চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ প্রারম্ভিক প্রতিরােধ যুদ্ধের
স্বরূপ ও তাৎপর্য (২৫ মার্চ-২ মে, ১৯৭১)
২৫ মার্চের কালরাতে ঢাকা শহরে পাকিস্তানি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ আর গণহত্যা শুরুর আগেই চট্টগ্রাম শহরের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। সড়কে সড়কে তৈরি করে ব্যারিকেড। বিভিন্ন ব্যক্তির লাইসেন্সধারী অস্ত্র দিয়ে জনগণ। পাকিস্তানি বাহিনীর মােকাবিলায় নিজেদের প্রস্তুত করতে থাকে এমনকি শুধু বাঁশের লাঠি নিয়েও শত শত ছাত্র-জনতা হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ রচনায় এগিয়ে এসেছিল। শহর জুড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর টহল সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত অস্ত্র বােঝাই জাহাজ ‘সােয়াত’ থেকে অস্ত্রশস্ত্র খালাস এবং সেগুলাে পশ্চিমা সৈন্যদের হাতে যাতে না পৌঁছাতে পারে, তার বিরুদ্ধে গড়ে তােলা হয়েছিল প্রবল গণ প্রতিরােধ ইতােমধ্যে ২৫ মার্চের গভীর রাতে সারা দেশে গােপন ও নিখুঁত পরিকল্পনা। অনুযায়ী বাঙালি নিধনে উন্মত্ত হয়ে ঝাপিয়ে পড়ে হানাদার বাহিনী। এ রাতেই চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অবস্থিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে অতর্কিতভাবে হামলা করে ঘুমন্ত সহস্রাধিক প্রশিক্ষণার্থী সৈনিককে দখলদার বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। এ মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডের খবর বিদ্যুৎবেগে সারা চট্টগ্রামে ছড়িয়ে পড়লে চট্টগ্রামবাসী শক্র হননে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠে। সশস্ত্র বাহিনীর দেশপ্রেমিক সদস্যদের উদ্যোগে এবং ছাত্র-জনতার সক্রিয় সহযােগিতায় গড়ে তােলা হয় প্রবল ও সুদৃঢ় প্রতিরােধ। স্বাধীনতা যুদ্ধের উষালগ্নে ২৫ মার্চের কালরাতেই মেজর জিয়ার নেতৃত্বে ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং চট্টগ্রাম ইপিআর (বর্তমানে বিজিবি) সেক্টরের অ্যাডজুটেন্ট ক্যাপটেন রফিকের নেতৃত্বে ইপিআর-এর দেশপ্রেমিক ও সাহসী বাঙালি সৈনিকরা প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ইপিআর সদস্যরা ছাত্র জনতার সাহায্যে পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে হালিশহর ও পাহাড়তলি এলাকায় গড়ে তােলে প্রথম সফল প্রতিরােধ।
প্রতিরােধকালীন সামরিক সংগঠন পাকিস্তানি বাহিনী চট্টগ্রামে শত্রুপক্ষের সৈন্যবল ও সংগঠন ছিল নিম্নরূপঃ-
১. ২০ বালুচ রেজিমেন্ট (অধিনায়ক লে. কর্নেল ফাতেমী)। ২. ২৯ ক্যাভালরি (১ টুপ-৩টি ট্যাংক)। ৩. ২৪ ফ্রন্টিয়ার্স ফোর্স (কুমিল্লা থেকে ২৮ মার্চে আগত)। ৪. ২ কমান্ডাে ব্যাটালিয়ন (২৭ মার্চে ঢাকা থেকে আগত)। ৫. ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ার ডিটাচমেন্ট। ৬. ৮৮ মর্টার ব্যাটারি (১২০ মিলিমিটার মর্টারবাহী)। যুদ্ধজাহাজ বাবর ও জাহাঙ্গীর (বাঙালি প্রতিরােধ বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ নিয়ে আসা হয় চট্টগ্রাম বন্দরে। ডেস্ট্রয়ারও যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়)।
এয়ার সাপাের্ট। ৯. অধিনায়ক: ব্রিগেডিয়ার আনসারি। (কুমিল্লা থেকে রি-ইনফোর্সমেন্ট নিয়ে ২৮ মার্চ ৫৩ ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির আগমন)। মুক্তিবাহিনী। সুসজ্জিত ও সুসংগঠিত হানাদার বাহিনীর মােকাবিলায় প্রতিরােধের প্রাথমিক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর শক্তি ছিল নিতান্তই অপ্রতুল এবং সংগঠন ছিল প্রায়। অপরিকল্পিত। নিচের সাংগঠনিক বিবরণে তা সুস্পষ্ট হবে: ১. জনবল ক. ইপিআর সদস্য প্রায় ১৫,০০জন। খ, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় ৪০০জন সৈনিক। এরা প্রধানত ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইবিআরসিতে বিভিন্ন দায়িত্ব পালনরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক। ইবিআরসি’র প্রায় ১,৫০০জন রিক্রুট। মতান্তরে প্রায় ৫০০ ইবিআরসি সৈনিক। উল্লেখ্য, তৎকালীন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৮টি ব্যাটালিয়নের জন্য প্রয়ােজনীয় সৈন্য ইবিআরসিতেই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করত। ৮টি ব্যাটালিয়নের জন্য প্রয়ােজনের ভিত্তিতে ৫০০ প্রশিক্ষণার্থী থাকার ধারণাই বেশি গ্রহণযােগ্য। ঘ. রিজার্ভ ও পুলিশ লাইনের কয়েক শত সদস্য। ২. অস্ত্র: এলএমজি, ৩ ইঞ্চি মর্টার, গােলাবিহীন ১টি আরআর ও মেশিনগান (১-২টি)।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড