You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২রা অক্টোবর, বুধবার, ১৯৭৪, ১৫ই আশ্বিন, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

পর্তুগালে পট পরিবর্তনের পশ্চাতে—?

পাঁচ মাস পাঁচ দিন পর পর্তুগালের ইতিহাসে আর একবার পট পরিবর্তন হল। ৬৪ বছর বয়স্ক জেনারেল এন্টনিও স্পিনোলা ৩০শে সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করলেন। নতুন প্রেসিডেন্ট কস্টা গোমেজ কাউন্সিল অব স্টেট জেনারেল কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে এলেন পর্তুগালের রাজনৈতিক মঞ্চে। জেনারেল স্পিনোলা তাঁর বিদায়ী ভাষণে জাতির উদ্দেশে বলেন যে, এক সপ্তাহব্যাপী ডানপন্থী বিক্ষোভের দুঃখজনক পরিণতিই তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। তিনি আরও বলেছেন—সমগ্র দেশ আজ অরাজকতা ও স্বৈরাচারী তৎপরতায় লিপ্ত। বিগত অর্ধশতাব্দীর একনায়কত্ব শেষ করে এপ্রিলে যে আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। এবং পর্তুগাল এখন ভুয়া গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে চলছে।
এ কথা সত্য যে, ২৫শে এপ্রিল পর্তুগালে স্পিনোলা সরকারের সামরিক অভ্যুত্থানে বিশ্ববাসীকে সচকিত হয়েছিল। একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও উপনিবেশগুলোর প্রশ্নে তাঁদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের ব্যাপারে সন্তোষজনক ব্যবস্থা অবলম্বন করার প্রতিশ্রুতি দিলেও স্পিনোলা সরকারের কার্যপদ্ধতির প্রতি বিশ্ববাসী সজাগ দৃষ্টি রেখেছিল। ক্ষমতায় আসার অব্যবহিত পরেই স্পিনোলা বিশ্ববাসীর আস্থা কুড়োবার জন্য বা স্ব-প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্যই এমন কিছু গণতান্ত্রিক আদর্শানুসারী কাজও করেছিলেন। সংবাদপত্রের উপর থেকে সরকারী নিয়ন্ত্রণাদেশ হ্রাস করা, পুরানো রাজবন্দীদের মুক্তি দেয়া এবং বেসামরিক সরকার গঠন করার প্রয়াস তারই ফলশ্রুতি।
অপরপক্ষে উপনিবেশগুলোর প্রশ্নে জেনারেল স্পিনোলা কর্তৃক বাধ্য হয়েই অবশেষে শান্তিপূর্ণ সমঝোতায় আসতে শুরু করেছিলেন। গিনি-বিসাউকে স্বাধীনতা স্বীকৃতি দেওয়া, মোজাম্বিকে অন্তর্বর্তীকালীন ক্যালিমো সরকার গঠনের সুযোগ দেওয়া এবং এঙ্গোলা ও কেপভার্দের প্রশ্নে সহিষ্ণু ও সহানুভূতি সম্পন্ন মানসিকতার প্রকাশ দেখানো তারই প্রমাণও বটে। হয়তো বা ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যবাদী পর্তুগালের প্রেসিডেন্ট ধীরে ধীরে বর্তমান বিশ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করার একটা চেষ্টা নিতেই চেয়েছিলেন এমনটাও ভাবা যায়। কিন্তু তবুও স্পিনোলাকে পদত্যাগ করতে হল।
পর্তুগালের এই পরিবর্তন যে আকস্মিক কোনো ঘটনা নয় এ কথাও আজ সচেতন বিশ্ববাসীকে ভাবতে হচ্ছে। এবং এই ভাবনার পেছনে বাস্তব তথ্যও কিন্তু পাওয়া গেছে। লিসবনের ইউ.পি.আই সূত্র থেকে বলা হয়েছে যে, পর্তুগালের অস্থিরাবস্থার জন্য সিআইএ বহুলাংশে দায়ী। ডানপন্থী ও বামপন্থীদের পারস্পরিক বিরোধের জন্যই মধ্যপন্থী স্পিনোলা সরকারের পদচ্যুত দেখা দিয়েছিল।
বর্তমান বিশ্বে সিআইএ যেন একটা বিভীষিকার সৃষ্টি করেছে। এবং সম্প্রতি প্রকাশিত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার ডিরেক্টর উইলিয়াম কলবি’র প্রকাশ্যে বিবৃতি তাতে ইন্ধন যুগিয়েছে। তিনি বলেছেন যে—চিলিতে সালভেদর আলেন্দে সরকারকে উৎখাত করার জন্য সি.আই.এ ১ কোটি ১০ লাখ ডলার খরচ করে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ৮০ লাখ ডলার খরচ করবার অনুমোদন দিয়েছিলেন। সিআইএ নিজস্ব বাজেট থেকে অতিরিক্ত ৩০ লাখ ডলার খরচ করে। এবং এ সমস্ত ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে সি.আই.এ তার নিয়মিত দায়িত্ব পালন করছে বলে উইলিয়াম কলবি সন্তোষ প্রকাশ করেন।
প্রসঙ্গক্রমেই বলা যায় যে, শুধু এইটুকুই নয় পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারী আইয়ুব খানকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা, বাংলাদেশে গণহত্যার কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা দেয়া, ইরানের জনপ্রিয় মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করা, দক্ষিণ ভিয়েতনামে দিয়েমের পতন ঘটানো, কম্বোডিয়ায় গোপন বোমাবর্ষণ, কিউবার বিপ্লবী বিজয়কে বানচাল করার জন্য নৌবহর পাঠানো ইত্যাদি সব কাজের সঙ্গেই সি.আই.এ’র নাম জড়িত। এসব গল্প বা অনুমান নয়। প্রামাণ্য তথ্য আছে এসবের।
পর্তুগালের ঘটনায় দেখা যাচ্ছে—যে বামপন্থী নেতা প্রধানমন্ত্রী হলেন, সেই গণকালভেস ২৫শে এপ্রিলের সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা রচনা করেছিলেন। গণজালভেসের অস্থায়ী মন্ত্রীসভায় সোশ্যালিস্ট কমিউনিস্ট এবং মধ্যপন্থী ডেমোক্র্যাটিক পপুলার পার্টির প্রতিনিধিও ছিলেন। কিন্তু তবু তাঁর সরকার সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজ করতে পারলেন না। বামপন্থীরাও বলেছেন যে, স্পিনোলা সরকার বিরোধী চক্রান্তে সি.আই.এ’র কালো হাত আছে। এবং সি.আই.এ’র কালোহাতই দক্ষিণপন্থীদের সক্রিয় করেছে। জেনারেল স্পিনোলাও তাঁর পদত্যাগের ভাষণে দক্ষিণপন্থীদের প্রতি সরাসরি অভিযোগ রাখেন।
পৃথিবীর ইতিহাসেই আমরা দেখেছি যে, কোনো সরকারের প্রায় নিরঙ্কুশ জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও সি.আই.এ মুষ্টিমেয় লোভীদের কাছে অর্থের মায়াজাল বিস্তার করে। সেখানে ক্রমশঃ ধরা দেয় অনেকে। এবং এই রন্ধ্র পথ ক্রমশঃ অর্থের জৌলুসে সরগরম হয়। অপরপক্ষে জনপ্রিয় সরকারের কাল ঘনিয়ে আসে। পৃথিবীব্যাপী এমন ধরনের অসংখ্য অর্থ মায়াজাল সি.আই.এ ফেলে রেখেছে। দুর্ভাগ্যবশতঃ জনগণের আস্থা উদ্রেককারী সরকারের পতন ঘটানো এবং দেশে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা ঘটানোই হয় তাদের একমাত্র লক্ষ্য। কারণ পানি ঘোলা করলেই নাকি মাছ শিকার সহজসাধ্য হয়ে উঠে। কিন্তু বর্তমানের সভ্যজগতে মানবতা ও শান্তিবাদের পথ কি এমনিভাবেই কলুষিত হতে থাকবে? এই শাশ্বত প্রশ্নের জবাব কোথায় কেমন করে পাওয়া যাবে আমরা জানি না। তবু সোচ্চার দাবী রাখছি আমরা—সি.আই.এ’র এহেন তৎপরতা বিশ্বশান্তি ও বৃহত্তর মানবতার স্বার্থেই বন্ধ হোক।

বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের ভাষণের আলোকে

বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের বার্ষিক যৌথ অধিবেশনে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট মিঃ ম্যাকনামারা এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্বোধনী ভাষণ দিয়েছেন। রবার্ট ম্যাকনামারা তাঁর ভাষণে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতির জন্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তেলের নতুন মূল্য বৃদ্ধি পৃথিবীর লাখ লাখ ‘দরিদ্রতম’ মানুষকে বঞ্চনা এবং মৃত্যুর সম্মুখীন করেছে বলে তিনি ঘোষণা করেছেন। বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মোকাবেলার জন্যে ১৯৭৫-১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তিন হাজার ছয় শত কোটি ডলারের একটি নতুন ঋণদান পরিকল্পনা পেশ করেছেন। উল্লেখিত এই পরিমাণ বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় একশত পঁচিশ শতাংশ বেশী। জানা গেছে, ব্যাংক ডিরেক্টররা চলতি অর্থ বছরে সাড়ে পাঁচশ’ কোটি ডলার ঋণদান অনুমোদন করেছেন। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট আরো বলেছেন, ‘রোগ, অশি ও অপুষ্টি থেকে বিশ্বের আশি কোটি লোককে উদ্ধারের জন্যে উন্নয়নশীল দেশকে ঋণ ও অন্যান্য আকারে সাহায্য দেয়া অত্যাবশ্যক। এই ঋণের মূল-উদ্দেশ্য থাকবে কৃষি উৎপাদন ও গ্রামীণ জনগণের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যে অগ্রাধিকার দেয়া।’ মিঃ ম্যাকনামারা আরো সুস্পষ্টভাবে বলেন, ‘নিজেদের পণ্যের রপ্তানী ও চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রাস্ফীতির কারণে উন্নয়ন সাহায্যের প্রকৃত মূল্য কমে যাওয়ার দরুণ দরিদ্র দেশগুলো গুরুতর আঘাত পেয়েছে।’
বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট মিঃ রবার্ট ম্যাকনামারা বাংলাদেশ সহ আরো কয়েকটি প্রতিবেশী দেশ সম্পর্কে সরাসরি তাঁর ভাষণে বলেছেন, উন্নয়নকামী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু আয় দু’শ’ ডলারেরও কম। এটা অত্যন্ত ‘হতাশাব্যঞ্জক’ পরিমাণ। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাবার জন্যে উল্লেখিত দেশগুলোকে চলতি দশকের অবশিষ্ট বছরগুলোতে সহজ শর্তে প্রতি বছর তিনশ’ থেকে চারশ’ ডলারেরও বেশী অতিরিক্ত সাহায্য দেওয়া প্রয়োজন। আমদানী পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির জন্যে বাংলাদেশ তার উন্নয়ন কর্মসূচী সুষ্ঠুভাবে শুরু করতে সক্ষম হচ্ছে না, আমদানীর জন্যে বাংলাদেশের প্রয়োজন সতেরো কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রার। একইভাবে ভারতের জন্যে একশত চল্লিশ কোটি ডলার প্রয়োজন। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট মিঃ ম্যাকনামারার উল্লেখিত এই ভাষণটি উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সর্বশেষ অবস্থা এ ভাষণ থেকে অনুমান করা যায়। উন্নত দেশগুলোর আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন নীতির কারণেই বিশ্বব্যাপী আজ নানা কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। যুদ্ধখাতে এবং বিশ্বরাজনীতিকে করায়ত্ত্ব করার অভিসন্ধিতে যে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে ইতিপূর্বে তার দরুণ ডলার-পাউন্ডের কর্তৃত্ব বেড়েছে সর্বত্র। উন্নত দেশগুলো তাদের স্বার্থের অনুকূলে বিশ্বের আর্থিক অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আর তার খেসারত দিতে হয় দরিদ্র দেশগুলোকে। তেলের দাম বৃদ্ধি করানোর পেছনে কতিপয় উন্নত দেশের যুদ্ধংদেহী আচরণ ও নীতিই মূলতঃ দায়ী। কোনো আপোষ ফর্মূলা বের না করে হুমকি দিয়ে যারা সমস্যার সমাধান করতে চান তারা মূলতঃ বিশ্বের দরিদ্র বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর দিকে না তাকিয়েই তা করেন। ফলে কষ্ট ভোগ করতে হয় দরিদ্র দেশকেই। বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সহ উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে যে নতুন ঋণদান মঞ্জুরীর প্রস্তাব করেছেন আমরা আশা করি ঋণদানযোগ্য উন্নত দেশসমূহ মানবতার প্রতি সশ্রদ্ধ হয়ে এ প্রস্তাবের প্রতি সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসবেন। দরিদ্রতম মানুষের আকুতির প্রতি সদয় হবেন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!