You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.09.21 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | বঙ্গবন্ধু জাপান যাবেন | জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনুন | রমজান না আসতেই জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২১শে সেপ্টেম্বর, শনিবার, ৫ই আশ্বিন, ১৩৮০

বঙ্গবন্ধু জাপান যাবেন

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগামী মাসের আঠারো তারিখে জাপান সফরে যাবেন বলে গতকাল একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় জানিয়েছেন। জাপানি প্রধানমন্ত্রী গত মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুকে জাপান সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। এই সফর ছয়দিন স্থায়ী হবে। বঙ্গবন্ধু জাপানি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করবেন। এছাড়াও তিনি জাপানের সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। বঙ্গবন্ধুর জাপান সফর একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এশিয়ার উল্লেখযোগ্য এই দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরো নিবিড় করার মানসে এই সফর কার্যকরী হবে। বাংলাদেশের গঠনকার্যের ঠিক এই মুহূর্তে জাপানের কারিগরি সহায়তা আমাদের জন্য অত্যন্ত আবশ্যকীয়। জাপান কারিগরি দিক দিয়ে যে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে তার সবই সে দেশের জনগণ ও সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফল।
দু-একটা মহাযুদ্ধের পর জাপান যে বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তা ইতিহাসে বিরল ঘটনা। যুদ্ধের কারণে যে নিদারুণ অবক্ষয় জাপানের বুকে নেমে এসেছিল তাকে রোধ করে একটি সুসংগঠিত কার্যক্রমের মাধ্যমে তারা আজ উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে। দেশ গঠনের অপরিসীম কর্মঠ জাপানিরা আমাদের বন্ধু। জাপানের জনগণের সঙ্গে আমাদের মৈত্রী সুদৃঢ় হোক এটা আমরা কামনা করি। বারবার তাদের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যে হুমকি এসেছিল তাকে তারা বীরত্বের সঙ্গে প্রতিহত করেছে। এরপর যত দ্রুত বিশ্বযুদ্ধোত্তর ধ্বংসের ওপর তারা তাদের দেশের পুনর্গঠন ও উন্নয়ন সম্ভব করেছে ইতিহাসে তা একটি উল্লেখযোগ্য নজির। কারিগরি পদ্ধতির মাধ্যমে দেশের প্রতিটি শিল্পের ও কৃষির দ্রুত উন্নতি সাধন করেছে জাপান। বঙ্গবন্ধুর জাপান সফর উভয় দেশের কারিগরি উন্নয়ন ও দেশের জনগণের সম্পর্ক দৃঢ়তর হওয়ার পথে একটি ফলপ্রসূ সফর হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনুন

গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী বিল গৃহীত হয়। এই সংশোধনী অনুযায়ী সংসদকে নিবর্তনমূলক আটকের বিধান সম্বলিত আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দান, সংসদের দুই অধিবেশনের মধ্যবর্তী সময় ৬০ দিন থেকে ১২০ দিন করা, যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণ অথবা আভ্যন্তরীণ গোলযোগের কারণে বাংলাদেশ বা তার যেকোনো অংশে নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এই সংশোধনী অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রয়োজনবোধে জাতীয় ভিত্তিতে বা আংশিকভাবে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে পরিস্থিতির মোকাবেলা করার চেষ্টা করবেন। জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা বাংলাদেশের অনেক আগেই প্রয়োজন ছিল – স্বাধীনতার পরপরই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে স্বাধীনতার শত্রুদের চক্রান্ত নস্যাৎ করা এবং দেশ গঠনে জনগণকে উদ্যমশীল ও ব্রতী করে তোলার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। এবং এই মুহূর্তে যে হচ্ছে তার কোন প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। তবে সংশোধনীর মাধ্যমে তেমন একটা প্রবিশন রাখা হলো এই যা।
বস্তুতঃ বর্তমানে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাগতভাবে যে হারে নিম্নগামী হচ্ছে, তাতে করে একদিন এইদেশে ওই দু’টি শব্দেরও কোন অস্তিত্ব থাকবে কিনা তা নিশ্চিত করে বলা চলে না। প্রতিনিয়ত দেশের কোথাও না কোথাও থানা আক্রমণ, বাজার লুট, ব্যাংক ডাকাতি, বাড়ী ডাকাতি, গুপ্তহত্যা, নারী অপহরণ, হাইজ্যাক, প্রতারণা, প্রকাশ্য দিবালোকে রাহাজানি ঘটছেই এবং বাড়ছেই। প্রতিটি রাত যেন গায়ের মানুষের জন্য এক একটি দুঃস্বপ্নের রাত হয়ে নেমে আসে। প্রতিটি দিন যেন ত্রাশ আর সন্ত্রাসের নতুন বারতার জানান দিয়ে যায়। এ এক দুর্বিষহ অসহায় পরিস্থিতি। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা।
বাংলাদেশের বর্তমান আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেশের মানুষকে তো বটেই, বিদেশিদের ও উদ্বিগ্ন করেছে। স্বাধীনতার শত্রুদের হিংসাত্মক কার্যকলাপের হীন চক্রান্তের প্রেক্ষিতে বিদেশীরাও আমাদের স্বাধীনতা রক্তার্জিত স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ রাহুগ্ৰস্ততা সম্পর্কে শঙ্কিত হচ্ছেন। লন্ডনের দি ইকোনমিস্ট পত্রিকার গত ১৫ই সেপ্টেম্বর সংখ্যায় তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। তথাকথিত মুসলিম বাংলার প্রবক্তা পাকিস্তান বাদীরা এবং চীন মার্কিন আদালতের অবৈধ সন্তান অতিবিপ্লবী সন্ত্রাসবাদীরা এখন উত্তরবাংলা, দক্ষিণ বাংলার খুলনা ও যশোর, পূর্ব বাংলার চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী যায় খোদ রাজধানী ঢাকা নগরীর আশেপাশে তাদের হীন চক্রান্ত চরিতার্থ করতে লিপ্ত রয়েছে। এদের সাথে যোগসাজশ রয়েছে বর্ণচোরা একশ্রেণীর তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও সমাজের উঁচু তলার লোক। আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া এক শ্রেণীর মুনাফাখোর -মজুতদার ও তথাকথিত অভিজাত শ্রেণীও এদের পেছনে মদদ জোগায়। অন্যদিকে নিছক ডাকাত ও দুর্বৃত্ত শ্রেণীর লোকেরা এদের ঘেঁটু হিসেবে কাজ করছে।
এমতাবস্থায় জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিল পাস একটি পদক্ষেপের উদ্বোধন মাত্র। সরকারকে সততা, বাস্তবতা উপলব্ধি, বিচক্ষণতা এবং অসৎ ব্যক্তিদের প্রভাবমুক্ত হয়ে আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করার সাথে সাথে দেশের মানুষের অন্তর থেকে নিরাপত্তাহীনতাবোধ দূরীভূতকরণ ও স্বস্তি ফিরে পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে অবশ্যই।

রমজান না আসতেই জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি

পবিত্র রমজান না আসতেই মাছ-মাংস, শাক-সব্জির দাম বাড়তে শুরু করেছে। কিছুদিন আগেও যে জিনিসের দাম পূর্বের চাইতে কিছুটা কম ছিল তা আবার বেড়ে পূর্বাবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। কোন জিনিসের মূল্য আবার পূর্বোক্ত সর্বোচ্চ মূল্য অতিক্রম করার দিকে।
খবরে প্রকাশ, মাঝারি পরিমাপের একটা ইলিশ মাছের দাম পাঁচ-ছয় টাকা, রুই পনেরা-ষোল টাকা, কুঁচো চিংড়ি এবং গুঁড়ো চিংড়ি প্রতি ভাগা দু’টাকা, গরুর মাংস আট টাকা সের, খাসীর মাংস বারো টাকা, প্রতি হালি ডিম দু’টাকা, প্রতি সের আলু দু’ টাকা সোয়া দু’টাকা, পেঁয়াজ দেড় টাকা, কাঁচা মরিচ তিন-চার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। চালের দামও কিছুটা কমেছিল কিন্তু রেশনে চাল বিতরণ অনিয়মিত হওয়ায় চালের দাম ও আগের চাইতে সামান্য বেড়েছে। অথচ অল্প কিছুদিন আগেও এসব জিনিসের মূল্য তুলনামূলকভাবে এখনকার চাইতে কম ছিল। ব্যবসায়ী মহলের মতে, রোজার আগমনে জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে এবং এসব জিনিসের মূল্য সুনিশ্চিত ভাবে আরো কিছুটা বাড়বে।
প্রতি বছরই দেখা যায় পবিত্র রমজান মাসে খাদ্য দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। রোজার মাসে বিশেষ করে মুসলমান পরিবারের লোকেরা সারাদিন রোজা থেকে রাতের বেলায় একটু ভালো খাবারের আশা করেন। সুতরাং জিনিসপত্রের দাম কিছুটা বাড়লেও ক্রেতারা তা কিনে থাকেন। ব্যবসায়ীগণ ক্রেতাদের এই মনোভাবকে সুকৌশলে কাজে লাগিয়ে নিত্য ব্যবহার্য জিনিস বিশেষ করে খাদ্য দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দিয়ে অধিক মুনাফা অর্জনের পথ করেন। ব্যবসায়ীদের এহেন মনোভাব এবং কার্যকলাপকে কোনক্রমেই সমর্থন করা যায় না। বরং একে আমরা গুরুতর অপরাধ বলে মনে করি।
আমরা জানি বাজারদর নিয়ন্ত্রণ এবং পরিদর্শনের জন্য একটি সরকারি বিভাগ রয়েছে। তাদের মূল দায়িত্ব বাজারদর স্থিতিশীল করণের জন্য তদারক করা। সরকারি অর্থ বিভাগ সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করলে জিনিসপত্রের বাজারদর হঠাৎ করে বেড়ে না গিয়ে একটা স্থিতিশীল অবস্থায় অবস্থান করতে পারে বলে আমরা দৃঢ়মত পোষণ করি।
সুতরাং বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে পবিত্র রমজান মাসে জনগণ যেন মোটামুটি সঙ্গত মূল্যে জিনিসপত্র ক্রয় করতে পারেন সে বিষয়ে সুষ্ঠু ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগের আশুদৃষ্টি আমরা আন্তরিক ভাবে কামনা করি। অপরপক্ষে ব্যবসায়ীদের প্রতিও বক্তব্য তারা যেন ব্যবসায় লাভ করতে গিয়ে একেবারে মনুষ্যত্বহীন না হয়ে পড়েন। জনগণের দুঃখ দুর্দশার কথা তাঁরাও সহৃদয়তার সঙ্গে বিবেচনা করে দেখতে একেবারে যেন ভুলে না যান।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন