You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভারতের সাথে চুক্তিঃ সোভিয়েতের যুদ্ধ এড়াবার চেষ্টা
নিউ ইয়র্ক টাইমস, ১৩ আগস্ট, ১৯৭১, শুক্রবার
রচনায় ট্যাড জুল, নিউ ইয়র্ক টাইমসের বিশেষ সংখ্যা

ওয়াশিংটনঃ ১২ই অগাস্ট, যুক্তরাষ্ট্রের কিছু সরকারী কর্মকর্তা বলেছেন যে তারা ধারনা করছেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ৩ দিন আগে অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে ভারতের সাথে যে মৈত্রীচুক্তিতে সাক্ষর করেছে তার মাধ্যমে তারা ভারতে নিরুতসাহিত করতে সফল হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষনা দিতে।

ভারত এখন পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে যে বিলম্ব করছে, তার মুল্য হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী আন্দ্রেই এ গ্রমিকোর উপস্থিতিতে ২০ বছরের শান্তি, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার একটি চুক্তি নিউ দিল্লীতে সাক্ষরিত হয়। মাত্র দুইদিনের নোটিসে মিঃ গ্রোমিকো এ চুক্তিতে সাক্ষর করার জন্য সাপ্তাহিক ছুটির মধ্যেই ভারতের রাজধানীতে গমন করেন।
সোমবার প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে দেয়া ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টে বলা হয় যে, সোভিয়েত ইউনিয়নকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে ভারত সরকার যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় তবে তা পাকিস্তান ও ভারত মধ্যে যুদ্ধের সুচনা করবে।

দমন-নিপীড়নের শুরু ২৫শে মার্চঃ
বাংলাদেশ নামটি ভারতের সমর্থনপুষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদী বাঙ্গালি জনগনের দাওয়া। ২৫শে মার্চ থেকেই পাকিস্তান এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ঠেকাতে মিলিটারি অভিযান চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের গৃহীত অনুমান অনুযায়ী ইতিমধ্যে এই মিলিটারি হামলায় ২ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছেন এবং ৭ লক্ষের বেশি শরণার্থী হিসেবে দেশ ত্যাগ করেছেন।

পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, তাতে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কে প্রচণ্ড উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। এর জন্য অনেকাংশে দায়ী ভারতের উপর চেপে বসা লক্ষ লক্ষ শরনারথীর দায়। দুই দেশ একে অপরকে ইতিমধ্যে যুদ্ধের হুমকিও দিয়েছে।

ওয়াশিংটনের রিপোর্ট বলছে যে ভারত গত সপ্তাহের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নকে জানিয়েছিল যে তারা ৯ অগাস্ট বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের নেতাদের দল পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতে অবস্থান করছে। জানা যায় যে, গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের সমর্থনপুষ্ট।

রিপোর্ট অনুযায়ী স্বীকৃতি দেয়ার এই পরিকল্পনা গত ২রা অগাস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নে নিযুক্ত ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদুত এবং বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ দুত হিসেবে কর্মরত শ্রী দুর্গা প্রসাদ ধরের মাধ্যমে মস্কোতে জানানো হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিভাগ ও কুটনৈতিক বিভাগের রিপোর্ট অনুযায়ী মিঃ গমিকো শ্রী ধরকে বলেছেন ভারতের আরো সাবধানী হওয়া প্রয়োজন এবং বাংলাদেশের স্বীকৃতি একটি যুদ্ধাবস্থার অবতারনা করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যসুত্রমতে, পরবরতী ধাপ হিসেবে মিঃ গোমিকো অনতিবিলম্বে নয়া দিল্লীতে গমন করে শ্রীমতী গান্ধী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী শরন সিং এর সাথে আলোচনা করার প্রস্তাব দেন। গত শুক্রবার এই ভ্রমনের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দাওয়া হয় এবং মিঃ গোমিকো রবিবার পৌছান।

রিপোর্ট অনুযায়ী মিঃ গমিকো ভারতীয় প্রতিনিধিকে মস্কোতেই জানিয়েছিলেন যে তিনি এই মুহূর্তে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে শ্রীমতি গান্ধিকে নিরুৎসাহিত করবেন, এবং প্রয়োজনে যেকোন ধরনের চাপ প্রয়োগ করতে পারেন।

যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যসুত্রমতে, পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ শুরু হলে ভারতকে যেকোন বাড়তি আর্থিক ও সৈন্য সহায়তা দিতে মস্কো প্রস্তুত আছে। কিন্তু একি সাথে তারা ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু হয় এমন কোন বেপরোয়া পরিস্থিতি তৈরি করা থেকে ভারতকে বিরত করতে বদ্ধপরিকর।

কর্মকর্তারা আবারো স্মরন করিয়ে দিয়েছেন যে, প্রেসিডেন্ট আগা মোঃ ইয়াহিয়া খান সম্প্রতিই ঘোষণা দিয়েছেন যে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাকা দাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। তিনি বলেন যে যদি ভারত অবৈধ ভাবে রাজ্যকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামীদের সাহায্য করে তবে পাকিস্তান এটাকে ভারতের হামলা বলে ধরে নিবে এবং তারা যুদ্ধের ডাক দিবেন।

সম্প্রতি, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যের বৈরিভাব কমাতে ও যুদ্ধাবস্থাকে প্রশমিত করতে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চায়না, সকলেই কাজ করে যাচ্ছে। ওয়াশিংটন সকলের সম্মুখেই দুই দেশকে নিজেদের নিয়ন্ত্রন করার পরামর্শ দিয়েছে।

কুটনৈতিকদের রিপোর্ট অনুযায়ী, পাকিস্তানের বন্ধুরাষ্ট্র চায়নাও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে সাবধানতার সাথে আগানোর পরামর্শ দেন। আমেরিকান অফিসিয়ালরা ধারনা করছেন যে মিঃ গোমিকো এই মৈত্রীচুক্তি সাক্ষর করতে সম্মতি দিয়ে ভারতের মতপরিবর্তন করাতে সক্ষম হয়েছেন। এই চুক্তিটি বেশ কয়েক মাস ধরেই আলোচিত হচ্ছিল, কিন্তু মস্কো এত দ্রুত এ চুক্তিতে সাক্ষর করতে প্রস্তুত ছিলনা।

কর্তৃপক্ষীয় সুত্র থেকে জানা যায় যে, পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধের যে পটভুমি তৈরি হয়েছে তাতে ভারত ও এ চুক্তিতে সাক্ষর করতে একবাক্যে সম্মত হয়েছে। ১৯৬৫ সালে দুই দেশের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়। ভারত তার বর্তমান নিরাপত্তা হিসেবে এই সোভিয়েত চুক্তিকে গন্য করছে বলে ধারনা করা হচ্ছে। সোভিয়েতদের মধ্যস্থতার মাধ্যমেই ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের অবসান ঘটেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে নতুন করে অর্থ ও সামরিক সাহায্য করবে কিনা তা এখনও জানা যায়নি।

যুক্তরাষ্ট্র অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানা যায় যে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার পরিকল্পনা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে আগে থেকে কিছু জানায়নি এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন এ তথ্য ওয়াশিংটনে পাঠানোর কোন উদ্যোগ নেয়নি।

এ অধিদপ্তরের মুখপাত্র মিঃ রবার্ট জি ম্যাকগলস্কি আজ বলেছেন যে ভারত-পাকিস্তানের বিবাদের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন এর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কোন যোগাযোগ হয়নি। আজকের সংবাদ ব্রিফিং এর সময় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি একথা বলেন এবং তিনি সেখানে কোন গোয়েন্দা প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করেননি।

ভারত সরকার গতকাল তার অবস্থান বদল করে স্টেট ডিপার্টমেন্ট সচিব উইলিয়াম পি রজারসকে জানিয়েছে যে এটি শুধুই একটি নতুন চুক্তি ও মৈত্রীগঠন। ভারতের রাষ্ট্রদূত লক্ষীকান্ত ঝা এ প্রতিবেদন মিঃ রজারস এর কাছে নিয়ে যান এবং তিনি তা গ্রহন করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাগণ আশংকা করছেন যে নিউ দিল্লী যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টি স্থগিতও রাখে, তবুও অদুরভবিষ্যতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এ বিবাদের শেষ হওয়ার সম্ভাবনা কম।

গোয়েন্দা বিভাগ আরো বলছে যে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দেয়া এবং গেরিলাদের আরও বেশি সাহায্য করার জন্য সংসদ সদস্যগন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে চাপ দিয়ে যাচ্ছে।

গেরিলাদের কর্মকাণ্ড ও শরণার্থী সমস্যা যত বৃদ্ধি পাবে, এই চাপ ততই আরো বেড়ে যাবে বলে মনে হয়।

পুরব পাকিস্তানের এ সমস্যার সমাধান তখনি হবে যখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এ প্রদেশে স্বায়ত্তশাসন অনুমোদিত করবেন, এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রও ভারতের সাথে একমত। প্রশ্ন হচ্ছে, এরকম একটি গেরিলা যুদ্ধের মধ্যে কোন প্রেসিডেন্ট তা করবে?

মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগঃ

নিউ দিল্লী, ১২ই অগাস্ট (রয়টার্স) আজ ভারতীয় একজন নেতা তার দেশ ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের সাথে বিসবাসঘাতকতা করেছে বলে অভিযোগ করেন।

জনসঙ্ঘ পার্টির ডানপন্থীদের নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ী আজ একটি র‍্যালীতে বলেন যে আজকে সোভিয়েত-ভারত ইস্যুতে বাংলাদেশের কোনোই উল্লেখ নেই। মিঃ বাজপেয়ী বলেন, বরং এ চুক্তি পাকিস্তানের সকল লোকের স্বার্থরক্ষার কথাই বলছে। তিনি ঘোষণা দেন যে এটি আসলে বাংলাদেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা এবং পাকিস্তানের অখন্ডতাকে সমর্থনের সামিল।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!