসাররা দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য পরিকল্পনা পর্যালােচনা এবং নিজেদের দায়িত্ব, কর্তব্য, ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ইত্যাদি নির্ধারণ করার জন্য বেশ কয়েকবার গােপন আলােচনায় বসেছিলেন। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত এরূপ কয়েকটি বৈঠকের প্রসঙ্গ তারিখের ক্রমানুসারে উল্লেখ করা হলাে: ক, ৬ মার্চ ক্যাপটেন রফিক হালিশহরে ইপিআর-এর বাঙালি জেসিও ও এনসিওদের নিয়ে গােপন বৈঠক করেন। এর আগে তার সাথে এম. আর, সিদ্দিকীর একটি গােপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। খ. ৮ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান ও ক্যাপটেন অলি আহমদ পরস্পর আলােচনা করেন। গ, ১৭ মার্চ চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে সামরিক আইন প্রশাসকের দপ্তরে একটি একান্ত বৈঠক হয়। এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন লে. কর্নেল এম আর চৌধুরী, মেজর জিয়াউর রহমান, ক্যাপটেন আমিন আহমদ চৌধুরী ও ক্যাপটেন অলি আহমদ। বৈঠকে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে লে. কর্নেল এম আর চৌধুরীর নেতৃত্বে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। ২২ মার্চ ক্যাপটেন রফিক মেজর জিয়ার সাথে দেখা করে স্বাধীনতা যুদ্ধে ইপিআর বাহিনীর যােগদানের সিদ্ধান্ত জানান।
২৩ মার্চ সন্ধ্যায় ক্যাপটেন হারুন, লে. শমসের মবিন, ক্যাপটেন জোমান ও ক্যাপটেন অলি আহমদ ক্যাপটেন রফিকের বাসায় এলের জন্য ন ক্যাপটেন রফিকের বক্তব্য অনুযায়ী এ আলােচনা ১৭ তারিখ রাতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল (প্রাগুক্ত: ৭৮)। নিরাপত্তার কথা ববেচনা করে সেখান থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান শামসুল আলমের বাসায় তাদের বৈঠকস্থল স্থানান্তর করেন। এ বৈঠকে আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান কায়সার ও ডা. এম এ মান্নান উপস্থিত ছিলেন। এ বৈঠক সম্পর্কে মেজর জিয়াও অবহিত ছিলেন। তখন পর্যন্ত কোনাে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না পাওয়ায় বৈঠকে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে কোনাে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয় নি। তবে এ বৈঠকে বিভিন্ন সেনা ইউনিটের বাঙালি অফিসারদের সাথে যােগাযােগ বজায় রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। চ, তা হাত অত্যাসন্ন সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রস্তুতি হিসেবে মার্চের শুরুতেই অন্য দায়িত্বের ছলে পার্বত্য বান্দরবানে গুপ্তাশ্রয় স্থাপনের জন্য ক্যাপটেন অলি আহমদ পর্যবেক্ষণ পরিচালনা করেন।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড