উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে
মার্কিন প্রভুদের সুতাের টানে জাতিসংঘের সচিব প্রধান উ-থান্ট নাচতে শুরু করেছেন। বাঙলাদেশ নিয়ে তাই জল-ঘােলাবার তালে আছেন তিনি। পাকিস্তানের জঙ্গীচক্রের বিরুদ্ধে বাঙলাদেশের সশস্ত্র অভ্যুত্থানকে তিনি ভারতও পাকিস্তানের বিরােধ রূপে দাঁড় করাতে চান। এ বিষয়ে আলােচনার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের এক বে-সরকারী অধিবেশনের প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে। ভারত এবং পাকিস্তানও সেই বিজ্ঞপ্তি পেয়েছে। বাংলাদেশ নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সশস্ত্র সম্মুখ যুদ্ধের দুঃস্বপ্ন দেখে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছে তার; তাই আর স্থির থাকতে পারেন নি। তা রােধের জন্য কোমরের বেল্ট শক্ত করে এঁটে লাগতে চান তিনি, আর এজন্যই নিরাপত্তা পরিষদের বে-সরকারী অধিবেশনের তােড়জোড়।
যুদ্ধটা হচ্ছে পাকিস্তানের সশস্ত্রবাহিনী ও প্রায় নিরস্ত্র বাঙালীদের মধ্যে। সেদিকে তাঁর দৃষ্টি বা কোনাে কর্তব্য নেই। গণতন্ত্র যে সেখানেই জবাই হচ্ছে তার দরুন তিনি মােটেই উদ্বিগ্ন নন। জঙ্গীশাহীর নির্বিচার গণহত্যার বিরুদ্ধে তাঁর কোনাে প্রতিবাদ নেই। পাকিস্তান জাতিসংঘের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও এই নৃশংসতা বন্ধ করার জন্য তাকে হুঁশিয়ার করে দেয়া তিনি দরকার মনে করেন নি। যে নৃশংসতার দরুন লক্ষ লক্ষ মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতে শরণার্থী হিসেবে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন সেই নৃশংসতার বিরুদ্ধে টু শব্দটিও না করে শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য মামুলী ধরনের এক আবেদন করেই তিনি দায় সেরেছেন। তিনি হয়তাে ভেবেছিলেন অত্যল্পকালের মধ্যেই বাঙলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ পাক জঙ্গী জুন্টার কাছে মাথা নােয়বে এবং ভারতের কাঁধেই লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর বােঝা স্থায়ীভাবে চেপে থাকবে।
কিন্তু তাঁর সেই প্রত্যাশা পূরণ হয় নি। পরিস্থিতি বিপরীত দিকে গড়িয়েছে। বাঙলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ উত্তরােত্তর প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠেছে। তাই সেদিক থেকে দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেবার প্রয়ােজন বােধ করছেন উথান্ট। এর পেছনে আছে মার্কিন ও পাকিস্তানী শয়তানী। নিরাপত্তা পরিষদে বাঙলাদেশ প্রসঙ্গ আলােচ্য বিষয় করে কার্যত ভারত ও পাকিস্তানকে একই বন্ধনীর মধ্যে ফেলার উদ্দেশ্য—অর্থাৎ মূল সংঘাত যেন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। তাই তাঁর কল্পিত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের এই ভণিতা।
নিরাপত্তা পরিষদকে সামনে রেখে এই খেলা আমরা অনেক দেখেছি। কঙ্গোতে প্যাট্রিস লুমুম্বা এ খেলার প্রথম বলি। তারপর কোরিয়া, কাশ্মীর ও ইস্রাইলে হস্তক্ষেপ করে নিরাপত্তা পরিষদ যা করেছে তাও আমরা দেখেছি। এ যাবত সমস্যা ঝুলেই আছে, কোনাে ফয়সালা হয় নি। বরং সর্বত্র আগ্রাসীরাই সুবিধা পেয়েছে এবং প্রতিরােধকে স্তব্ধ করে রাখা হয়েছে। বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে স্তব্ধ করে ইয়াহিয়া খানের কজা শক্ত করার জন্য আবার এই চক্রান্ত। সচিব প্রধান উ-থাপ্ট এ না করে করেন কি—তাঁর বিবেক যে মার্কিন প্রভুদের কাছে বাধা।
সূত্র: কালান্তর, ২৯.৭.১৯৭১