You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব চট্টগ্রামের সংগ্রামী ঐতিহ্য - সংগ্রামের নোটবুক
মুক্তিযুদ্ধপূর্ব চট্টগ্রামের সংগ্রামী ঐতিহ্য
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে নব্য প্রস্তর যুগের ছয়টি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটিতে দুটি অশ্মীভূত কাঠের অস্ত্র প্রাপ্তির সূত্রে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সংগ্রামী সুপ্রাচীনতা সম্পর্কে নৃতাত্ত্বিকগণ বর্তমানে নিঃসন্দেহ (রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৭৪: ৭; আবদুল হক চৌধুরী ১৯৯৪: ৫)। এমনকি চট্টগ্রামকে মহাভারতে বর্ণিত কিরাতরাজ্য এবং গ্রিক ভূগােলবিদদের বর্ণিত কিরাপীয় রাজ্যের অন্তর্গত বলে পণ্ডিতরা বিবেচনা করেছেন। মহাভারতীয় যুগে এ অঞ্চল বলির পুত্র সুহ্মের এবং পরে কর্ণের পুত্র বিকর্ণের শাসনাধীন ছিল বলেও কিংবদন্তি রয়েছে। ড. আহমদ। শরীফ একে ইতিহাসের দূরাগত ধ্বনি’ রূপে বিবেচনা করেছেন (আহমদ শরীফ ২০০১: ১১)। তবে প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে কিংবা শাসন লিপিতে চট্টগ্রামের নাম সুস্পষ্টরূপে পাওয়া না গেলেও ঐতিহাসিক যুগের সূচনায় খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের স্ট্রাবাের ভ্রমণবৃত্তান্ত এবং জল বাণিজ্য তত্ত্বের আদি গ্রন্থ রােমান ঐতিহাসিক প্লিনির Periplus of the Erythraean Sea থেকে সমুদ্রবন্দর হিসেবে চট্টগ্রামের পরিচয় জানা যায়। বিবিধ ইতিহাস সূত্রে গবেষকগণের অভিমত এই যে, খ্রিষ্টপূর্ব দুই শতক হতেই এয়মন ও ব্যাবিলনীয় অঞ্চলের (অমুসলিম) আরবগণ চীন ও ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের সহিত ব্যাবসাবাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকারী ছিল। চাটগা এভাবে দুই হাজার বছরের অধিক কাল পর্যন্ত এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বন্দররূপে পরিগণিত ছিল এবং পশ্চিমে আরব, আবিসিনিয়া, এয়মন, আশিরিয়া, গ্রীস ও রােম এবং পূর্বে চীনের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালনা করত (আবদুল হক চৌধুরী ১৯৯৪: ৩০)। সমুদ্র উপকূলের বিখ্যাত বন্দর, পর্তুগিজ ভাষায় ‘Porte grando’ বা ‘বড় বন্দর হিসেবে এবং নৌযান প্রস্তুত, বিশেষ করে বাণিজ্য ও রণতরি নির্মাণ প্রযুক্তির। সহজলভ্যতা ও উৎকর্ষের কারণে চট্টগ্রাম প্রাচীন শক্তিশালী দেশ ও জাতিসমূহের নিকট Gateway of the east (আজাদী ১৯৯৫: ৮৬) এবং কালক্রমে Gateway to Bengal (Qanungo 1988: xi) নামে সুপরিচিত হয়। সুতরাং প্রাচ্যের বা বাংলার প্রবেশদ্বার হিসেবে চট্টগ্রামে কালান্তরে বিভিন্ন জাতি, সভ্যতা ও সংস্কৃতির স্পর্শ প্রবাহ ছিল অবারিত। একই সঙ্গে বিদেশি যােদ্ধজাতির   রক্তের মিশ্রণও ঘটেছে অজস্র।
খ্রিষ্টপূর্ব আর্যীকরণের প্রবল প্রভাব থেকেও চট্টগ্রাম বিমুক্ত থাকে নি। কানুনগাে এ প্রভাবের অপ্রতিরােধ্য বিস্তারকে খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে এতদঞ্চলে বুদ্ধবাদ ও পালি ভাষা প্রবর্তনের সময়ের সমান্তরাল বলে উল্লেখ করেছেন (Ibid: 42 )। প্রকৃতপক্ষে, সমুদ্রমেখলা এবং পাহাড়-পর্বত বেষ্টিত চট্টগ্রামের বন্দও সুবিধা, বাণিজ্য প্রসার, প্রাকৃতিক অঢেল সম্পদ, রণকৌশলগত ভৌগােলিক অবস্থান, এমনকি তকালীন নৌ প্রযুক্তির উল্কর্ষ ইত্যাদির কারণে প্রাচীন শক্তিশালী সামরিক জাতিসমূহের নিকট এ অঞ্চল সব সময়েই আকর্ষণীয় ছিল। ড. কানুনগাে এ অবস্থার ফলাফল বিশ্লেষণ করেছেন এভাবে, Chittagong became a meeting ground of conflicting races, religions and nationalities (Ibid: xii)। এ বিষয়ে তিনি আরাে বলেছেন, Besides her stiategic position, the abundance of resources, excellent facilities of ports and harbours and similar other factors made the district an invaluable one, for the possession of which the powers both foreign and of the subcontinent shed blood through the ages (Ibid: 30) ফলে এ অঞ্চলের জনজীবন, সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই যে সার্বক্ষণিক সাংঘর্ষিক অবস্থা বিরাজ করত তা সহজেই অনুমেয়। সে কারণে এই তথ্য অস্বীকার করা যাবে না যে, চট্টগ্রাম সবসময়েই ছিলাে ‘Battleground of the neighbouring ambitious monarch’ (Ibid: xi)। প্লেটোর আদর্শ ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রমাত্রেই আক্রমণােদ্যত রাষ্ট্র পরিবেষ্টিত এবং সেজন্য সে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই রাষ্ট্রনীতির তত্ত্বটি এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযােগ্য (প্লেটো ১৯৭৬ ১০২-৩)। এই তথ্য-উপাত্তের সাদামাটা অর্থ এই যে, চট্টগ্রামবাসীকে যাবজ্জীবন কোন না কোনােভাবে যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে কাটাতে এবং যােগ্যতমেরই কেবল অভিষেক- এই ডারউইন তত্ত্বকে প্রণিধান করে নিয়ত সংগ্রামশীল থাকতে হয়েছে।
সাহসিকতা ও সংগ্রামশীলতা
 
পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বিবৃত এ এলাকার ভৌগােলিক-প্রাকৃতিক অবস্থা এবং প্রভাব এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার্য। এ কথা সবারই জানা যে পাহাড়-পর্বত, নদী, খাল, সমুদ্র, উপত্যকা, অরণ্য প্রভৃতি নৈসর্গিক বৈশিষ্ট্যের মিশেলে এ অঞ্চল সমতল ভূমি থেকে এক ভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক পরিবেশে সংস্থাপিত। তাই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই যােগ্যতমের প্রতিভূ হিসেবে জীবনের উপাদান আহরণেও আলােচ্য ভূপ্রাকৃতিক এবং জলবায়ুগত কারণে এ অঞ্চলের মানুষকে অবিরত লড়াকু অবস্থায় দিনাতিপাত করতে হয়েছে। উর্মিমুখর উত্তাল সুগভীর সমুদ্র থেকে সে উপাদানের সন্ধান, সংগ্রহ ও সঞ্চয়ে অসমসাহস ও সংগ্রামের পরিচয় প্রদান করতে হয়েছে। চট্টগ্রামের নাবিকরা ইতিহাসে তাদের সাহসিকতা এবং দক্ষতার জন্য সুবিদিত। সুউচ্চ পাহাড় ও শ্বাপদসংকুল পরিবেশে চট্টগ্রামের অরণ্যবাসীকে কঠোর শ্রম, ধৈর্য এবং সাহসিকতার সাথে বাঁচতে হয়েছে। উপকূলের বাসিন্দাদের প্রতিনিয়ত সামুদ্রিক ঝড়-ঝঞা, লােনা পানির জলােচ্ছাস ও অতিবর্ষণ জনিত প্লাবনের মােকাবিলা করে জীবনযাপনের ইতিহাস আবহমানকালের। অনিবার্যভাবেই চট্টগ্রামবাসীর বিদ্যমান চারিত্র বৈশিষ্ট্যের নেপথ্যে এসব কারণ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। সুতরাং এ কথা নিঃসংশয়ে বলা যায় যে সাহসিকতা ও সংগ্রামশীলতা এই অঞ্চলবাসীর সুপ্রাচীন ঐতিহ্যিক সত্তা। সে পরিচয় কালান্তরের ইতিবৃত্তে বিধৃত। চট্টগ্রাম নামের ব্যুৎপত্তিগত অর্থেও সংগ্রামী পরিচয় চট্টগ্রাম নামের ব্যুৎপত্তিগত অর্থও আলােচ্য সাহসিক যুধ্যমান বৈশিষ্ট্য ও ইতিহাসের পরিচায়ক। অবশ্য সুপ্রাচীন কাল থেকে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন পরিব্রাজক, ভূগােলবিদ এবং পণ্ডিতগণের লিখিত বিবরণে, প্রণীত মানচিত্রে, শাসন লিপি এবং মুদ্রায় চট্টগ্রাম বিবিধ নামে অভিহিত হয়েছে; যেমন: জলন্দর, সামন্দর, চৈত্যগ্রাম, চাটিগ্রাম, শ্যাগাঙ, সুদকাওন, কর্ণবুল, চট্টল, ইসলামাবাদ ইত্যাদি। এসব নাম প্রধানত এ এলাকার ভূ-প্রাকৃতিক গঠন, অভিবাসন প্রক্রিয়া, বিজয়, রাজনৈতিক বা কিংবদন্তিকে কেন্দ্র করেই সৃষ্ট, প্রদত্ত, বর্ণিত ও প্রচলিত এবং অর্থব্যবস্থা নিরূপিত। সামপ্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, চট্টগ্রাম নামের নেপথ্যেও সামরিক ইতিহাস নিহিত। আরাকানি শব্দ ‘চইট্টেগং’ বা ‘চইট্রেকুং’ থেকেই চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি বলে এই অন্বেষণের সিদ্ধান্ত (আবদুল হক চৌধুরী ১৯৯৫: ৮৩)।
 
তিনি দেখিয়েছেন, আরাকানি ভাষায় ‘চইট্টে’ অর্থ সেনানিবাস বা দুর্গ। আর ‘গং’ অর্থ শক্তিশালী, দুর্ভেদ্য, শ্রেষ্ঠ, সর্বোত্তম, প্রধান, শীর্ষস্থানীয় এগুলাের মধ্যে যে-কোনাে একটি। চইট্টে’ আর ‘গং’-এর মিলনে এই ‘চইট্টেগং’ শব্দটি সৃষ্ট এবং এর অর্থ শক্তিশালী, দুর্ভেদ্য ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক সেনানিবাস। তেমনি ‘চইট্টেকুং’ শব্দটিও সমার্থক এবং এ এলাকার ভূতাত্ত্বিক গঠনশৈলীর সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। এখানে ‘কুং’ অর্থ পাহাড়চূড়া। চইট্রেকুং’ মানে পাহাড়চূড়ার সেনানিবাস। এই অঞ্চলের বহমান ইতিহাসের কথা মনে রাখলে চট্টগ্রামের নামের এই নতুন অর্থ-উৎস অধিকতর গ্রহণযােগ্য। শুধু তাই নয়, ইতিহাসের পাতাতেও চট্টগ্রাম কর্ণফুলি নদীতীরে পাহাড় সারি বেষ্টিত এক দুর্ভেদ্য দুর্গের কথা বিধৃত। সেটিই বর্তমানের ‘আন্দরকিল্লা’। ১৬৬৫ সালে মােগল অভিযানে অংশগ্রহণকারী ঐতিহাসিক শিহাবুদ্দিন তালিশ তার ফতিয়াহ-ই-ইব্রিয়া গ্রন্থে আরাকানিদের দুর্ভেদ্য ও শক্তিশালী চাটিগাঁ দুর্গের বিবরণ লিপিবদ্ধ এবং সুরক্ষিত দুর্গ হিসেবে এটাকে মহাবীর আলেকজান্ডারের দুর্গের সাথে তুলনা করেছেন। আবার এটাও ইতিবৃত্ত যে, মােগলদের তিন বারের আক্রমণ  প্রচেষ্টার পরই কেবল চাটগাঁ দুর্গ অধিকৃত হয়েছিল এবং এর নবতর নাম প্রদত্ত হয়েছিল ‘আন্দরকিল্লা’ (পূর্ণচন্দ্র চৌধুরী ১৯২০:১৩)। পর্বত ও সমুদ্র বেষ্টিত এ অঞ্চল একটি প্রাচীন ভূখণ্ড এবং এর সঙ্গে আরাকানের সম্পর্কও সুপ্রাচীন। গবেষকরাও সুনিশ্চিত, প্রকৃতপক্ষে আরাকান ও চট্টগ্রাম একই ভূখণ্ড।
একটি সুপ্রতিষ্ঠিত রাজশক্তি হিসেবে পুরাকালেই আরাকান চট্টগ্রামে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করে এবং সভ্যতা-সংস্কৃতি-সাহিত্যের ক্রমবিকাশের মাধ্যমে প্রভূত প্রভাব বিস্তার ঘটায় (আহমদ শরীফ ২০০১:২০-২১)। এখানকার জনজীবনের সঙ্গে আরাকানিদের সুগভীর সংশ্লিষ্টতা এবং সকল পর্যায়ে আরাকানি ভাষা-সংস্কৃতির অনিবার্য প্রভাব অনস্বীকার্য। সে পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের নামের উৎস মূলে আলােচ্য সামরিকত্ব, সংগ্রাম শীলতা তথা সাহসী জীবনের ইতিবৃত্ত নিহিত। ইতিহাস এই সাক্ষ্য দেয়, আরাকান আমলে উত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে স্বীয় সামরিক প্রতিরক্ষার প্রয়ােজনে মাটির দুর্গ ‘কোট’ এবং কাঠের দুর্গ ‘কাঠগড়’ নির্মিত হয়েছিল। এসব দুর্গ প্রধানত নির্মিত হতাে শত্রুপক্ষের সম্ভাব্য অভিযান পথের ওপর, বিশেষত নদী বা সমুদ্রতীর সন্নিহিত এলাকায় (আবদুল হক চৌধুরী ১৯৯৫: ১০৬)। মনে রাখা প্রয়ােজন, চট্টগ্রামের ভূ-প্রাকৃতিক গঠনবৈশিষ্ট্যের জন্যে এ অঞ্চল সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে অদ্যাবধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম-আরাকান রাজ্য স্থাপিত আরাকানের প্রাচীন ইতিহাস রাজোয়াং-এর বর্ণনানুযায়ী খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি চন্দ্রসূর্য নামের এক মগধ সামন্ত কর্তৃক চট্টগ্রাম-আরাকান সমন্বিত প্রাচীন ভূভাগে রাজ্য স্থাপিত হয়।
 
তখনকার আদিম জনগােষ্ঠীর মধ্যে এই রাজ্য স্থাপনের মাধ্যমে আর্য ধর্ম, ভাষা, লিপি ও সংস্কৃতির দীক্ষা ও শিক্ষার বিস্তার ঘটে। চন্দ্রসূর্য বংশের কয়েক শতাব্দীর শাসনের পর পালাক্রমে সমতট, পাল, হরিকেল, পাট্টিক, ত্রিপুরা, পগা, পারিম প্রমুখ রাজবংশ এবং আরাকান রাজা কর্তৃক অধিকৃত হয় (আবদুল হক চৌধুরী ১৯৯৪: ৫-৭)। চতুর্দশ শতক থেকে এ অঞ্চল মুসলমান। অধিকারভুক্ত হয়। সুলতানি, আফগানি, মােগল, নবাবি ইত্যাদি আমলে দীর্ঘকাল ধরে চট্টগ্রামকে মুসলমান শাসন, সমর ও প্রভাব বলয়ে কাটাতে হয়েছে। সেই সাথে বিভিন্ন সময়ে আরাকানিদের সাথে অব্যাহত ক্ষমতার লড়াইও বিদ্যমান ছিল। পাশাপাশি ছিল মগ, পর্তুগিজ প্রমুখ জলদস্যু-তস্করদের সশস্ত্র তৎপরতা। সমগ্র মােগল আমলে ইউরােপীয়রা চট্টগ্রামে বাণিজ্য কুঠি স্থাপনে নিষ্ফল সামরিক প্রয়াস পরিচালনা করে। কারণ, চট্টগ্রামের সুপ্রাচীন বন্দর ও পােতাশ্রয় ইংরেজদের কাছে বিশেষ প্রয়ােজনীয় ছিল। কিন্তু মােগল সুবেদার ও চট্টগ্রামস্থ তার ফৌজদারদের চেষ্টায় ইংরেজদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত আঠারাে শতকে এসে ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থানের মতাে চট্টগ্রামকেও ইংরেজদের অধিকারে যেতে হয়। এসব যুদ্ধবিগ্রহনির্ভর শাসনামলে এতদঞ্চলের মানুষকে বিচিত্র উত্থান-পতনের, জয়-পরাজয়ের, সুশাসন-দুঃশাসনের মধ্যে প্রাকৃতিক বৈরিতাকে মােকাবিলার পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার জন্যেও সেই প্রাচীনকাল থেকেই সংগ্রামশীল থাকতে হয়েছে। চাকমা বিদ্রোহ ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন আমলে শােষণ, অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে।
সর্বভারতীয় জনসাধারণের মতাে বৃহত্তর চট্টগ্রামের মানুষও ক্রমে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তার প্রথম প্রকাশ ঘটে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের প্রতিরােধে। মােগল আমলে চাকমারা প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন জীবনযাপন করত। মুদ্রা বিনিময় প্রথা চালু না থাকায় চাকমা রাজারা সে আমলে কার্পাস তুলা দিয়ে কর আদায় করত। ইংরেজ আগমণের পর প্রথম দিকে এই পদ্ধতিতেই রাজস্ব পরিশােধ করা হতাে। কিন্তু শীঘই কার্পাসমহল নামে পরিচিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে ইংরেজরা ফড়িয়াদের নিকট ইজারা দিতে শুরু করে। আর ইজারাদাররা বিভিন্ন কৌশলে সরল প্রকৃতির পার্বত্য অধিবাসীদের ঠকিয়ে আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে রাজস্বের পরিমাণের চাইতে বেশি। তুলা আদায় করত। ফলে দ্রব্য বিনিময় প্রথার সুবাদে তারা দৃশ্যত অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে থাকে। এদিকে ১৭৬১ সাল থেকে ইংরেজ কোম্পানি ক্রমেই রাজস্বের হার বাড়াতে থাকে। এভাবে দু-মুখাে শোষণে অতিষ্ঠ হয়ে আদিবাসী ও চাকমারা বিদ্রোহী হয়ে। ওঠে। ১৭৭৬ সালের মধ্যভাগে তারা প্রথম বার বিদ্রোহ করে। এই বিদ্রোহের নায়ক ছিলেন চাকমা রাজা শের দৌলত এবং তাঁর সেনাপতি রামু খা। তারা। চাকমাদের সংঘবদ্ধ করে ইজারাদারি ও ইংরেজ শাসন অবসানের জন্যে প্রস্তুতি নিয়ে এ লক্ষ্যে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করেন। এতে ইজারাদাররা পার্বত্য এলাকা থেকে পালিয়ে যায়। ইংরেজ শাসকরা ইজারাদারদের সাহায্য করার জন্যে সেনাবাহিনীর একটি দল প্রেরণ করে। আগ্নেয়াস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রচলিত তিরধনুক-বর্শা। দিয়ে সংঘটিত অসম যুদ্ধের পরিণাম বিবেচনা করে বিদ্রোহী চাকমারা গভীর অরণ্যে পালিয়ে যায়। প্রতিপক্ষের দেখা না পেয়ে ইংরেজ বাহিনী সমতলে ফিরে এলে চাকমারা সুযােগমতাে ইজারাদারদের ঘাঁটি আর ব্যাপারীদের দোকানপাট আক্রমণ করত। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে যতদিন ইজারাদার প্রথা প্রচলিত ছিল। ততদিন চাকমা জাতি বারংবার বিদ্রোহ করেছে। লড়াই করে গেছে গেরিলা পদ্ধতিতে। চাকমা বিদ্রোহীদের ফাঁদে আটকা পড়ে অগণিত ইংরেজ ও অন্য সরকারি সৈন্যকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। সম্মুখ বা অস্ত্র শক্তির জোরে চাকমা বিদ্রোহীদের পরাস্ত করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ইংরেজরা গড়ে তােলে কঠিন। অর্থনৈতিক অবরােধ। এর ফলে চাকমাদের বশ্যতা স্বীকার করে নিতে হয়। তবে এজন্য ইংরেজদের ইৎরা প্রথা ও কার্পাস কর ব্যবস্থা তুলে পরিমিত জমা ধার্য এবং চাকমাদের অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করতে হয়।
 
সিপাহি বিদ্রোহ
 
উনিশ শতকে ভারতবর্ষে প্রভূত শক্তিশালী ইংরেজ শাসনের ভিত্তিভূমিকে প্রায় অস্থিতিশীল করে দিয়েছিল ঐতিহাসিক সিপাহি বিদ্রোহ। সেই বিদ্রোহের ঢেউ চট্টগ্রামে অবস্থিত ৩৪ নম্বর নেটিভ ইনফেন্ট্রির ২, ৩ ও ৪ নম্বর কোম্পানির সিপাহিদের মাঝেও এসে লাগে। ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ ব্যারাকপুরে মঙ্গল পাণ্ডের নেতৃত্বে ৩৪ নম্বর নেটিভ ইনফেন্ট্রি প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করে। তার প্রভাব যাতে এখানকার কোম্পানির সিপাহিদের মাঝে বিস্তৃত না হয় এজন্য প্রাত্যহিক কুচকাওয়াজের সময় এ বিষয়ে এবং এর পরিণতি সম্পর্কে সকলকে অবহিত ও সতর্ক করা হতাে। সিপাহিরাও এ ব্যাপারে কৌশলের আশ্রয় নিয়ে প্রকাশ্যে বারাকপুরের ঘটনার নিন্দা ও সরকারের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করেন। তবে তারা সময়-সুযােগমতাে বিদ্রোহ করার জন্য অপেক্ষায় থাকেন। ১৮৫৭ সালের ১৮ নভেম্বর, চট্টগ্রামে দেশীয় পদাতিক কোম্পানির সিপাহিরা শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহ করেন। সরকারি কোনাে নথিপত্রে বা অন্য কোনাে তথ্যসূত্রে পাওয়া না গেলেও এটি বহুল কথিত যে রজব আলী নামে দেশীয় পদাতিক কোম্পানির এক হাবিলদার এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়। বিদ্রোহের আগের দিন সিপাহিরা এক ভােজসভায় মিলিত হয়ে বিদ্রোহের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন বলে জানা যায়। সে রাতে বিদ্রোহী সিপাহিরা দলে দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন রাস্তায় অবস্থান নেয় এবং টহল দিতে থাকেন। তারা ট্রেজারি থেকে অর্থ, অলংকারসহ বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী লুণ্ঠন করে নেয়। জেলখানা ভেঙে কয়েদিদের মুক্ত করে এবং অস্ত্রাগারে আগুন লাগিয়ে দেয়। তারপর মির্জাপুর, পিলখানা থেকে তিনটি হাতি নিয়ে সিপাহিরা কয়েদিদের বহরসহ সিলেটের দিকে চলে যায় (শচীন্দ্রনাথ গুহ ১৯৭৬: ৩২০)।
 
সরকারি নথিপত্র সূত্রে জানা যায়, ত্রিপুরা ও সিলেট হয়ে নেপাল যাবার জন্যে বিদ্রোহী সিপাহিরা সীতাকুণ্ড-ফটিকছড়ি-রামগড় হয়ে ফেনি নদী অতিক্রম করেছিলেন। তবে এক ইংরেজ ঐতিহাসিকের মতে তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল ঢাকায় অবস্থানরত ৭৩ নম্বর দেশীয় পদাতিক বাহিনীর সাথে যােগ দেওয়া (আজাদী ১৯৯৫: ৩১)। চট্টগ্রামের বিদ্রোহী সিপাহিদের ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়ার সংবাদের প্রতিক্রিয়ায় ঢাকার কোম্পানি কর্তৃপক্ষ আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ঢাকার কোষাগার ও লালবাগে অবস্থানরত দেশি সিপাহিদের নিরস্ত্র করার সিদ্ধান্ত নেয়। কুমিল্লা হয়ে বিদ্রোহীদের ঢাকা আসার সম্ভাবনার কথা মনে রেখে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ তাদেরকে প্রতিরােধকল্পে নারায়ণগঞ্জ অভিমুখে সশস্ত্র সৈন্যদল প্রেরণ করে। দাউদকান্দিতে মােতায়েন করে নৌবাহিনী। কুমিল্লার সরকারি কোষাগারের অর্থ সংরক্ষণে সমুদয় অর্থ ঢাকায় প্রেরণ করে। ইতােমধ্যে ঢাকার বিদ্রোহীদের ইংরেজ সরকার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিলে চট্টগ্রামের বিদ্রোহীরা গতিপথ পরিবর্তন করে উদয়পুর হয়ে ত্রিপুরার আগরতলার দিকে যাত্রা করেন। ইংরেজ কর্তৃপক্ষের অনুরােধে ত্রিপুরার রাজা তাঁদের গতিরােধ এবং কুমিল্লার দিকে বিতাড়িত করে। সেখানেও বিপত্তির সম্মুখীন হলে তারা মণিপুরের দিকে রওনা দেয়। পথিমধ্যে ইংরেজ বাহিনীর সাথে তাদের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে বিদ্রোহী সিপাহিরা শেষ পর্যন্ত ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। এভাবেই ১৮৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে এই সাড়া জাগানাে বিদ্রোহের সমাপ্তি ঘটে। তবে ভারতবর্ষব্যাপী সংঘটিত এই বিদ্রোহের ইতিবৃত্তে চট্টগ্রামের বিদ্রোহ গৌরবােজ্জ্বল এক ব্যতিক্রম ঘটনা। এ প্রসঙ্গে নিমােক্ত তথ্য প্রণিধানযােগ্য উপমহাদেশের এই প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় দেখা যায় যে, সর্বত্র দেশীয় স্থানীয় ভূস্বামী এবং সুবিধা প্রাপ্ত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে সহযােগিতা করেছে। কোম্পানির দুর্দিনে অর্থ, অস্ত্র এমনকি হাতিঘােড়া পর্যন্ত দিয়ে সিপাহিদের দমন করতে সাহায্য করেছে। কিন্তু চট্টগ্রামের তত্বকালীন ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষ থেকে কোম্পানি কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানাে এক চিঠি থেকে জানা যায়, চট্টগ্রামে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কোনাে রাজানুরাগী ব্যক্তির কাছ । থেকে তিনি তেমন সাহায্য-সহযােগিতা পান নি (আজাদী ১৯৯৫: ৩২)। বিদ্রোহ-বিপ্লবের সূতিকাগার চট্টগ্রামের এই ভূমিকা ব্রিটিশ বিরােধী সকল আন্দোলনের সময় বিদ্যমান ছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালেও চট্টগ্রামের এই ভূমিকার কোনাে ব্যত্যয় ঘটে নি। পাকিস্তানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরােধ রচিত হয়েছিল এখানেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণাও দেশ এবং বিশ্ববাসী শুনেছিল এখান থেকেই।
 
আন্দোলনে চট্টগ্রামবাসী
 
উনিশ শতকের শেষ বছরগুলােতে ভারতের সর্বত্র ইংরেজ সরকারের দমনপীড়নমূলক অপশাসনের বিরুদ্ধে ক্রমেই প্রবল আন্দোলন গড়ে ওঠে। সেসময়। চট্টগ্রামবাসীরাও এতে সম্পৃক্ত হয়। এই সম্পৃক্তির নেপথ্যে চট্টগ্রাম অ্যাসােসিয়েশনের ভূমিকা ও অবদান অসামান্য। ইংরেজ শাসকগােষ্ঠী চট্টগ্রামকে ১৮৯২ ও ১৮৯৬ সালে পর পর দুবার বঙ্গদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করে। চট্টগ্রামবাসীরা এ চেষ্টাকে অপচেষ্টা হিসেবে গণ্য করে এবং এর বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সে সময় চট্টগ্রাম অ্যাসােসিয়েশনের অব্যাহত তীব্র সাংগঠনিক তৎপরতার ফলে সৃষ্ট বিপুল জনমত ইংরেজদের পদক্ষেপকে প্রতিহত করে। উল্লেখ্য, পরবর্তীতে বাংলাদেশের বিখ্যাত স্বদেশী আন্দোলনের প্রায় এক যুগ আগেই চট্টগ্রামে এরকম আন্দোলন শুরু হয়েছিল। চট্টগ্রামের নলিনীকান্ত সেন ও তার বন্ধুবান্ধবগণ অভিন্ন উদ্দেশ্যে গঠন করেছিলেন জাতীয় শিল্প-রক্ষিণী সমিতি। তাদেরই সাংগঠনিক উদ্যোগ ও একান্ত প্রচেষ্টার ফলে ১৮৯৫-৯৬ সালেই চট্টগ্রামে স্বদেশী বস্ত্রের কদর ও চাহিদা প্রভূত পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছিল । বিশ শতকের প্রথম ভাগে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত সংগঠিত স্বাধিকার আন্দোলনগুলাের সময়ও চট্টগ্রামবাসীর ভূমিকা ছিল প্রতিবাদ, প্রতিরােধ এবং সংগ্রামের।
১৯০১ সালে চট্টগ্রামকে আবার বঙ্গদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে আসামের সাথে যুক্ত করার সরকারি প্রস্তাব ওঠে। এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে আবারও চট্টগ্রামবাসী প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। দশ বছরের মধ্যে তৃতীয় বারের মতাে সরকারি এই প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট আন্দোলনে চট্টগ্রামবাসীর সাথে এবার সম্পৃক্ত হয় ননায়াখালী, কুমিল্লা ও ত্রিপুরার অধিবাসীরাও। বছরের শেষ দিকে ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ, ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন পরিচালনার লক্ষ্যে গঠিত হয় চট্টগ্রাম বিভাগীয় সম্মিলন’ নামে একটা রাজনৈতিক সংস্থার। চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক প্যারেড মাঠে ১৯০২ সালের ২৯ ও ৩০ মার্চ বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয় উক্ত সংস্থার দুদিনব্যাপী প্রথম বার্ষিক সভা। সভাপতিত্ব করেন যাত্রামােহন সেন। চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করার অপচেষ্টা তখন পর্যন্ত স্তিমিত হয় নি। এ প্রসঙ্গে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় সরাসরি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল এবং তা করেছিলেন সভার চট্টগ্রাম বিভাগের প্রতিনিধি খানবাহাদুর সিরাজুল ইসলাম খান। এমন পরিস্থিতিতে ১৯০৩ সালের ১৩ ও ১৪ মার্চ কুমিল্লা টাউন হলের পাশের মাঠে দ্বিতীয় চট্টগ্রাম বিভাগীয় সম্মিলন অনুষ্ঠিত হয়। সভায় চট্টগ্রাম বিভাগকে আসামের অন্তর্ভুক্ত না করার জন্যে আহ্বান জানিয়ে ১১ দফা প্রস্তাব গৃহীত হয়। সে বছরের সেপটেম্বর মাসে এ ধরনের সরকারি প্রচেষ্টা ও পরিকল্পনার প্রতিবাদে চট্টগ্রামের প্যারেড ময়দানে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯০৩ সালে ভারত সরকারের হােম সেক্রেটারির এক মন্তব্য থেকে বঙ্গভঙ্গের চূড়ান্ত সরকারি সিদ্ধান্তের কথা প্রকাশ পেলে বিচ্ছিন্নতার আশঙ্কায় চট্টগ্রামের অধিবাসীরা আবারও প্রচণ্ডভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
 
১৯০৪ সালের ১৭ জানুয়ারি চট্টগ্রামের সর্বস্তরের জনগণ আবারও প্যারেড ময়দানে প্রতিবাদ সভায় মিলিত হয়। বঙ্গভঙ্গ ও চট্টগ্রামকে আসামের সাথে অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে আয়ােজিত এই প্রতিবাদ সভায় উপস্থিতি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, সামুদ্রিক জোয়ারতুল্য এবং তেজোদীপ্ত উদ্দীপনাপূর্ণ। ফেব্রুয়ারি মাসে চট্টগ্রামের হিন্দু-মুসলিম নেতৃবৃন্দ এ বিষয়ে প্রতিবাদ সংবলিত স্মারকলিপি চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারের নিকট প্রদান করেন। কলকাতায় সরকারের দ্বিতীয়। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকেও এই স্মারকলিপির অনুলিপি প্রদান করা হয়। চট্টগ্রাম। অ্যাসােসিয়েশনও এর বিরুদ্ধে লর্ড কার্জনের কাছে টেলিগ্রাম পাঠায়। স্বদেশী, অসহযােগ ও খেলাফত আন্দোলন স্বদেশী আন্দোলনের প্রায় একযুগ আগে থেকেই চট্টগ্রামবাসী সমশ্রেণির আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিল এ তথ্য পূর্বের অনুচ্ছেদেই বলা হয়েছে। স্বদেশী আন্দোলন শুরু হলে এই সম্পৃক্তি আরও গভীর হয়ে ওঠে। ১৯০৫ সালে রাউজানের কোয়েপাড়ার যামিনী সেন চট্টল হিতসাধিনী সভা’ নামে একটা সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। এতে জড়িত ছিলেন কবি শশাঙ্কমােহন সেন, কাজেম আলী, মাস্টার, মহিমচন্দ্র দাশ, বিপিনবিহারী চৌধুরী প্রমুখ। এ সভার সদস্যরাই ছিলেন চট্টগ্রামে বঙ্গভঙ্গ বিরােধিতা ও ব্রিটিশ পণ্য বর্জন আন্দোলনের মূল উদ্যোক্তা। কাজেম আলী মাস্টার, মহিমচন্দ্র দাশ, বিপিনবিহারী চৌধুরী যথাক্রমে কাজেম আলী স্কুল, কলেজিয়েট স্কুল এবং খাস্তগির বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ত্যাগ করে স্বদেশী আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেন। এ আন্দোলনের সময়েই চট্টগ্রামের দেশপ্রেমিক উৎসাহী যুবকদের সঙ্গে কলকাতার বিপ্লবীদের যােগাযােগ ঘটে। ক্রমে সে যােগাযােগ ঘনিষ্টতায় পর্যবসিত হয়। প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে ব্রিটিশ সরকার শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর উপলক্ষ্যে সমগ্র ভারতে উৎসবের আয়ােজন করেছিল। চট্টগ্রামবাসীদের নেতৃবৃন্দ সেই বিজয়ােৎসব বর্জনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে উৎসবের দিন জেলখানায় সরবরাহকৃত উন্নতমানের খাবার কয়েদিরা স্পর্শও করে নি। দরিদ্ররাও সরকার প্রদত্ত বিনামূল্যের চাল, কাপড়চোপড় ইত্যাদি গ্রহণ করে নি। বিদ্যুৎ শ্রমিকদের অসহযােগিতায় উৎসব উপলক্ষ্যে পরিকল্পিত আলােকসজ্জার আয়ােজন ব্যর্থ হয়। এই শান্তিচুক্তি বর্জন আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামবাসীর বিদ্রোহেরই বহিঃপ্রকাশ। অসহযােগ আন্দোলনের সময়েও চট্টগ্রাম পালন করেছিল স্বীয় বিপ্লবাত্মক ভূমিকা। এ আন্দোলনে প্রথম চট্টগ্রাম মুসলিম হাই স্কুলের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে।
 
তারপর অন্যান্য স্কুল কলেজের ছাত্ররা ধর্মঘট পালন করে। এ সময় তারা রাজপথে সরব মিছিল করে। জে এম সেন হলে ধর্মঘটরত ছাত্র এবং জনতার এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভার সভাপতি ছিলেন মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী। হলের কাছে স্থাপিত হয় জাতীয়তাবাদীদের প্রতিষ্ঠান ‘স্বরাজ সংঘ’। অন্যদিকে ঘাটফরহাদবেগে কমল সেনের বাড়িতে স্থাপিত হয় জেলা খেলাফত কমিটির অফিস। চট্টগ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান বলে অসহযােগ আন্দোলনের পাশাপাশি সমকালের খেলাফত আন্দোলনের দিকেও চট্টগ্রামবাসী সমানভাবে আকৃষ্ট হয় এবং ব্যাপকভাবে এতে জড়িয়ে পড়ে। এজন্যে হাজার হাজার আন্দোলনকারী কারাবরণেও পিছপা হয় নি। একই সময়ে গড়ে ওঠে ‘মুসলিম ন্যাশনালিস্ট পার্টি’। ইতিহাস সূত্রে এটিই চট্টগ্রামে মুসলমানদের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন বলে। স্বীকৃত। | মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী এবং সৈয়দ আবদুস সুলতান এই সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন। ১৯২১ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ভাষণ প্রদানকালীন সভার মধ্যেই চট্টগ্রাম কলেজের উপাধ্যক্ষসহ পিয়ন সারদা দে চাকুরি ছেড়ে অসহযােগ আন্দোলনে যােগ দেন। দেশবন্ধু এই গরিব অথচ গভীর দেশপ্রেমে উদবুদ্ধ ব্যক্তিটিকে পরম শ্রদ্ধাভরে আলিঙ্গনাবদ্ধ করেন। তারপর থেকে চট্টগ্রাম জেলায়। ইংরেজ বিরােধিতা, বিপ্লবী কর্মকাণ্ড এবং স্বাধীনতা আন্দোলন এক নতুনমাত্রা লাভ করে। সে বছর আরেক সভায় গােপন বিপ্লবী দলের সভাপতি হলেন সূর্য সেন। আর সহ সভাপতি ছিলেন অম্বিকা চক্রবর্তী। মাস্টারদা সূর্য সেন বিপ্লবী দলটির। অনেক সদস্যসহ যােগ দেন অসহযােগ আন্দোলনে। রেল ধর্মঘট ১৯২০-২১ সালে চট্টগ্রামের রেল ধর্মঘট সে সময়কার রাজনীতিতে ব্যাপক আলােড়ন সৃষ্টি করেছিল।
সে ঘটনার পূর্ব সূত্র এরকম: আসাম ও সিলেট অঞ্চলে। ইউরােপীয় মালিকানাধীন চা-বাগানগুলাের শ্রমিকরা অসহযােগ আন্দোলনে যােগ । দিয়ে নিজ নিজ এলাকার দিকে রওনা দেয়। এ ব্যাপারে ক্ষুব্ধ মালিকদের স্বার্থে। রেল কর্তৃপক্ষ ওই শ্রমিকদের কাছে টিকেট বিক্রি বন্ধ করে দেয়। কিন্তু শ্রমিকেরা। এতে বিন্দুমাত্র না দমে হেঁটে চাঁদপুর পৌছে। আবার সেখান থেকেও স্টিমারে করে তাদেরকে গন্তব্যে যেতে বাধা দেওয়া হয়। স্থানীয় রেল স্টেশনে সমবেত শ্রমিকদের এক পর্যায়ে স্টেশন ত্যাগ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। অসহায় ও বিক্ষুব্ধ। শ্রমিকরা সে নির্দেশ অমান্য করলে তাদের ওপর গুলি চালানাে হয়। এ মর্মান্তিক ঘটনা ইতিহাসে ‘চাদপুরের কুলিনিগ্রহ’ নামে পরিচিত। চাঁদপুরের এ ঘটনায় আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের চট্টগ্রাম থেকে চাদপুর পর্যন্ত লাইনে এক স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ ধর্মঘট পালিত হয় এবং চট্টগ্রাম রেলওয়ে ধর্মঘট নামে তকালীন সারা বাংলাদেশে প্রচুর সাড়া জাগায়। উপরন্তু এই রেল ধর্মঘটকে চট্টগ্রামের বিওসি, টার্নার মরিসন প্রভৃতি বিদেশি কোম্পানির শ্রমিকরাও সমর্থন জানায় এবং শহরে মিছিল করে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম কলেজ এবং কলেজিয়েট ও মিউনিসিপল স্কুলের ছাত্ররাও ধর্মঘট পালন করে। এদিকে রেল কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামের ধর্মঘটরত শ্রমিক-কর্মচারীদের বরাদ্দকৃত বাসভবন ত্যাগ করার আদেশ দিলে তারা জে এম সেন হল এবং তার চারপাশে তাবু খাটিয়ে থাকতে শুরু করে।
 
দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমােহন সেনগুপ্ত, মােহাম্মদ সিরাজুল হক প্রমুখসহ স্থানীয় নেতা কর্মীরা। তাদের সাহায্য-সহযােগিতা প্রদান করেন। এক পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের পুলিশ। আটক করে এবং পরদিন শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে। এই গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ১৪৪ ধারা অমান্য করলে দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমােহনসহ অন্য নেতৃবৃন্দকেও আটক করা হয়। গ্রেপ্তারের পর দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমােহনকে কোর্টে আনার সংবাদে চট্টগ্রাম শহর। এবং কর্ণফুলি নদীর ওপার থেকেও হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনসাধারণ দলে দলে কোর্টহিল ভবনে এসে সমবেত হতে শুরু করেন। এতে কোর্টহিল। ভবনসহ চারপাশ, লালদিঘির পাড়, কতােয়ালি থানা থেকে ফিরিঙ্গিবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় বিপুল জনসমাগম ঘটে। তাদের বিক্ষুব্ধ কণ্ঠ ও আচরণে ধ্বনিত ও প্রকাশিত হয়েছিল যতীন্দ্রমােহনের মুক্তির ঐকান্তিক দাবি। অপরাহ্নে স্বতঃস্ফুর্ত গণজমায়েতের ক্ষোভ অহিংস থেকে ক্রমেই সহিংসরূপ গ্রহণের আভাস দেখা দিলে শেখ-এ-চাটগাম কাজেম আলী চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে যতীন্দ্রমােহনের জামিন মঞ্জুর হয়। জনতা তাকে উল্লাস ও সমাদর সহকারে গান্ধী ময়দানে নিয়ে আসে। তিনি সেখানে তুমুল বৃষ্টিতেও ভাষণ দিয়ে ইংরেজ প্রশাসনের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ সমবেত বিশাল জনতাকে শান্ত করেন।
 
১৯৩০-এর সশস্ত্র বিপ্লবী অভ্যুত্থান
 
ইতিহাসখ্যাত অসহযােগ আন্দোলনে চট্টগ্রামের গােপন বিপ্লবী সংগঠনের সদস্যরাও নিজেদের গােপন ঘাঁটি ও সংগঠনের অস্তিত্ব বজায় রেখে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু তারা ইতােমধ্যে সংঘটিত জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড এবং চাদপুরসহ দেশের অন্য স্থানে ইংরেজদের বর্বরতা প্রত্যক্ষ করেন। এসব নির্মম ও অন্যায় ঘটনা তাদের প্রবলভাবে আলােড়িত করে এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের বিষয়ে তাঁদের পূর্ব ধারণাকে সঙ্গত ও চিন্তাকে দৃঢ়মূল করে তােলে। এর বাস্তবরূপ প্রদানে তারা আরও সংগঠিত ও তৎপর হয়ে ওঠেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অসহযােগ আন্দোলনের পরে সূর্য সেন ও অম্বিকা চক্রবর্তী চট্টগ্রামের দেওয়ানজি পুকুর পাড়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘শান্তি আশ্রম’। এই আশ্রমে এসে গােপন সভায় বিপ্লবী সদস্যরা মিলিত হতেন। ক্রমেই তারা তাদের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মপন্থার প্রতি গভীর আস্থা অর্জন করেন এবং মুক্তিসংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন। সূর্য সেনের নেতৃত্বে পরিচালিত বিপ্লবী দলটিই পরবর্তীতে চট্টগ্রামের বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে এক অনন্য ভূমিকা পালন করে। | সশস্ত্র বিপ্লবের প্রস্তুতির লক্ষ্যে দলের জন্য অর্থসংগ্রহের প্রচেষ্টায় প্রথম দিকে ডাকাতি/লুট করার পন্থা গ্রহণ করা হতাে। উদাহরণস্বরূপ পরৈকোড়া এবং টাইগারপাস এলাকায় রেলওয়ে ডাকাতির কথা উল্লেখ্য। এজন্যে তাদের ইংরেজদের প্রতিশােধের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। উপরিউক্ত দ্বিতীয় ঘটনার প্রেক্ষিতে সংঘটিত নাগরখানা পাহাড়ের যুদ্ধে অম্বিকা চক্রবর্তীসহ কয়েকজন বিপ্লবী সদস্যকে ধরা পড়ে বিচারের জন্য সােপর্দ হতে হয়েছিলেন। তাই পরবর্তীকালে এই প্রক্রিয়ায় অর্থসগ্রহের প্রচেষ্টা বাতিল করা হয়। দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সদস্যরা নিজ নিজ পরিবারের সম্মতি বা অসম্মতিতেও তাদের অর্থভাণ্ডার থেকে যে-কোনাে প্রকারে দলের জন্য অর্থসগ্রহ করবেন। তারা প্রয়ােজনে মা, বােন বা অন্য কোনাে নিকটাত্মীয়ার কাছ থেকে বিপ্লবের কাজের কথা বুঝিয়ে তাদের ব্যবহৃত স্বর্ণের অলংকার নেওয়ার প্রচেষ্টা গ্রহণ করবেন। এমনকি বুঝিয়ে নেওয়া সম্ভব না হলে চুরি করে নেওয়া হবে বলেও স্থির হয়। মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য এসব কাজ অনৈতিক হবে না- এই বিষয়টি সাধারণ সদস্যদের কাছে ব্যাখ্যা করার বিষয়টিও স্থির হয় (সৈয়দ আনােয়ার হােসেন ও মুনতাসীর মামুন ১৯৮৬: ২৮০)।
 
ব্যায়ামাগার স্থাপনের মাধ্যমে বিপ্লবী অভ্যুত্থানের জন্য সদস্য সংগ্রহের কৌশল গ্রহণ করা হয়। সে লক্ষ্যে সদরঘাট, চন্দনপুরা প্রভৃতি স্থানে ব্যায়ামাগার স্থাপিত হয়। তা ছাড়া ক্রমে শহর ছাড়িয়ে গ্রামেও ব্যায়ামাগার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। এসব ব্যায়ামাগারের মাধ্যমে স্কুলকলেজের সচ্চরিত্র, সাহসী ও বুদ্ধিমান ছাত্রদের সংগ্রহ করে তাদের ভেতর থেকেই নিবেদিতপ্রাণ বিপ্লবী বাহিনী গড়ে তােলাই ছিল লক্ষ্য। পরবর্তীকালে সংঘটিত যুব বিদ্রোহের মধ্যে এই উদ্দেশ্যের বাস্তবায়নের সাফল্য প্রমাণিত। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৯৩০ সালের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল, জালালাবাদের যুদ্ধ এবং পরবর্তী বহু খণ্ডযুদ্ধে এসব ব্যায়ামাগারে প্রশিক্ষিত ছাত্র ও যুবক বিপ্লবীরাই ছিল মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে অকুণ্ঠিতচিত্তে প্রাণদানকারী যােদ্ধা।
 
চট্টগ্রামের বিপ্লবী নেতারা তাদের সশস্ত্র বিপ্লবী অভ্যুত্থান বাংলার বিভিন্ন। জেলায় সমন্বিতভাবে সংঘটনের পরিকল্পনা করেন। এজন্য সংশ্লিষ্ট নেতাদের সাথে যােগাযােগ করা হলে তারা অভ্যুত্থানের সময় ও অবস্থার অনুপযুক্ততা ইত্যাদি অজুহাতে এতে সম্পৃক্ত হতে চাইলেন না। শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রামের বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ। অন্য কোনাে জেলার বা কলকাতার বিপ্লবী নেতাদের ও স্বাধীনতার জন্য তাদের সশস্ত্র অভ্যুত্থানের এই নীতিতে সামিল করতে সক্ষম হন নি (সৈয়দ আনােয়ার হােসেন ও মুনতাসীর মামুন ১৯৮৬: ২৮২)। সে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, তাদের এই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় আর কেউ যােগ না দিলেও সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম জেলা সদরে তা করা হবে। তারা আলােচনায় এও স্থির করেন যে, এজন্য উপযুক্ত সময় হলাে সমসময়ের আইন। অমান্য আন্দোলনের তীব্র চাঞ্চল্য। কারণ, ইংরেজ সরকার এই আন্দোলনে ব্ৰিত এবং তা দমনে অত্যন্ত ব্যস্ত আর জনসাধারণের চিত্তে দেশপ্রেমের প্রবল জোয়ার। শুধু একটি জেলা সদরে এই সশস্ত্র বিপ্লব প্রবল ক্ষমতাশালী ইংরেজদের বিরুদ্ধে কতটুকু ফলপ্রসূ হবে এই প্রশ্নও বিপ্লবী নেতৃত্বের আলােচনায় স্থান পেয়েছিল। কিন্তু এ ধরনের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে চট্টগ্রাম জেলাকে কয়েকদিনের জন্য হলেও ব্রিটিশ শাসন মুক্ত রাখা গেলে এর একটা বিরাট প্রেরণা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে- এই চিন্তা বিপ্লবী নেতৃত্বের মধ্যে সক্রিয় ছিল। তারা এও প্রত্যাশা করেছিলেন যে, এই প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে পরাধীনতার শেকল থেকে মুক্তি পাবার ইচ্ছা ও উদ্যমে জেগে উঠে হৃত শক্তি জাতি ফিরে পাবে, মুক্তি সংগ্রামে চরম আত্মদানের জন্য নবপ্রেরণায় উদবুদ্ধ হবে। এজন্য যদি বিপ্লবীদের প্রাণবিসর্জন দিতে হয় তাতেও তারা অকুণ্ঠিতচিত্ত ছিলেন। চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের অস্ত্রাগার দখল-যুদ্ধ এবং অন্যান্য কর্মসূচি গ্রহণের নেপথ্যে মূলত এই ভাবনাই ক্রিয়াশীল ছিল। সূর্য সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নির্মল সেন প্রমুখ বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ। 
 
স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে এক গুরুত্বপূর্ণ সােপান অতিক্রম করার লক্ষ্যে সশস্ত্র অ্যুত্থানের এই পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন। | সূর্য সেনের অধিনায়কত্বে চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা আইরিশ রিপাবলিকান বিপ্লবীদের অনুসরণে তাদের সশস্ত্র দলের নামকরণ করেছিলেন ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি”। এমনকি, আইরিশ বিপ্লবীরা যেমন ‘ইস্টার রাইজিং (ইস্টারকালীন অভ্যুত্থান) শুরু করেছিলেন গুড ফ্রাইডের দিন, চট্টগ্রামের বিপ্লবীরাও ঠিক ১৯৩০ সালের গুড ফ্রাইডের দিনই তাঁদের সশস্ত্র অভ্যুত্থানের তারিখ ধার্য করেছিলেন। বিপ্লবী দলের অগ্রাধিকারমূলক কর্মসূচি ছিল নিমরূপ
ক. সংবাদ সরবরাহ ব্যবস্থা ধ্বংসকল্পে টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ আক্রমণ; খ. পাহাড়তলি অস্ত্রাগার দখল; গ. ইউরােপীয় ক্লাব (বর্তমানে চট্টগ্রাম ক্লাব) আক্রমণ। উদ্দেশ্য, ত্রাস সৃষ্টির জন্য একসঙ্গে অনেক ইউরােপীয়ানদের হত্যা করা; ঘ. উপরিউক্ত কাজগুলাের সফল সমাপ্তির পর জেলার রিজার্ভ পুলিশ ঘাঁটি আক্রমণ এবং অস্ত্রাগার লুট; ঙ. এগুলাের সাফল্যের নিরিখে চট্টগ্রামকে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘােষণা এবং সূর্য সেনকে এর প্রেসিডেন্ট পদ প্রদান; চ. ইংরেজ সামরিকবাহিনীর আগমন ঠেকাতে চট্টগ্রাম থেকে চল্লিশ মাইল দূরে | রেললাইন উপড়ে ফেলা; ছ, এসব কাজের সাফল্যকে স্মরণীয় ও জনপ্রিয় করার জন্যে জেলখানার | কয়েদিদের মুক্তি প্রদান; জ, আরও অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে শহরের বন্দুকের দোকানসমূহ লুট করা; ঝ. বিপ্লবের প্রয়ােজনে সরকারি ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক লুট; এবং ঞ. চট্টগ্রাম শহর দখল করে কোর্টহিলে বিপ্লবীদের পতাৰ্কা উত্তোলন, প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা এবং ইংরেজ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও অন্য সরকারি কর্মচারীদের গ্রেপ্তার করে সূর্য সেনের কাছে প্রেরণ এবং কোর্টহিলে তাদের প্রকাশ্যে বিচার করা (পূর্ণেন্দু দস্তিদার ১৩৯৭: ১১০ উপযুক্ত কর্মসূচি সম্পাদনের লক্ষ্যে প্রয়ােজনীয় প্রস্তুতি দ্রুততা, সতর্কতা এবং গােপনীয়তার সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়। এজন্য খাকি পােশাক, গােৰ্খা ভােজালি, ওয়াটার বটল ইত্যাদি সংগ্রহ করা হয়। জেলখানার প্রধান ফটকের তালার বিকল্প চাবিও তৈরি করা হয়। আগ্নেয়াস্ত্র, বােমা, সংগৃহীত বন্দুক ও অন্যান্য সামগ্রী শহরের বিভিন্ন ঘাটিতে ভাগ করে রাখা হয়।
 
পাশাপাশি সঠিক সময়ে পরম আত্মত্যাগের জন্য বিপ্লবীদের মানসিক প্রস্তুতিও চলতে থাকে। তা ছাড়া দলটি জনসাধারণের, বিশেষ করে ছাত্র, যুবক ও নাগরিকদের উদ্দেশ্যে তিনটি প্রচারপত্র বিলি করে। এগুলাে বিলির লক্ষ্য ছিল প্রথমত চট্টগ্রামবাসীদের এই অ্যুত্থান ও করণীয় সম্পর্কে জানানাে এবং পরবর্তী পরিস্থিতিতে সাহসী তারুণ্যের সক্রিয় সহায়তা প্রাপ্তির জন্যে তাদের মানসিকভাবে উদ্দীপ্ত করা। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিলের রাত ছিল আলােচ্য যুববিদ্রোহের নির্দিষ্ট সময়। এদিকে সেদিন সন্ধ্যায় প্যারেড ময়দানে যৌথ মুসলিম কনফারেন্স উপলক্ষ্যে কুস্তি গীর গামার সঙ্গে অন্য এক পালােয়ানের প্রতিযােগিতার আয়ােজন করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, আগের দিন বিপ্লবী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং এতে বিশিষ্ট মুসলিম নেতা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আক্রাম খাঁ , আসাদ উল্লা সিরাজী, ড. আনসারী, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী প্রমুখ যােগ দিয়েছিলেন। সকলের মনােযােগ নিবিষ্ট ছিল সেদিকে। তা ছাড়া কুমিরায় চলছিল লবণ সত্যাগ্রহ। এমন পরিস্থিতিতে সে রাতে নির্বাচিত ৬৪জন বিপ্লবী যােদ্ধাদের চারটি দল চট্টগ্রাম শহরের পূর্বনির্ধারিত চারটি গােপন ঘাঁটিতে একত্রিত হয়। প্রধান নেতা সূর্য সেনের পরিচালনায় রাত দশটার দিকে সেই ঐতিহাসিক ঘটনার সূত্রপাত হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী বিপ্লবী অম্বিকা চক্রবর্তীর নেতৃত্বে প্রথম দলটি এখানকার সংবাদ সরবরাহ ব্যবস্থা বিকল করার উদ্দেশ্যে নন্দনকাননের টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ এক্সচেঞ্জ হাতুড়ির আঘাতে ভেঙে-গুঁড়িয়ে আগুন জ্বালিয়ে বিনষ্ট করে দেয়। ফলে চট্টগ্রামের সাথে বহির্জগত ও অন্যান্য স্থানের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে অ্যুথান পরিকল্পনার প্রথম লক্ষ্য অর্জিত হয়। দ্বিতীয় দল বিপ্লবী নরেশ রায়ের নেতৃত্বে ইউরােপীয় ক্লাব আক্রমণের জন্য রওনা হন। কিন্তু ক্লাব নির্ধারিত সময়ের পূর্বে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উদ্দেশ্য সফল হয় নি। আরেকটি দল নির্মল সেন ও লােকনাথ বলের নেতৃত্বে পাহাড়তলি রেলওয়ের সরকারি অস্ত্রাগার দখলের জন্য যাত্রা করেন। এই অস্ত্রাগারটিতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অস্ত্র ছাড়াও সরকারি অন্যান্য অস্ত্রও রাখা হতাে, যেমন: রাইফেল, মেশিনগান, লুইসগান এবং প্রচুর গােলাবারুদ। সেজন্য এটি অত্যন্ত সুরক্ষিত ছিল। বিপ্লবীরা পূর্বপরিকল্পিত এবং তাৎক্ষণিক উদ্ভাবিত বিভিন্ন পদ্ধতিতে অস্ত্রাগারের ভারী লােহার দরজা ভেঙে ভেতরের অস্ত্র ভাণ্ডার। থেকে তাদের পরিচিত ও প্রয়ােজনীয় অস্ত্র সংগ্রহ করেন। মেশিনগান, লুইসগান ইত্যাদি ভেঙে ফেলে রাখে যাতে ইংরেজরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে না পারে। তা ছাড়া তারা অস্ত্রাগারে আগুন লাগিয়ে দেয়।
 
সেদিনের পরবর্তী কর্মসূচি ছিলাে দামপাড়া পুলিশ রিজার্ভ বাহিনীর ওপর আক্রমণ করা। এজন্য পূর্বপরিকল্পনামতাে উক্ত তিনটি দল সফল হয়ে ফিরে এসে রিপাবলিকান আর্মির সর্বাধিনায়ক সূর্য সেনের নেতৃত্বে অপেক্ষমাণ চতুর্থ দলের সঙ্গে মিলিত হন এবং একযােগে আক্রমণ শুরু করেন। আক্রমণের শুরুতেই বিপ্লবীদের সামরিক পােশাক-আশাক, ক্ষিপ্র আক্রমণ এবং উদ্দীপনাময় ও রাতের আঁধার বিদীর্ণ করা শ্লোগানে বিভ্রান্ত ও ভীত ইংরেজ সরকারের বেতনভুক্ত প্রহরীরা পালিয়ে গেলে প্রায় বিনা বাধায় ইংরেজদের সর্ব শেষ প্রধান সশস্ত্র ঘাটি বিপ্লবীদের দখলে চলে আসে। সেখানেই সূর্য সেনের প্রধান দফতর স্থাপন করা হয়। বিপ্লবীদের ইতােমধ্যে বিভিন্ন অস্ত্রাগার থেকে প্রাপ্ত রাইফেল চালনার প্রশিক্ষণ শুরু হয় সেখানে। পাশাপাশি পরবর্তী কর্মপন্থা স্থির করার জন্য জরুরি সভা চলে। এদিকে সন্ধ্যা থেকে শহরের এই আকস্মিক ঘটনায় ইংরেজরা বিমূঢ় ও বিচলিত হয়ে পড়লেও সামলে ওঠার চেষ্টা করে। কিছু সাহসী ইংরেজ পাের্ট জেটির অস্ত্রাগার থেকে সেখানকার একমাত্র মেশিনগানটি এনে দামপাড়া পানির ট্যাংকের ওপর তুলে বিপ্লবীদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। হঠাৎ আক্রমণে বিপ্লবীরা মােটেও বিচলিত না হয়ে পালটা আক্রমণ করে তাদের চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। তারপর সূর্য। সেন একটি সামরিক বিপ্লবী গণতন্ত্রী সরকার গঠন করে এক ঘােষণাপত্রের মাধ্যমে স্বাধীনতার লক্ষ্যে এই জয়কে সুনিশ্চিত করার জন্য তাদের বর্তমান প্রতিরােধ ও সশস্ত্র সংগ্রামকে আরও ব্যাপক ও তীব্র করে তােলার আহ্বান জানান টেলিফোনটেলিগ্রাফ সংযােগ বিচ্ছিন্ন থাকায় শেষ পর্যন্ত ইংরেজ কর্তৃপক্ষ বন্দরের বেতারের মাধ্যমে রাজধানী কলকাতায় চট্টগ্রামের ঘটনা অবহিত করে। এতে অবিভক্ত বাংলার গভর্নর তাৎক্ষণিকভাবে বিশেষ ক্ষমতা প্রয়ােগ করে যে কাউকে বিনা বিচারে আটক করার জরুরি আইন জারী করেন এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় এবং ঐ আইনের প্রেক্ষিতে ১৯ এপ্রিল সারা বাংলায় শুরু হয় পুলিশের তাণ্ডব এবং ব্যাপক ধরপাকড় এদিকে নানা কারণে বিপ্লবীরা তাদের সমুদয় অস্ত্রশস্ত্রসহ পুলিশ ব্যারাকের পাহাড় ত্যাগ করে উত্তর দিকে বিস্তৃত জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যান।
 
সেদিন সকালে বায়েজিদ বােস্তামির কাছাকাছি নাগরখানা পাহাড়ে সূর্য সেন, নির্মল সেন ও অম্বিকা চক্রবর্তী এক বৈঠকে মিলিত হন। ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা স্থির করার লক্ষ্যে একজন বিপ্লবীকে শহরের অবস্থা জানার জন্যে পাঠানাে হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে বিশ্বাসঘাতকতা করে। তার। অপেক্ষায় সারাদিন কেটে যাওয়ার পর উদবিগ্ন বিপ্লবী নেতারা অমরেন্দ্র নন্দী নামে অন্য একজনকে আবার খবর সংগ্রহ করতে প্রেরণ করেন। সারা চট্টগ্রাম শহরে ততক্ষণে সৈন্য ও পুলিশের কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। সেই অবস্থায় অমরেন্দ্র ঘটনাক্রমে পুলিশের কর্ডনের ভেতর পড়ে যান। কিন্তু ধরা না দিয়ে অকুতােভয়ে তিনি একাকী অসম যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং এই যুববিদ্রোহে প্রথম শহিদ হন। তারপরও শহরের খবরাখবর না পৌছায় বিপ্লবী নেতারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে সদলবলে উত্তর ফতেয়াবাদের নিকটে এক পাহাড়ে চলে যান এবং ২০ ও ২১ এপ্রিল পর্যন্ত দুদিন সংবাদ প্রাপ্তির জন্য অপেক্ষায় থাকেন।

২২ এপ্রিল ভােরে বিপ্লবীরা জালালাবাদ পাহাড়ে এসে পৌছান। তাদের এখানকার অবস্থানের সংবাদ পেয়ে বিকেল ৫টায় কর্নেল ডালসস্মিথের নেতৃত্বে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস ও সুর্মাভ্যালি লাইট ইনফ্রেন্ট্রির ৭৫০জনের মতাে ইংরেজ ও গােৰ্খা সৈন্য একটি আর্মড ট্রেনে করে সেখানে উপস্থিত হয়। বিপ্লবীদের পাহারা চৌকি থেকে এদের আগমন পরিলক্ষিত হলে ইংরেজ বাহিনীকে মােকবিলা করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। পাহাড়ের ওপর অবস্থান তাদেরকে আক্রমণ রচনা ও পরিচালনায় সুবিধা প্রদান করে। এতে ইংরেজ বাহিনী অনেকটা হতচকিত ও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তবে মেশিনগান, লুইসগান প্রভৃতি অত্যাধুনিক অস্ত্র ছিল তাদের শক্তি। অপর দিকে রেলওয়ে ও পুলিশ অস্ত্রাগার থেকে লুণ্ঠন করা পিস্তল, রিভলভার ও রাইফেল ছিল বিপ্লবীদের অস্ত্র শক্তি। লোেকবলের দিক থেকেও বিপ্লবীরা অসম শক্তির অধিকারী। ছিল। তবুও সেদিন ইংরেজ বাহিনীর মরিয়া আক্রমণের প্রত্যুত্তরে বিপ্লবীরা ছিল অকুতােভয়, স্বাধীনতা কাতর এবং মরণপণ লড়াইয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতাহীন বিপ্লবীরা সেই শক্তিতে উজ্জীবিত হয়েই সেদিন অধিকতর শক্তিশালী ইংরেজ বাহিনীকে সম্মুখসমরে পর্যদস্ত করতে পেরেছিল। ইংরেজরা রাত ৮টা পর্যন্ত। যুদ্ধ করে বিপ্লবীদের পরাস্ত করতে না পেরে তাদের পক্ষের হতাহতদের নিয়ে শহরে ফিরে যায়। বিপ্লবীদের ১৩জন শহিদ হয়েছিল।

 
সে সব বীর যােদ্ধাকে সামরিক মর্যাদায় সমাধি দিয়ে অন্যরা ক্রমে বিচ্ছিন্নভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মগােপন করেন। এভাবে এক দুর্দম সাহসের পরিচয়বাহী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের এই গৌরবজনক অধ্যায় রচিত হয়। তবে পরবর্তীকালে বিদ্রোহীদের সাথে বিভিন্ন স্থানে খণ্ডযুদ্ধ হয়। এর মধ্যে উল্লেখ্য কালারপােল ও ধলঘাটের যুদ্ধ তা ছাড়া ইউরােপীয়ানদের ক্লাবে আবারও তারা আক্রমণ করেন। তবে এবার এই কাজে ব্যবহৃত হয় নারী নেতৃত্ব। সর্বশেষ এই আক্রমণের নেতৃত্ব দেন বীর বাঙালি নারী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। তিনি উক্ত ঘটনার শেষ দিকে আহত অবস্থায় ইংরেজ সৈন্যের পালটা আক্রমণের মুখে অন্য সকল বিপ্লবীকে নিরাপদে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ করে দিয়ে পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। পরবর্তী সময়ে ক্রমে বিদ্রোহীরা ধরা পড়েন এবং বিচারে এদের দ্বীপান্তর করা হয়। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রামের এই স্মরণীয় এবং সফল বিদ্রোহের নেতা সূর্য সেন এবং তারকেশ্বর দত্তকে চট্টগ্রাম জেলে ফাঁসি দিয়ে তাদের মৃতদেহ বঙ্গোপসাগরে সলিলসমাধি দেওয়া হয়। সূর্য সেন ও অন্যান্য বিপ্লবীদের ফাঁসি, কারাদণ্ড ও দ্বীপান্ত রের পর বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ড স্তিমিত ও দুর্বল হয়ে পড়ে চট্টগ্রামের এই যুববিদ্রোহ বাঙালিদের ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিবৃত্তে এক অনন্যসাধারণ এবং উদ্দীপনা সঞ্চারী ঐতিহ্য সৃষ্টি করে।
 
কাহারপাড়া মিলিটারি প্রতিরােধ আন্দোলন
 
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামে উপস্থিত ছিল পাইওনিয়ার কোরের সেনা দল। তাদের ক্যাম্প ছিল তক্কালীন চট্টগ্রাম শহরের প্রায় দুই মাইল দূরের নাসিরাবাদে। বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিতপরে ১৯৪৫ সালের শেষ দিকে এই ক্যাম্পের কিছু সৈন্যের অনৈতিক ও মন্দ আচরণে স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তাদের এই আচরণ শহরের উপকণ্ঠ পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছিল। শহর থেকে প্রায় দু মাইল উত্তরে কাহারপাড়া এলাকায় নারীদের অশালীনভাবে উত্যক্ত করার ঘটনায় একজন কৃষক। প্রতিবাদ করলে সৈন্যরা তাকে নির্মমভাবে প্রহার করে। শুধু তাই নয়, পাইওনিয়ার ফোর্সের সৈন্যরা সেদিন সন্ধ্যার দিকে সদলবলে এসে সেই গ্রামে অগ্নিকাণ্ড, নারীনির্যাতন এবং জীবন্ত পুড়িয়ে মারার মতাে নিষ্ঠুর, নির্মম কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। মর্মান্তিক ও অমানুষিক ঘটনায় সংক্ষুব্ধ চট্টগ্রামবাসী তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সম্মিলিত আন্দোলন গড়ে তােলেন। আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয় চট্টগ্রাম জেলা নারী সমিতি, জেলা মুসলিম লীগ, জেলা ছাত্র ফেডারেশন, হিন্দু মহাসভা, সমাজতন্ত্রী দল, কমিউনিস্ট পার্টিসহ বিভিন্ন দল এবং এলাকার আপামর জনসাধারণ। সকলে আলােচনা করে একটি প্রতিরােধ কমিটি গঠন এবং পরদিন প্রতিবাদ মিছিলসহ বিক্ষোভ প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রতিরােধ কমিটির নাম করা হয় ‘কাহারপাড়া মিলিটারি রেজিসট্যান্স কমিটি’। সেই রাতেই ছাত্রদেরও একটি বিশাল দল মিছিল করে তাদের সংক্ষোভ প্রদর্শন করেছিল। পরদিন ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি ও দলমতনির্বিশেষে গঠিত এক বিরাট বিক্ষোভ মিছিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনী বিরােধী বিবিধ স্লোগান দিয়ে শহর পরিক্রম করে এবং পরের দিন শহরে পূর্ণ হরতাল পালিত হয় এই গণ অসন্তোষজনক পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসক চট্টগ্রাম শহরকে সেনা সদস্যদের অবারিত চলাচল বহির্ভূত ঘােষণা প্রদান করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পরে দায়ী সেনা সদস্যদের বিচার ও শাস্তি হয়। তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনের শেষ পর্যায়ে এবং ভারত বিভাগের পূর্বে চট্টগ্রামে সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী এমন বিশাল ও স্বতঃস্ফূর্ত এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন পরে আর হয় নি (পূর্ণেন্দু। দস্তিদার ১৩৯৭: ৩০৫-৬)।
 
ভাষা আন্দোলনে পথিকৃতের ভূমিকা
 
বাঙালির ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও সংগ্রামের ধারাবাহিকতায়ও চট্টগ্রামের অবদান কম নয়; বরং কোন কোন ক্ষেত্রে তা পথিকৃতের ভূমিকায় উত্তীর্ণ। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপটেম্বর প্রকাশিত হয় ভাষা আন্দোলনের ওপর আলােড়ন সৃষ্টিকারী প্রথম পুস্তিকা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু। নতুন স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি সম্বলিত এই পুস্তিকাটির প্রকাশনায় উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন চট্টগ্রামেরই সন্তান অধ্যাপক আবুল কাশেম। এই পুস্তিকার মুখবন্ধে তিনি লিখেছিলেন- বাংলা ভাষাই হবে- পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন, আদালতের ও অফিসাদির ভাষা’ (আজাদী ১৯৯৫: ৩৯)। পরবর্তী। বছরেও এই সংক্রান্ত আন্দোলনের ধারা বহমান ছিল। সেই সময় নিষিদ্ধ ঘােষিত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ছাত্র ফেডারেশনের নেতারা গােপন বৈঠকে মিলিত হন। সে বৈঠকে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশও যােগ দেয়। সেখানে সরকার কর্তৃক ইতােমধ্যে ঘােষিত মূলনীতির বিরােধিতা করার জন্যে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। তারা সরকারের মূলনীতি পরিকল্পনার বিরােধী জনসভা করেন এবং তৎকালীন পাকিস্তান গণপরিষদ সদস্য এ কে খান ও নূর আহমদ চেয়ারম্যানের বাড়ি ঘেরাও করে তাদের কাছ থেকে এই মর্মে অঙ্গীকার আদায় করেন যে, সরকারের মূলনীতিতে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি অর্জন করা না গেলে তারা পদত্যাগ করবেন। রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে ঢাকায় মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর কুখ্যাত ঘােষণায় চট্টগ্রামে শুধু শহর নয় গ্রামেগঞ্জেও এর বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
 
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং তকালীন পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা করার দাবিতে চট্টগ্রামের কানুনগােপাড়া কলেজ ও স্কুলসহ ধলঘাট, কেলিশহর, সারােয়ারতলি, কাটিরহাট, নানুপুর, নােয়াপাড়া, আর্যমিত্র, কোয়েপাড়া, মহামুনি প্রভৃতি স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা ধর্মঘট ও শােভাযাত্রা করে পাকিস্তান সরকারের বাংলা ভাষা বিরােধী অপতৎপরতার বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত ও সােচ্চার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন আবার রাষ্ট্রভাষা উর্দুর ঘােষণা দিলে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক কর্মসূচি হিসেবে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দেশজুড়ে সর্বাত্মক হরতাল আহ্বান করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে এক সর্বদলীয় সভা আহ্বান এবং সেখানে সকল স্তর ও পেশার। নেতৃবৃন্দের সাথে আলােচনাক্রমে একটি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন। করা হয়। আন্দোলনের বিষয়ে ব্যাপক প্রচারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর মধ্যে অন্যতম পােস্টার ও পথসভা। এজন্য গঠিত হয় নিবেদিত প্রাণ প্রচার স্কোয়াড। চট্টগ্রামে ২১ ফেব্রুয়ারির হরতাল আন্তরিক, শান্তি পূর্ণ ও সফলভাবে পালিত হয়।
ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলি বর্ষণ ও হত্যার খবরটি দুপুর আড়াইটার দিকে চট্টগ্রামে এসে পৌছায়। এই খবরে সর্বস্তরের জনসাধারণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়ে সারা শহরে মিছিলের স্রোত বয়ে যেতে থাকে। পরে সব মিছিল একত্র হয় প্রথমে ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউটে এবং পরে লালদিঘি ময়দানে। সেখানে পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত হয়। এদিকে চট্টগ্রামের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক অসুস্থ মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী ঢাকার মর্মান্তিক এই ঘটনা শুনে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় একটি কবিতা রচনা করেন এবং কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে রাতারাতি তা মুদ্রিত হয়। এই ঘটনাটি আমাদের ভাষা আন্দোলনের গতি প্রবাহে এক ঐতিহাসিক সংযােজন। সেদিন আলােচ্য প্রেসটি ঝুঁকি সত্ত্বেও তাদের সাহসিকতাপূর্ণ উদ্যোগ দ্বারা প্রকৃতপক্ষে জনগণের ক্ষোভ এবং মাতৃভাষা বাংলার প্রতি প্রগাঢ় ভালােবাসারই প্রকাশ ঘটিয়েছেন। শুধু তাই নয়, মাহবুব-উল-আলমের কবিতা পুস্তিকাটি একুশের প্রথম সংকলনেরও গৌরব অর্জন করে। উল্লেখ্য, পুস্তিকাটি প্রকাশের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে সরকারি হয়রানির শিকার হতে, এমনকি প্রেস ম্যানেজারকে কারাবরণও করতে হয়েছে। তা ছাড়া। সরকার কর্তৃক পুস্তিকাটি বাজেয়াপ্ত এবং কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসকে বন্ধ করার আদেশ প্রদান করা হয়। এদিকে সর্বস্তরের জনসাধারণের বিক্ষোভ মিছিল চলতেই থাকে। ঢাকায় শহিদদের স্মরণে প্রথম অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয় খুরশিদ মহলের সামনের বর্তমানের পেট্রোল পাম্প এলাকায় ২৩ ফেব্রুয়ারি পরে এটি পুলিশ ভেঙে ফেলে।
 

৪ তারিখ আবারও স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল এবং লালদিঘি ময়দানে প্রতিবাদী জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেদিনের জনসভায় মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীর সেই কবিতাটি প্রথম বারের মতাে জনসমক্ষে পাঠ করে শােনানাে হয়। এর পরের দিনগুলােতে প্রায় প্রতিদিনই বিক্ষোভ মিছিল, ছাত্রদের ক্লাস বর্জন ও জনসভা অব্যাহত থাকে। এভাবে ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চট্টগ্রামে ৫টি বৃহৎ জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আন্দোলন ও ক্লাস বর্জনসহ সব ধরনের বিক্ষোভ তৎপরতা চালু রাখার পৌনঃপুনিক সিদ্ধান্ত গৃহীত ও অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বানে ৫ মার্চ শহিদ দিবস পালন কর্মসূচি ঢাকায় নানা কারণে সফল না হলেও চট্টগ্রামে পূর্ব বাংলার সবচেয়ে বিশাল জনসভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতে অর্ধ লক্ষাধিক প্রতিবাদী জনসাধারণ সমবেত হয়ে সরকারের নীতি ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরােধের সংকল্প ঘােষণা করেন তা ছাড়া চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থান ও সড়ককে ভাষা আন্দোলন এবং ভাষার জন্য আত্মাহুতি দেওয়া শহিদদের নামে নামকরণ করার দাবি সারা শহরে প্রচারের ও পৌর কর্তৃপক্ষের কাছে উত্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরে সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে কার্যক্রমও গ্রহণ করা হয় ভাষা আন্দোলনের সেই উত্তাল সময়ে চট্টগ্রামবাসীদের এই ভূমিকা চিরস্মরণীয় সংবিধান বিরােধী আন্দোলন পাকিস্তানে সংবিধানের মূলনীতি প্রণয়নের উদ্দেশ্যে যে কমিটি গঠিত হয়েছিল তার রিপাের্ট প্রকাশিত হলে এর অগণতান্ত্রিক চরিত্রের কারণে চট্টগ্রামে সীমিত পর্যায়ে সংবিধান বিরােধী আন্দোলন গড়ে ওঠে। ১৯৫০ সালে লিয়াকত আলী খান চট্টগ্রামে এলে মুসলিম লীগের একটি অংশ মূলনীতি রিপাের্টে এই প্রদেশের ব্যাপক স্বায়ত্তশাসন প্রদানের দাবি অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান। শুধু তাই নয় বিভিন্ন স্কুলকলেজের ছাত্ররা এ মূলনীতি রিপাের্টের প্রতিবাদে মিছিল বের করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিকদেরও এক মিছিল বের হয়। 

 
সাংস্কৃতিক আন্দোলন
 
পাকিস্তানে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক পরিবেশ অর্জন ও বজায় রাখার লক্ষ্যে চট্টগ্রামে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এগুলাের মধ্যে ছিল প্রগতি সংঘ, সাংস্কৃতিক বৈঠক, প্রতীক নাট্যগােষ্ঠী প্রভৃতি। তা ছাড়া সাংস্কৃতিক কর্মীদের উদ্যোগে ১৯৫১ সালে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব বাংলার প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন সংস্কৃতিসেবীদের একটি সাংস্কৃতিক সম্মেলন। এই সম্মেলন থেকে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানাে হয়েছিল। তা ছাড়াও চট্টগ্রামের বেশ কিছু স্থানীয় পত্রপত্রিকা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। এগুলাের মধ্যে ছিল ‘দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান’, ‘মাসিক সীমান্ত’ ‘আওয়াজ’ প্রভৃতি। কৃষক-শ্রমিক আন্দোলন ১৯৫০ সালে চট্টগ্রাম অঞ্চলের চা-বাগানের শ্রমিকরা লালমাদা বাহিনী গঠন করে ফটিকছড়িতে মালিক শ্রেণির বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তােলেন। যাদের নেতা ছিলেন আন্দামানে নির্বাসন ফেরত বিপ্লবী নগেন দে। তা ছাড়া বিভিন্ন স্থানে দোকান কর্মচারীদের এবং হাটহাজারিতে কৃষক আন্দোলন হয় স্থানীয়ভাবে শ্রমিক-কৃষকের এ আন্দোলনে বামপন্থিরা সমর্থন যােগায় বিভিন্ন ক্লাবের মাধ্যমে। চট্টগ্রামে এ সময় ক্লাবের মধ্যে সক্রিয় ছিল ‘শক্তি সংঘ’ ‘অগ্রণী সংঘ’, ‘ঘাট ফরহাদবেগ ক্লাব’ ‘মাদারবাড়ি ক্লাব প্রভৃতি।
 
১৯৫৪ সালে নির্বাচন
 
১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যে নির্বাচন হয়, সে নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য স্থানের মত চট্টগ্রামেও মুসলিম লীগ যুক্তফ্রন্টের কাছে পরাজিত হয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচন প্রমাণ করে পূর্ব বাংলার অন্যান্য স্থানের মত এখানেও মুসলিম লীগের ভিত্তি ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে। ইতােমধ্যে পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রশ্নে আওয়ামী লীগের মধ্যে যে অন্তর্দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় তার ঢেউ চট্টগ্রামের স্থানীয় রাজনীতির ওপর এসে পড়ে। চট্টগ্রামের অধিকাংশ রাজনীতিবিদ সােহরাওয়ার্দীর পক্ষ নেন। আর বামপন্থি নেতারা অবস্থান নেন মাওলানা ভাসানীর পক্ষে। এর মধ্যে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের মৃতদেহের ওপর দিয়ে এগিয়ে আসে সামরিক শাসন। পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ আইয়ুবের এই অন্যায় ক্ষমতা গ্রহণ ও তার স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। অচিরেই যে আন্দোলন শুরু করে চট্টগ্রামও সে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়। ১৯৬২ সালে চট্টগ্রামে সামরিক আইন বিরােধী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। সােহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১৯৬২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি দেশের অন্যান্য স্থানের মতাে এখানেও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। গঠিত হয় আইয়ুব বিরােধী সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ (চট্টগ্রাম শাখা)। এ সময় ছাত্র সংগঠক এ এম এম শহীদুলাহ, খায়রুল বশর, ফেরদৌস আহমদ কোরেশী, মাহমুদুল আলম, তারা মিয়া প্রমুখের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম সিটি কলেজ, কমার্স কলেজ, মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা সামরিক আইন ভঙ্গ করে মিছিল করে। ২০শে ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম কলেজে ‘শহিদমিনার স্থাপন করার জন্য গ্রেফতার হন ছাত্রনেতা রশীদ আল ফারুকী ও মােহাম্মদ হােসেন খান। তারপরও ছাত্ররা সামরিক আইন অমান্য করে ১৯৬২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপন করেন এবং সভা শেষে মিছিল বের করেন। পুলিশ উক্ত মিছিলে লাঠি চার্জ করে এবং ফেরদৌস আহমদ কোরেশী, এম এ মান্নান, খায়রুল বশর, বদরুল কামালসহ অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু পুলিশি এ দমননীতি আইয়ুব বিরােধী ছাত্র আন্দোলনকে স্তিমিত করতে পারে নি। ৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে চট্টগ্রাম ১৯৬২ সালে শরীফ শিক্ষা কমিশনের রিপাের্ট প্রকাশিত হয় এবং তাতে শিক্ষাকে একটি পণ্য হিসেবে গণ্য করা হলে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য অংশের মতাে চট্টগ্রামেও এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও আন্দোলন গড়ে ওঠে। ১৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ছাত্ররা সামরিক আইন ভঙ্গ করে মিছিল বের করে।
 
মিছিলকারীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। পুলিশের লাঠি চার্জ ও গুলিতে ১জন নিহত ও অনেকে আহত হন। গ্রেফতার করা ছয় শতাধিক ছাত্র। ছাত্রদের ওপর পুলিশের এ নির্যাতনের নিন্দা করে বিবৃতি দেন জাকেরুল হক চৌধুরী ও তােফাতুন্নেসা, জাতীয় পরিষদ সদস্য এম আর সিদ্দিকী, জহুর আহমেদ চৌধুরী প্রমুখ। ২৮ সেপটেম্বর ঘাট ফরহাদবেগ হাই স্কুলের ছাত্র ও পাহাড়তলি পাঞ্জাবি লেন গার্লস স্কুলের ছাত্রীরা শরীফ শিক্ষা কমিশনের রিপাের্ট ও পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ছাত্র ধর্মঘট পালন করে। ১৯৬৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চট্টগ্রাম ১৯৬৫ সালের প্রহসনমূলক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইয়ুব খান ভয়ভীতি ও প্রশাসনিক যন্ত্রের ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে চট্টগ্রাম থেকে আইয়ুব খান ১১৩১ ভোেট এবং ফাতেমা জিন্নাহ ৯০০ ভােট পান। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এ দুজন প্রার্থী যথাক্রমে ২৩৪ ও ১৪৪ ভােট পান। জাতীয় পরিষদের মতাে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে আইয়ুব সমর্থক প্রতিনিধিরা জবরদস্তি ও ভয়ভীতির মাধ্যমে নির্বাচিত হন। ৬-দফা আন্দোলন ও চট্টগ্রাম। পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও নিরাপত্তা বিষয়ক ৬দফা দাবি সর্বস্তরের সমর্থন লাভ করেছিল। এই ৬-দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে পূর্ব পাবিস্তানের জনগণ যে তীব্র আন্দোলন শুরু করে তারই অংশ হিসেবে ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। আন্দোলনরত চট্টগ্রামবাসী ১৯৬৬ সালের মে মাসে চট্টগ্রাম কারাগার আক্রমণ করলে পুলিশের গুলিতে ৩জন  নিহত ও শতাধিক আহত হন। শান্তিপূর্ণ উপায়ে ৬-দফা আন্দোলন পরিচালিত হবে বলে ঠিক করা হলেও দেশের অন্যান্য স্থানের মতাে চট্টগ্রামেও তা শেষ পর্যন্ত আর শান্তিপূর্ণ থাকে নি। ৭ জুন চট্টগ্রামে ৬-দফার পক্ষে কার্যকর হরতাল পালিত হয়।  চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ঘােষণা করেন যে পাকিস্তানে প্রত্যক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে চট্টগ্রামবাসী তা বর্জন করবে। এ আহবান অন্যান্য রাজনৈতিক দলও অনুসরণ করে।
 
এ সময়ে চট্টগ্রামের ছাত্রনেতারা স্বায়ত্তশাসন ও ৬-দফার পক্ষে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৮ সালের জুন মাসে চট্টগ্রাম শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হলেও জেলা আওয়ামী লীগ ১৪৪ ধারা ভাঙতে দ্বিধা করে নি। ১৯৬৮ সালের ৮ আগস্ট হতে পুনরায় চট্টগ্রামে ১৪৪ ধারা জারি করলে ছাত্ররা তা ভঙ্গ করে এবং পুলিশ ছাত্রলীগের সৈয়দ আহাম্মদ, ছাত্র ইউনিয়নের আবদুল্লাহ আল নােমান ও শাহ আলমকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১১ ও ১২ আগস্ট এবং শিক্ষা কমিশন রিপাের্ট বাতিলের দাবিতে ১৫ আগস্ট চট্টগ্রামে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ১১ ডিসেম্বর ন্যাপ (ভাসানী) চট্টগ্রামে হরতাল আহ্বান করে। আওয়ামী লীগ এ হরতালে সমর্থন ব্যক্ত করে। এ আন্দোলনে সাংবাদিকরাও শরিক হন। ১৮ ডিসেম্বও দেশের অন্যান্য স্থানের মতাে চট্টগ্রামেও হরতাল পালিত হয়। মূল কথা সারা দেশে আইয়ুবের বিরুদ্ধে যে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল চট্টগ্রামেও তার প্রভাব কোনাে অংশে কম ছিল না। এ আন্দোলনের সূত্র ধরে ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রামে ছাত্র ধর্মঘট ও ১১-দফার সমর্থনে মিছিল হয়। মিছিলে পুলিশ লাঠি চার্জ করে। এর প্রতিবাদে ২২ জানুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট ও ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে হরতাল পালিত হয়।
এ সময় পুলিশের সাথে জনতার ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পুলিশের গুলিতে হাসানুজ্জামান নামে আন্দোলনকারী এক শ্রমিক নিহত হন এবং আহত হন অনেকে। রাজবন্দিদের মুক্তির আন্দোলনের জন্য। ২৬ জানুয়ারি চট্টগ্রামে গঠিত হয় Legal Aid Committee। ২৮ জানুয়ারি এসব হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে যে কালাে দিবস পালিত হয় তাতে চট্টগ্রামের ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীরাও ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেন। ৩১ জানুয়ারি চট্টগ্রামে LAC-এর আহ্বানে শােক দিবস পালন করা হয়। ছাত্ররা ১১ দফাকে আন্দোলনের কেন্দ্রীয় ইস্যুতে পরিণত করে। এ সময় আইয়ুব বিরােধী আন্দোলন চট্টগ্রামে ক্রমান্বয়ে চরম সহিংসরূপ লাভ করে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ১৯৬৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। উত্তেজিত ছাত্রজনতা মুসলিম। লীগ নেতাদের দোকানপাট ভাঙচুরসহ তাদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। ১১-দফাভিত্তিক এ আন্দোলন ও মিছিলে পুলিশ লাঠি চার্জ করে ১১জনকে গ্রেফতার করে। চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতৃত্ব আইয়ুব প্রস্তাবিত গােলটেবিল বৈঠক রাওয়ালপিন্ডির পরিবর্তে ঢাকায় অনুষ্ঠানের দাবি জানায়। এসময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘােষণা করেন। মার্চে চট্টগ্রামবাসী জিন্নাহ পার্কে শহিদমিনার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। ইতােমধ্যে জেনারেল আইয়ুব খান প্রবল গণবিক্ষোবে মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
 
১৯৭১ সাল এবং চট্টগ্রাম
 
স্বাজাত্যবােধ ও স্বাধিকার চেতনা এবং সংগ্রামী ঐতিহ্যের এই ধারা পাকিস্তান। আমলের পুরাে সময়েও সমানভাবে বিদ্যমান ছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে চট্টগ্রামও গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিল। সংগ্রামী চেতনা ও ঐতিহ্যের এই ধারাবাহিকতায় এসে উপনীত হয় বাঙালির জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ও ঐতিহাসিক বছর ১৯৭১। এই মহত্তম বছরেও চট্টগ্রাম তার ঐতিহ্যগত সাহসী এবং পথিকৃতের ভূমিকা পালনে বিরত থাকে নি। মার্চ মাসের দেশব্যাপী রাজনৈতিক আন্দোলন এবং সশস্ত্র প্রস্তুতিপর্বে চট্টগ্রামবাসীও বিপুল উৎসাহ-উণ্ডীপনার সাথে অংশগ্রহণ করে। সেইসঙ্গে চট্টগ্রামে অবস্থানরত বাঙালি সেনা অফিসারবৃন্দও অত্যাসন্ন সশস্ত্র বিদ্রোহের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে থাকেন। তবে এই মাসের ২৩ ও ২৪ তারিখে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সুপরিকল্পিত কূট উদ্দেশ্য সাধনে ‘সােয়াত’ নামক জাহাজে আনীত অস্ত্রশস্ত্র নামানােকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের আপামব শ্রমিক জনতার সমন্বিত রক্তক্ষয়ী প্রতিরােধ স্বাধীনতার জন্য আমাদের সশস্ত্র জনযুদ্ধের সূচনা লগ্নে এক উল্লেখযােগ্য মাইলফলক। এই ঘটনায় ২০জন নিহত হন। আধুনিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে লাঠি-বর্শাবন্দুকধারী লড়াকু শ্রমিক জনতার সে প্রতিবােধ উপাখ্যানের নায়ক ছিলেন প্রায় ২৫ হাজার মানুষ (আজাদী ১৯৯৫: ৪৬)। উত্তুঙ্গ স্বাধীকার চেতনায় উদ্বুদ্ধ অকুতােভয় হাজারাে জনতা ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক নৃশংসতা শুরুর পূর্বপর্যন্ত আলােচ্য অস্ত্র খালাসের বিরুদ্ধে সােচ্চার প্রতিবাদ এবং দৃঢ় ও রক্তে রঞ্জিত প্রতিরােধ গড়ে তুলেছিল। এর পাশাপাশি সেই কালরাতে ইপিআর-এর ক্যাপটেন রফিক এবং ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়া পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে চট্টগ্রামে স্বাধীনতা সংগ্রামের সশস্ত্র অধ্যায়ের সূচনা করেন। ২৬ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ছাত্র জনতা সমভিব্যাহারে প্রশিক্ষিত সৈন্যের কনভেনশনাল পদ্ধতিতে প্রতিরােধ যুদ্ধ সূচিত হয় এখান থেকেই।
 
সে রাত থেকেই বৃহত্তর চট্টগ্রামের ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে এই প্রতিরােধ যুদ্ধের ইতিহাস রচিত হতে থাকে এবং তা অব্যাহত থাকে ১৯৭১ সালের ২ মে পর্যন্ত। এ অসাধারণ প্রতিরােধযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল কুমিরার যুদ্ধ, কালুরঘাটের যুদ্ধ, হালিশহরের যুদ্ধ, কোর্টহিলের যুদ্ধ, মহালছড়ির যুদ্ধ, রামগড়ের যুদ্ধ, মিরসরাইয়ের যুদ্ধ, শুভপুর সেতুর যুদ্ধ ইত্যাদি অসংখ্য যুদ্ধ। এইসব ঐতিহাসিক প্রতিরােধ যুদ্ধসমূহের আলােচনা রয়েছে এই গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে প্রতিরােধযুদ্ধ পর্বে। বাস্তবিক, এজন্যই সম্ভবত পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী তার How Pakistan Got Divided গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, ‘চট্টগ্রাম ছিল সবচেয়ে সংকটপূর্ণ ও বিপজ্জনক এলাকা বা মিলিটারি অ্যাকশনের ক্ষেত্রেও ‘চট্টগ্রামকে সবচেয়ে সংকটময় এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। (রাও ফরমান আলী ১৯৯৬: ৮৪, ৮৮)। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই জেনারেলের ভূমিকা সম্পর্কে প্রতিটি বাঙালিরই জানা। সুতরাং অভিজ্ঞতার আলােকে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে চট্টগ্রাম সম্পর্কে তার করা এই মন্তব্য অবশ্যই প্রণিধানযােগ্য।
স্বাধীনতার লক্ষ্যে রচিত প্রতিরােধের প্রথম প্রহরে উপযুক্ত সশস্ত্র যুদ্ধ ব্যতীত অন্যতম শ্রেষ্ঠ দুটি ঐতিহাসিক ঘটনা চট্টগ্রামের সংগ্রামী ঐতিহ্যকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। সেই সাথে এও বুঝিয়ে দেয় ব্রিটিশ ভারতে অসহযােগ আন্দোলনের সময় এখানকার আন্দোলনের গতি, ব্যাপ্তি ও শক্তি দেখে মহাত্মা গান্ধী তার তরুণ ভারত’ সাপ্তাহিকে যথার্থই চট্টগ্রাম সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, “চট্টগ্রাম সবার আগে (Chittagong to the fore!” (উদ্ধৃত পূর্ণেন্দু দস্তিদার ১৩৯৭: ৩৯)। স্বাধীনতা যুদ্ধে চট্টগ্রামের অন্যতম দুটি শ্রেষ্ঠ ঘটনার একটি চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র। থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে মেজর জিয়ার কণ্ঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘােষণা প্রচার (বাংলাপিডিয়া: খণ্ড ৮, ২০০৩ : ২০৫) এবং অন্যটি: স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র চালুকরণ (বাংলাপিডিয়া: খণ্ড ১০, ২০০৩: ৩১৫)। এই দুটি ঐতিহাসিক ঘটনা সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য ইতােমধ্যে সামগ্রিকভাবে প্রস্তুত দেশবাসীকে আরও উদবুদ্ধ এবং মরণপণ লড়াইয়ের জন্য সাহসী, ঐক্যবদ্ধ ও নিবেদিতপ্রাণ করেছিল। এভাবে সংগ্রামী ঐতিহ্যেও ধারবাহিকতায় চট্টগ্রাম আবারও তার যথাযথ ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে রচনা করেছিল নতুনতর ইতিহাস। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের সময়েও চট্টগ্রাম তার ঐতিহ্যবাহী সাহসী ভূমিকা; বহমান রেখেছিল। 

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড