You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
১৩ই আগস্ট, সোমবার, ১৯৭৩, ২৮শে শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

স্বাগতম বঙ্গবন্ধু

আজ আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কমনওয়েলথ সম্মেলন শেষে দেশে ফিরছেন। অটোয়ায় প্রধানমন্ত্রী সম্মেলন শেষে তিনি জেনেভায় গিয়েছিলেন। জেনেভা থেকেই আজ তিনি বিকেলে ঢাকায় পদার্পণ করবেন। নেতাকে সম্বর্ধনা দেবার জন্যে সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলেও জানা গেছে। কমনওয়েলথ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর যোগদান নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বিশ্বের প্রতিটি দেশ কৌতুহলের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করেছে এই সম্মেলন এবং বঙ্গবন্ধুর তৎপরতা। প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনে যোগদানের জন্যে বঙ্গবন্ধু দেশ ত্যাগ করলেও তিনি প্রথমে যুগোশ্লাভিয়ায় যান। সেখানে তিনি যুগোশ্লাভিয়ার প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কয়েক দিনব্যাপী পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। বিশেষ করে যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোর সঙ্গে তাঁর আন্তরিক ও হৃদ্যতাপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদ ও জাতীয় স্বাধীনতার শত্রুদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সফল নেতৃত্বদানকারী এই দু’জন নেতার মিলন নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। দু’জনেই দু’দেশের সংগ্রামের মহানায়ক। বিশ্বের সকল মেহনতি মানুষ ও স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রামরত মানুষের মুক্তিকামী নেতা বঙ্গবন্ধু ও মার্শাল টিটো তাদের সংগ্রামের সাথী। পরম আপনজন। আমাদের জাতির জনক তাঁর যুগোশ্লাভিয়ার সাফল্যজনক সফর শেষ করে নয় দিনের কমনওয়েলথ প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে অটোয়া গিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু তাঁর চিরাচরিত দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য পেশ করেছেন বিভিন্ন সভা ও অনুষ্ঠানে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা, আটক বাঙালী ফিরিয়ে আনা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, আটক যুদ্ধবন্দীদের ফেরত প্রভৃতি বিষয়ের চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্যে ভারত-বাংলাদেশ যে যুক্ত ইশতেহার প্রকাশ করেছে সে সম্পর্কেও বঙ্গবন্ধু অটোয়া সম্মেলনে তাঁর সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করেছেন। এছাড়া বিশ্বের সকল মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামের প্রতি বাংলাদেশের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের কথাও বঙ্গবন্ধু জানিয়েছেন। মুক্তিকামী মানুষের স্বপক্ষে দ্ব্যর্থহীন সমর্থন দানের প্রশ্নে কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগদানকারী দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশই যে সবচেয়ে বেশী প্রত্যক্ষ এবং সুস্পষ্ট তা আর কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের স্বপক্ষে বাংলাদেশ সব সময়ই যে সরাসরি বক্তব্য রেখেছে এবং তার জন্যে সংগ্রামও করেছে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের সংগ্রামের সঙ্গেও সংহতি ঘোষণা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ‍ছিলেন সবচাইতে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর চিন্তাধারা ও বক্তব্যের প্রতি বিশ্বের সকল চিন্তাশীল মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। সম্মেলনে তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ যে সাফল্যজনক হয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। আমরা আজ আমাদের প্রিয় নেতাকে আমাদের মাঝে ফিরে পাবো। নেতা বেশ কিছুদিন আমাদের ছেড়ে বিদেশে ছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতি দেশের নানা অভাবের মাঝে আরো প্রকট মনে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু দেশের মাঝে থাকলে সাধারণ মানুষ একটা বড় অবলম্বন খুঁজে পায় আমরা আমাদের দেশের গঠন পর্বে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব লাভ করতে পেরে কৃতজ্ঞ। তাঁর মহান ভাবমূর্তিই আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের পাথেয়। তাঁর মাঝেই লুকিয়ে আছে আমাদের সকল পরিচয়, সকল অহঙ্কার। নেতার আজকের এই প্রত্যাবর্তনের দিনে আমরা তাঁকে স্বাগত জানাই,—তাঁর মহত্ত্বের কাছে আর একবার আমরা আমাদের কৃতজ্ঞতা জানাই।

তোমারই হোক জয়

‘বোমার আঘাতে পুড়ে যাওয়া বাংলা বুক দিয়ে আমি হেঁটেছি, আমি দেখেছি ট্যাংকের আঘাতে বিধ্বস্ত ঘর-বাড়ী, আমি ছিন্নমূল নারী-পুরুষ-শিশুর চোখে দেখেছি কান্নার সমুদ্র। এইসব সকরুণ দৃশ্যাবলী আমার হৃদয়ে তরঙ্গ তুলেছে। আমি কাঁদতে ভুলে গেছি। দুর্যোগ কবলিত বাংলাদেশের নির্যাতন ও দুঃখে আমার চোখের জল শুকিয়ে গেছে।’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘দি সং অব বাংলাদেশ’ নামক দীর্ঘ একটি কবিতায় মার্কিন কবি মাদাম রেবেকা শেলী উপরের পংক্তিগুলো আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে রচনা করেছিলেন। মাদাম শেলীর কবিতার প্রতিটি ছত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাঙময় হয়ে উঠেছিলো। তাঁর ‘ইন মারর্নিং’ নামক কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বলেছেন : ‘মার্কিন নাগরিক হিসেবে আমার প্রাথমিক কর্তব্য হচ্ছে আমার সরকারের আগ্রাসী নীতির উপর চাপ প্রয়োগ করা। ‘মানবিক-পরিবারের’ সদস্যা হিসেবে ‘বাংলাদেশের নির্যাতিত মানবতার প্রতি আমার ঐকান্তিক সহানুভূতি রয়েছে।’ মাদাম শেলী বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্য অর্জিত হবেই’ বলে দৃঢ় আশা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি তাঁর কবিতায়ও লিখেছিলেন যে, ‘আমি জানি—বুলেট, বোমা, ট্যাংক কিংবা বেয়নেট কিছুই বাংলাদেশকে হত্যা করতে পারবেনা—সোনার বাংলার সঙ্গীতের সুরধ্বনি বিশ্বের আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হবে।’
সেই বয়োবৃদ্ধা মার্কিন কবি মাদাম রেবেকা শেীল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা এসেছেন। গত পরশু মাদাম শেলী হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের সামনে এক ঘন্টা নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে কম্বোডিয়ায় মার্কিন বোমাবর্ষণের প্রতিবাদে মৌন বিক্ষোভ জানিয়েছেন। বিশ্বের বুক থেকে যুদ্ধের অভিশাপ দূর করার জন্যে তিনি ইতিপূর্বে দেশ হতে দেশান্তরে ঘুরে ঘুরে শান্তির ললিত বাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন। শান্তির অন্বেষণে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বের প্রতিটি শান্তিকামী মানুষকে রুখে দাঁড়াতে উদ্বদ্ধ করার জন্যে এই মহিয়সী মার্কিন মহিলা কবি সুদীর্ঘদিন ধরে আবেদন নিবেদন উচ্চকিত করে আসছেন। মাদাম শেলী ঢাকায় সাংবাদিকদের কাছে দৃপ্তকন্ঠে ঘোষণা করেছেন যে, ‘বিশ্বের দেশে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত আমার পথ চলার বিরাম নেই।’ ‘পিস ওয়েজ ইন্টারন্যাশনাল’ নামক একটি শান্তিবাদী প্রতিষ্ঠানের তিনি প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। শান্তির সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই তাঁর এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম আদর্শ ও উদ্দেশ্য। জীবনের অন্তিম দিন পর্যন্ত মাদাম শেলী শান্তির সংগ্রামে নিয়োজিত থাকবেন বলে জানিয়েছেন। বিশ্বের মুক্তির আন্দোলনকে সমর্থন করে তিনি নানা সময়ে নানা গ্রন্থ রচনা করেছেন। অদূরভবিষ্যতে ‘মেনি ভয়েজেস’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করবেন এবং এই গ্রন্থটিতে ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া ইত্যাদি দেশের বিপ্লবী ও সংগ্রামী মানুষের কন্ঠস্বরকে অক্ষরের কারাগারে বন্দী করবেন বলেও জানিয়েছেন।
১৮৮৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়াতে রেবেকা শেলীর জন্ম। এবং ১৯১৫ সাল থেকেই শান্তির সংগ্রামে নিবেদিত প্রাণকর্মী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে মার্কিনী যুদ্ধবাজ ভূমিকার তিনি তীব্র প্রতিবাদী কন্ঠ। সম্ভবতঃ এ জন্যেই মাদাম শেলীকে ‘বিশ্বের জাগ্রত বিবেক’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাঁর কবিতায় আমরা বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের দুর্দশার কাহিনীই বিধৃত দেখতে পাই। মানবতার প্রতি অপরিসীম মমতা তাঁর রচিত প্রতিটি কবিতায় উজ্জল হয়ে রয়েছে। তিনি তাই বারংবার উচ্চকন্ঠ হয়েছেন : ‘নো মোর হিরোশিমাস, নো মোর ভিয়েতনামস, নো মোর ওয়ার।’ তাঁর কাব্যাদর্শের এটা অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয়। ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের সামনে মাদাম রেবেকা শেলীর নীরব বিক্ষোভের ভাষাও সেই প্রতিবাদী কন্ঠটিই সোচ্চার হয়ে উঠেছে। মার্কিন আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে এবং শান্তির স্বপক্ষে জীবন সায়াহ্নেও যে তাঁর কন্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে যায়নি, সেজন্যে মাদাম শেলী শান্তির পূজারীদের অকুন্ঠ অভিনন্দন পাবেন। তাঁর শান্তির পতাকা উড্ডীন থাক, এই আমরা কায়মনোবাক্যে কামনা করি। শান্তির সংগ্রামী সেনানায়িকা মাদাম রেবেকা শেলীরই হোক জয় জয়কার।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!