You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৫শে জুন, বুধবার, ১১ই আষাঢ়, ১৩৮১

বন্যার অশুভ পদধ্বনি

আষাঢ় মাস এসেছে বন্যার দুঃসংবাদ নিয়ে। নদীর পানি বৃদ্ধি, বিপদসীমা অতিক্রম, বাধ নষ্ট হয়ে যাওয়া, ফসল নষ্ট, গ্রামগঞ্জ ডুবে যাওয়া, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, প্রাণহানি, মহামারী ইত্যাকার খবরে প্রতিদিনের দৈনিক সংবাদপত্র গুলো ভারাক্রান্ত হয়ে থাকছে। প্রতিবছরের মতো এবারও বাধা গতে প্রবল বর্ষণ ও বন্যা শুরু হয়ে গেছে। নদীর তীরবর্তী দৃশ্য গ্রামগুলো সাময়িকভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে পানির তলায়। ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ানও প্রচুর।
গত বৃহস্পতিবার (৫ই আষাঢ়) থেকে একটানা ১৮ ঘন্টা বর্ষণের ফলে চট্টগ্রামের অধিকাংশ এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ১৮ ইঞ্চি বৃষ্টি হয়েছে। শহরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। চকবাজার, কাপাসগোলা, বদ্দারহাট, মাদার বাড়ি, ঘাট ফরহাদ বেগ, টেরিবাজার ও খাতুনগঞ্জের কোন কোন অংশ বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। আগ্রাবাদ, চকবাজার ও চাকতাই এলাকা এক ফুট পানির তলায় চলে যায়। চিরিংগা দোহাজারী কাছে মাতামুহুরী নদীর বাঁধ ভেঙ্গে টাঙ্করোডের উপর পানি উঠেছে। বলতে গেলে চকরিয়া থানা থেকে সাতকানিয়া পর্যন্ত সমগ্র এলাকায় পানি নিচে চলে যায়। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সড়ক যোগাযোগ ব্যাহত হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কপথও কোথাও কোথাও ডুবে গেছে।
এই বন্যায় রাউজান ও বেতছরি থানার সাত্তার খান বাঁধের কয়েকটি অংশে ফাটল দেখা দেয়। মিরেশ্বরাই ও সীতাকুণ্ড থানার সামুদ্রিক বাঁধেও ফাটল দেখা দিয়েছে। সেই ফাটল দিয়ে নোনাপানি জনপদের ঢুকে পড়েছে এবং পানীয় জলকে অযোগ্য করে তুলছে।
চট্টগ্রামের এই বন্যায় এ পর্যন্ত জানা খবরে ৬০ জনেরও বেশি প্রাণ হারিয়েছে। অসংখ্য কাঁচা বাড়ি ধসে গেছে। এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বন্যা কবলিত এলাকার শতকরা ৮০ ভাগ কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লক্ষ লক্ষ একর জমির ফসল পানির নিচে চলে গেছে।
সিলেট ও রংপুরের বন্যার ছোবল আঘাত হেনেছে।
সিলেটে খোয়াই, ধলাই, সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি বাড়ছে। হবিগঞ্জের খোয়াই ও মৌলভীবাজারে মনু নদীর ভাঙ্গনের ফলে ১৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত। এখানেও ৫ দিন ধরে প্রায় একটানা প্রবল বর্ষণ হয়। বন্যা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো হচ্ছে জাকিগঞ্জ, ছাতক, বিয়ানীবাজার, কুলাউড়া, হবিগঞ্জ, চুনারুঘাট, বাহুবল, মাধবপুর ও মৌলভীবাজার।
কুশিয়ারার ভাঙ্গনে রাজনগর থানার ফতেহপুর, তাজগাও, মুন্সির বাজার, মনু নদীর ভাঙ্গনে তামার চক এবং সুরমা ও ধলাই নদীর বন্যা কাটাবোনা, নাজিরাবাগ ও কমলা পুর ইউনিয়নের ঘরবাড়ি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি অবনতির দিকে। এ জেলার সবকটি প্রধান নদীর পানি এখনো বাড়ছে। হবিগঞ্জের সাথে জেলা শহরের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। শতশত গ্রাম জনপদ দোকানপাট পানিতে ভাসছে। হাজার হাজার একর জমির ফসল জলমগ্ন হয়েছে। এবং হাজার হাজার মানুষের জীবন বিপন্ন ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হয়েছে।
কুড়িগ্রামেও অতি বর্ষণের ফলে স্থানীয় নদীগুলোর অস্বাভাবিক জলস্ফীতি ঘটে। ২৫শে জুনের প্রতিবেদনও জানা যাচ্ছে সেখানে বর্ষণ চলছে এবং যেকোনো মুহূর্তে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার উপরে উঠতে পারে। এখানে বন্যা শত শত একর ধানী জমির ফসল বুকে নিয়েই পানির তলায় চলে গেছে। নদী তীরবর্তী গ্রামীণ মানুষরা বন্যার আতঙ্কে ভীত-সম্ভ্রস্ত জীবনযাপন করছে।
বন্যা কবলিত এলাকায় বন্যা পরবর্তী বিপদ স্বরূপ মহামারীতে আক্রান্ত হয়েছে। সেখানে কলেরা মহামারী আকারে প্রকাশ পেয়েছে এবং পত্রিকান্তরে প্রতিবেদন অনুযায়ী শুধুমাত্র চট্টগ্রামে প্রায় ৬০ জন লোক মারা গেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে, ওই এলাকায় প্রায় ২০০০ লোক কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত নাকি কোনো চিকিৎসা সামগ্রী সেখানে যেয়ে পৌঁছায়নি।
পত্রিকান্তরে সংবাদ মারফত জানা যাচ্ছে যে, বন্যা কবলিত এলাকায় অপর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী যাচ্ছে। সেখানে এখনো পানীয় পানির প্রচুর অভাব রয়েছে। মহামারী প্রতিরোধক ব্যবস্থা আনুপাতিক হারে খুবই কম। কম ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের ব্যবস্থাও শম্বুক গতিতে চলছে।
বন্যার খবর এদেশের নতুন নয়। বন্যা পরিস্থিতির আনুষঙ্গিক উপসর্গাদিও প্রতি বছরের আগুন্তক। জানমালের ক্ষতি, ফসল বিনষ্ট, মহামারী, ত্রাণের অবস্থা এসব আমাদের কাছে বাঁধা গতের মত হয়ে গেছে। তবু বলতে হয় এর কি কোন প্রকার প্রতিকার নেই? বন্যা আসছে ইশারা পাওয়ার সাথে সাথে জান ও মালের জন্য কিছু নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া অসম্ভব নয়। বন্যা কবলিত এলাকায় দুর্গত মানুষের প্রাণের কাজে দ্রুত তৎপরতার রাখা বা বন্যার সঙ্গীকে প্রতিরোধ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে।
আমরা জানি বন্যা পরিস্থিতি আমাদের আয়ত্বের বাইরে। তা বলে হতাশা হলে তো চলবে না। জান ও মাল সহ ফসল এবং সর্বাত্মক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণকে যথাসম্ভব কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। দেশের এই অর্থনৈতিক সংকটের দিনে ত্রাণ সামগ্রী যতটা কমানো যায় বৃহত্তর কল্যাণের ক্ষেত্রে ততই মঙ্গল জনক। কন্ট্রোল রুম আছে, সংশ্লিষ্ট দপ্তর আছে এদের মাধ্যমে প্লাবনের পূর্ব পরিস্থিতি অনুধাবন করা যায়। তখনই প্রাণের কাজ শুরু করা উচিত। অত্যন্ত পরিচিত ত্রাণসামগ্রী তথা প্রতিষেধক টিকা, ইনজেকশন, পানীয় জল সরবরাহ এবং উপকূলবর্তী এলাকার জনগণকে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেয়া বাঞ্ছনীয়। স্বাধীন দেশে বন্যার অশুভ পদধ্বনিও যে সমান মৃদঙ্গ বাজাবে-এতো প্রত্যাশিত নয়।

মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি

মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি আসবে কবে? নানা জন নানাভাবে এই প্রশ্নের জবাব খোঁজে। কারো কারো মতে হুমকি হামলা করেই সবকিছু ঠাণ্ডা রাখা যাবে, কেউ ভাবে দু’চার দেশের মধ্যে একটা সমঝোতায় আনতে পারলে সব ল্যাঠা চুকে যাবে। এ পথে বিভিন্নভাবে আগাতেও চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ। ফলোদয় হয়নি। বারবার যুদ্ধ হয়েছে আর সর্বশেষ যুদ্ধের ক্ষত পরিষ্কার করতে হিমশিম খেতে হয়েছে রাষ্ট্রনায়ক, কূটনীতিকদের।
যারা বারবার শান্তির কপোত হয়ে উড়ে উড়ে আসেন মধ্যপ্রাচ্যের রাজধানী সমূহ তারা সবাইকে আন্তরিকভাবে কামনা করেন মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আসুক? এ নিয়েও সন্দেহ সংশয় রয়েছে সারা দুনিয়া বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসকারী কয়েক কোটি মানুষের মনে। শান্তি প্রতিষ্ঠায় কার্যকরীভাবে আগানের লক্ষণ তবে দেখা যাচ্ছে না কেন?
এইতো কয়েকদিন আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার সাটল কর্কের মতো আজ এদেশ ওদেশ ঘুরে বেড়ালেন। চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো গত বৎসরে ইসরাইল অধিকৃত বিভিন্ন এলাকা থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যাপারে। এটা অবশ্য সর্বশেষ মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের ক্ষত পরিষ্কার করবার একটা প্রচেষ্টা মাত্র। কিন্তু মূল সমস্যা যেখানে ঠিক সেখানেই রয়ে গেছে।
ওদিকটায় হাত দেয়া হয় না যেন? ইসরাইলের আগ্রাসনী নীতি কার্যকরী করতে গিয়ে যাদের নিজ বাসভূমে থেকে বিতাড়িত করা হল যাদের এলাকা দখল করে নিল ইসরাইল তাঁদের সমস্যাটাকে শুধুমাত্র ‘রিফিউজি সমস্যা’ বলে চালিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা কেন? ইসরাইলের সেই অধিকৃত এলাকার জনসাধারণ তাদের আবাসভূমি মুক্তি এবং নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে সংগ্রামে ব্রত। জাতিসংঘের কোনো সেবামূলক প্রতিষ্ঠান করুণা এবং সাহায্য নয় বরং মুক্ত স্বদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য এবং সমর্থনই তাদের দরকার।
অথচ এই মুক্তিসংগ্রামীদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য সামরিক হামলা এবং ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। ইসরাইল তার মুরুব্বীদের সহায়তায় হামলা চালাচ্ছে এমনকি এই মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক সহানুভূতিসম্পন্ন রাষ্ট্রগুলোর ওপর। কদিন আগে এমনই এক হামলা তারা চালিয়েছে লেবাননে। এই হামলা তারা অব্যাহত রাখবে বলেও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী হুমকি দিয়েছেন।
এটা শান্তির পথ প্রশস্ত করবেন না। যারা মুক্তিসংগ্রামীদের বাদ দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার একটা সমাধানের আশা করেন তাদের লক্ষ্য সেখানে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা নয়। একমাত্র অধিকৃত এলাকার পুনরুদ্ধার এবং প্যালেস্টাইনি জনসাধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা লুকায়িত রয়েছে। সারাবিশ্বের শান্তিকামী মানুষের মতো এই। এ মত তারা পোষণ করে আসছেন বারবার। কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত ইসলামী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে যোগদানকারী বিভিন্ন রাষ্ট্র সেকথা পুর্নবার উল্লেখ করেছেন। যারা একটা বিস্ফোরণ ঘটায় পরপরই শান্তির কপোত এর ভেতরে সাটল কর্কের মতে রাজধানী ও রাজধানী করে বেড়ায় তারা কি এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারবেন?
আজ হোক কাল হোক প্যালেস্টাইনিরা তাদের মাতৃভূমিকে মুক্ত করবেই। হামলা, হুমকি অথবা কোন ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা এই বিজয়কে রোধ করতে পারবেনা। এই লক্ষ্যে প্যালেস্টাইনের বিভিন্ন সংগঠন পুরোপুরি ঐক্যবদ্ধ। কদিন আগে তারা তা স্বার্থহীন ভাষায় ঘোষণাও করেছেন। সে লক্ষ্য অর্জন শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র আসলেই যদি কেউ মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হন তবে তাকে অবশ্যই এ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে উপলব্ধি করতে হবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!