বাংলার বাণী
ঢাকা : ৮ই নভেম্বর, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৩, ২২শে কার্তিক, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
অক্টোবর বিপ্লব : সংগ্রামী প্রেরণার উৎস
গতকাল ৭ই নভেম্বর ছিলো মহান অক্টোবর বিপ্লব বার্ষিকী। রুশ জনসাধারণ তথা বিশ্বের মেহনতি মানুষের রক্তস্নাত ইতিহাসের একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। বিশ্বের সংগ্রামী মানুষের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এক বাণীতে আমাদের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরীও এদিনকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছেন। তিনি বাণী পাঠিয়েছেন সোভিয়েত প্রেসিডিয়ামের চেয়ারম্যান মিঃ এন.ভি. পদগর্নীর কাছে।
তাঁর শুভেচ্ছা বাণীতে রাষ্ট্রপতি বলেছেন যে, বাংলাদেশের সেই বিভীষিকাময় মুক্তি সংগ্রামের নিবিড় তমসাঘন ক্ষণে মহান সোভিয়েত জনগণ বাংলাদেশকে যে অকুণ্ঠ সাহায্য, সমর্থন ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, তা বাংলার সংগ্রামী মানুষ আজীবন ও যুগ যুগ ধরে কৃতজ্ঞ আনত চিত্তে স্মরণ করতে থাকবে।
তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, বাংলাদেশ ও সোভিয়েতের পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অবশ্যই উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকবে।
অপর এক বাণীতে আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহান অক্টোবর বিপ্লবের ৫৬তম বার্ষিকী উপলক্ষে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের কাছে এক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন বাণী পাঠিয়েছেন।
বাণীতে বঙ্গবন্ধু বলেছেন যে, মহান অক্টোবরের বিজয় দুনিয়ার সব জনপ্রিয় ও প্রগতিশীল সংগ্রামের অনুপ্রেরণার উৎস।
তিনি সর্বক্ষেত্রে সোভিয়েত জনসাধারণের অব্যাহত অগ্রগতি কামনা করে আশা প্রকাশ করেছেন যে, বাংলাদেশ ও সোভিয়েত সম্পর্ক ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই আরো হৃদ্যতাপূর্ণ ও সুদৃঢ় হবে।
স্থানীয় এক জনসমাবেশে আমাদের শিল্পমন্ত্রী জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলামও মহান অক্টোবরের এ মাহেন্দ্রক্ষণকে স্বাগতম জানিয়েছেন।
তিনি তাঁর এক ঘন্টাব্যাপী বক্তৃতায় ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের নেতৃত্বে পরিচালিত মহান অক্টোবরের সংগ্রামী ইতিহাস পর্যালোচনা করে আমাদের বিগত স্বাধীনতা সংগ্রামে সোভিয়েত রাশিয়ার সাহায্য ও সহযোগিতার কথা অত্যন্ত কৃতজ্ঞতা সহ স্মরণ করেন।
সোভিয়েত রাশিয়াকে এক অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে আখ্যায়িত করে জনাব নজরুল বলেন যে, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা যদি সময়োচিত রুশ সহযোগিতা না পেতাম তাহলে আমাদের স্বাধীনতা-সফলতা এতো ক্ষিপ্রগতিতে ত্বরান্বিত হোত না।
তিনি বাংলাদেশের পক্ষে জাতিসংঘে সোভিয়েত ভেটো ও বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষার আহ্বান জানিয়ে পাকিস্তান সরকারের কাছে লিখিত ব্রেজনেভের পত্রের কথা পুনরুল্লেখ করে অসীম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
অক্টোবরের রুশ বিপ্লব বিশ্বের সর্বহারা মানুষের জীবনে মুক্তির এক অনন্য দ্যোতক।
আজ থেকে ৫৬ বছর আগে এমনি একদিনে গ্রহ পৃথিবীর এক প্রান্তে রাশিয়ায় এক মাহেন্দ্রক্ষণে যে রক্তিম সূর্যের উদয় হয়েছিলো, তা যুগ যুগ ধরে বিশ্বের সর্বহারা মানুষের চৈতন্যের আকাশ থেকে হতাশা ও দ্বিধাহততার তমসা দূর করে এক অতন্দ্র আশা ও মুক্তির প্রোজ্জ্বল আলোক রশ্মি ছড়াতে থাকবে।
বিশ্বের অন্যান্য মুক্তিকামী জাতির মতো আমাদের বাংলাদেশের মানুষের কাছেও এ মহান দিন এক অনন্ত সংগ্রামী প্রেরণার উৎস হিসেবে প্রতিভাত হতে থাকবে।
তাই যখনি এদিন আসে তখনি বাংলার মানুষ শ্রদ্ধাবনত চিত্তে একে স্মরণ করে, বরণ করে। আমরা একাত্মতাবোধ করি রাশিয়ার মহান সংগ্রামী জনগণের সঙ্গে।
কারণ, আমাদের দেশের সর্বহারা ও মেহনতি মানুষেরও ঠিক একই ইতিহাস। এক নদী রক্তের বিনিময়ে এবং ঠিক এমনি কামান ও গোলাগুলির সদর্পতায় আমরা ভেঙে চুরমার করেছি শত্রুর বিষদাঁত—জোর করে আমাদের অধিকার সূর্য ছিনিয়ে এনেছি আমাদের দেশের পূবর্তন জার-তুল্য বর্বর পাক হার্মাদদের কুটিল কবল থেকে। রাশিয়ার মতো বিশ্ব মানচিত্রে আমরাও এক মুক্ত বিহঙ্গম।
মহান অক্টোবর বিপ্লব বিশ্বের নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের সংগ্রামী প্রেরণার উৎস। সেই উৎস আগামী দিনগুলোতে প্রেরণা যোগাবে এ বিশ্বাস আমাদের আছে।
দুর্বৃত্তদের এহেন প্রকাশ্য হামলার ক্ষমা হতে পারে না
প্রকাশ্য দিবালোকে গতকাল ঢাকায় রক্ষী ও পুলিশ বাহিনী বনাম একদল দুর্বৃত্ত বলে অভিহিতদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে এ ধরনের প্রকাশ্য সশস্ত্র সংঘর্ষ ঢাকায় এটাই বোধ হয় প্রথম। অভিহিত দুর্বৃত্ত দলের নায়ক ইডেন কলেজের ইংরেজীর অধ্যাপক সাহেবও আহত অবস্থায় রক্ষী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছেন। আরও ধরা পড়েছেন তার কয়েকজন সঙ্গীও। দেশের প্রায় প্রত্যেকটি জাতীয় সংবাদপত্রের খবরেই প্রকাশ, ভাড়াটিয়া উচ্ছেদের নগ্ন ষড়যন্ত্রের দরুণই এই ঘটনার অবতারণা হয়েছে। বাড়ীর মালিক অধ্যাপক সাহেব মোহাম্মদপুরের উল্লেখিত ফ্লাটটি প্রথমে দখল ও পরে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের ভোগদখলের অনুমতি পেয়ে বসবাস করছিলেন। এরপর অধ্যাপক সাহেব নিজে উপরের তলায় ছিলেন নীচে জনৈক মহিলার কাছে ভাড়া দিয়েছিলেন। অজ্ঞাত কারণে বেশ কিছুদিন ধরে অধ্যাপক সাহেব ভাড়াটিয়া উচ্ছেদের প্রচেষ্টা চালান। জানা গেছে, ইতিপূর্বে মালিক ও ভাড়াটিয়ার মধ্যে আপোষের চেষ্টা করেও তা ব্যর্থ হয়েছে। শেষ অবধি অধ্যাপনার মতো গৌরবময় ব্রতজীবীদের কলঙ্ক ইডেনের এই অধ্যাপকটি সীমাহীনভাবে তার কদর্য চেহারা জনসমক্ষে তুলে ধরেছেন। যার নগ্ন প্রকাশ্যে একজন নিরীহ ব্যক্তির জীবনাবসান হয়েছে। পত্রিকান্তরের ঘটনার বিবরণে জানা গেছে—জনৈক কুতুব নামক ব্যক্তিই সর্বপ্রথম এই কলঙ্ক অধ্যায়ের সূচনা করেছে। পরে ইডেন কলেজের দু’টো মাইক্রো বাস ও ট্রাক ভর্তি আনীত দুষ্কৃতিকারীদের সহায়তায় তারা ভাড়াটিয়াদের মারধর ও আসবাবপত্র লুট করেছে। ইতিমধ্যে রক্ষী বাহিনীর কেন্দ্রীয় অফিস খবর পেয়ে কিছুসংখ্যক রক্ষীকে প্রেরণ করে। ঘটনাস্থলে রক্ষীর গাড়ী পৌঁছা মাত্রই তাদের উপর দুর্বৃত্তরা গুলি ছোঁড়ে। এবং প্রকাশ্যে তুমুল গুলি বিনিময় হয়। স্থানীয় পুলিশ বাহিনীও রক্ষীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এক পর্যায়ে অধ্যাপক সাহেবের দল রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে যেতে থাকে। সবাই পালিয়ে যেতে পারলেও হয়তো বা আহত হওয়ার কারণেই পালিয়ে যেতে পারেননি অধ্যাপক সাহেব ও তার নিকটতম কয়েকজন সঙ্গী।
বস্তুতঃপক্ষে, গত পরশু মোহাম্মদপুরে সংঘটিত রক্ষী বনাম দুর্বৃত্তের এই প্রকাশ্য সংঘর্ষের সংবাদে দেশের প্রতিটি মানুষ উৎকন্ঠিত হয়ে উঠেছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে এহেন প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জের ঘটনা একটি মারাত্মক উদ্বেগের কারণ হিসেবে শান্তিপ্রিয় মানুষের কাছে উপস্থাপিত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে রক্ষীবাহিনী ও পুলিশ বাহিনী কর্তৃক ত্বড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে দেশবাসীও আইন প্রয়োগকারী ঐ দু’টি সংস্থার প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে বলে আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস। বিশেষ করে দুর্বৃত্তদের আক্রমণের মুখে সঙ্গে সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর একটি দলের দ্রুত ঘটনাস্থলে আগমন ও ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণে আমরাও তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই। এতে করে রক্ষীবাহিনীর প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আমরা মনে করি।
কথিত দুর্বৃত্ত দলের নায়ক অধ্যাপনাব্রতের কলঙ্ক শরিফুল ইসলাম সাহেব সংবাদপত্রে তার কদর্যতার জন্যে খবর হিসেবে এবারই প্রথম আমাদের কাছে ধরা পড়েছেন তা নয়। ইতিপূর্বে কর্তৃপক্ষের নিকট ইডেন মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রীদের দাবী-দাওয়ার অন্যতম ব্যক্তি শরিফুল ইসলামকে পদত্যাগ করানোর খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিলো। তাঁর অপসারণের দাবীতে গোটা কলেজের ছাত্রীরা ধর্মঘট, মিছিল, শিক্ষা বোর্ড ঘেরাও, এমনকি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হয়েছিলো। কিন্তু অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী এই অধ্যাপকটির তাতে কিছুই হয়নি।
আমরা দেশের প্রতিটি শান্তিকামী মানুষের কাছে সচেতন হয়ে এ ধরনের অদৃশ্য শক্তিবলে বলীয়ান দুর্বৃত্তদের কীর্তিকলাপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাবো। কর্তৃপক্ষের নিকট উল্লেখিত এ ঘটনার প্রকাশ্য ও নেপথ্য নায়কদের খুঁজে বের করার জন্যে জনগণের পক্ষ থেকে আমরাও আবেদন জানাই। যারা প্রকাশ্য সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলো জনগণ তাদের প্রকাশ্য বিচারও দাবী করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক