বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৬শে জুন, বৃহস্পতিবার, ১২ই আষাঢ়, ১৩৮১
ঢাকায় পাকিস্তানের মহামান্য অতিথি
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব জুলফিকার আলি ভূট্টো আজ ঢাকা আসছেন। গত এপ্রিল মাসের লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামিক শীর্ষ বৈঠকের প্রাক্কালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনাব ভুট্টোকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। তিনি সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং আজই আমরা একজন সম্মানী নতুন মেহমানকে অভ্যর্থনা জানাব। দুই প্রধানমন্ত্রী আলোচনায় দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক বিষয়াদি গুরুত্ব পাবে বলে বাংলাদেশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন জানিয়েছেন। উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি অর্জনের দুই দেশের কর্তব্যের প্রশ্নটিও তাদের আলোচনায় স্বাভাবিকভাবেই এসে যাবে। কী পটভূমিকায় দুই দেশের দুই প্রধান মন্ত্রীর ঢাকা বৈঠকে বসেছেন তার আদি-অন্ত নিয়ে আমরা আলোচনা করবো না। কারণ এর দূর-অতীত যেমনি তিক্ত এর ভবিষ্যৎ তেমনি সম্ভাবনাময়। ১৯৭৪ সাল ১৯৭১ সাল নয়, এ সত্যটা মেনে নিয়েই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় আসছেন। ’৭১ যে ’৫৮ নয়, এ সত্যটা একাত্তরে মেনে নিলে দু’দেশের দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষগুলি অনেক তপ্ত অশ্রু, অহেতুক রক্তপাত, অজস্র বেদনাপীড়িত স্মৃতি এড়িয়ে যেতে পারত। তা হয়নি। হয়নি বলে কোনদিন হতে পারবে না। এমন কথা নেই। ইতিহাস তার প্রতিশোধ কখন কিভাবে গ্রহণ করে সমকালে দাঁড়িয়ে তার বিচার করা কঠিন।
ঢাকা আলোচনায় অনেক বিষয়ের মধ্যে যে বিষয়গুলি আসবে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে দায়-দেনা ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। এছাড়া রয়েছে একটি বড় মানবিক প্রশ্ন। লাখ লাখ অবাঙালি পাকিস্তানি নাগরিক। তারা আজ সত্যিই বড় নিঃস্হায়। গরিব বাংলাদেশ, জনপ্রবল বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিয়েছিল। জীবিকা দিয়েছিলো। দিয়েছিলো শান্তির নীড় গড়ে তোলার সকল সুযোগ। তারা তা গ্রহণ করেনি। তারা নিজেদেরকে পাকিস্তানি বলে ভাবতে শিখে ছিল। গর্ব নিয়ে ভরসা নিয়ে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব দাবি করেছিল। আজ পাকিস্তান তাদের গ্রহণ করবেন কি করবেন না সে সম্পর্কে চূড়ান্ত মীমাংসার দিন এসে গিয়েছে। মুজিব-ভুট্টো আলোচনায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে। এই মানবিক সমস্যার মীমাংসার জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী কতটা উদার সাহসিকতার পরিচয় দিতে পারবেন পর্যবেক্ষক মাত্রেই সেদিকে লক্ষ্য রাখছেন।
সমস্যা হিসেবে এগুলোর তেমন জটিল নয়। জটিলতার সমস্যাগুলো মীমাংসা ইতিপূর্বে করা গেছে। এগুলো উপমহাদেশের নতুন বাস্তবতা অবশিষ্ট সমস্যা। এবং ঢাকায় দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী বৈঠক সমাধানের জন্য অবদান রাখতে পারবে বলে আমরা আশা রাখি। এবং এই আলোচনার সাফল্য নির্ভর করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী কয়েকটি সাধারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সাহসিকতার ওপর, সদিচ্ছার ওপর।
পরমাণু বিস্ফোরণ নিষিদ্ধকরণ
কোন রকম দুর্ঘটনা না ঘটলে আজ থেকেই শুরু হবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরকালে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জিরাল্ড ওয়ারেন বলেছেন যে, ২৮ই শে জুন প্রথম চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে এবং শেষ চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হবে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের মস্কোর ত্যাগের প্রাক্কালে। শেষোক্ত চুক্তিটি হবে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক বিস্ফোরণ নিষিদ্ধকরণ সম্পর্কে।
প্রেসিডেন্ট নিক্সনের বর্তমান মস্কো সফর যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এতে কোন সন্দেহ নেই। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ১৯৭২ সালের মে মাসেও একবার সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেছিলেন। এরই মধ্যে প্রায় দুই বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। দু’বছর সময়ের ব্যবধানে অনেক ঘটনার জন্ম হয়েছে। ইতিহাস আপন গতিতে এগিয়ে চলেছে। ইতিহাসের গতিধারায় একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, আণবিক ও পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যাপক প্রসার বিশ্বসভ্যতাকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। কাজেই সমগ্র মানব জাতির কল্যাণে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা খেলা বন্ধ করা উচিত। প্রশ্ন হল বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? অতীতের ঘটনায় একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, ঘন্টা বাজতে কেউ এগিয়ে আসেননি। তাই দেখা গেছে, কোন ১৯৬৩ সালে পারমাণবিক পরীক্ষা সীমিতকরণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পরও অনেকবারই আণবিক বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। সাম্প্রতিক এক হিসেবে দেখা গেছে চলতি অর্থবছরে ১৪টি রাশিয়া, ৯টি যুক্তরাষ্ট্র, ৫টি ফ্রান্স ও ভারত একটি বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এছাড়াও গণচীন এবং ব্রিটেনও রয়েছে। ব্রিটেনের নেভাদা মরু গর্ভে উদযান বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাপানের নাগাসাকি ও হিরোশিমা শহরে আণবিক বোমা বিস্ফোরণের ফলে প্রভূত পরিমাণ যে ক্ষয়ক্ষতি হয় তার বেশ এখনো কেটে যায় নি। জাপানের মানুষ তাই আজ আণবিক ও পারমাণবিক অস্ত্রের নাম শুনলে আঁৎকে ওঠে। কারণ ওদের সৃষ্টির পথ থেকে এখনো ভয়াবহ ধ্বংসলীলার স্মৃতি মুছে যায়নি।
জাপান কেন সমগ্র বিশ্বের শান্তিকামী মানুষই চায় যে, পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা সমাপ্তি ঘটুক। জাতিসংঘও এ ব্যাপারে এগিয়ে এসেছে। অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করার স্বপক্ষে জাতিসংঘও রায় দিয়েছে। এতদ্বসত্ত্বেও এখন পর্যন্ত আণবিক ও পারমাণবিক শক্তি সঞ্চয় প্রবণতা হ্রাস পায়নি।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন আণবিক বা পারমাণবিক অস্ত্র সীমিতকরণ এর প্রশ্নের সাগ্রহে এগিয়ে এসেছে ইতিপূর্বে অনেকবার। কিন্তু এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তেমন সাড়া দেয়নি। এমনকি গণচীনও এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করে আসছে। এ অবস্থার পটভূমিতে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের মস্কো সফর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
প্রেসিডেন্ট নিক্সনের মস্কোর সফরের পর ভূ-গর্ভস্থ পারমাণবিক বিস্ফোরণ নিষিদ্ধকরণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে বলে যদি ধরে নেয়া যায়। তবু এরপর কথা থাকে। আর তা হলো কাগজে পত্রে লিখিত চুক্তির উপরই সব কিছু নির্ভরশীল নয়। আসল কথা হলো বিশ্ব শান্তির স্বপক্ষে কার কতখানি আগ্রহ রয়েছে তারই উপর চুক্তির ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক