You dont have javascript enabled! Please enable it! কুষ্টিয়া যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক

কুষ্টিয়া যুদ্ধ
মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্বে কুষ্টিয়ার সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থান ইতিহাসের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে। কুষ্টিয়ায় উত্তাল জনতার গণবিদ্রোহ যাঁরা সেদিন সচক্ষে দেখেছেন, তারা আমার সাথে একমত হবেন—এত বিদ্রোহ কেউ কখনাে দেখেননি। হাজার হাজার জনতা ঢাল, সুড়কি, বল্লম নিয়ে যুদ্ধ শুরু করার প্রস্তুতি নিল। গগনবিদারি ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠল। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাহসী তরুণেরা ও বাঙালী সৈনিকেরা অমিত তেজে অসীম সাহসিকতার সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হল। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা ধরে যেসব মুক্তিযােদ্ধারা সেদিন স্বাধীনতার জন্য আত্মবলিদানের মহান প্রত্যয়ে, সুমহান দেশ প্রেমের অঙ্গিকারে সংগ্রামী মানুষের কাতারে সামিল হয়েছিলেন—ইতিহাসে তাদের অনেকের নামই কখনাে উল্লেখ থাকবে না। তবুও সেই মহাজাগরণের অবিস্মরণীয় মুহূর্তে জাতির ক্রান্তিলগ্নে, দেশের চরম দুর্দিনে অস্ত্র হাতে যারা লড়াই করেছিলেন—ইতিহাস ব্যর্থ হলেও তারা অনাদিকাল পর্যন্ত বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবেন।
| পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধ পরিকল্পনা অপারেশন সার্চ লাইট’ অনুসারে ২৫শে মার্চ রাতে যশাের সেনানিবাস থেকে ১৭ বেলুচ রেজিমেন্টের এক কোম্পানী সৈন্য কুষ্টিয়া শহরে এসে অবস্থান গ্রহণ করে। পাকবাহিনী কুষ্টিয়া শহরে ত্রিশ ঘন্টার জন্য সান্ধ্য আইন জারি করে এবং টহল দিতে থাকে।
পাকসেনাদের অধিনায়ক ছিল মেজর শােয়েব। ক্যাপ্টেন শাকিল, ক্যাপ্টেন সামাদ ও লেঃ আতাউল্লাহ শাহ্ মেজর শায়েবের অধীনস্থ অফিসার হিসেবে এই কোম্পানীর সাথে কুষ্টিয়ায় অবস্থান করছিল। পাকবাহিনীর সঙ্গে ছিল ১০৬ এম. এম. জীপ আরােহিত রিকয়েলেস রাইফেল, ভারী ও হালকা চাইনিজ মেশিনগান, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, শক্তিশালী বেতার যন্ত্র এবং প্রচুর পরিমাণে গােলাবারুদ। ২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনী কর্তৃক ইপিআর বাহিনীর আক্রান্ত হওয়ার খবর এবং কুষ্টিয়ায় পাকসেনাদের আগমনের খবর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
ইপিআর (বর্তমানে বিডিআর)-এর যশাের সেক্টরের নিয়ন্ত্রণাধীনে ৪ নং উইং-এর সদর দপ্তর অবস্থিত ছিল চুয়াডাংগা মহকুমা শহরে। মেজর এম এ ওসমান চৌধুরী (বাঙালির বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত লেঃ কর্নেল) ৭১ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বদলি হয়ে উইং কমাণ্ডারের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ক্যাপ্টেন এ এম আযম চৌধুরী (বাঙালি, বর্তমানে লেঃ কর্নেল) ও ক্যাপ্টেন সাদেক (পাঞ্জাবী) সহকারী অধিনায়ক ছিলেন। পাঁচটি কোম্পানী ও একটি সাপাের্ট প্লাটুনের সমন্বয়ে গঠিত ছিল ৪নং উইং। প্রত্যেকটি কোম্পানী প্রয়ােজনীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল। একটি কোম্পানীতে পাঁচটি হালকা ট্যাংক বিধ্বংসী কামান, সাতটি হালকা মেশিনগান, একটি মেশিনগান এবং বাকী ৩০৩ রাইফেল ছিল। উইং সদর দপ্তরে এক কোম্পানী সৈন্য ছাড়াও ছয়টি ৩ ইঞ্চি মর্টার ও ২০০ চাইনিজ স্বয়ংক্রিয় রাইফেল ছিল। এছাড়া একটি ব্যাটালিয়ন যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য গােলাবারুদ ও যানবাহন ৪ নং উইং-এ জমা ছিল।।
৪ নং উইং-এর পাঁচটি কোম্পানীর অবস্থান ছিল নিম্নরূপ :এক ও প্রাগপুর এলাকা—‘এ’কোম্পানী। কমাণ্ডার ঃ সুবেদার মােজাফফর আহমদ।
দুই ঃ ধােপখালী এলাকা—‘বি’কোম্পানী। কমাণ্ডার সুবেদার খায়রুল বাশার খান। তিন ঃ বৈদ্যনাথতলা (মুজিব নগর) ‘সি’কোম্পানী। কমাণ্ডার ও সুবেদার মুকি।। চার ও যাদবপুর এলাকা—‘ডি’ কোম্পানী। কমাণ্ডার ঃ সুবেদার মজিদ মােল্লা। পাচ ও উইং সদর দপ্তর-‘ই’ কোম্পানী। কমাণ্ডার ঃ সুবেদার-রাজ্জাক।
এছাড়া সিগন্যাল প্লাটুন হাবিলদার মুসলেম উদ্দিনের অধীনে উইং সদর দপ্তরে অবস্থান করছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, উইং কমাণ্ডার মেজর এম এ ওসমান চৌধুরী, পাঁচজন কোম্পানী কমাণ্ডার, সিগন্যাল প্লাটুন কমাণ্ডার ও সাপাের্ট প্লাটুন কমাণ্ডার সবাই বাঙালি ছিলেন। সাধারণ সৈনিকরাও প্রায় সবাই বাঙালি ছিলেন।
মেজর ওসমান চৌধুরী ২৫শে মার্চ রাতে সস্ত্রীক কুষ্টিয়া সার্কিট হাউজে অবস্থান করছিলেন। ২৬শে মার্চ সকাল ১০টায় সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা বেতার থেকে নতুন নতুন সামরিক বিধি জারী করতে থাকে। অবিলম্বে মেজর ওসমান ঝিনাইদহ হয়ে চুয়াডাংগার পথে যাত্রা করেন। তিনি বেলা সাড়ে এগারােটা নাগাদ ঝিনাইদহ পৌছলে উত্তাল জনতা তাঁর জীপ ঘিরে ধরে। জনতাকে সশস্ত্র প্রতিরােধের জন্য আহ্বান জানিয়ে তিনি চুয়াডাংগার দিকে অগ্রসর হন। মেজর ওসমান বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া পীলখানায় মমান্তিক ঘটনার বিবরণ জানতে পারলেন। হাবিলদার মেজর মজিবর রহমান (শহীদ) এর আগে কোন নির্দেশ ছাড়াই কৌশলে সদর দপ্তরের সমস্ত অস্ত্র অস্ত্রাগার থেকে অন্যত্র নিরাপদ স্থানে সরিয়ে রেখেছিলেন। শহরের ছাত্র, শ্রমিক ও মেহনতি জনতা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার জন্য প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছিল। ইপিআর-এর বাঙালি সৈনিকেরা সচেতন বাঙালি হিসেবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তৈরি ছিল। স্বদেশের জন্য জীবন দেয়ার উন্মাদনা সৈনিক ও জনতার মধ্যে সৃষ্টি করেছিল এক অবিচ্ছেদ্য যােগসূত্র।
মেজর ওসমান চৌধুরী পরিস্থিতি সম্যক উপলব্ধি করে ২৬শে মার্চ চুয়াডাংগা পৌছেই এক জরুরি সভা ডাকলেন। ক্যাপ্টেন এ আর আযম চৌধুরী, ডাঃ আসহাবুল হক, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও পুলিশ কর্মকর্তাগণ এই সভায় উপস্থিত ছিলেন। ঢাকার পরিস্থিতি, হানাদার বাহিনর অঘােষিত যুদ্ধ ও গণহত্যা পর্যালােচনা করে এই সভায় এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। হানাদার বাহিনীর হাত থেকে দেশকে মুক্ত করে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার দৃঢ় শপথ গ্রহণ করা হয়। ঐদিন বেলা আড়াইটার সময় হাজার হাজার জনতার উপস্থিতিতে মেজর ওসমান চৌধুরী বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। ইপিআর-এর বাঙালি সৈনিকেরা পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশের পতাকার সার্বিক অভিবাদন জানায়।
| ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরী সকল বাধা বিপত্তিতেও বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার নির্দেশ দেন। চুয়াডাংগা-যশােহর সড়ক, দামুবহুদা-চুয়াডাংগা ও জীবন নগর সড়কে ব্যারিকেড তৈরি করা হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করা হয়।
| ২৭শে মার্চ সকালে যাদবপুর অবস্থানরত কোম্পানী কমাণ্ডার সুবেদার আবদুল মজিদ মােল্লা অয়ারলেসে মেজর ওসমান চৌধুরীকে জানালেন যে, পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেন সাদেক মাসলিয়া বিওপিতে এসেছে। মেজর ওসমান ক্যাপ্টেন সাদেকের প্রতি দৃষ্টি রাখার নির্দেশ দেন। ক্যাপ্টেন সাদেকও বাঙালি ইপিআর সৈনিকদের নিরস্ত্র করার জন্য মাসলিয়া বিওপিতে প্রবেশ করে। ক্যাপ্টেন সাদেকের সাথে কয়েকজন অবাঙালি সৈনিক ছিল কিন্তু তার ড্রাইভার ছিল বাঙালি। ক্যাপ্টেন সাদেক যাদবপুর কোম্পানী সদর দপ্তরে এসে বাঙালি
গার্ডের সাথে অশােভন আচরণ করলে সংঘর্ষ শুরু হয়। ক্যাপ্টেন ওসমান প্রশাসনিক বিষয়, সামরিক ও বেসামরিক সিদ্ধান্ত এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যােগাযােগ স্থাপন ও রাজনৈতিক সমর্থনের জন্য একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন। ডাঃ আসহাবুল হক সংসদ সদস্য, এডভভাকেট ইউনুস আলী ও ব্যারিষ্টার বাদল রশীদ এর উপদেষ্টা ছিলেন। উপদেষ্টা পরিষদের সাথে আলােচনা ক্রমে কুষ্টিয়া জেলা শত্রু মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। মেজর ওসমান সীমান্তে অবস্থানরত সব ইপিআর সৈনিকদেরকে চুয়াডাংগা সদর দপ্তরে সমবেত হওয়ার নির্দেশ দিলেন এবং প্রাগপুরের কোম্পানী কমাণ্ডার—সুবেদার মােজাফফরকে কুষ্টিয়ার পথে অভিযান শুরু করার আদেশ দিলেন।
কুষ্টিয়া শহরে পাকবাহিনী তখন তিন জায়গায় অবস্থান করছিল ঃ কুষ্টিয়া জেলা স্কুল, পুলিশ লাইন ও অয়ারলেস স্টেশন। তিন দিক থেকে একই সময়ে যুগপৎ তিনটি পাকঘাঁটির ওপর প্রবলভাবে আক্রমণ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরীকে জেলা স্কুলে অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্যদের আক্রমণ করতে আদেশ দেয়া হয়। এবং নায়েব সুবেদার মনিরুজ্জামানকে (শহীদ) ওয়ারলেস স্টেশন আক্রমণ করতে আদেশ দেয়া হয়।
| মেজর ওসমান চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণাধীন আনুমানিক ৭০০ বাঙালি ইপিআর সৈন্য ছিল। সহস্রাধিক আনসার, মুজাহিদ ও পুলিশ তার বাহিনীর সাথে যােগ দিল। যােগাযােগ রক্ষার জন্য পােড়াদহের খােলা মাঠে একটি একচেঞ্জের মাধ্যমে কুষ্টিয়া যুদ্ধ ক্ষেত্র ও চুয়াডাংগা সদর দপ্তরের সাথে যােগাযােগ রক্ষা করা সম্ভব হল। ডাঃ আসহাবুল হক ফিল্ড চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন ও প্রয়ােজনীয় ঔষধপত্রের ব্যবস্থা করলেন। | ২৮শে মার্চ কুষ্টিয়া আক্রমণের পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি কোম্পানী ঝিনাইদহ পৌছে গেল এবং যশাের-ঝিনাইদহ সড়ক অবরােধ করল। যশাের সেনানিবাস থেকে কুষ্টিয়ার পাকঘাটিতে পাকবাহিনী আসতে চাইলে তা প্রতিহত করাই ছিল এই অবরােধের উদ্দেশ্য। ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরীর নির্দেশ মােতাবেক এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে চুয়াডাংগায় পােড়াদহ কাঁচা রাস্তা ধরে অগ্রসর হতে লাগল। সুবেদার মােজাফফরকে তার কোম্পানীসহ ভেড়ামারা হয়ে কুষ্টিয়া শহরের উপকণ্ঠে অপেক্ষা করতে নির্দেশ দেয়া হল। চুয়াডাংগা সদর দপ্তর রক্ষা করার জন্য প্রায় ২০০ মুক্তিযােদ্ধা বিশ খালিতে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করল। সুবেদার মজিদ মােল্লা দুই প্লাটুন নিয়ে কোর্ট চাদপুরে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিলেন। কালিগঞ্জে প্রায় ২০০ মুক্তিযােদ্ধা। ঝিনাইদহের এস. ডি. পি.ও মাহবুব উদ্দিন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিলেন। তিনি ঝিনাইদহে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধাদের নেতৃত্বে গ্রহণ করলেন।
| ২৯শে মার্চ ভাের ৪ টায় আক্রমণ করার কথা ছিল। গাড়ি দুর্ঘটনার জন্য সুবেদার মােজাফফরের কোম্পানী যথাসময়ে এসে না পৌছতে পারায় ৩০শে মার্চ ভাের ৪ টায় তিন দিক থেকে পাকঘাটিগুল সংযুক্তভাবে আক্রমণ করা হয়। আক্রমণের সাথে সাথে জনগণ গগনবিদারি জয়ধ্বনি দিতে থাকে।
৩০শে মার্চ ভাের ৪ টায় প্রথম সুবেদার মােজাফফরের অধীনস্থ কোম্পানী পুলিশ লাইনের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে একটি বাড়ির তিনতলা থেকে আগত এক কোম্পানী আনসার ও এক কোম্পানী মুজাহিদ এই যুদ্ধে যােগ দেয়। হাজার হাজার মানুষ আক্রমণের সাথে সাথে মুহুর্মুহ ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিতে থাকে। সারাদিন যুদ্ধের পর বিকাল ৫টার দিকে কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে।
গার্ডের সাথে অশােভন আচরণ করলে সংঘর্ষ শুরু হয়। ক্যাপ্টেন ওসমান প্রশাসনিক বিষয়, সামরিক ও বেসামরিক সিদ্ধান্ত এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যােগাযােগ স্থাপন ও রাজনৈতিক সমর্থনের জন্য একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন। ডাঃ আসহাবুল হক সংসদ সদস্য, এডভভাকেট ইউনুস আলী ও ব্যারিষ্টার বাদল রশীদ এর উপদেষ্টা ছিলেন। উপদেষ্টা পরিষদের সাথে আলােচনা ক্রমে কুষ্টিয়া জেলা শত্রু মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। মেজর ওসমান সীমান্তে অবস্থানরত সব ইপিআর সৈনিকদেরকে চুয়াডাংগা সদর দপ্তরে সমবেত হওয়ার নির্দেশ দিলেন এবং প্রাগপুরের কোম্পানী কমাণ্ডার—সুবেদার মােজাফফরকে কুষ্টিয়ার পথে অভিযান শুরু করার আদেশ দিলেন।
কুষ্টিয়া শহরে পাকবাহিনী তখন তিন জায়গায় অবস্থান করছিল ঃ কুষ্টিয়া জেলা স্কুল, পুলিশ লাইন ও অয়ারলেস স্টেশন। তিন দিক থেকে একই সময়ে যুগপৎ তিনটি পাকঘাঁটির ওপর প্রবলভাবে আক্রমণ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরীকে জেলা স্কুলে অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্যদের আক্রমণ করতে আদেশ দেয়া হয়। এবং নায়েব সুবেদার মনিরুজ্জামানকে (শহীদ) ওয়ারলেস স্টেশন আক্রমণ করতে আদেশ দেয়া হয়।
| মেজর ওসমান চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণাধীন আনুমানিক ৭০০ বাঙালি ইপিআর সৈন্য ছিল। সহস্রাধিক আনসার, মুজাহিদ ও পুলিশ তার বাহিনীর সাথে যােগ দিল। যােগাযােগ রক্ষার জন্য পােড়াদহের খােলা মাঠে একটি একচেঞ্জের মাধ্যমে কুষ্টিয়া যুদ্ধ ক্ষেত্র ও চুয়াডাংগা সদর দপ্তরের সাথে যােগাযােগ রক্ষা করা সম্ভব হল। ডাঃ আসহাবুল হক ফিল্ড চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন ও প্রয়ােজনীয় ঔষধপত্রের ব্যবস্থা করলেন। | ২৮শে মার্চ কুষ্টিয়া আক্রমণের পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি কোম্পানী ঝিনাইদহ পৌছে গেল এবং যশাের-ঝিনাইদহ সড়ক অবরােধ করল। যশাের সেনানিবাস থেকে কুষ্টিয়ার পাকঘাটিতে পাকবাহিনী আসতে চাইলে তা প্রতিহত করাই ছিল এই অবরােধের উদ্দেশ্য। ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরীর নির্দেশ মােতাবেক এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে চুয়াডাংগায় পােড়াদহ কাঁচা রাস্তা ধরে অগ্রসর হতে লাগল। সুবেদার মােজাফফরকে তার কোম্পানীসহ ভেড়ামারা হয়ে কুষ্টিয়া শহরের উপকণ্ঠে অপেক্ষা করতে নির্দেশ দেয়া হল। চুয়াডাংগা সদর দপ্তর রক্ষা করার জন্য প্রায় ২০০ মুক্তিযােদ্ধা বিশ খালিতে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করল। সুবেদার মজিদ মােল্লা দুই প্লাটুন নিয়ে কোর্ট চাদপুরে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিলেন। কালিগঞ্জে প্রায় ২০০ মুক্তিযােদ্ধা। ঝিনাইদহের এস. ডি. পি.ও মাহবুব উদ্দিন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিলেন। তিনি ঝিনাইদহে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধাদের নেতৃত্বে গ্রহণ করলেন।
| ২৯শে মার্চ ভাের ৪ টায় আক্রমণ করার কথা ছিল। গাড়ি দুর্ঘটনার জন্য সুবেদার মােজাফফরের কোম্পানী যথাসময়ে এসে না পৌছতে পারায় ৩০শে মার্চ ভাের ৪ টায় তিন দিক থেকে পাকঘাটিগুল সংযুক্তভাবে আক্রমণ করা হয়। আক্রমণের সাথে সাথে জনগণ গগনবিদারি জয়ধ্বনি দিতে থাকে।
৩০শে মার্চ ভাের ৪ টায় প্রথম সুবেদার মােজাফফরের অধীনস্থ কোম্পানী পুলিশ লাইনের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে একটি বাড়ির তিনতলা থেকে আগত এক কোম্পানী আনসার ও এক কোম্পানী মুজাহিদ এই যুদ্ধে যােগ দেয়। হাজার হাজার মানুষ আক্রমণের সাথে সাথে মুহুর্মুহ ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিতে থাকে। সারাদিন যুদ্ধের পর বিকাল ৫টার দিকে কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে।
ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরী তার বাহিনী নিয়ে জেলা স্কুলে অবস্থানরত পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালায়। নায়েব সুবেদার মনিরুজ্জামান (শহীদ) মােহিনী মিলের দিক থেকে অয়ারলেস স্টেশনের উপর আক্রমণ অব্যাহত রাখে।
তিনদিকের যুগপৎ আক্রমণ ও গগণবিদারি জয় বাংলা’ শ্লোগানের ফলে পাকসেনারা মুক্তিযােদ্ধাদের প্রকৃত সংখ্যা অনুমান করতে ব্যর্থ হয়। ঘেরাও অবস্থায় আতংকগ্রস্থ পাকবাহিনীর মনােবল ভেঙ্গে পড়ে এবং দিশেহারা হয়ে পড়ে। সারাদিন যুদ্ধ চলার পর মাত্র ৪০/৫০ জন পাকসেনা জীবিত ছিল। জীবিত পাকসেনারা জেলা স্কুলে সমবেত হওয়ার চেষ্টা করে। পালাবার সময় অনেক পাকসেনা নিহত হয়।
| বিকেল নাগাদ শুধুমাত্র স্কুল ছাড়া সমস্ত শহর মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে আসে। বিজয়ের আনন্দে মুক্তিযােদ্ধারা প্রবল শক্তিতে জেলা স্কুল চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং অবিরাম আঘাত হানতে থাকে।
রাতের অন্ধকারে জীবিত পাকসেনারা ২টি জীপ ও ২টি ডজ গাড়িতে করে ঝিনাইদহের পথে পালাবার চেষ্টা করে। মুক্তিবাহিনী পলায়নের পর পাকসেনাদের শৈলকুপা সেতুর সন্নিকটে এ্যামবুশ করে। মুক্তিযােদ্ধারা শৈলকুপা সেতুটি ধংস করে শূন্যস্থানে বাঁশের চাটাই দিয়ে ঢেকে আলকাতারা দিয়ে রঙ করে পীচ ঢালা রাস্তার মতাে করে রাখে। পলায়নরত পাকসেনাদের গাড়ি দুইটি গর্তের মধ্যে পড়ে গেলে মুক্তিবাহিনী অতর্কিতভাবে আক্রমণ করে। এখানে মেজর শােয়েবসহ বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। অবশিষ্ট পাকসেনা আহত অবস্থায় আশেপাশের গ্রামে পালিয়ে যায়। গ্রামবাসীরা এসব পাকসেনাদের পিটিয়ে হত্যা করে।
৩১শে মার্চ আহত অবস্থায় লেঃ আতাউল্লাহ শাহ ধরা পড়ে। ১লা এপ্রিল কুষ্টিয়া শত্রুমুক্ত হয়। ২রা এপ্রিল চুয়াডাংগায় মেজর ওসমান চৌধুরী তার জবানবন্দি দেন। এই যুদ্ধে মাত্র ৪ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন ও কয়েকজন আহত হন। কুষ্টিয়া বিজয়ের পরে দখল করা সকল অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ চুয়াডাংগা সদর দপ্তরে নিয়ে আসা হয়। ৩রা এপ্রিল ফরাসী টেলিভিশন কর্পোরেশনের একটি ভ্রাম্যমান দল চুয়াডাংগা আসেন। তারা যুদ্ধবন্দি পাকঅফিসার লেঃ আতাউল্লাহ শাহ-এর ছবিসহ দখলকৃত সকল অস্ত্রশস্ত্রের ছবি তােলেন। তেজোদীপ্ত যুদ্ধরত মুক্তিযােদ্ধাদের ছবিও তারা তােলেন এবং মেজর ওসমান চৌধুরীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। এই দিনই পাকিস্তান বিমান বাহিনী চুয়াডাংগায় নেপাম বােমা নিক্ষেপ করে। ফরাসী টেলিভিশন কর্পোরেশনের সদস্যরা বােমা নিক্ষেপের জীবন্ত ছবি গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে এসবই বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে টেলিভিশনে দেখানাে হয় এবং এই চিত্র প্রদর্শনের ফলে বিশ্বে ব্যাপক আলােড়ন সৃষ্টি হয়।
তৌফিক-ই এলাহী চৌধুরী মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক ছিলেন। ২৫শে মার্চেই তিনি পাকিস্তান সরকারের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করেন। ২৯শে মার্চ তৌফিক-ই এলাহী চৌধুরী নদীয়ার জেলা প্রশাসক ও ভারতীয় বিএসএফ বাহিনীর অধিনায়কের সাথে বেতাই সীমান্তে মিলিত হন। সম্ভাব্য ভারতীয় সাহায্য, অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ সরবরাহের বিষয়টি আলােচিত হয়। এই সময় আওয়ামী লীগ নেতা জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ ও ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম ঝিনাইদহে এসে উপস্থিত হন। তৌফিক-ই এলাহী চৌধুরী ও মাহবুবউদ্দিন ঝিনাইদহের (এসডিও) বিএসএফ-এর কর্মকতার সাথে আলােচনা ক্রমে নেতৃদ্বয়ের ভারতে যাবার ব্যবস্থা করেন। পরে দমদম বিমান বন্দরে সামরিক বিমানে চড়ে নেতৃদ্বয় নয়াদিল্লী চলে যান।
এখানে পরিশেষে উল্লেখযােগ্য যে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ানটি ২৭শে মার্চ লেঃ কর্নেল রেজাউল জলিলের (বাঙালি) নেতৃত্বে চৌগাছায় অবস্থান করছিলেন। মেজর ওসমান চৌধুরী এই সময় দু’বার লেঃ কর্নেল রেজাউল জলিলকে বিদ্রোহ করে তার ব্যাটালিয়ানসহ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য অনুরােধ করেন। কিন্তু লেঃ কর্নেল রেজাউল জলিল মুক্তিযুদ্ধে যােগদান না করে ২৯শে মার্চ যশাের সেনানিবাসে তার ব্যাটালিয়ান নিয়ে ফিরে যান এবং অস্ত্র জমা দেন। ব্রিগেডিয়ার আবদুর রহিম দুররানীর প্রথম ইস্ট বেঙ্গলকে নিরস্ত্র করার এই আদেশ সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে এক তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে। ৩০শে মার্চ সকাল ৮ টার সময় প্রথম বেঙ্গলের সৈনিকরা বিদ্রোহ করে এবং অস্ত্রাগার ভেঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র গােলাবারুদ দখল করে। ৭ম ফিল্ড এম্বুলেন্সের বাঙালি সৈনিকেরাও এদের সাথে যােগ দেয়। সারাদিন ধরে যুদ্ধ চলে এবং ৩০/৪০ জন বাঙালি সৈনিক নিহত হয়। সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে আসার সময় লেঃ আনােয়ার শহীদ হন। লেঃ আবদুল হাফিজ (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর) অবশিষ্ট সৈন্যদের নিয়ে বীর বিক্রমে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং মেজর ওসমান চৌধুরীর সাথে যােগ দেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই শােচনীয় পরাজয়ের পর কুষ্টিয়া পুনর্দখলের জন্য সচেষ্ট হয়। আকাশ ও জলপথে যশাের সেনানিবাসে ব্যাপক সৈন্য ও অস্ত্র নিয়ে আসা হয়। এই সময় পাকবাহিনীর একটি দল আরিচা থেকে জলপথে গােয়ালন্দের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাকবাহিনীর অপর একটি দল নগর বাড়ি ঘাটে অবতরনের চেষ্টা করে। মুক্তিবাহিনী সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরােধের চেষ্টা করে কিন্তু সীমিত অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে শেষ রক্ষা করা যায়নি। ১৪ই এপ্রিল নগরবাড়ি ঘাট পাকবাহিনীর দখলে চলে যায়। ১১ই এপ্রিল ভেড়ামারায় মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে পাকবাহিনীর সংঘর্ষ হয়। কিন্তু পাকবাহিনী মেহেরপুরে স্থানান্তর করেন। অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। মুক্তিবাহিনী মেহেরপুর থেকে ভৈরব নদীর তীরে ইছাখালী সীমান্ত এলাকায় চলে যেতে বাধ্য হয়। | বাঙালি জাতির জীবনে ১৭ই এপ্রিল একটি ঐতিহাসিক দিন। এই দিন মেহেরপুর বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বহু দেশীবিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে শপথ গ্রহণ করেন। পলাশীর আম্রকাননে একদিন যে স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়েছিল—আবার সেই সূর্য উদিত হল আর এক আম্রকাননে। এই ঐতিহাসিক স্থানটিকে বাংলাদেশের রাজধানী ঘােষণা করে এর নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। ঐতিহাসিক কারণেই কুষ্টিয়া জেলার মুজিবনগর স্মৃতিময় হয়ে আছে।
| কুষ্টিয়া যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রাথমিক পর্যায়ে একটি বড় ধরনে বিজয়। এই যুদ্ধ জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করে। প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ ও যানবাহন মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। অপর দিকে পাকবাহিনীর মনােবল ভেঙ্গে পড়ে এবং মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে ভীতি ও ত্রাসের সৃষ্টি হয়। মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্বে কুষ্টিয়া বিজয়ে জনগণে সাহস, আত্মবিশ্বাস, উদ্দীপনা আকাশচুম্বী রূপ নেয়। মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের মােকাবেলা করেছে বীরত্বের সঙ্গে। এই এলাকার সাহসী জনগণের নির্ভীক ভূমিকা যুগে যুগে জাতিকে প্রেরণা যােগাবে।
ইতিহাসের পাতায় রক্তাক্ষরে লেখা থাকবে বিজয়ের এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়।
সূত্র – মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন